“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ৭ অক্টোবর, ২০১৬

সুরমা গাঙর পানিঃ উজান পর্ব ৩২

(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই  উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার  উজান  পর্বের  অধ্যায়  বত্রিশ     ---সুব্রতা 
মজুমদার।)  


বত্রিশ

  মাটিজুরির সাজিদ মিয়ার বাড়িতে খাওয়া দাওয়ার আয়োজনও এলাহি । সকাল গড়িয়ে গেছে কখন, তবু আয়োজিত নাস্তা খেতেই হয়, কয়েক দিস্তে চার কোনা পরোটা, মুরগির মাংস আর তালের বড়া । দ্বিপ্রহরের খাবারও বড় কম নয়, নদীর ঘাঘট আর বোয়াল মাছ শুধু । বৈতল বেশি খাবার দেখলে একটু বেসামাল হয় । সাজিদ মিয়াকে উদ্দেশ্য করে অন্তঃপুরে বার্তা পাঠায় এরকম,
--- আমরার লাগি অততা না করলেও অইব, আমরারে হুকইনপুড়া ভাত দিলাইন যে । খালি মামুর খেয়াল রাখইন যে ধনো । মামু অইলা দাতা, তাইন খাইলেউ আমরার পেট ভরব ।
---  আমরার ভরত নায় ভাবিজান, আমারে খাওয়ানি লাগব মাছে মুছে গুস্তে । ইগু এক বেদিশা, তার কথা বাদ দেইন । তার গান হুনছইন নি । ইগুর গানর লাগি আমরার মামুও দিওয়ানা, সবরে মারইন, তার গাত হাতও দেইন না । মামু এমনেউ বদমাইশহর গাত হাত দেইন না ।
    দুখুর বদমাশি কথায় রাগ হয় বৈতলের, আবার গানের প্রশংসা শুনে রাগ গলে জলও হয় বোকার মতো হাসে । পিরের গা ঘেঁষে দাঁড়ায়, মামুর গায়ের গন্ধ নেয়, বুকের
 উপর টেনে রাখা লুঙিতে মুখ লাগায় । কী জানি কী এক সুবাস খুঁজে পায় বৈতল মামুর আভরণে । অপার্থিব এক আনন্দে, সুখে ভরে যায় মন । ভাবে এমন নির্মল হৃদয় কেন হয় না তার । বৈতল কখনই তার মতো ছোটখাটো কাউকে শ্রদ্ধেয়জন ভাবতে পারে না, মামুর দীর্ঘ দেহ সবার থেকে আলাদা হয়ে তাকে আশ্রয় দেয় । গুরু সৃষ্টিধর মামুর মতো বিশালদেহী না হলেও মনের ধনে মামুর মতো বড় । আর শিশুর মতো মন যার, দুখু বছই আপদ যাকে বাবার মতো সম্মান দেয়, শহরের মানুষ, জেলার মানুষের কাছে ধর্মগুরু হিসেবে যাঁর সম্মান, সেই মানুষকে বৈতল কখনও নিয়ম মেনে ধর্মাচরণ করতে দেখেনি । সময় ধরে নমাজ পড়তে দেখেনি, আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা জায়নামাজ বিছিয়ে ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলেন, সিজদা করতে করতে মাথায় কালো দাগ হয়ে যায় । আর নিয়মের বাকি ধর্মাচরণ সব করে দেয় দুখু । বৈতল ভাবে ধর্মগুরুরা কেন মামুর মতো হয় না । মামুর মুখের কথা স্পষ্ট নয় বলে কেউ তার মুখ দিয়ে মন্দ কথা বলিয়ে নিতে পারে না । মামুও খুব রাগে, রাগলে মারে খুব, কিল মারে । আর মামু হাসে, মামু হাসলে দেবতার মতো মনে হয় । মামু পির হলে কী হবে, অন্য ধর্মকে অসম্মান করে না । মামু জানে বৈতল মুসলমান নয় তবু তাকে আদর করে কাছে রাখে । মনসাপুঁথির গান শোনে । লখাইর দুঃখে কাঁদে । বৈতলের পয়ার কীর্তন শুনে চোখের জল ফেলে মামু, টপ টপ করে জল ঝরে চোখে । বৈতলও যে গায় স্বামীশোক, পুত্রশোকের দুঃখ জড়িয়ে,
--- ‘লোহার বাসরে কান্দে শাহের কুমারী
পুরী মধ্যে থাকি শুনে সুনুকা সুন্দরী
বুদ্ধিস্থির নহে সুনাই উচাটন করে ।
প্রমাদ ঘটিল বড় বলিল চান্দেরে
নাহি পিন্দে বস্ত্র সুনাই নাহি বান্দে কেশ
ঘর হতে বাহির হইল পাগলের বেশ ।
আর ঘুরে ফিরেই বৈতল গাইছে দুঃখময় দিশা,
বিনাইয়া বিনাইয়া বিপুলায় কান্দে গো, ও সখি গো
বিনাইয়া বিপুলায় কান্দে
   মামুকে যেমন কাঁদিয়ে দেওয়া সহজ, হাসিতেও খিলখিলানো যায় । মামুর কলকলানো হাসিতে তখন এক বছরের শিশুর সারল্য । বৈতল মনের আনন্দে এক গুরুর বিদ্যা অন্য গুরুতে চালান করে । বিয়ানিবাজার রইদপুয়ানির সূত্রধর গুরু সৃষ্টিধরের শেখানো সিলেটি রামায়ণ শুনেও মামু শরীর কাঁপিয়ে হাসে । বৈতল গায়,
   অউ যে দেখ সূর্য উঠইন বিয়ানিয়া বেলা
   অউ বংশর রাজা দশরথ বড় বালা ।
   তিন বিয়া করলা রাজায় পুড়া কপাল চাইয়া
   কুনু রানির পেটো না অইল একগুয়া পুয়া
   কুবাই থাকি আইল এক মুনি দিয়া গেল বর
   তিন রাণির ঘরো অইল গাট্টা গাট্টা চাইর পুয়া,
   বড়রাণির রাম, মাইজমজনর লক্ষণ
   আর ছোট কেকয়ীর পুয়া ভরত শত্রুঘন ।
   এর মাঝে কেকইয়ে কইন রামরে পাঠাও বন
   ভরতের বওয়াও রাজ সিংহাসন ।
   রাম গেলা বনবাস, ভরত বেটা বুকা
   সিংহাসনো আনি রাখলা রামর পাদুকা
   বাউগ পাইয়া বউ চুরি করল রাবণ
   বান্দর লইয়া করে রাম যুদ্ধর আয়োজন ।
   আর,
   রাবণ মারি সীতা আনলা অউত্ত রামায়ণ ।
   মামুপির সারা শরীর দুলিয়ে হাসে আর বলে অউত্ত । এর পর থেকে বৈতলকে দেখলেই ডাকে অউত্তআর হাসে খিলখিলিয়ে । দুখু অবাক হয়ে দেখে মামুর হাসি । বৈতলের উপর হিংসার ভান করে বলে,
--- কিতা বে, মামুয়ে দেখি অখন আর তরে বৈতল ডাকইন না অউত্ত ডাকইন, ‘অউত্তকিতা হাত্তি নি । বয়েল থাকি হাত্তি অইলে নি ।
--- ছিলটি রামায়ণ হুনাইছলাম । রাবণ মারি সীতা আনলা অউত্ত রামায়ণকওয়ার পরে কী হাসি রে কী হাসি । কিতা কইতাম তরে । খালি তান অউত্ত
--- হই বেটা মালাউন মামুরে ইতা রামায়ণ হুনাইছ না । ইতা না-পাক কিচ্ছা ফকিরর হুনাও গুনা ।
--- কেনে ঢলানি হুনিয়া তুইও তো বেটা কান্দলে ।
--- আমি কান্দি না । তে পুথির গান আলেদা । ইতা হক্কলেউ গায়, হুনে ।
--- রামায়ণ মহাভারতও পুথি, হক্কলে গায় হুনে । আমরা হুনি না নি কুরাণর গপ, জুলেখার গান । রূপবানর গান হুনি না নি বেটা ? ইতা খামকা খামকা লেইঞ্জা আগুন লাগাইছ না । যেতা ভালা লাগে অতাউ কর, অতাউ হুন, তেউ গিয়া তর শিঙ বার অইব ।
--- আমার কিওর শিঙ বার অইত ।
--- হুন না এক গপ । আমার গুরুয়ে কইচলা, তান বাড়ি আছিল পঞ্চখণ্ড, বিয়ানিবাজার । হিনো সব পণ্ডিত হকল থাকতা, পণ্ডিতপাড়া নাম অউ আছিল । তারার বউত শিষ্য । এক গুরুর আছিল এক মগরা শিষ্য, ইয়া গাট্টা, তার বাড়িত আছিল আর এক গাট্টা ভইস হে অউ ভইসর দুধ খাইত আর মুটা অইত । অখন বাবনর পুত ভইস রাখাল অইত নি, তেউ বাপে পাঠাইলা গুরুবাড়ি, পণ্ডিতপাড়াত । হে আর ধেয়ান উয়ান করত পারে না, কয় ইতা বই পুথি তার ভাল্লাগে না । গুরুয়ে কইলা আইচ্ছা । কইলা তুমার বই পড়ন লাগত নায়, খালি ধেয়ান কর । হেও কয়, আইচ্ছা । কয়, কিতা ধেয়ান করতাম । গুরুয়ে কইন তুমার যেতা পছন্দ । হেও কইল আইচ্ছা । কইবাউ চউখ বন্ধ করিয়া ভইসর ধেয়ান আরম্ভ করল । হে অউ ভইস অই গেল । গুরুয়ে ডাকইন, আয় বেটা উপাস ভাঙতে নানি । হে কয় ভাঙতাম তো, আইতাম কেমনে কইন । গুরুয়ে জিগাইন কেনে, কিতা অইছে । হে কয়, আমার শিঙ দুইটা যে দরজাত লাগি যার, বার অইতাম কেমনে । হাসলে তো । তেউ ক । হাসিলা দুই দিনর লাগি আইচছ আল্লাউ ক, ভগবানউ ক, তর শিঙ ভাঙ্গি দিত পারব নি কেউ । অউ গপ তুই পণ্ডিতপাড়া থাকি মাদ্রাছাত লই যাছ না, এক অউ থাকব নানি ।
    ভাবের ঘোরে থাকলে বৈতলের মন অতিবর্ষণের টিলার মতো হয়ে যায় । ঝুর ঝুর করে নয়, গলে গলে পড়ে যায় মাটি, মাটি কাদা হয় । আসলে বৈতল মামুর কাছে তার মেয়ের নাম পেয়েছে । দুষ্ট জমিদার যমুনা প্রসাদের দেওয়া নাম তার পছন্দ হয়নি, মরনি নামের মধ্যে বৈতল কোনও অমঙ্গল খুঁজে পায় না । মরতে মরতেই বাঁচবে, বাঁচার মতো বাঁচবে গরিবের মেয়ে । দুর্গাবতীর পছন্দ হয়নি বলে স্থগিত রাখে নামকরণ । সোনা নামেই ডাকে । বৈতল মামুর আশীর্বাদ চেয়ে পিরের পায়ের কাছে রাখে সোনাকে, মামু পা সরিয়ে নেয় । বৈতল বলে মেয়ের নাম মরনি । মামুর ও মুখ খুশিতে উদ্‌ভাসিত হয় । অস্ফুটে বলে, বাঃ । বলে ম নি, ম নি, মনি ।
    মরনি নামের একটা দুঃখ আছে বৈতলের, মরে যাওয়ার কথা বলে জমিদার, জমিদারের শয়তানি কথায় বিশ্বাস করে দুর্গাবতী । জেদের বশে নামকরণ থেকে সরে নি বৈতল, তার যুক্তিতে মরণজয়ী তার কন্যার নাম । আর তাদের গ্রামে, ছাতক পরগনার বইয়াখাউরির অনেক ভাল ভাল মেয়ের নাম মরনি । মান্যগণ্যরাও বলেন ভাটির দেশে মরণ নিয়ে লড়াই সর্বক্ষণ । জলের সঙ্গে লড়াই, সাপি খুপির লড়াই, ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই, অপুষ্টির সঙ্গে লড়াই । লড়াই দেখেনি সুখি জমিদার, শোষণ করছে একতরফা, গরিবের রক্ত বেচতে বেচতে দুমহলা অট্টালিকা করেছে, দেবালয় গড়েছে । গাড়ি চাকরবাকর, বৈতল আর বৈতল এর বৌ এর সেবা । পরবর্তী প্রজন্মের প্রস্তুতিতে সোনার পালঙ্কে জন্ম নেওয়া রাজপুত্র । একই সময়ে জন্ম রাজপুত্র আর বৈতলের মেয়ের । শুধু জন্মসময়ের মিলে ভাগ্যকেও মিলিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা গ্রহবিপ্র আচার্যি ঠাকুরের । তাই বৈতলমেয়ের মরনি নামে তার প্রতিবাদ জানিয়েছে, কিন্তু মরনি নামে ডাকে নি একদিনও, সোনা বাবা মিঠাই এসব আদরের নামে ডেকেছে । কথা বলতে-না-পারা সাধু যখন নামটাকে সাজিয়ে দেন মাঝখানের বেয়াড়া বর্ণটাকে তাড়িয়ে দিয়ে, বৈতলের মনে আনন্দ হয় । ভাবে এমন সহজ সমাধানটা কেন তার মাথায় আসে নি । সে কিন্তু মনি নামেও ডেকেছে সোনাকে, আদরের মাত্রা বেশি হলে সোনামনি ডেকেছে । বৈতল তাই মন থেকে মরনি বিতর্কের ইতি টানে । বৈতল বুঝতে পারে সাধুপিরদের কেরামতি, যা সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ায় আছে কিন্তু ধরতে পারে না, তাই ওরা ধরিয়ে দেন । এখন নির্ভার বৈতল তার সোনার শত নামের মধ্যমণি সাজায় মনিকে, দুর্গাবতীও মেয়েকে ডাকে মনি ।
    সাজিদ মিয়া ঠিকাদারের অন্তঃপুরের সম্পদ দেখে অভিভূত হয় বৈতল । যে মানুষটার জীবনে শুধু টাকা দেদার টাকা আর লাম্পট্য ছাড়া কিছুই নেই, পাপের ভরা উপচে উঠলে ধর্মচিন্তায় মনোযোগী হয়, পির ফকিরের সেবা যত্ন করে লাঘব করে, কিছুটা কমিয়ে রাখে । সেই মানুষটার ভিতরবাড়ির সৌন্দর্যে অবাক হয় বৈতল । বৈতল গন্ধ শুঁকতে জানে । বৈতল দেখেছে মিয়ার দুই বৌকে খাবার পরিবেশন করতে । কোনও মহাত্মার জন্য নয় শুধু, তারা যে পিরের মুরিদ তাদেরও মাতৃস্নেহে আহার করিয়েছে দুই মা । গপ গপাগপ তালের পিঠে তার পাতে পড়ায় যে বৈতলের এই সহৃদয়তা তাও নয় । তালের বড়া তার প্রিয় খুব, দুর্গাবতী করে খাওয়ায় ভাদ্রমাসে । আসলে সাজিদ মিয়া আর তার পরিবারের বৈসাদৃশ্যে সে এক গন্ধ পায় । কেমন মা মা গন্ধ সাজিদ মিয়ার দুই পরিবারে ।
   খাওয়ার পর বেশ অস্বস্তি হয় বৈতলের । অপরিমিত খাওয়া হয়ে গেছে, পান চিবিয়েও স্বস্তি হচ্চে না । একটা বিড়ির সুখটান না হলে ভোজের মজা মাটি । ইচ্ছে করলেই বৈতল খেতে পারে । দুখু দারোগা তার কিছু করতে পারবে না । বৈতলকে ঠেকাবে এমন শক্তি কারো নেই দুনিয়ায় । মামুর শিষ্য হয়ে মামুর সফরে সঙ্গী হয়ে এসেছে সে, মামুকে সম্মান জানাতেই তাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত কোনও নেশা করবে না । তবে বৈতল অন্য এক নেশায় বুঁদ হয়ে আছে এখন, মনটা কেমন ভিজে কাদা হয়ে আছে । বৈতল আপন মনে ভাবতে থাকে দুর্গাবতীর কথা । এক বৌ নিয়ে জেরবার হয়ে আছে বৈতল আর সাজিদমিয়া দু দুজন সুশীলা রমণীর পতি হয়ে আছে সুখে । দুই বিবির কেউই গৌরী নয়, মাথায় কানে শাড়ির আঁচল জড়ানো ঘোমটায় প্রয়োজনীয় পর্দা বজায় রেখেও কেমন সপ্রতিভ । নারীত্বের আভা জ্বলজ্বল করছে অসিত মুখমন্ডলে । সুখী একজোড়া মুখ, দেখলেই নুঝা যায় স্বামীসুখে গরবিনীর সুখ নয় এ । এক অন্য আলো, দুর্গাবতীর সঙ্গে তুলনায় অনেক সহজ এই রমণীদ্বয় । বৈতলের নারী দুর্গাবতীও তা বলে ওদের থেকে কম নয় কিছুতেই, দুর্গারও এমন নির্মল মুখশ্রী দেখেছে বৈতল । সিতবরণী দুর্গার মতো লড়াই তো করতে হয়নি এদের । মিয়া ঠিকাদার প্রাচুর্য দিয়ে বন্দী করে রেখেছে এদের তাই তো ধনসম্পদের দুর্গে এরা সুখেই আছে । ঠিকাদারের আদেশ কেমন নির্বিবাদে পালন করে যাচ্ছে দুই সতীন । চেনা নেই জানা নেই পরপুরুষ অতিথিদের আপ্যায়নে কোনও ত্রুটি রাখছে না । বৈতল পারে না দুর্গাবতীকে দিয়ে একটা ভোজ লাগিয়ে দিতে । দুখু বছইদের ঘরেই ঢুকতে দেয় না দুর্গা । ওরা এলেও পুকুরপারে বসে থাকে । একটা জলবাতাসার আপ্যায়নও করে না । দুর্গাবতী বৈতলের কাছে মাপ চেয়ে নেয় । বলে,
--- বাবনর পুড়ি ইতা পারি না ।
   আলাদা চিলিম তামাক টিকে থাকে, সব জ্বালিয়ে নিতে হয় বছই আপদকে । উনুনের কাঠকয়লা পর্যন্ত বরাদ্দ নয় । বলে,
--- ইতা পারতাম নায়, আমরার বাবনবাড়ি ইলা বাঙাল হামাইছইন না কুনুদিন । তুমার পিরিত দেখিয়াউত্ত টিকি চিলিম আলাদা করি দিছি, আঙড়া উঠাইয়া আমি পাখাল নষ্ট করতাম নায় ।
    স্পষ্ট কথার মানুষ বৈতলের এই এক দুঃখ । তার জীবন বড় বিভক্ত । যারা তার প্রিয়জন তারা এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে । বৈতল জানে দুর্গাবতী ইদানীং যা বলে এবং করে, তাতে তার মনের সায় নেই । দুর্গাবতী নিরাপত্তাহীনতা থেকেই ব্রাহ্মণী সাজার চেষ্টা করছে । হিন্দু মুসলমান ছোঁয়াছুতি করছে । বৈতলকে দুঃখিত করছে । বৈতল তাই বেজার মুখে দুখুর সামনে মাথা নুইয়ে থাকে । মানে দুঃখ প্রকাশ । দুখুর সামনে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করাও বিপদের । পেয়ে বসে দুখু । বলে,
--- অখন কান্দিয়া কিতা করতে বেটা বে-আক্কল । ধলা দেখিয়া নাচছস, অখন তরে নাকো দড়ি দিয়া ঘুরার ইতা নতুন কথা কিতা । কথাত আছে, চেনাইতে ছাগি না ধরলে দৌড়াইয়া লাগাল পাওয়া যায় না, পয়লা রাইত অউ বিলাই মারণ লাগে, অখন মর ।
    দুখু বৈতলকে উস্কে দেয় । আর বৈতলও দুর্গাবতীর সমালোচনা অন্যের মুখে শুনতে চায় না । দুখুকেও উল্টো গালাগাল দেয় মনের মতো । বলে,

--- অই হালার হালা রাঢ়ি বেটি, বৌর লগে তো ঘর করচছ না, বৌরে মারিয়া অখন মুরব্বিগিরি মাররে, আমারে হিকাইরে বিলাই মারার কল । মামুর লগে থাকিয়াও তোর কুনু কাণ্ডজ্ঞান অইল না হাত্তি লেটলেও বেটা ঘুড়া থাকি বড়, আমার বৌ কুনু বাঙাল বাড়ির বেটি নি, আজাব নায়, ছোয়াছুতি মানন লাগে । আর তুই কিগুরে আমার বৌ নিয়া মাততে । সাবধান করি দিলাম, আমার বৌরে নিয়া আমি যত ইচ্ছা মাততাম পারি, আরি পরিয়ে মাতলে মানতাম নায় কল্লা লামাই লিমু বেটা । বৈতল কিতা তো চিনছ না । তুই কুনুদিন কেউর ভালা দেখচছ নি ? এশক জানছ নি, পিরাকির পয়লা পাতাত অউ আছে এশকর কথা । এশক বিনা লাভ নাই । এশক মানে ভালা পাওয়া । প্রেম রে বেটা মদন ।




কোন মন্তব্য নেই: