“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ৯ অক্টোবর, ২০১৬

সুরমা গাঙর পানিঃ উজান পর্ব ৩৮

(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই  উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার  উজান  পর্বের  অধ্যায়  আটত্রিশ   ---সুব্রতা 
মজুমদার।)   

আটত্রিশ

   বৈতল রাজনীতির কারবারি নয় কোনোদিন । বৈতল শুধু মেনে নিতে পারেনি কারো উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে শুধু গরিব মানুষের রক্ত জমাট বাঁধবে কেন বারবার নদীর জলে । আগুনে পুড়ে খাক হবে গরিবের অবলম্বন । রাজনীতি না করলেও আরো বেশি নিষ্ঠুর হতে পারে বৈতল । বইয়াখাউরির জলের জন্তু বৈতলকে নিয়ে খেললে বৈতল হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর । বৈতল ধর্মের কিংবা রাজনীতির হিসেবনিকেশ জানে না । বৈতল তার গুরু সৃষ্টিধরের শিষ্য । তাই বৈতল সব পারে, মানুষের ভালর জন্য নির্মম হতে পারে বৈতল । তাই তো বৈতলের অনুশোচনা হয়েছে কুতুবের মতো নির্মল মনের কিশোরের বদলে যাওয়ায় তার পক্ষীরাজ পুড়িয়ে ফেলার জন্য বৈতলের ক্রোধ হয়েছে, আর ক্রোধ হলে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না তার । আসল কথা জানার পর অনুশোচনা হয়েছে বৈতলের । শান্তির এলাকা হরিৎবরণ ইটখোলা মালুগ্রাম ঘনিয়ালার হঠাৎ উত্তপ্ত হওয়ার কোনও কারণই নেই । পরিশ্রমী খেটে-খাওয়া মানুষ হঠাৎ কেন খেপে যাবে । আগুনে ঘি না পড়লে প্রজ্বলন্ত যজ্ঞাগ্নির কেরামতি যে যায় না হোমকারী ব্রাহ্মণের । যম জমিদারের হাতের নীরব ছোঁয়ায় মশাল জ্বলছে সারিসারি । হিন্দু মহাসভা থেকে জনসংঘের পথ না ধরে ধর্মনিরপেক্ষ জননেতা হওয়ার মরিয়া প্রচেষ্টা শুরু হতেই সন্দেহ হয় বৈতলের । যম সিং-এর রাজবাড়িতে শর্মা ব্রাহ্মণ বলেই থাকতে পেরেছে বৈতল, পাটনি কৈবর্ত ওঝা পদবির বিতর্ক শুনলেও দুর্গাবতীকে বিশ্বাস করেছে । অন্ত্যজ এবং বিধর্মীর প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে দিতে হয়েছে শেষপর্যন্ত রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় । জমিদার এখন মধুরবন্দ বেরেঙ্গা ঘনিয়ালা সদরঘাটে মিটিং করে ঘনঘন । ময়নূল হল চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে ঘন ঘন উঠাবসা । বৈতল এসব দেখে হাসে আর জমিদার তাওয়ার উপর রুটির মতো ফোলে । প্রাণ বাঁচানোর কৃতজ্ঞতায় রং কখনই ফিকে হয়ে গেছে যমুনাপ্রসাদের । বৈতলের উপর বিরক্তি বাড়ছে জমিদারের দিনদিন । দাঙ্গার রাতে নদীর আর বৃষ্টির জলেলুলানোবৈতল এখন শুধু সূর্য ওঠার প্রতীক্ষা করে । তার এখন চাই তেজ । বৈতলের চোয়াল এখন দৃঢ় । বৈতল এখন প্রস্তুত । কুতুবের সঙ্গে যা হয়েছে হয়েছে, দুখুকেও মাফ করে দিয়েছে বৈতল , অন্নপূর্ণাঘাটে ভোরের বেলা ভেসে ওঠার পর বৈতল ঠিক করে নিয়েছে তার ইতিকর্তব্য । গরিবের যাওয়ার কিছু নেই তার তেনাছাড়া, গরিব মানুষ কখনও চক্রান্ত করে মানুষ মারে না, সে সবই একতরফা মালিকানা বড়লোকের । অল্পবুদ্ধি মানুষকে তারা প্রলোভিত করে, জলকে কাত দেখায়, তখনই কাত হওয়া চোখে সন্দেহে নীল চোখ অনর্থ ঘটিয়ে দেয় । প্রিয় বন্ধুর আস্তিনকে বড় ভয় তার, কী জানি কখন রামপুরি না রহিমপুরি ছুরি বের করে । এক রাত নদীর জলে বাঁশের চালিতে লুকিয়ে থেকে অনেক কথা শিখেছে বৈতল । লুসাই পাহাড়ের বাঁশের চালি দুলে দুলে এগিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যের দিকে, আর গন্তব্যহীন বৈতলও কোথাও যেন যাচ্ছে, কোনও দেবপুর কিংবা কোনও অসুরপুরে, কোনও এক নিধনের প্রতিজ্ঞায় । চালি চলে রাতের অন্ধকারে, যেমন চলে গাঙুড় নদীতে বেহুলার ভেলা । গোধার ঘাটের বর্ণনা গান বৈতল গায় মুখবিকৃতি আর হাস্যরস মিলিয়ে । বাঁধের উপর লুক্কাওয়ালাদের কার্যকলাপ দেখে রামনামী বিশজন গোধার নাম মনে পড়ে বৈতলের,
ভাউলকা গোধার নাতিন জামাই নাম তার নিজাম আর,
ফেক্‌ড়া গোধার নাতিন জামাই মেড়ু গোধার নাতি
ফেক্‌ড়া গোধার সমন্ধিকের নাতির ঘরের পন্তি
তার নাম খেট্‌কা গোধা সর্বকনিষ্ঠ ।
    একদার দেবকিশোর কুতুবকে দেখে বৈতলের খেট্‌কা গোধার নাম মনে পড়ে । বৈতল জলের অতলে ডুব দেয় গোধার পালের কার্যকলাপ থেকে চোখ ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য । জলের জন্তুর সঙ্গে সখ্য চেয়ে হাত বাড়ায় ডুবসাঁতারে । রাত গভীর হতেই, আগুন নিভে যেতেই, গোধার ঘাট ছাড়তেই ধোপানীর মৎস্য বরাকনদী ভরে ওঠে,
লাচো খরিস ভাসে বড় বড় পুটা ।
ভাসিল ঘাঘট মৎস্য পৃষ্টে উবা কাটা ।।
চিতল কাতল মৎস্য ভাসে শত শত ।
শউল ও গজার ভাসে মূঢ়া পর্বত ।।
গুতুম চান্দখিরা মৎস্য ভাসিল প্রচুর ।
কাকি মৎস্য ভাসে যেন তাল ও খাজুর ।।
নানিন্দ পিপলা ভাসে আর ভাসে টেংরা ।
     এত এত মাছ দেখেও মনসামঙ্গল গায়ক বৈতল তোলপাড় তোলে না জলে । মাছের সখ্যে রাত কাটিয়ে দেয় ভুরায় । এক সময় ভুরভুর করে সব নদীর মাছও যায় তলে । ভোর হয় অন্নপূর্ণাঘাটে ।
     অনেক কারণে তখন শহরে বৈতলের বিস্তর পরিচিতি । হরিৎবরণ জমিদারবাড়ির পোষ্য বলে চেনে অনেকে । চেনে জালাল পিরের বাহন হিসেবে । মামুকে শহর পরিক্রমায় নিয়ে যায় বৈতল তার রিক্সা পক্ষীরাজে । চেনে নাগাপট্টির মাতাল বাহক রাতের রিক্সাওয়ালা হিসেবে । চেনে গুরমি নাচের ওঝা বলে । তাই চেনা মানুষটার অচৈতন্য দেহ গরুর গাড়িতে তুলে নিয়ে আসে জগরদেও গোয়ালা । জমিদার বাড়ির গাছতলায় শুইয়ে দেয় । সবাই জানে যম জমিদার রায়তের ভগবান । অচৈতন্য ভেবে পৌঁছে দিলেও বৈতল হুঁশ হারায়নি ! ঠিক শুনতে পেয়েছে জমিদারের বিরক্তি । পরিকল্পনা যে রূপায়িত হয় না । বৈতল যে মরে না । দুর্গাবতী বলে সিবিল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা । জমিদার শ্বাস নড়ছে দেখে বলে, না । পুলিশের ভয় পায় কি যমুনাপ্রসাদ । বাড়িতে ডেকে আনা হয় বীরেশ ভট্টাচার্যকে । হোমিওপ্যাথির বিধান রায় শহরে । দুদিনেও বৈতলের ঠাণ্ডা শরীর গরম হয় না দেখে আনা হয় মুর্তজা আলি কম্পাউণ্ডারকে । সবাই বলে ডাক্তার, হাবেভাবেও ষোলআনা, স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে রোগী দেখে । ডাক্তার দেয় গুলি, দাগকাটা ঔষধ শিশিতে । জ্বর কখনও বাড়ে কখনও কমে । কমলেই ভয় পায় দুর্গাবতী, হিমঠাণ্ডা হয়ে যায় শরীর । আবার ঔষধ খায়, কমে বাড়ে, দুর্বলতা যায় না । বৈতল দুর্গাকে কাছছাড়া করে না, মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বসে থাকে । রাতে যায়, আবার ফিরে আসে । জমিদারবাড়িতে দুর্গার অনেক কাজ । সারা রাতের কাজ, অন্নকূট উৎসবের প্রস্তুতি, বাড়ির এয়োতিরা মিলে একশর উপর পদ রান্না করে, আরো হবে সকাল পর্যন্ত । দুর্গাবতী ফিরে এসে বৈতলের মাথায় হাত বুলোয় । বলে,
--- তুমারে দেখাইমু ভালা ডাক্তার । অমূল্য হালদাররে দেখাইমু ।
    মুর্তজা ডাক্তারের ঔষধ খাওয়া ছেড়ে দেয় বৈতল । বৈতলের আক্রান্ত হওয়ার খবর শুনে, কুতুবের মৃত্যুর খবর শুনে বাট্টি আচার্য যামিনী একদিন দেখতে আসে বৈতলকে । পরদিন তার মামা অশ্বিনী কবিরাজকেও নিয়ে আসে দুধপাতিল থেকে । কবিরাজের মকরধ্বজ খেয়েই সুস্থ হয়ে ওঠে বৈতল । কিশোর যামিনী বৈতলের কাছে বন্ধু কুতুবের কথা শোনায় । বলে,
--- তুমি তো গান গাও কাকা ।
--- পুঁথি গাই আর কিতা । পড়ালেখা জানি না । গুরুমারা বিদ্যা । গুরুয়ে যেলাখান শিখাইছইন ।
   কুতুবে কিতা করত জান নি ।
--- কিতা করত আবার কিতা কত্ত রেবা । হে অখন কই ।
--- , ইতা জানো না নি কাকায় । হে তো গেছে গি-বাঁশকান্দি । নানার দেওয়া টেকা পয়সা সব শেষ । আর পড়া অইত নায়তার । নাইলে কিতা আইল না নে নি তুমারে দেখাত । তুমারে দি তার জান ।
--- কেনে রেবা জান ।
--- তুমি যে পুথির গান গাও এর লাগি । হে কইত হেও পুথি লেখব । এর লাগি লুকাই লুকাই বাংলা লেখত ।
--- ভালা অউত্ত ।
--- না কাকা । হে কুরাণর বাংলা লেখত । আমার কাছে রাখত । কইত কেউরে না কওয়ার লাগি । কুরাণর বাংলা করা বুলে গুনা ।
--- হেও গুনা করল ।
--- হুনতায় নি কাকা তার বাংলা ।
--- হুনিয়া আর কিতা করতাম ।
--- হুন না । হে আমারে কইত এক নরকর কথা । আগুনর কুণ্ড বুলে নাম হাবিয়া । কুরাণর অউ টুকরা নিয়া লেখছে ছিলটি বাংলাত । হুন,
আগুনো যেলা উড়ে প্রলয়র পতঙ্গ
পাড়োর উপরে জ্বালাইয়া ধুনি
সুমতির সাবাশ পায় গুনি
ভালা কী আর যায় হাবিয়া বিজন
হাবিয়া কিতা কও চাই সুজন
দুর্জনে যে ঝাঁপ দেয় আগুনর কুণ্ড ।
--- ইতা কিতা লেখছে ।
--- কেনে বুঝলায় নানি । হে আমারে বুঝাই দিছিল, ভালা মাইনষর কুনু ডর নাই, আল্লায় দোয়া করইন । আর শয়তানি করলেউ আগুনর কুণ্ড, হাবিয়া ।
--- হে নু হুনছি খুব ধুনি জালাইছিল নদীর পারো ।
--- ইতা খামোকা মাত । কুতুব ইলাখান নায় ।
    তার মন বড় নরম । আগুন দেখলে যে বেটায় ডরায়, রক্ত দেখলে ফিট অই যায় হে নি বার অইব রায়টর রাইত । ইতা আমিও হুনছি মাইনষে রটাইছে, হে বুলে তুমার রিক্সা জ্বালাইছে । আমরার টোলর ধারউ থাকে কত কুতুব, কিগুয়ে করছে আর নাম দিলাইছে সাধুবেটার ।
--- ঠিকঅউ কইছ, কুতুব কুনু দুনিয়াত এগু নি কত হাজারে বিজারে আছে । আমার লুলারও আছিল এক দোস্ত কুতুব ।
--- তেউ কও ।
--- আইচ্ছা ইতা বাদ দেও । অখন কও বন্ধুরে তোমার লাগে নি ।
--- লাগে । তারে কইছলাম আমি দিমু দশ টেকা । আমার ত অউ পুঞ্জি । ইবার দাশগুপ্ত বাড়ির দুর্গাপূজাত পণ্ডিত মাশয়র লগে আছলাম পাঁচদিন । প্রণামীর থাল থাকি দিছলা দশটেকা । খর্চ করছি না । হে কয় অইত নায় ।
--- কত লাগে রেবা ।
--- পাঁচশ টেকা বছরে । মজিদো খানি খর্চ দেওন লাগে ।
--- ঠিক আছে, আমি দিমু ।
    অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই বৈতল কথা দিয়ে দেয় । বৈতল জানে সিদ্ধান্ত নিতে পারলেই উপায় বেরিয়ে যাবে । যামিনী আচার্যকে আবার অভয় দেয় । বলে,
--- তুমার বন্ধুরে আনি দিমু রেবা, মন খারাপ করিও না । বন্ধু বড় প্রাণর ধন জানি, ছাড়াছাড়ি অইও না ।
--- আনি দিবায় নি কাকাহে কিরতিবাসী রামায়ণ পড়ত চাইছিল, দিতাম পারলাম না ।
--- দিবায় নে তে, সময় কুনু যার গিনি । খামকা কান্দিয়া ভরাইরায় কেনে ।
    বন্ধু বিরহে হাউহাউ করে কাঁদে যামিনী । বৈতল টোলের পড়ুয়া কিশোর পণ্ডিতকে সান্ত্বনা দেয় । বলে,
--- বুঝি রেবা বুঝি । আমারও আছিল এক বন্ধু ।
--- তুমার বন্ধুরে হক্কলেউ চিনে ।
--- কার কথা কইরায় বা । তুমি কেমনে জানলায় ।
--- কেনে দুখু চাচারে সবে চিনে ।
--- ও । ইতা বাদ দেও । আমার বন্ধু আছিল বইয়াখাউরিত, ছাতক পরগণা, সুনামগইঞ্জ মহকুমা জিলা ছিলট অখন পাকিস্তান । হে নাই । আমি কান্দি না । আমার আছিল পক্ষীরাজ নাই । আমার রিক্সা আছিল আমার পুয়া আমি কান্দি না ।





চলবে 

< উজান পর্ব ৩৭ পড়ুন                                                  উজান পর্ব ৩৯ পড়ুন >

কোন মন্তব্য নেই: