(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার উজান পর্বের অধ্যায় সতের ---সুব্রতা মজুমদার।)
সতের
উপযাচক
শুভানুধ্যায়ীর কুচক্রী কথাবার্তা বৈতল চুপ করে শুনে যায় । সে সব জানে । বৈতল যে
জমিদারকে নিজের হাতে ঢলানি দিয়ে এসেছে পদ্মপুকুরের পারে । এত সহজে জিয়ানি দেবে না । এবার
শুধু খেলা । ক্যাম্পে বৈতলকে দেখে তো যম জমিদারের খুশি আর ধরে না । সর্পদংশনের হাত
থেকে বাঁচানোর জন্য বারবার কৃতজ্ঞতা জানায় । বৈতলকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে । একা বৈতল
নয়, বৈতলের পরিবারকেও মনে ধরে রাহু
জমিদারের । বৈতলকে বলে,
--- চলো চলো রেবা । মালউল যেতা আছে
উঠাও । তুমার ইখানো থাকা অইত নায় । আমার বাড়িত থাকবায়, পুকইরর পারো একচালা ঘর আছে আমার । হি ঘর তুমরার, থাকবায় নিজর মতো করিয়া । চলো ।
বৈতল ভাবে তার কেরামতি, ভাবে পূর্বাপর । পুকুর পারে মাছধরা, সাপের খেলা, মুর্চ্ছাও পতন, হাতের আংটি হাতিয়ে নেওয়া, আংটির দাম সত্তর টাকা, পক্ষীরাজ রিক্সার দামও এক । ব্রাহ্মণ কন্যা দুর্গাবতীকে
দেখেই যে জমিদারের সব পরিকল্পনা সে বৈতল ভাবেনি । বৈতলের এই এক দোষ, সে যখন ভাবে তখন তার নিজস্ব ছক নিয়েই ব্যস্ত
থাকে, বিপক্ষকে গুরুত্ব দেয় না । তাই
প্রাথমিক জয়ের আভাস পেয়েই সে ফিরিয়ে দেয় গাড়ি করে যাওয়ার প্রস্তাব । জমিদারের
সঙ্গী ভোলাকে জানিয়ে দেয় সে যাবে, তবে জমিদারের ভাঙা গাড়িতে নয়, সে যাবে তার নতুন রিক্সায় ।
বৈতল একবারও ভাবে না শুধু
কৃতজ্ঞতার বশে কেন নিয়ে যাবে তাকে যমুনা জমিদার । দশ বিশ টাকা হাতে গুঁজে দিলেই তো
কৃতজ্ঞতার শোধবোধ । তা বলে একজন অজানা মানুষকে বাড়িতে ঠাঁই করে দেওয়া । কিসে এত
মুগ্ধতা, কেন কোনও প্রশ্ন করবে না, জানতে চাইবে না দেশ কোথায় । কেন দেশভাগের
দুবছর পর এপারে । আর সিলেট তো হরিৎবরণ নয়, ইটখোলা নয়, মালুগ্রাম নয়, অম্বিকাপট্টি নয় যে সবাইকে চেনে । কোন পরগণা
কোন গ্রামে তার বাড়ি, জানবে না । বৈতল নাম বলেছে
সৃষ্টিধর শর্মা, সিলেট শর্মা ব্রাহ্মণ বললে কিছুই
বোঝায় না । ব্রাহ্মণ মাত্রেই শর্মা । গোত্র কী । বৈতল এত সব ভাবেনি, কৃতজ্ঞতার প্রতিদানকেই বড় করে ভেবেছে ।
পুকুরপারের
খড়বাঁশের ঘরটাকে সারিয়ে তোলে বৈতল । বাঁশের বেড়া গোবর মাটি দিয়ে লেপে দেয়
দুর্গাবতী । নিজের বাড়ি আর লাগোয়া জমিদার বাড়ির উঠোনও সুন্দর হয় লেপনে পুছনে ।
দুর্গাবতী মহুয়া গাছের বেদি লেপে দেয়, লেপে ঠাকুরঘরের দাওয়া । বৈঠকখানার বারান্দায় আরামচেয়ারে গা এলিয়ে বসে থাকে
জমিদার যমুনাপ্রসাদ । অবাক হয়ে দেখে দুর্গাবতীর অপরূপ শরীরী বিভঙ্গ । চোখের
দৃষ্টির বাইরে চলে গেলে চোখ দিয়ে খোঁজে, চেয়ার ছেড়ে ওঠে, বারান্দার ওমাথায় যায় । ঘুরে
ঘুরে দেখতে থাকে বরতনু । মাটিলেপায় বিশাল সুন্দর শ্রোণীযুগলের আঁটো বাঁধুনি টানটান
হয় । নির্বাধ এমন যুগল বক্ষ আর উন্নতদরশন । চোখে দেখে আশ মেটে না । জমিদার ডাকে
মধুর স্বরে । বলে,
--- ও বউ শোন ।
দুর্গাবতী গোবর
মাটির হাত ধুয়ে কাপড় চোপড় ঠিক করে নেয় । হাঁটুর উপর থেকে গোড়ালিতে নামায় শাড়ি ।
বুকদুটি আধভেজা কাপড়ে ঢাকে । তা ও কি বাঁধ মানে । জমিদার ভুলে যায় কথা । দুর্গা
বলে,
--- আইজ্ঞা ।
--- উঝা বেটা ইগু তুমার বিয়া করা
মানুষ নি ?
দুর্গাবতী চমকায়
। এ আবার কেমন প্রশ্ন । কিছু কি ধরা পড়ে যায় । এরকম তো হওয়ার কথা নয় । বিয়ে টিয়ে
তাদের কিছু হয় নি ঠিক । কিন্তু সে তো অন্য দেশের ঘটনা । এখানে কেউ জানে না তাদের
পূর্বপরিচয় । সবাই জানে ওদের দেশ সুনামগঞ্জ । ভাটির দেশের মানুষ । গ্রাম বইয়াখাউরি
পরগণা ছাতক । শর্মা, ব্রাহ্মণ বাড়ির মেয়ে দুর্গাবতী ।
বইয়াখাউরি শ্মশানের গায়ে ঘর । পিয়াইন আর সুরমার সঙ্গম যেখানে । অগ্রদানী ব্রাহ্মণ
বাপ । তিনি তিনকাঞ্চন না করলে মড়া পোড়ানো যায় না । শ্রাদ্ধেও প্রথম ভাগ তার ।
পিন্ডদানেও তাই । সেই বাপের একমাত্র কন্যা । মানুষ বলে কটার বাবণ, তুচ্ছ করে ব্রাহ্মণ সমাজও । তবুও পিতার
মৃত্যুর পর তিলকাঞ্চনের অধিকার চেয়েছে দুর্গাবতী ব্রাহ্মণী । সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়া
স্বধর্মের মানুষ দেয়নি তাকে সে অধিকার । সমাজমানুষেরা রক্ষাও করতে পারেনি তাকে
ধর্ষকের হাত থেকে । ব্রাহ্মণ তথা বাবুসমাজ যা পারেনি তাকে তাই করে দেখিয়েছে এক
নিম্নবর্ণের যুবক । বৈতল রক্ষা করেছে দুর্গাবতীকে ।
বইয়াখাউরির বড়বিল আর
দেখার হাওর । কুচা হাতে কালো কুচকুচে একটা মানুষ শুনেছে নদীর জলেও দাপিয়ে বেড়ায় ।
হাওর বিলে লড়াই করে সকাল সন্ধে রাতের অন্ধকারে । জলের ফসল নিয়ে যায় মাধবগঞ্জ ঝাউয়া
বাজারে । যেদিন নদীর জলে জাল ফেলে সেদিন দুর্গাবতীকে দেয় মাছ । মা নেই বাপ নেই
বৈতলের, তাই নিজের বাড়ি ছেড়ে থাকে
মালিরভিটায় । বইয়াখাউরির কালিবাড়ি টিলার উপর, নিচে নদীর পারে শ্মশান ।
কালিভক্ত নয় তবু যায় মন্দিরে, থাকে নেশার টানে, আর বন্ধু লুলার টানে । শ্মশানের গা-লাগোয়া কবরখানার ঘরে থাকে বন্ধু লুলা । দুই
বন্ধুতে নেশা করে নদীর পারে । মদফদ খুব একটা খায় না বৈতল, কিন্তু গাঁজার নেশায় বুঁদ হয় । আর নেশা গৌরাঙ্গী
ব্রাহ্মণকুমারী । দূর থেকে দেখা, এমন নেশার কথা বলার সাহস হয়নি
কোনোদিন তেলাল কালো বৈতলের ।
দুর্গাবতীও
ছিংলাকাঠির মতো মানুষটাকে দেখে । কালো তেলতেলে শরীরে পছন্দ হওয়ার মতো কী যে দেখে
দুর্গা সেই জানে । বৈতলের এক আকর্ষণী শক্তি আছে নিশ্চিত, নইলে সেই সেই ডামাডোলের সময়ে, দেশভাগের আগেও পরে দুই সমাজ, হিন্দু মুসলমানের সমান প্রিয় হয়ে ওঠে কোন মন্ত্রবলে কে জানে
। যখন মন্দিরে থাকতে শুরু করে বৈতল, তখন থেকেই মন্দির পুরোহিত ও
ভক্তভজন সবার ভালবাসা কুড়িয়েছে বৈতল । দুর্গাবতী তো থাকে অনেকদুরে, একা শ্মশানে যুবতি । কেউ বলতে পারবে না বৈতল
কোনোদিন তাকিয়েও দেখেছে । বৈতলের চকিত দেখা তার মনে মনে । দুর্গাবতীও জানে ঐ
মানুষটি আছে, জালি বেত এর শরীরটা কাছাকাছি
থাকলে আর কোনও ভয় নেই । বৈতলেরও ইচ্ছে হয় নি কখনও, বৈতল নিজেকে জানে । বামন হয়ে চাঁদ হাত দিতে চায়নি । সুন্দরী
ব্রাহ্মণকন্যা তার কামনার বস্তু নয় জানে । আবার ভুড়ুৎ আচার্য মারা যাওয়ার পর
অসহায়া যুবতীর সব ভার যে কেমন করে বৈতলে এসে বর্তায় কে জানে । কখনও মাথা তুলে
দেখেনি যুবতীকে, আবার দৃঢ়তার সঙ্গে অভয় দেয়
কালিবাড়ির সেবাইতকে, সবার অভিবাবক গিরিবাবাকে । বলে,
--- তাইন থাকউকা ইখানোউ । আমি আছি, দেখমু ।
দিনে একবার দেখা
দিয়েছে বৈতল । মাছ দিয়েছে বিস্তর, একবারও ভাবেনি মাছ ছাড়াও কত
কিছুর দরকার । চাল ডাল তেল নুন দরকার, দরকার কাপড়চোপড়ড়েরও । তবু দুর্গাবতী চেষ্টা করেছে ভালভাবে বাঁচতে । পিতার কাজ
করার অধিকার চেয়েছে, পুরুষ নয় বলে প্রত্যখান হেয়েছে ।
বইয়াখাউরি কেন, গোটা ছাতক পরগণাই অগ্রদানী
ব্রাহ্মণ পুরুষের অভাব, তাই বাসস্থান থেকে উৎখাত হতে
হয়নি । বড় বড় মানুষের বাড়িতে গেছে, বলেছে রান্নার কাজ পেলেও তার
চলবে । কেউ দেয়নি । ব্রাহ্মণ কায়স্থ সবার কাছেই সে অচ্ছুৎ । রাধামাধব আখড়ার
পরিচালকরা বলেছে নেবে । তবে বষ্টুমি হয়ে আখড়ায় থাকতে হবে । খেতে হবে নিরামিষ ।
বৈতল বলেছে, না । বৈতলের সুপারিশেই বড়বিলের
পারে কৈবর্তদের বিষহরি মন্দিরের লেপাপুছার কাজে বহাল হয় দুর্গাবতী ।
বাপ বেঁচে থাকতে
তো ঘরের বাইরে বেরোয়নি দুর্গাবতী । বাপ মরতে ধান্দা শেখে । ভদ্রলোক পুরুষরা
দুর্গাবতীর সঙ্গে কথা বলে । দুর্গাবতীর প্রয়োজন তখন, কাউকে ফিরিয়েছে, কাউকে ডেকেছে । দুর্গাবতীর জন্য কিছু করতে পেরে গর্ব হয় বৈতলের । তখনও বৈতল
মুখ তুলে তাকায়নি, কিন্তু নেশা ধরে ।
শৈশবের বন্ধু
লুলাও তখন বইয়াখাউরিতে । বাজারে বাজারে কবিগান গায় । দোহালিয়া বাজারে বৈতলও ওর
সঙ্গে যায় । রুল আমিন রেজ ওরফে লুলা যখন কবি গায় তখন তার নাম হয় দিলবাহার বাঙাল ।
এক এক জায়গায় যায় আর স্থানীয় মানুষকে মোহিত করে দেয় ছড়া গেয়ে । প্রচলিত সব ছড়াকে
সে তার নিজের মতো পরিবেশন করে টিনের চোঙা মুখে লাগিয়ে । জলঢুপ বিয়ানিবাজার
ঢাকাদক্ষিণ শাল্লা, বংশীকুন্ডা, খুরমা, দিরাই, বালাগঞ্জ, লংলা, লামাকাজি একসঙ্গে গান গেয়ে বেড়ানোর সুখস্মৃতি ভুলবে না
জীবনে । বন্ধু লুলার কবিগান তো একটুকরো কাগজে পাঁচ মিনিটের গল্প । সব স্থানীয়
প্রেম পিরিতির কথা । তবে লুলা বুদ্ধি করে রূপবান এর গানও গায় । আবার বর্ষায় যখন
জলঢুপ বাজার আনারসের ফসলে স্তূপীকৃত, তখন করে স্থানবন্দনা । গায়,
‘জলঢুপের আনারস জগতের সেরা
শ্রীমঙ্গল ফলায় বুঝি দেখতে যাব মোরা
শ্রীমঙ্গল চায়ের বাগান সবার আছে জানা
কেমন করে বানায় চা দেখব তার নমুনা ।’
বাজারে গাইতে
গাইতে সুরের সঙ্গে এমন মিতালি করেছে লুলা যে চা বাগানের গান গেয়েই সুরকে বদলে দেয়
ভিন্নগানে । গায়,
‘ও ধাইমা,
ধাইমা গো, কিসের বাজন বাজে গো আমার ধাইমা ।
বারো দিনের শিশুর সঙ্গে ও রূপবান তোমার হবে
বিয়া গো ।’
সোনাউতা বাজারে গিয়ে বৈতল দেখে ভিন্ন রূপ । নদীর পারে বাজার
। নদীর উপর এক লোহার পুল, এপার ওপার । ওপার থেকে হাটুরেরা
জড়ো হয় বাজারে । বুধবারের জমজমাট বাজার দেখতে বৈতল পুলের উপর ওঠে । শুধু সাদা
তকিতে ছেয়ে আছে বাজার । লুলা এক একদিন এক এক ছন্তরে দাঁড়িয়ে শুরু করে গান । এক
পয়সা থেকে বাড়িয়ে দুপয়সা দাম করে দিয়েছে লুলা এক পাতার কবিগানের । লুলার লেখায়
গ্রাম্য কথাই বেশি, তার উপস্থাপনা আর প্রচলিত ছড়ার
গানে শ্রোতা মোহিত হয়ে কিনে নেয় দু পয়সার পাতা । সোনাউতা বাজারে গিয়েই লুলা তার
ঝুলি থেকে বের করে এক সোনালি জরির কাজ টুপি । বৈতলের হাতে দিয়ে বলে,
--- তুইন পিন্দিলা । দেখরে নানি
ইখানো সব অউ বাঙ্গাল ।
বৈতল তকি হাতে
নিতেই লুলা হাটুরে শ্রোতাদের আদাব জানায় । তারপর শুধু করে তার অননুকরণীয় গান । গায়,
‘পয়লা বন্দনা করি মালিক ছাত্তার।
দুছরা বন্দনা করি নবি মছতকার ।
তিছরা বন্দনা করি ছিলটি মানুষ ।
দিলবাহারের কথা হুন দিয়ে হুশ ।
ধন আছে জন আছে, আছে ধান চাউল
হরিণ আছে পাখি আছে, আছে মাছ হউল ।
কি অর লাগি গম কর আল্লা আছইন লগে ।
যত নিয়ামত দিছে আল্লা দুনিয়ার মাঝ ।
বাদশাগিরি করা অইল ছিলটির কাজ ।
আরব দেশর মাটির লগে মিল ছিলটর ।
এর লাগি বাস অইল বাবা শাহজালারর ।
জালালি কবুতর উড়ে কাজল পাংখা দিয়া ।
আল্লা আল্লা জিকির পড়ে তারা সব বইয়া ।’
বৈতল তার বন্ধুর
রূপ দেখে গর্বিত হয় । আবার এক কষ্টের অনুভূতিও তাকে করে খায় । তার শৈশবের সাদাসিধে
বন্ধু কি তবে পাল্টে যাচ্ছে । শুধু ধর্মের কথা কয় ধর্মের গান গায় । বৈতল ভাবেও সে
ও কি পাল্টে গেছে, সেও তো আর গ্রামের বাড়িতে থাকে
না, মন্দিরে থাকে । মন্দিরে সবাই আসে
যায়, প্রাণের বন্ধুকে আনতে পারে না ।
মন্দিরটিলার নিচে বসে থাকে লুলা । ধর্ম সম্পত্তির শেষ সীমায় দাঁড়িয়ে দুজনে
চালাচালি করে মনের কথা । বৈতল লুলাকে দিয়ে দেয় তার বসতবাড়ি । বলে,
--- থাক বেটা ভূতর বাড়িত । ইখানো আমি
থাকতাম নায় । ই বাড়িত আমার মাই আছিল ।
--- তাইন আছইন অখনও । আমি গেলে টের
পাই, পাগলার দেবীমার লাখান বই রইছইন
ভাত বাড়িয়া । ডাকরা তরে ডাকরা আমারে, লুলা আয় বাপ । তুইন বেটা মাইর
লাগি কিতা করচছ । আমি করছি, তানে ভাসাই দিছি সুরমার পানিত ।
তুইন তখন কই আছলে বেটা। অখন দিলাইরে বাড়ি ।
মিরতিঙ্গার মামার
বাড়িতে মরেছে মা । বৈতল জানতেও পারেনি । লুলা, বৈতলের মুসলমান বন্ধু গেছে, সাপের কামড়ে মৃত মায়ের শেষকৃত্য করেছে, সুরমার জলে কলার ভেলায় ভাসিয়ে দিয়েছে মাকে । লুলা এখনও
বিশ্বাস করে মা ফিরে আসবে আবার প্রাণ নিয়ে । ইচ্ছে হলে ঠগঠগামির চুরি ডাকাতি সবই
করে লুলা, দুই বন্ধুতে মিলে এসব করে ।
কিন্তু লুলা লোভী নয় । বৈতলের দিয়ে দেওয়া বাড়ি নেয়নি । বলেছে,
--- অয়, তখন সবে কইব, দেখো কিলাখান দোস্তি, পাকিস্তান অইতেউ বাড়ি নিছে গিয়া । ইতা আমি
পারতাম নায়, দিলা তুই যে কুনু কালা মিয়ারে ।
অই হালা, ভিটা ছাড়ন লাগে না, আমি কুনু ছাড়ছি নি, খিত্তা থাকি গিয়া মামাইন্তর কাছ থাকি আমার হিস্সা লইয়া
আইছি, নানিহালি সম্পত্তি আমার কম নায় ।
তর ইতা নিতাম কার লাগি । আর অখন নায় তো লেইঞ্জ নাই, কল্লা নাহ, কালিবাড়ির ছাগি, যখন বিয়া করবে বউ আইব, কই রাখবে বেটিরে ।
--- কেনে তুই দিতে নায়নি থাকার জাগা ?
--- তুইন কিতা ইন্ডিয়াত ভাগার কথা ভাবিতরে নি বে ?
দেশ ছেড়ে কেন যাবে বৈতল । বন্ধুর কথায় দুঃখ পায়
। দুঃখ থেকে হয় রাগ । রাগ করে মন্দিরে যায়, এক চিলিম, দুই চিলিম তিন চিলিম টানে এক
সন্ধ্যায় । নেশায় টলতে টলতে নামে টিলার নিচে । লুলাকে মারে এক লাথি, মারে দুই লাথি, তিন লাথি মারতে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ে শক্তমাটিতে, পড়ে বন্ধুর গায়ে । পদাঘাত খাওয়া দশাসই বন্ধু
মার খেতে বলে,
--- মার হালার হালা । আরো মার, আমিও অইলাম খিত্তাগাউর বাঙাল, গুসা উঠলে কিন্তু আস্তা রাখতাম নায় ।
আর ঠিক তখনই, সন্ধ্যা হয় হয়, পিয়াইন পারের শশ্মান থেকে বেরিয়ে আসে এক লক্ষীপ্রতিমা । দুই বন্ধুর মধ্যস্থতা
করে । দুর্গাবতী কিছু বলে তাদের, তারপর দুজন গলা জড়াজড়ি করে
বেরিয়ে যায় সন্ধ্যার আঁধারে । এরপর কেটে গেছে আরো কিছুদিন । এসেছে বর্ষা, পিয়াইন সুরমার আবার শুরু হয়েছে মাতলামি ।
ফুঁসছে জল । তেমনি এক অন্ধকার রাতে প্রলয় চারদিকে । শ্মশানের পাশে মুখোমুখি দুই
নদী । কানায় কানায় কানাকানি করে । বন্যাজল শ্মশান থেকে অনেক দূরে । ঘরে একা
সাহসিনী দুর্গাবতী কুপিলম্ফ নিভিয়ে শুয়েছে । ঘুমঘোরে বুঝতেও পারে না কী করে ঘরে
ঢোকে দুর্বিপাক । একাকিনী যুবতীর তো ঘুমিয়েও স্বস্তি নেই, সদা জাগ্রত থাকে । কোনও শব্দ না করে কী করে ঢোকে লুলা, সিঁদ কেটে না দরজা ভেঙে । দরজা ভাঙেনি কারণ
দুর্গাইতো দরজা খুলে বেরিয়েছে বৈতলকে ডাকতে । একা লুলার মতো দানবকে বশ করার মতো ক্ষমতা
আছে দুর্গার, নইলে কী আর একা থাকে শ্মশানঘরে ।
কিন্তু লজ্জা আর ঘৃণায় দুর্গা ছুটে বেরিয়েছে । লুলার জাপট থেকে বেরিয়ে বৈতলের
বিশ্বাসে আঘাত দিতে চেয়েছে । লুলা যে বৈতলের প্রাণের বন্ধু, বইয়াখাউরির মানুষ জানে হরিহর আত্মা । বৈতল বিশ্বাস করে না ।
বৈতল জানে তার লুলা এক সাধুপুরুষ । তার বন্ধুত্বের কল্যাণপরশ দিয়ে ঘিরে রাখে । দুর্গাবতীর
চিৎকার শুনে হতভম্ব হয়ে যায় বৈতল । ভাবে এ কেমনে আক্রোশ । শুধু বিধর্মীকন্যা বলে
ধর্ষক হয়ে সর্বনাশ করতে হবে । দুর্গার গায়ে হাত দেওয়ার দুঃসাহস কেউ কখনও করেনি ।
দুর্গা একাই অসুরনাশিনী হয়ে সংহার করতে পারে, কিন্তু করে না, বৈতলকে ডাকে, বন্ধুর হাতে সৌপর্দ্দ করে দুষ্ট
সহচরকে । তখনই দুর্গা তার নামের মহিমায় সংবরণ করে নিজেকে । নিশ্চিন্ত হয়ে ভাবে, সে যদি দুর্গা হয়, তবে গাঁজাখোর বৈতল তার মহাদেব । তার আশ্রয় ।
বন্ধুকে মারতে হাত কাঁপেনি বৈতলের ।
বইয়াখাউরিতে ফোঁসে জল, দুই নদীর সম্মিলিত আক্রোশে বাড়ে
জল । দুর্গাবতীর ভিটা শুধু ভেসে আছে নদীর পারে । বন্ধুর দেহ নদীর জলে ভাসায় বৈতল ।
দুর্গাবতীর বাবা ভুড়ুৎ আচার্যের মতো এক আজলা জল, জলের দেহে দিয়ে বলে,
--- পবিত্রোপবিত্রবা ।
বৃষ্টির জল আর চোখের জল একাকার
হয় বৈতলের । মনে মনে বলে,
--- শেষ বিচারের দিন দেখা অইব দোস্ত ।
দুর্গাবতী আর সময় দেয়নি বৈতলকে । মালিভিটার
বেতখলার জালিবেত বৈতল পাটনির চোখে তাকিয়ে দেখেনি কোনোদিন । কালিবাড়ির সেবাইত
গিরিবাবার নির্দেশে বৈতল দেখভাল করেছে অনাথা যুবতীর । ঘনিষ্ঠতার কোনও কারণ ঘটেনি
গৌরাঙ্গী আর কৃষ্ণবর্ণের । দুর্যোগের রাতেই প্রথম চোখাচোখি । প্রথম হাত ধরাধরি । হাত
ধরে তাড়া দেয় দুর্গাবতী । বলে,
--- চলো চলো আর দেরি না ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন