(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার উজান পর্বের অধ্যায় আঠাশ ---সুব্রতা মজুমদার।)
আঠাশ
বিপদের মুখোমুখি হলে বৈতলের সাহস
বেড়ে যায় । কোন জট জঞ্জাল তাকে কাবু করতে পারে না । বিয়ানিবাজারের সাধু সৃষ্টিধর
তাকে রক্ষা করেন । গুরুর মুখের কথা যেন অমৃতবানী । দুঃখ বেদনার ধারে কাছেও থাকেন
না তিনি । তিনি ভিন্নপথে নিরাময় দেন । একথা সেকথায় ভুলিয়ে রাখেন জীবনের জটিলতা
থেকে । মন শান্ত রাখার নানা উপায় বাৎলে দেন । বলেন,
--- জানো নি রেবা ঘরর ভিতর ঘর কারে কয় ।
--- আইজ্ঞা অয় জানি, মশইর ।
--- ইতো রেবা পই ভাঙ্গাইলায় । ঘরর ভিতরে ঘর, তার মাঝে ছই রইছে পরমেশ্বর । আমি হি কথা
কইয়ার না । আমরার মুখর কথা । আমরা বাঙালি না নি । বাংলা আমরার ভাষা, তার ভিতরে আবার সিলেটি, আমরার মাতৃভাষা । তুমি বাংলাত মাত্তায় পারো নি ।
--- হুনছি, যোগেন মণ্ডল আইছলা একবার হবিগঞ্জো, তাইন ভাষণ দিছলা বাংলাত । আর হুনছি গান মুকুন্দরামর, ‘ছেড়ে দাও রেশমি চুড়ি, বঙ্গনারী আর পরো না’ নেতাজিয়ে কইছলা ‘ তোমরা আমায় রক্ত দাও । আমি তোমাদের স্বাধীনতা
দেব ।’
--- আর রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথর গান হুনছ নানি । ‘বাংলার মাটি বাংলার জল,বাংলার বায়ু বাংলার ফল – পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান ।’ আরো কত গান রেবা, তাইন নবেল পুরষ্কার পাইছইন । তান গান দিয়া আমরা মনর কথা
কইতাম পারি, তাইন অইলা বিশ্বকবি । আমরা
সিলেটি অইলেও আমরা বাঙালি । চৌদ্দ কোটি হাত আছে বাঙালির ।
--- সিলেটিত অউত্ত আমরা মাতি ।
--- মাতি, কিন্তু আসল ভাষা অইল বাংলা । এর লাগিয়াউ কইছলাম ঘরর ভিতরে ঘর । সারা বাংলা
ঘুরলেও সিলেটির লাখান মিঠা মাত পাইতায় নায় । আর সিলেটি মাইনষর বুদ্ধির ধারো কাছো কেউ নাই । সিলেটি পই
ডিটান ইতা কুনু ভাষাত পাইতায় নায় । তুমার মুখর আগাত হক্কল সময় পাইবায় হাজাইল মাত ।
--- মাইনষে যে কইন ঢাকাইয়া মাতর কথা ।
--- কইন, ঠিকঅউ কইন । সবর মাতৃভাষাউ মিঠা । ময়মনসিং কুমিল্লা বরিশাল নোয়াখালি চট্টগ্রাম
খুলনা নবদ্বীপ সব ভাষাউ মিঠা যারযার কাছে । যেমন শ্রীচৈতন্য দেবর মাতৃভাষা তো
সিলেটি, তাইন মাততা পারতা না সিলেটিত, নবদ্বীপ শান্তিপুরর বাংলাত মাততা ।
--- তান বাপর বাড়ি তো ঢাকাদক্ষিণ । একবার গেছলাম
মিশ্রবাড়ি । হারাদিন কীর্তন । এরমাঝে মিরদঙ্গ লইয়া কী নাচ ! আর শ্রীচৈতন্যর বাড়িত তো হক্কলেউ পরসাদ পাইন । নাউচরা
বেটাইন্ত হকলরে দেখিয়াউ মনো অইল কথা,
‘ভাব নাই ভক্তি নাই
উবা উবা ফাল
পসাদ খাইবার বেলা
ঠাউয়া ঠাউয়া গাল ।’
--- না রেবা ইলাখান কইওনা, ভক্তি ছাড়া কুনু কেউ অতদূর যাইবনি । অউ যে তুমি আইছ উঝা
অইতায় । আইর গান শিখতায় এমনে পারবায় নি । উবা ফাল দিলে অইব নি । নাচ শিখন লাগব, গান গাওন লাগব । নাচতে নাচতে গাইতে গাইতে
শিখবায় সব । মিলাইয়া যদি কই তে কইমু ‘গাইতে
গাইতে গাইন আর বাইতে বাইতে বাইন ।’ ঠিক নানি । তে সব থাকি বড় কথা
অইল সাহস, লুকাই থাকলে অইত নায়, তুমার নাচ গান তুমার জানা হক্কলতা নিয়া বারে
আওন লাগব । না দেখাইলে কে তুমারে কইব উঝা ।
বৈতলের ভয়ডর নেই । তাই গায়ক হয়েছে বৈতল ।
গুরুর আশীর্বাদে পদ্মপুরাণের দেবখন্ড শিখেছে ভক্তিভরে, বানিয়াখন্ড শিখেছে সমান ভক্তিভরে তবে চম্পকনগরী ঘিরে যে
মানব সমাজ তার কীর্তন গানে বৈতল আপনভোলা হয়ে যায় । যেন নিজের সঙ্গেই কথা গান দুঃখ
সুখ । গুরু তাকে ভাষার কারিকুরি শেখান । বলেন,
--- সব আমার কথা নায় রেবা । তুমি আসর বুঝিয়া
বদলাইবায় গান, পয়ার লাচাড়ি । তেউ না গান তুমার
অইব ।
বৈতল সিলেটি ভিন্ন ভাষা জানে না, বই এর বাংলা বলতে হাসি পায় । দেশ ছেড়ে আষাঢ়
পর বিশ্বকবির একটা গান তার খুব গাইতে ইচ্ছে করে । ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা,’ গাইতে পারে না ঠিকঠাক । অন্যগান
হয়ে যায়, দেশ ‘দ্যাশ’ হয় তোমার ‘তুমার’ হয়, ‘পরে’ ‘ফরে’ ‘ঠেকাই’ ‘টেকাই’ আর ‘মাথা’ ‘মাতা’ হয়ে যায় । রবীন্দ্রনাথের গান হয় ‘ ও আমার দ্যাশের মাটি তুমার ফরে টেকাই মাতা ।’ কলের গানে যদি কখনও বাজে সেন্ট্রাল রোডে, বৈতল মন দিয়ে শোনে । মন খারাপ করে ঠিকঠাক
উচ্চারণ করতে পারে না বলে । বইয়াখাউরি ফিরে যাওয়ার কথা ভাবে, গ্রামের ভাষায় এত সব বিচিত্র বাণী নেই । ইটখোলা ঘাটের
বটগাছের নিচে বসে বৈতল তখন আপন মনে গায় ‘ফাহান্দে পড়িয়া বগা কাহান্দেরে...
গুরুর মনটা মনে পড়লেই বৈতলের সব মন খারাপ দূর
হয়ে যায় । মন যখন খুব আতালঝতাল তখনও তার নিরাময়ের নিদান দেন গুরু । বলেন,
--- মন ঠান্ডা রাখবায় কুয়ার তলর ঠান্ডা পানির
লাখান । বুদ্ধি দিয়া বার অইবায় হাসিমুখে । ই দুনিয়ার সব কিচ্ছু অউ রেবা বাবুই
পাখির বাসার লাখান, সুই বার করাউ আসল কাম । আর জাননি মাথা ঠান্ডা রাখলে অত
আপাঞ্জালির ভিতরে থাকিও দেখবায় বার অইব সোনার সুই । গোলোকধাম খেলছ নি ।
--- দেখছি, কাগজো ছবি আকা কুঠা কুঠা । সব তীর্থস্থানর ছবি পার অইয়া যাওন লাগে । খেলছি না
।
--- নরককুণ্ডও আছে । উপরে উঠা নিচে লামা, গোলোকধাম তো স্বর্গপুরি, দেখলায় আগর ঘরো আইছ, আবার মারলায় তিনচিত নামই গেলায় নীচে । তিনচিতে নরককুণ্ডে পতন লেখা থাকে । অতাউ
হইল ধাঁধা, ধান্দা লাগাই দেওয়া আরি ।
--- চিনি, পই আরি ।
‘রাজার বাড়ির মেনা গাই
মেন মেনাইয়া ডাকে
হাজার টেকার মরিচ খাইয়া
আরো খাইত চায় ।’
--- পাটা পুতাইল । ই পইর কথা কইয়ার না রেবা ।
কইয়ার ধাঁধা, ধান্দা লাগি গেলে কেমনে বার
অইবায় । বুদ্ধি দিয়া বার অইবায় । অঙ্কর লাখান । ধরো, তুমার যে নদী মহামায়া, খুরমা আর রাউলি গাউর মাঝখানো কুনু মহামায়া নি, না নাইওর খাল ।
--- আইজ্ঞা আমরার নদীতো সুরমা, পিয়াইন ।
--- ঠিক আছে রেবা, তুমার নায় আমার অউ তাইন মহামায়া । মহামায়ার উপরে আছে এক
বাশর পুল । অউ পুল ছাড়া আর কুনুপথ নাই রাউলি যাওয়ার । অখন মনো করো তুমি যাইতায়
হিপারো, তুমার লগে আছে এক আটি কাটলপাতা
এক ছাগি আর এক ধুম্বা মারা বাঘ ।
--- বাঘ কেনে । বাঘ লইয়া কুনু কেউ যায় নি ।
--- ধরো না । যায় না আমিও জানি মনো করো বাঘে
তুমারে খাইত নায়, ছাগি পাইলে ছাড়ত নায় । ছাগিয়েও
কাঠল পাতা ছাড়ত নায় । অখন তুমি এক একটা জিনিষ লগে লইয়া পার অইতায় পারবায় । কেমনে
পার অইবায় । বাঘ রাখিয়া আইলায় তারপরে ছাগি রাখলায়, বাঘে খাই লাইব । ছাগি রাখলায় কাঠল পাতা রাখলায়, ছাগিয়ে খাই লাইব । তেউ কিতা করবায় । শহরর
মানুষরে ইতা ধাঁধার কথা কইলে হাসবা । কিন্তু গাউর মানুষে অতাউ বুজে, সহজ কথা ।
বৈতল তার সহজ গুরুর সব কথা বোঝে, মেলায় জীবনের সঙ্গে । তাই নদীর পারে কাক গুনে
পয়সা আদায়ের পুরনো ফন্দির গল্প দুখুর অভিনয়ে মন্দ লাগে না বৈতলের । শহুরে বজ্জাতি
থেকে যে গাঁয়ের মানুষ এখনও দূরে রয়েছে জেনে ভাল লাগে । জটিলতাহীন জীবনই তো চেয়েছিল
বৈতল, সরাসরি খোলামেলা । এতসব
ভাবাভাবির সময় নেই । বৈতলের বাপও বলেছে তেমন এক ভিতু মানুষের কথা । বন্যার সময়
গাছে চড়ে বসেছিল, বাপ তার শ্বাসনালী টিপে মারে
অনুশোচনাহীন । বৈতল লুলাকে মেরেছে, তার প্রাণের বন্ধুকে মেরেছে । কিন্তু গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে কি
তবে বৈতলকেও শহুরে চালাকিতে পেয়ে বসে । সে কেন যমকে সরাসরি শাস্তি দিতে পারছে না ।
বৈতলের তো ভয়ডর নেই কোনকালে । তবু বৈতল বুদ্ধির খেলা খেলে, দুর্গাবতীর সঙ্গে শর্তের খেলা খেলে । শর্ত মেনেই দুর্গাবতী
আর বাবু বিপঙ্খার প্রমোদভ্রমণ বন্ধ হয় । কিন্তু মনেই যে কচকচি প্যাঁচ তাও জানে
বৈতল । শর্ত মানে পথ খুলে দেওয়া, শর্তের বাইরে যা থাকল দুনিয়ায়
তাতে কোনও আপত্তি নেই । তাই নতুন উপসর্গ দেখা দিতেই বৈতল প্রমাদ গোনে । যমজমিদারের
বৌ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে, দুর্গাবতী বলে সুতিকা । বৈতল বলে
এ কেমন রোগ । দুর্গা বলে মেয়েদের হয় । বৈতল চুপ করে যায় । দুর্গাবতীর যে কাজ বেড়ে
যায় এদিকে । চন্দ্রধর বাবাজির সর্বক্ষণের কাজে নিয়োগ হয় দুর্গাবতীর । খাইয়ে দাইয়ে
ঘুমপাড়িয়ে তবে ছুটি । শরতে কোনও বাধা না থাকলেও মেয়েকে নিয়ে যায় না দুর্গাবতী
ভিতরবাড়িতে । একা যায় একা আসে । দিনমান তাই বৈতল মেয়ের সঙ্গে কাটায় আর বাবুই পাখির
বাসার জট ছাড়ায় । শয়তান যমুনাপ্রসাদের গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপায় খোঁজে ।
তার দুর্গাবতীকে, গ্রামের সরল মেয়ে তার বৌটাকে
ফিরে পেতে পাঁচালিকারের শরণাপন্ন হয় । আকুল হয়ে গায়,
‘সঙ্কট কালেতে কোথায় ভবানী শঙ্কর ।
কহে ষষ্ঠীবর কবি মনসার বর ।
বিপদ কালে কোথা রইলে ভবানী শঙ্কর
।।’
তবে কি তার গ্রামে ফিরে যাওয়াই উচিত । আবার
সেই মাছ ধরার জীবন । মালির ভিটেয় কালীমূর্তির সামনে বসে দুএক দম গাঁজা খাওয়া ।
বৈতল ফিরে গেলে সানন্দে টেনে নেবে সবাই । এতদিন পরে কে আর মনে রেখেছে লুলার কথা ।
লুলা তো আর ছাতক পরগণার মানুষ না, বইয়াখাউরি তার গ্রাম নয়, বৈতলের পরিচয়েই এসেছে খিত্তাগাউ-এর বাদিয়া । বইয়াখাউরিতে লুলার বেশ পরিচিতি
হয়েছে কবি গায়ক হিসেবে, কবি দিলবাহারের বেশ নামডাক
সিলেটে । তখন তো দেশভাগের হিড়িক, কে কাকে মেরেছে কোনও খবর রাখে না
কেউ । তার উপর প্রলয়ঙ্করী বন্যায় ভেসে গেছে লুলার দেহ । বৈতল এতদিন অনুপস্থিতির
একটা কারণ প্রচার করে দিতে পারবে । দেশে ফিরে গেলেই বৈতল সব পারে । ফিরে পাবে
হাওরের জল, জলের পারে মনসা মন্দির, অদূরে মালিরভিটার কালিমন্দির । আর পাবে তার
মায়ের কুঁড়েঘরটি । কী জানি ঘরটা এখনও অক্ষত আছে তো, মায়ের ভাঙা টিনের বাক্সটি । বাক্সের ভিতর রাখার মতো কিছুই
নেই বৈতলজননীর । পাট করে রাখা দুটি কাপড় আর একটি প্রাণের ঢঙ, এক আয়না । মা সকাল সন্ধ্যা নিজের মুখ দেখে, শিশু বৈতলও লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে, নিজের মুখ যে অবিকল দেখা যায় আয়নায় । বৈতল
নিজের মুখকে ভেংচি কাটে, কখনও জিভ দিয়ে কেড়ে নেয়, বৈতল দেয় না, মাটিতে পড়ে ভাঙে আয়না । মা ভাঙা টুকরোটিই উঠিয়ে রাখে টিনের
বাক্সে । লালপেড়ে শাড়িটার পাড়ে হাঁস আঁকা শঙ্খ আঁকা, বছরে একদিন মা কাপড়টা পরে যায় হাওরের পারে বিষহরির মন্দিরে
। পরাণ ওঝার মনসামঙ্গল শোনে মা । এবার থেকে বইয়াখাউরিতে মনসাপুঁথি গাওয়ার একমাত্র
ওঝাই হবে বৈতল । দেশে ফিরে গেলে সে পাবে আলাদা সম্মান, হাওরের জলে তার মতো ক্ষিপ্রগতি মাছুয়াকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে
যাবে । জমিদারের পদ্মদিঘীর জলে বাউস মাছের বুড়বুড়ি দেখতে বৈতল ভাবে এখনও কি ওদেশে
আইর পুঁথি পড়া হয়, গুরমির নাচ হয়, ঢলানি হয় জিয়ানি হয় । ওর নিজের দেশ কতখানি
নিজের আছে । উদ্বাস্তু হয়ে ফিরে-আসা মানুষেরা শুধু শত্রুতার কথা
বলে । বলে মন্দির ফন্দির কিছু নেই এখন ওদেশে সব মসজিদ । আল্লা হো আকবর । হিন্দুদের
সব সম্পত্তি দখল করতে হবে । ওদের দুঃখ এদেশে তো হিন্দুর, এখান থেকে কেন ওদের তাড়ানো হবে না । শুরুতে বৈতলেরও মাথা
ঘুরে যায়, বিভ্রান্ত হয় । যমুনা প্রসাদ সিং কংগ্রেসি নেতা
হয়েও উল্টোপাল্টা কথা বলে । ইটখোলা মাঠে খাকি হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি গায়ে কসরৎকারী
বিহারি মানুষদের সঙ্গে যমুনাপ্রসাদকেও যেতে দেখে বৈতল । ভোরের বেলা খালি পায়ে
বেরিয়ে পড়ে জমিদার । বৈতলকে দেখে উৎসাহ ডাকে । বলে,
--- চলো, যাইতায় নি ।
--- কই যাইরা ।
--- মাঠো । ইটখোলা মাঠো একটু ব্যায়াম করিয়া আই ।
--- ইখানো তো বিহারি হকলে লেফরাইট করইন ।
--- বিহারি নায় রেবা তারা হইলা রাষ্ট্রীয়
স্বয়ংসেবক সংঘ । ইখানো খালি বিহারি নি সবেউ যাইন । আর হি কথা কইলে আমিও তো বিহারি
।
--- হাচানি ।
--- আমরা অখন বাঙালি অউ । কুনদিন বুলে ঠাকুরদাদার
ঠাকুরদাদা আইছলা আরা জিলা থাকি । বাদ দেও বা বিহারি বাঙালি, মুসলমান হকলে দেখলায় নি কিলাখান মারিয়া খেদাইলা হিন্দু
হকলরে । ইখানোও দেখরায় নি কি রওয়াব । বাঘর বাচ্চা অইলা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ।
তাইন কইছইন হিন্দুর দেশো হিন্দুর কথাউ হুনন লাগব ।
--- তে তারা যাইত কই ।
--- তারা থাকব । হিন্দুর মাথাত উঠিয়া নাচত নি এর
লাগি । নতুন দল বানাইছইন তাইন ।
--- কিতা নাম ।
--- জনসংঘ ।
--- আপনে তো কংগ্রেস ।
--- কতদিন কংগ্রেস থাকমু বুজিয়ার না । হিন্দুর
দেশো হিন্দু অউ না থাকলে কিয়র কংগ্রেস ।
যমুনাপ্রসাদের কথা মন্দ লাগেনি বৈতলের । যদিও
বইয়াখাউরি বা সিলেট জেলার কোনও তিক্ত অভিজ্ঞতা নেই তার । তবু তো সবাই বলে ‘বাঙাল মনুষ্য নহে অন্য এক জিব’ । বাঙাল মানে মুসলমান । লোকেল বোর্ডের ভোটের
আগে আবার অন্য এক রূপ দেখে যম জমিদারের । জমিদার বাড়ির বৈঠকখানায় শহরের গণ্যমান্য
কংগ্রেস নেতাদের নিয়ে সভা হয় । সভার শেষে যমুনাপ্রসাদ বৈতলকে বলে,
--- চলো, যাইতায় নি ।
--- আবার কই যাইতা । আপনার লগে তো ভোলা যায় ।
--- তুমিও যাইবায় । কুম্ভা বাগানো যাইতাম । অখন
আমার সব চা বাগান দেখন লাগব । কংগ্রেসর দায়িত্ব ।
--- আপনে নু জনসংঘ ।
--- চুপচুপ, ইতা মাতিও না । কংগ্রেস অইল মহাত্মা গান্ধীর দল, জহরলালর দল, সর্দার পেটেলর দল ।
--- মৌলানাও একজন আছইন ।
--- আছইন তো, সবে মিলিমিশি থাকা হিকাইছে কংগ্রেসে । অউ যে আমরার ময়নূল হক
চধরি তাইন অতো আছলা লিগ । অখন তাইন কংগ্রেসি, মাইনষর চাকরি করলে ধর্ম দেখন লাগে না রেবা । কংগ্রেস অইল
ধর্মনিরপেক্ষ দল ।
বৈতল বোঝে টোপ গিলেছে সিং জমিদার । ক্ষমতা
পেয়েছে হাতে । এখন তাই সে ধর্মনিরপেক্ষ । পঞ্চখন্ডতেও অনেক কম্যুনিস্ট নেতাদের
দেখেছে বৈতল, তারিক ভাই সামসুল ভাই এর মতো
কট্টর কম্যুনিস্ট নেতারা কি সব এখন মুসলিম লিগ করছে । বিয়ানিবাজারের রইদপুয়ানি গ্রামের
পুকুরপারে চায়নার সঙ্গে কথায় কথায় স্বপ্নের স্বদেশ গড়েছে বৈতল । নেতাজির দাদা
শরৎবাবুকে রাষ্ট্রপতি শাহিদ সুরাবর্দিকে প্রধানমন্ত্রী করে নবীন দেশ গড়েছে । গুরু
সৃষ্টিধরের কাছে যা শুনেছে সব তার ফিঙ্গে পাখিকে বলেছে । গুরুকেও বলেছে,
--- আর আপনে, অনন্ত সাধু মন্ত্রী অইতা নায় নি ।
--- মন্ত্রী এমনে হওয়া যায় না রেবা ।
শিক্ষাদীক্ষা লাগে, আমার কিচ্ছু নাই রেবা । অনন্ত
বাবু পারলা নে, তাইন ত আবার কম্যুনিস্ট । তানে
নিত নায় । নিলেও তাইন যাইতা নায় ।
--- যাইতা নায় কেনে ।
--- কম্যুনিস্ট জন্ম মন্ত্রী হওয়ার লাগি নায় রেবা
। গরিবর হক দেওয়ানি তারার কাম ।
বৈতল গুরুর বাক্য সত্যবচন ধরে নেয়, তবু সংশয় যায় না । গরিবর ত্রাতা যদি
কম্যুনিস্ট হয় তবে যমুনাপ্রসাদ কী, সেও তো এখন চা শ্রমিকের নেতা ।
এই দেশে কত নতুন নতুন নেতা আছেন, তারাপুরের সতীদেব সেন্ট্রাল
রোডএর জ্যোৎস্না চন্দ সোনাবাড়িঘাটের ময়নূল হক চৌধুরি, চামড়াগুদামের হুরমত আলি লস্কর, বড়খলার যতীন্দ্রমোহন দেব লস্কর । আসাম থেকে এসেছেন শ্রমিক
নেতা মহীতোষ পুরকায়স্থ । আর কম্যুনিস্টদের মধ্যে আছেন অচিন্ত্য ভট্টাচার্য, বীরেশ মিশ্র, গোপেন রায় । তারাপদ ভট্টাচার্যকে কেন যে পার্টি থেকে
বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় কে জানে । রাজনীতির মাথামুন্ডু কিছুই জানে না বৈতল, শুধু গুরুর শিখিয়ে দেওয়া মন্ত্রে সব জেনে নেয়
। অলস বিকেলে জমিদার বাড়ির পদ্মাদিঘীর জলে বাউস মাছের ঘাই দেখে দেখে ভাবে এবার
একবার যাবে পার্টি অফিসে, বলবে গিয়ে সে গুরু সৃষ্টিধরের
শিষ্য । জলের আলোড়ন থেমে যাওয়ায় বৈতলের মনও আবার ফেরে বাস্তবে । মেয়ের ঘুম
ভেঙ্গেছে এবার, ইতিউতি চাইছে অবাক চোখে তার
সোনামনি । মাকে খুঁজেছে মেয়ে, মা তো এখন ফিরবে না, কাকমা হয়ে কোকিলের বাচ্চা মানুষ করছে । বৈতল
মেয়েকে কোলে নেয়, পুকুরপারের ঘর পেরিয়ে মহুয়া
গাছের নিচে যায়, নাটমন্ডপের মাটির বেদিতে বসিয়ে
দেয় সোনাকে, লুঙ্গির খুট থেকে বের করে নাসির
বিড়ির বান, একটা ধরায় । মেয়ে আপনমনে খেলা
করে, বৈতলও অপেক্ষা করে দুর্গাবতীর ।
এক বছরের মেয়ে হামাগুড়ি দিতে শিখেছে, একটু এগোয় আর বৈতল তাগা ধরে টানে
। মেয়ে বিরক্ত হয়, বাপও বিরক্ত হয়ে উঠিয়ে
নাটমন্ডপের মাঝখানে নিয়ে ছেড়ে দেয় । এর মধ্যেই প্রতীক্ষা শেষ হয়, দুর্গাবতীকে দেখা যায় । হালকা সবুজ রঙের, কচি কলাপাতার রঙ কী সবুজ, ওরকম একটা কাঁচের কাপে চা নিয়ে উদয় হয়, দুর্গাবতীর সঙ্গের পিরিচটাও একই কাঁচের ।
দুর্গাবতী চা নিয়ে যায় কাছারিঘরে, বাঁ হাতে ঘোমটা টানে । বৈতল
ইশারায় ডাকে, ফিরেও তাকায় না তার বৌ । কাছারি
ঘরে যে একা জমিদার, দুর্গা ঢোকে । বেরোয় না, অনেকক্ষণ হয়ে যায় । এক কাপ চায়ে এত সময় ।
বৈতল রাগে, কাছারি ঘরের বন্ধ দরজা জানালায়
উঁকি দেয় দেবালয় থেকে ।
মেয়েটার এমন কান্নাও মায়ের কানে পৌঁছয় না ।
বৈতলেরও মাথার ঠিক থাকে না, কাছারি ঘরের বন্ধ দরজায় চোখ
রাখতে রাখতে মেয়ের কথা ভুলে যায় । নাটমন্ডপের মাটির বেদি থেকে দুম করে পড়ে যায়
মহুয়া গাছের শেকড়ে । বৈতল মেয়ে উঠিয়ে গায়ে হাত দেয়, মাথায় হাত দেয়, পায়ে হাত বুলিয়ে দেখে কোথায় চোট লেগেছে । মেয়ে শুধু কাঁদে । বৈতল মেয়েকে কোলে
নিয়ে কাছারি ঘরের বন্ধ দরজা খোলে । কই, কেউ নেই কোথাও । জমিদার নেই । দুর্গাবতীও নেই, চায়ের কাপ প্লেটও নেই । তাহলে বৈতল কি ভুল দেখেছে ।
দুর্গাবতী ভেতর বাড়ির রান্নাঘর থেকে ছুটতে ছুটতে আসে মেয়ের কান্না শুনে । ডালের
ফোঁড়ন মাথায় ওঠে, মেয়েকে নিয়ে মা বাপ দুজন ছোটে
সিবিল হাসপাতাল । কম্পাউন্ডার বলে ফ্যাকচার, হাড়ভাঙা । এইটুকু মেয়ের পায়ে লোহার শলা দিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেয় ডাক্তার ।
ডাক্তার বলে কচি বয়স তো ঠিক হয়ে যাবে, একটু খুত থাকবে, মামুলি । তার মানে কি খুঁড়িয়ে
খুঁড়িয়ে হাঁটবে । ‘ভেউঙ্গরা’ বলবে লোকে ।
ঘোরের ভিতর সময় কাটে যতক্ষণ না মেয়ের কান্না
থামে । কান্না থামতে যে কে সেই, কে বলবে এই মেয়ের পায়ে
ফ্র্যাকচার । আবার সেই খিলখিল হাসি । ডাক্তার ব্যথা কমানোর ইঞ্জেকশন দিয়েছে, বলেছে ব্যথা হলে মুর্তজা কম্পাউন্ডারকে দিয়ে
ার একটা দিয়ে দিতে । বৈতল অপরাধীর দৃষ্টিতে তাকায় দুর্গাবতীর দিকে, তার ভুলেই তো এত বড় খুত । বৈতল ভুলে যায়
দুর্গাবতীর প্রতি তার ক্ষোভ । ক্ষমাপ্রার্থী বৈতলকে দেখতে তখন ডাঙ্গার উপর পড়ে
থাকা কাংলা মাছের মতো, নড়াচড়া নেই । চোখের দৃষ্টি
মাটিতে । দুর্গাবতী একটু হাসিমুখ দেখিয়ে দিলেই ডানা দুলিয়ে নাচতে থাকবে জলে । বৈতল
গোবেচারা ভাবে কিছু বলতে চায় দুর্গাবতীতে । বলা হয় না, কারণ তখনই দুখুর রিক্সার বেল বাজে কিরিং কিরিং, পক্ষীরাজ নিয়ে যায় নি বৈতল হাসপাতাল, স্ট্যান্ড এ এসে দুখু খবর শুনেই ছুটিয়েছে
বছইর রিক্সা । অবাক বৈতল দুখুকে বলে,
--- এ তুই, মামু কই ।
--- মামুরে মকবুলর রিক্সাত উঠাই দিছি । বছই আছে
লগে । হেও আইত আছিল মামুরে দেখত কে । মোকামো পৌঁছাই দিব । তুই ডরাইছ না, তাই ভালা অই যাইব ।
দুখুর রিক্সায় চড়ে ওরা বাড়ি ফেরে । মেয়ে
ঘুমিয়ে পড়তেই দুই বন্ধু বেরিয়ে পড়ে । এবার প্যাডেলে বৈতল । বেলা দুই প্রহরে
হুড়মুড়িয়ে রিক্সা নামায় ঘোড়দৌড়ের মাঠে । মিলিটারি গাড়ির মতো বরই গাছের নিচে এসে
থামে রিক্সা । কোমরের প্যাঁচ খুলে বৈতল বের করে বস্তুনি । দুখু বৈতলের কাঁধে মারে
এক ঘুঁষি । বলে,
--- দে বেটা, তুইন পারতে নায় আমি বানাই দিয়ার হালার হালা ।
নেশা না করেই দুখু নেশাগ্রস্ত হয় বারবার ।
বেঁটে লোকটাকে দেখে বৈতলের আজ বড় গর্ব । বৈতল এই দেশ ছেড়ে যাওয়ার সব পরিকল্পনা
বাতিল করে । কিন্তু দুখু তো দুখুই, সুখে দুঃখে সব সময় সঙ্গে থাকবে
আর বৈতলকে জ্বালিয়ে মারবে তির্যক কথায় । বলে,
--- তোর তো জমিদারর লগে বাইচ্চা অইল ।
--- আমার বাইচ্চা । হালার হালা ।
--- অউ আরি, ভাবির ।
--- তেউ ।
--- তারও ঠেং ভাঙছে নি, খবর লইচছ নি ।
--- তার কেনে ঠেং ভাঙত ।
--- না, একদিনো তো জন্ম । কুষ্টিউষ্টি উঠাইচছনি ।
--- কুষ্টি ঠিকুজি ইতা আমরার বাইচ্চার নি । তে
হুনছি যমে বানাইছে তার পুয়ার লাগি, মস্ত বড় এখ চুঙার লাখান কুষ্টি, খুললে আর বন্দ অয় না ।
--- বালাউ অইছে । সব একতাউ হইব । একসময় জন্মাইলে
কুনু আলেদা নি ।
--- অয় অয় আচার্যি এ কইছে এক বছরে ক্ষতি আর নয়
মাসে প্রাপ্তি । প্রাপ্তি জানছনি । লাভ । পাওয়া ।
--- কিতা পাইলে নয় মাসো ।
--- ব্যাঙ, আর কিতা ।
--- ব্যাঙ কিতাবে ।
--- আমি তো ভাবিয়ার, আইজ পাওয়ার দিন । ভালা কিচ্ছু পাইব । তাইর হিদিন মুখো পসাদ, শ্যামসুন্দর থাকি ভোগ আনিয়া খাওয়াইয়ার, আক্তা থালো এক ঘাড়ু বেঙ ।
--- তেউ আর কিতা । তাইর তো খাওয়া অই গেল, আমরার খাওয়া অইল না ।
--- বুঝলাম । তে কিতা পাইলে ।
--- কইলাম নানি, ঘাড়ু বেঙ ।
--- আর হিগুয়ে । যমর পুয়া ।
--- হিগুর নানা মরল পাইল সম্পত্তি । অউত্ত অইল
গরিবর কিচ্ছা, পাইতে বেঙ যাইতে ঠেঙ ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন