“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ২ অক্টোবর, ২০১৬

সুরমা গাঙর পানিঃ উজান পর্ব ২৩

(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই  উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার  উজান  পর্বের  অধ্যায়  তেইশ  ---সুব্রতা মজুমদার।) 


তেইশ
                              
   জমিদার যমুনা প্রসাদ বৈতলের মধ্যে এক বিশ্বাসী মানুষ খুঁজে পায় । বৈতল রাগ পুষে রাখে, ফর্সা গায়ের বর্ণের ভূস্বামী কালো বৈতলকে অপমান করে, বলে পুকুরের মাছের ওজন তার থেকে বেশি । তাইতো বৈতল কেউটে ছাড়ে পুকুরপারে আর তার কম ওজনের শরীর দিয়ে রক্ষা করে । হাতের আংটি খুলে নেয় । তারপর লুকোচুরি শুরু হয়, বৈতল যম সিং-এর নাড়ি নক্ষত্রের খোঁজ নেয় । জমিদারও প্রাণপণ বৈতলকে চায়, কেন চায় জানতে সময় নেয় । সে কি তাকে দেহরক্ষী করে রাখতে চায় । নাকি অন্য কোনও প্রয়োজন, ভোলা তো আছে সর্বক্ষণের সঙ্গী । নাকি কৃতজ্ঞতার ঋণ শোধ করতে চায় বাড়িরাখাল রেখে । বৈতল তো আর কালো কেউটে নেয় যে বাড়ি রক্ষা করে । একবার ফেরায় বৈতল দুবার ফেরায়, তিনবারের বার দুর্গাবতীকে লোভ দেখায় । বলে,
--- চল যাই গিয়া । আলেদা ঘর দিব পুকইর পারো । দেখিয়া আইছি মস্ত বড় ঘর, দুয়ার পাকঘর উঠান পায়খানা একটু দূর । আমরার কী অসুবিধা কও, আমরা তো নদীয়ে হাওরে হাগরা মানুষ । চলো ।
দুর্গাবতীর মন সায় দেয় না । বলে,
--- ই মানুষ ইগু আর তার দলবল ভালা নায় । কিলাখান চায় বেটায় । মনো হয় গিলি লাইব অখন অউ । বুকে পিঠে নজর খালি । আমি ইতা মানুষ বউত দেখছি মালিরভিটাত বইয়াখাউরিত । যাইও না ।
--- কেনে যাইতাম না । বেটারে উজন শিখাইতাম ।
--- কিওর উজন ।
--- কয়...
--- কিতা কয় ।
--- না কিচ্ছু নায় । হুনো গাড়ি চড়িয়া যাইবায়, পছন্দ না অইলে হউ গাড়িত অউ আইবায় আবার চাটাইর বাড়িত । হরি শুক্লবৈদ্যর জমিদারিত আবার । ইগুও জমিদার হিগুও জমিদার । এরে গো বুঝলায় নি, যাওয়া গিয়াউ কাম, সাব্যস্তর কাম । না করিও না ।
--- কেনে আকতা সাব্যস্তর কাম দেখলায় । জমিদারনিরে দেখিলাইছ নানি । জিবরাত পানি আইছে ।
--- এ তুমি দেখি ভেল্কিও জান । কেমনে বুঝলায় ঠাউকরাইনরে দেখছি ।
--- আমার থাকি সুন্দরী নানি ।
--- পরমা সুন্দরী, আর গার রং । এক্কেবারে টিকির ছালি ।
--- মিছা মাতরায় ।
--- হাচাউ কইয়ার । জমিদার ইগু যত সুন্দর দেখাত, বউ এইন কালা । বেটার বুদ্ধি আছে, বাড়ির বউরে যেনে কেউ নজর দিতো পারে না এর লাগি কালা বউ বিয়া করছে ।
--- পুয়া পুড়ি কয়টা ।
--- নাই, অইব নানি ।
--- , অউ কথাউ কইছলায় হিদিন, তুমার পুড়ি লাগে । আমারে নি ধাই রাখত বড়লোকর বাড়িত ।
--- তোরে কেনে ধাই রাখত গো মাই, সূর্যমুখী মিডওয়াইফ আছইন নানি নারীশিক্ষাশ্রমর ।
--- আর আলদ ইগু কই, ঢুকাই রাখছ নি জমিদারর বাড়িত ।
--- রাখছি রাখছি । বৈতলর দংশানির লাগি সাপ লাগে না, বুদ্ধি দিয়া তারে এমনে পেচাইমু যে চামড়া উমড়া সব নীল অই যাইব ।
--- বুঝছি, আমার থাকি সুন্দরী কেউরে তোমার মনো ধরছে, এর লাগিয়াউ অততা কররায় । কে কও ।
--- কেউ নায় কেউ নায় । তুমি অউ আমার আনারকলি । তুমার লাগি..., তুমার লাগিউ সব বেটি ।
--- আমি আনারকলি অইলে তুমি কিতা ।
--- আমি তো শালা শরাবি । দেবানন্দ । তুমারে ই ছাপটা ঘরো আমি রাখতাম নায় ।
--- রাজবাড়িত রাখবায়, নানি । আমার কিতা বদলাইব কও, যে বান্দি হউ বান্দিউ থাকমু । লেপাপুছার কাম করন লাগব । কৈবর্ত মাইমলর বৌরে কুনু আর বাড়িত ঢুকতে দিব নি ।
--- তার বাপে দিব । হালার হালার নু জান বাচাইছি । হে আমারে নিয়া টিটকারি করছে, একবার ঢুকি লাই দেখবায় নে ।
--- কিতা করবায় ।
--- অউ দেওয়া জান লইয়া বার অইমু । বৈতল উঝারে চিনে না ।
--- আবার উঝা অইলায় কেমনে ।
--- তুমি অউও কইলায় আমি শর্মা । শর্মাউ উঝা, আমি আইর গান জানি । একবার শ্রাবণীত যদি গাইতাম পারি, নাচতাম পারি । দেখাই দিমু ঢলানি কারে কয়, জিয়ানিও দিমু । বেটারে একটু একটু করি ডর দেখাইমু ।
      দুর্গাবতী রাজি হয়, খুশি হয় । প্রাণ বাঁচাতে মিথ্যার আশ্রয় নিতে বৈতলকে প্ররোচিত করে । মিথ্যার আশ্রয় নেয়, নইলে ব্রাহ্মণকন্যা এত বড় অধর্মের কাজ করে না । এছাড়া উপায়ও বা কী । যে মানুষটা তাকে সব বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করেছে, আগলে আগলে রেখেছে তার মনে সে দুঃখ দিতে পারে না । বৈতল কখনও লোভ করে নি । মনের কথা মুখে আনেনি । বরং গৌরাঙ্গী দুর্গাবতীই তাকে পাঁকে জড়িয়েছে । বিয়ে শাদি না করেও স্বামী স্ত্রীর পরিচয়ে নতুন জীবন কাটাচ্ছে । বৈতল কিন্তু এতসব ভাবে না, বৈতলের কষ্ট দুর্গাবতীকে নিয়ে, দুর্গাবতীর সুখ নিয়ে । বৈতল তাই দুর্গাকে বলে,
--- কামটা কুনু ঠিক অইল নি ।
--- কিওর  কাম ।
--- এত্তাকি কই কিতা, চল যাই কামাইখ্যাতহিনো গেলেউ বিয়া অই যায় ।
--- যাইবায় নি । কিতা করতায় কও পাপ বাড়াইয়া । শর্মা উর্মা হওন লাগত নায় । তুমি যেতা কইবায় অইব । আমি নায় কৈবর্তবাড়ির বৌ হইয়া থাকমু । অখন জান বাঁচানির লাগি যেতা করন লাগে কর ।
--- তে তুমি রাজি ।
--- অয় রাজি । তে কামাখ্যাত নায় ।
   দুর্গাবতীর রাজি না হয়ে উপায় নেই । অগ্রদানী ব্রাহ্মণের কন্যা সুখ দেখেনি যৌবনে । গাঁজাখোর শ্মশানচরা ছেলের দল লোভ দেখিয়েছে বিস্তর । দুর্গার শরীরকে যে যেমন পারে মন্দ করেছেরূপের সঙ্গে যৌবন কাঁটার ঘায়ে জর্জরিত হয়েছে, ফিটের রোগ ধরেছে ।

   বৈতলের চতুরালির আস্তানায় দুর্গাবতী দিনে দিনে ধাতস্থ হয় । চাটাইর বেড়া দিয়ে ঘেরা আস্তানা থেকে এত বড় বাড়ি পুকুরপারে । দুর্গাবতী জমিদার বাড়িত লেপাপুছার কাজ নেয় যেচে । উঠোন লেপে দুর্গা উঠোনের মাঝখানে মস্তবড় মহুয়া গাছের গুঁড়ি লেপে । ফেটে পড়া যৌবনের বিভঙ্গে গৃহদেবতার দেউল লেপতে মাটির সিঁড়ি বেয়ে ওঠে, শরীরে সয় না এত পরিশ্রম, আলুথালু হয়ে যায় । জমিদার যম সিং-এর চোরা চোখ একদিকে আর যুবা সূর্যের তির্যক কিরণ অন্যদিকে । এফোঁড় ওফোঁড় আলোর তেজে দেবীপ্রতিমার সামনেই মাথা ঘুরে পড়ে যায় । 






চলবে 
  < উজান পর্ব ২২ পড়ুন                                                               উজান পর্ব ২৪ পড়ুন > 

কোন মন্তব্য নেই: