(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার উজান পর্বের অধ্যায় চৌত্রিশ ---সুব্রতা
মজুমদার।)
চৌত্রিশ
প্রেমের মাস্টার শফিউল্লা গ্রামে
গ্রামে ‘রূপবান’ এর গান গায় । সফির গান শুনতে মানুষ রাত জাগে
। লালা মনাছড়া কাটলিছড়া, কালাছড়া, কুচিলা, সরসপুর, আলগাপুর ভিচিংচায় শীতের রাতে
শামিয়ানা টাঙিয়ে গান হয় । সিলেটি কবি খলিল শাহর অপরূপ প্রেমকাহিনি চন্দ্রমুখী আর
গুলসুনাহর এর প্রেমকথা । যে রাজকুমারী কখনও হরিণির বেশ ধারণ করে কখনও শাহা সাইক্কা
নামের এক দরবেশের রূপে । ইন্দ্রপুরির অপ্সরার সঙ্গে গুলসুনাহরের বিয়ের রাতেই
আত্মহত্যা করে চন্দ্রমুখি । অপরূপা নববধূর রূপধারণ করে মৃত্যুর মুহূর্তে অন্তরের
অভিমান প্রকাশ করে গানের কথায়,
‘যদি বা থাকিত মনে চন্দ্রমুখি করি
তে কেনে করিত বিয়া ইন্দ্রের আবেশ্বরী
এ বুলিয়া আল্লা নবি করিয়া স্মরণ
কাটারি হির্দেতে হানি ত্যজিল
জীবন ।’
কোনোদিন শফি শুরু করে ‘ভেলুয়া সুন্দরী’র কাহিনি দিয়ে । রূপকথার জাদু
ভরপুর প্রেমকাহিনির মজা বাঁকে বাঁকে । দর্শকের দুঃখ ও আনন্দ যুগপৎ উথলে ওঠে গানে
যখন নায়ক আমির তার মায়ের কাছে ভেলুয়াকে রেখে বিদেশ যাত্রা করে । আমির মাকে ভেলুয়ার
যত্ন নিতে বলে,
‘না দিও গোবর ফেলিতে কন্যার গায়ে
দাগ লাগিবে
না দিও উঠান কুড়াইতে কন্যার পায়ে
ধূল পড়িবে ।
মরিচ বাটিতে না দিও ভেলুর হাত যে
জ্বলিবে
না দিও পানি আনিতে কন্যার গায়ে
ব্যথা হইবে ।’
শফির গান শুনতে গাঁয়ের মানুষ রাত
জাগে । রাজপুত্রের মতো দেখতে শফিউল্লার জন্য মানুষ দূর গ্রাম থেকে দল বেঁধে আসে ।
কেউ কেউ রুপোর মেডেল বেঁধে দেয় বুকে । বড়মা সাজগোজ করা জরির পাজামা পাঞ্জাবি আর
চাপদাড়ির ছেলেকে দেখে বলে,
--- ইরাণর ফকির আমার সফি ।
ছোটমাও বলে,
--- মাইনষে না নজর লাগাই দেয় । কিলা মহব্বতর গান গায় দেখছ নি
বুবু । ইবার বাপর নিকা একখান করানি লাগব ।
দুই মায়ের কথাবার্তা শুনে শফির মুচকি হাসি আরো বড় হয় । বলে,
--- ইতা ভেলুয়া আর চন্দ্রমুখি কও রূপবানর ধারোকাছো নাই । এক ‘ধাইমা’ টান দিলে জানো নি আঠারো গাউর মাই
হকলর পরাণ কাপে ।
--- তুমি কেমনে জানলায় বাপজান । মাই হকল না ছুকরি হকল । ইবার আর
আমরা ছাড়িয়ার না । ইবার তুমার বিয়া ।
দুইমাকে আশ্বস্ত করে শফিউল্লা শোনায় গান,
‘আমার বাড়ির পশ্চিম ধারে
ও ধাইমা কিসের বাজন বাজে গো আমার ধাইমা
বারো দিনের শিশুর সঙ্গে
ও রূপবান তুমার হবে বিয়া গো ।’
বড় বৌ ছোট বৌর সঙ্গে সফির সব মনের
কথা । কিন্তু ওদের কেউই তার আপন মা নয় । আপন মাকে মনে নেই, কিন্তু দুই ধাত্রী মাকে নিয়েই
তার সংসার । সফির মা মারা যাওয়ার পর দুটো বিয়ে করে সাজিদ মিয়া ঠিকাদার । সফি
দুজনকেই মা ডাকে, দুজনই বোঝে কাকে ডাকছে । এমনই বার্তা এমনই সংকেত এক শব্দের
। সেই ছেলে রাত জেগে ক্লান্ত হয়ে দুই মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়ে, বেশি স্নেহ কম স্নেহ নিয়ে কেউ
ভাবে না । শীতকালেই কবিগানের ধুম, তখন আর নাওয়া খাওয়ার সময় নেই । এ গ্রাম থেকে
ও গ্রাম, তবে সফিউল্লার নাম হওয়ার পর গ্রামে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছে, ছোট ছোট শহরেই শামিয়ানা পড়ে, থানার মাঠে মানুষ আসে শফি কবিকে
দেখতে । গ্রামের মানুষের কাছে শফির গান শুনতে যাওয়া উৎসবের মতো, যেন ইদের খুশি । রাত জাগা আর
অনিয়মের শফির টাইফয়েড হয় একবার । সাজিদ মিয়া বলে শিলচর নিয়ে যাবে সিবিল হাসপাতালে
। সাজিদ মিয়া দুই মার চোখে কী দেখে কে জানে, মায়ের চোখের জলে পাথরও গলে যায়, শিলচর থেকে টেক্সি গাড়ি করে সুর
ডাক্তারকে নিয়ে আসে । ডাক্তার ঔষধ দেন, দুই মা হেঁটে হেঁটে হাইলাকান্দি
গিয়ে চিরাগ ফকিরের জলপড়া নিয়ে আসে । ফকিরের কেরামতি আর ডাক্তারের ঔষধে সুস্থ হয়ে
ওঠে শফি । সাজিদ মিয়া বলে,
--- ডাক্তারে কিতা করত, দরবে কিতা করত, ফকিরর কী কাম । ই দুই বেটি না
থাকলে আমার পুয়া বাচল না নে ।
দুই মা সুযোগ বুঝে আর্জি জানায়
ঠিকাদারকে । বলে,
--- অখন পুয়ার মা থাকি বৌ দরকার । আমরার তনাইএও আর দেয় না ।
আপনারও কিতা নাতি নাতনর মুখ দেখার হাউস অয় নানি ।
--- তানে জিগাও, আমার কিতা, আইজ কইলে আইজ অউ লাগাই দিমু ।
জন্মদাতা পিতা ও দুই ধাত্রী মায়ের
কথোপকথন শুনে শফি মা দুজনকে শোনায় এক বহুপ্রচলিত মরুকাহিনি । বলে,
--- বিয়া যে দিতায় জান নি এক কিচ্ছা ।
--- কিচ্ছা ত অখন নায়, কিচ্ছা শুরু অইব বিয়ার পরে ।
হুনি না আমরা ইতা মাত ।
দুই মা বিবাহে অনিচ্ছুক পুত্রের
কোনও কথা শুনতে চায় না । আর শফিউল্লাও শোনাবে উপকথার রূপক । বলে,
--- আরব দেশর এক পুয়ায় কিনছে এক তুরুক দেশর ঘুড়া । ঘুড়াত চড়িয়া বালুর উপরে দি হে
দৌড়ার, দৌড়াইতে দৌড়াইতে দেখে এক পরি, পরি না হুরি । কইল বিয়া করত, তাইও কইল বিয়া করত । কইল একলা
থাকন লাগব । হে কইল আমার মা আছইন । হুরি পরিয়ে কয় মার কইলজা আনিয়া দিতায় পারবায় নি
। হে কয় দিমু । ঘুড়া লইয়া গেল মাটিজুরি মা দুইজনর দুই কইলজা লইয়া হে হাটিয়া যার
হুরির দেশো । আক্তা খাইছে এক উষ্টা ।
--- লাগল নি রে বাপ ।
--- লাগল নি রে বাপ ।
--- এ, আমার কিচ্চাত নু একবার মাতল মার কইলজায় ।
--- তোর কিচ্ছাত ও তো দুই মা । আমরা দুইজন । আর ই গপ তুই তিন
তিরিক্কা চৌদ্দ বার কইচ্ছ আমরারে ।
--- কইছিনি । তো কিতা অইছে আবার হুনলায় । মা অইলে হুনন লাগে ।
এত যে ভাল ছেলে শফিউল্লা । দুই মায়ের
বাধ্য যে, তারও আছে মনোব্যথা । কাউকে বলে না, শফি তার বাপের সঙ্গে কথা বলে না
।
শফির ছোট আতাউল্লা বাপকে শোনায়
চ্যাটাং চ্যাটাং কথা । তার বয়সী যুবক, কিশোরদের সে নেতা । আতার দোস্তির টানে কেউ দূরে
থাকতে পারে না । আটা বাপের পকেট কেটে বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে যায় । বাঘবাহার যায়
সরসপুরের জঙ্গলে যায় । ধোয়ারবন্দ জালেঙ্গা । আর সবুজবরণ পেরিয়ে যায় শিলচর ।
আহমদিয়া রেস্টুরেন্টের মতো মুরগির কোরমা নাকি বড়মা ছোটমা কেউ রাঁধতে পারে না ।
ওরিয়েন্টেল হলে ম্যাটিনি শো সিনেমা দেখে রাতে ফিরলে বাপ পেটায় খুব । আতার খুব ভয়
ডর নেই, মার খায় আবার ঝাড়ে বাপের টাকা । মার খেয়ে বাপের মুখের উপর
বলে,
--- চুরর পয়সা চুরি করছি কিওর লাজ । খোদার জাহান অত ছুট নায়, সব হিসাব দেওন লাগে । তুমি আর
তুমার বড় ঠিকাদারে মিলিয়া যে পুল বানাইবায় মাটিজুরিত, দেখবায় নে, ঝরঝরাইয়া পড়ব ।
--- পড়অউক, তর কিতা তে ।
--- আমার কিচ্ছু নায় । মাইনষে কয়, আমার বাপ ।
--- কইছ না বাপ ।
--- কই না । তেও তো কল্লা সোজা রাখতাম পারি না । আমি আমার তারিফ
লইয়াউ থাকি ।
--- তর আবার কিওর তারিফ । কিওর পরিচয় । নাক টিপলে চেনা বার অইব
আর বড়বড় মাত । ছাইকেল চালাইয়া তারিফ অয় না । ইতা পাচদশ গাউ পরে পরেউ আছইন একজন করি
সাইকেল মাস্টর । দিনরাইত সাইকেল চালানি নতুন খেলা নায় । ছাইকেলো গোছল, ছাইকেলো খাওয়া, ইতা সাতদিনর মেলা দেখাত আইব
মাইনষে, পয়সাও দিব, অউ সাতদিন অউ, আর নায় । মাদরেছা পাশ না করলে
কেউ ফিরিয়াও চাইত নায় ।
--- সাইকেল চালাইয়া আমি পয়সা নেই না । আমার মাদরেছা আমার ছাইকেল, আমার মজিদ আমার সাইকেল । ছাইকেল
অউ আমার পরিচয় । আমার পরিচয় ঠিক করব আমার ছাইকেল । তুমি নায় ।
--- তে আমি কিতা । তর বাপ কে ।
--- জানি না । আমি জানি আমারে আর আমার নানারে । মাঝখানো আন্দাইর
।
পড়াশুনায় মন নেই আতাউল্লার । বাপের
অন্নে প্রতিপালিত হতে লজ্জা নেই । আবার বাপের সঙ্গে বনিবনাও নেই । বাপকে বলে ‘আন্দাইর’ । নানা আর তার মধ্যিখানে বাপ
অন্ধকার । দুই সৎমা আর সৎবোনদের সঙ্গে বিরোধ নেই । তবে শফির মতো এত আদুরে নয়, সব সময় রাগে । আতাউল্লার সব রাগ
বাড়ির ভিতর, বড়ভাই আর ছোট ছোট বোন ছাড়া সবার উপর তার রাগ । বাচ্চা বয়স
থেকে বাপের পয়সায় দান খয়রাত করে, দোস্তি করে । বলে নানার উত্তরাধিকার পোক্ত
করছে । নানা আফজল ডাক্তারের সঙ্গে খুব ভাব আতার । নানারও খ্যাতি আছে ক্রমাগত
সাইকেল চালানোয় । সাইকেল থেকে না নেমে ঔষুধ দেয়, সারাদিন রাত নানা ঘুরে বেড়ায় এম
এন্ড বি গুলি আর ‘শূলশমন’ নিয়ে । বেমারি মানুষরা সবসময় ঔষুধের দামও দেয়
না, নানা নাতিকে বলে,
--- দাম না দেউক । ডাক্তার ত কয় । আমি মরলে তুমারেও আফজল
ডাক্তরর নাতি কইব ।
নানার উত্তরাধিকারে চড়ে আতাউল্লা
ঘুরে বেড়ায় গ্রামে গ্রামে, শহরে শহরে । শফিউল্লার কবিগানের আসরে গিয়ে
উদয় হয় । কুচিলা গিয়ে শিকার করে খরগোস, প্রেইরি হাঁস । সরসপুরে বাঘের
উপদ্রব হচ্ছে খুব । বাপকে বলেছে বন্দুক কিনে দিতে । আতাউল্লা ছোটবেলায়ই পেয়ে গেছে
নানার সাইকেল । নানার এন্তেকাল হতেই সাইকেল হাতিয়ে নেয় আতা । শুরু হয় সাইকেল
মাস্টারি, নানা কেরামতি । বাড়ির সামনে পাকারাস্তার পাশে নয়ানজুলি শীতে
শুকিয়ে যায় । গ্রামের ছেলেদের নিয়ে নালা বড় করে, মস্তবাটির আকার ধারণ করলে থামে ।
নানার হাম্বার সাইকেল নিয়ে নেমে পড়ে গর্তে । ছোট বোনের দল চিৎকার করে উৎসাহ দেয়, উরিবিচি গ্রামের বাচ্চা বুড়োদের
উৎসাহে আতাউল্লা দুরন্ত হয়ে ওঠে । ভয় পাইয়ে দেওয়া বিচিত্র সব কসরৎ দেখায় ।
অগ্রগতির চাকাকে আরো দ্রুত করার সব কায়দা কানুন রপ্ত করে । শফির মতো শামিয়ানা
টাঙিয়ে, রঙিন কাগজের ঝালর লাগিয়ে, হ্যাজাক বাতির আলোয়, শিশির ঝরা ভোরে, ধানকাটা মাঠের দুপুরে, সখি বেড়ালের রোদঘুমের দুপুরে, গোধূলির সন্ধ্যায় সে নাগাড়ে
চালায় তার সাইকেল । নানার মতো নিরুদ্বেগ আনন্দে ঘুরে ঘুরে চালাতে থাকে চাকা, আতাউল্লা চালায় । নাওয়া খাওয়া সব
বসে বসে, নয় পাদানিতে দাঁড়িয়ে থামে না আতার চাকা । চব্বিশ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে
মানুষের উৎসাহ বাড়ে, আটচল্লিশ ঘণ্টায় তুঙ্গে, চানামটর ঘুঘনির দোকান বসে, চা হোয়াইটের স্টলও বসে উজ্জ্বল
হয় অনুরাগীর মুখ, লোকেল বোর্ডের চেয়ারম্যান সাবাসি দিয়ে যায়, শিলং থেকে নেমেই চলে আসে এম এল এ, পঞ্চাশ টাকার পুরষ্কার ঘোষণা
করেন, আরো কত খবর যে রটে তার ইয়ত্তা নাই । ছোটমা বড়মা দুই মায়ের
চোখে মুখে উৎকণ্ঠা, আহা রে মুখটা শুকিয়ে যাচ্ছে । জনতার মনেও আশা
নিরাশার আনন্দ ভয়, এই বুঝি নেমে যাবে, আর পারবে না আতা । আতার শরীরে
ধকলের শ্রান্তি কিন্তু মনের ভিতর নানার মুখ । চারদিন পেরিয়ে যায় ছোটমা বড়মা পালা
করে নায়ক ছেলেকে খাওয়ায়, চলন্ত সাইকেলে জল ঢেলে চান করায় । শফিউল্লাও
ভাইয়ের সঙ্গে দৌড়য় মাটির পাত্র হাতে । বলে,
--- করিলা ভাই, দেখত নায় কেউ ।
এসব হয় রাতে । পায়খানা বন্ধ রাখতে
পারে আতা সাতদিনের সাতদিন । আতা শফিকে বলে,
--- ভাইজান যতখান মজা লাগব ততখান থাকমু, কিতা কও ।
--- অয়রে ভাই, তুইন কছ মজা, কবি হকলে কইন আনন্দ । আনন্দ থাকলে দুনিয়াত কুনু দুঃখ
নাই । হাইলাকান্দির পূর্বায়নো বার অইছে তর কেরামতির কথা । ফটো তুলি নিছলা নীতীশদায়, দিতা পারছইন না, ফটো ছাপার মেশিনে বুলে কাম করের
না । দিবা কইছইন পরে ।
বাপ সাজিদ মিয়াও মেলার মাঠ ঘুরে
বেড়াচ্ছে । দর্শকদের সঙ্গে পরিচিত হচ্চে, বলছে ‘আমার পুয়া’ । ছেলেকে বলেছে,
--- দেখিছ, মাথা ঘুরাই উরাই পড়িছ না । সাতদিন পরেউ লামবে
।
আতাউল্লা বাপকে চলে যেতে বলে,
--- তুমি কেনে আইছ । আফজল ডাক্তারর নাতি এ তার পরিচয় ঠিক করের
অখন । মজা করের, মজা করছ নি কুনুদিন, খালি ঠগঠগামি । আনন্দ কারে কয়
জান নি । যাও গি ইখান থাকি, তুমি থাকলে অখন অউ লামি যাইমু কইলাম ।
--- তে আমার কিতা । তুই লামি যা ।
--- দেখতায় নি কিতা অইব । ঠিকাদারর মান ইজ্জত নু মাটিজুরি পুলর
লাখান ভাঙ্গি যাইব ঝুরঝুরাইয়া । যাও গিয়া আফজল ডাক্তারর নাতিরে ছলাইও না ।
সাজিদ আলি ঠিকাদারের বাড়িতে মানুষে
মানুষে অরণ্য । পিরের পিরাকি দেখতে দূর গ্রামের মানুষ আসে উরিবিচি গ্রামে ।
মানুষের মনে সে কী প্রশান্তি, জালাল পিরকে একটু চোখের দেখা দেখে যেন সব
কষ্টের লাঘব হয় । সবার মুখে এক কথা,
--- অখন ত আর জিন্দাপির দেখা যায় না, সব ধোকাবাজি । তান গা থাকি যেন
লুক্কা বার্, অলা তেজ ।
সবাই মনে মনে প্রার্থনা করে,
--- বিসমিল্লা গুন কর, তানে বাচাই রাখ ।
সবাই চলে গেলে সারাদিন ধকলের পর
দুখু বৈতলকে বলে,
--- দরজা বন্ধ কর ।
--- কেনে । খানি উনি আইত নানি ।
--- খানির সময় এমনেউ ডাকবা তারা । তরে না দিয়া খাইত নায় কেউ ।
--- অইবেটা বাঙ্গাল, খানির খুটা দেছ কিতা খালি ।
সকালেও কইচছ, কিতা এমন খাওয়াইলার বাদশাভোগ তোর ঠিকাদারে । খালি মুরগি
খাওয়ার, হুনাইয়া আনল মাছ খাওয়াইয়া বে-আঙ্গাজ লাগাই দিব । এক ঘাঘটর ঝুল
খাওয়াইল, অউনি বে-আঙ্গাজ । এর থাকি বেটা হিন্দু বাড়িত থাকে কত
নানানি বিনানির মাছরান্দা । বাঙাল হকলে খাইতা জানইন নি । হে তো জানে মামুয়ে কিতা
ভালা পাইন, খাওয়াইল নি মকা মাছর কড়ু ।
--- খাইবে নে, আইলে তো মাত্র ।
--- আর খাওয়াইছে । হক্কলতাউ একরান্দা । পিয়াইজ আদা রসুন । রসুন
আদা আর পিয়াইজ । সব শরীল গরম ।
--- আর তুই কিতা খাছ রাজভোগ জানি নানি । পাটনি বাড়ির সব আনা
তেলে রান্দা । পুড়া পুড়া মাছ ।
--- খাইছ একদিন দুর্গার হাতো, চাটবে বেটা । অত আনাজ আর অত মাছ, কত একমের সম্ভাষ ! আইর পুথিত হুনচছ নানি, তে হুন অখন,
প্রথমে নালিতা শাকে রান্ধিলেক ঘৃতপাকে
কচুশাকে নারিকেল কাটি
শাচিয়া শাক ঘৃতে ভাজে আদা দিয়া তার মাঝে
নাটা শাকে জিরা লং বাটি
পালই শাক বসাইয়া তার মধ্যে জল দিয়া
পাসরিয়া না দিল লবণ
ঘৃতে ভাজে নিমপাতা উদাইয়া উরসি তাত
বেতের আগা থৈকরের চষি ।
বার্তাকু তুরই ঝিঙ্গা ঘৃতে ভাজে রাজডেঙ্গা
কাচকলা দুগ্ধে ভাজে কষি ।
লাউ কুমড়ার চাকি হরিদ্রা পিঠালি মাখি,
বচবাচ জিরা লং বাটি ।
কচু আনাজ কাঠল বিচি করিলেক ঘৃতে ভাজি
তার মধ্যে উরসি দিল কাটি ।
একে একে নিরামিষ রান্ধিলেক ব্যঞ্জন ত্রিশ
সুকতানি আর মগডালি ।’
অউ গেল নিরামিষা । অখন হুন মাছর কথা,
‘পাবিতা মৎস্য দিয়া রান্ধে
নালিতার ঝুল
পুরাণ কুমুড়া দিল চিতলের কুর ।
নবীন কুমুড়া দিয়া কই মৎস্যের সনে
কুরি মৎস্যের ঝুল সুনাই রান্ধিল
যতনে
খাসির ডাইল দিয়া রান্ধে রোহিতের
মাথা ।
হিং সহিতে তাতে দিল তেজপাতা ।
এতেক ব্যঞ্জন রান্ধে জামিরের রসে
বাড়িঘর মোহিত হইল ব্যঞ্জন সুবাসে
।
বদরি অম্বল রান্ধে কাঠি দিয়া
ঘুটে ।
সরা দিয়া ঘুরি দিলে ফুকাই ফুকাই
উঠে ।
মুরে পুড়ে অম্বল উপরে উঠে ফেনা
ঘাটিতে ঘাটিতে লড়ে দুই কর্ণে
সোনা ।
বড় বড় কই মৎস্য ঘন করি আজি
জিরা গুলমরিচ দিয়া তৈলে তুলে
ভাজি ।
রোহিতের পেটি ভাজে মাগুরের চাকি
চিতলের কুর ভাজে বারবাখর মাখি
ইলিশ বোয়াল ভাজে বাচা বাঙ্গিনা
বড় বড় পুটা রান্ধে ঘনিয়া তলিত
চেংপাবি কতরান্ধে তাহার সহিত ।’
তিতা মিঠা শুনতে নি অখন ? পয়লা হুন তিতা,
‘হিম তিতা নিম তিতা উদাইয়া শাক
আর তিতা রান্ধে কন্যা বেতের আগ ।’
আরো হুন, অখন জিবরাত পানি বারই যাইব,
‘এক লাউয়ে লাবড়া বিচিয়ে বড়া
বাকল দিয়া ভাজি
ধন্যধন্য লাউরে তরকারি শিরোমনি ।
কচুর খাড়ি কিম্বা আলুর খাড়ি যদি
দেও আনি
তার মধ্যে যদি লতা দেওয়া যায়
ফৌজদারি প্যাদায় যেমন ধাক্কাই লই
যায়।’
অখন যদি মাংসর পাকশালো গিয়া ঢুকি তর ভালা লাগত নায় । বাদ দে,
--- বাদ দিতাম কেনে । ইতা কুনু খালি ইন্দুবাড়ির খানি নি । আমরাও
খাই ।
--- হাচা ত । তে কই এর পরর কথা । খাচ তো । হেশে গাইল্লাইছনা
কিন্তু । তে হুন,
‘মৎস্যের ব্যঞ্জন রান্ধি করিলেক শেষ ।
মাংসের পাকশালে গিয়া করিল প্রবেশ
কাঠুয়া মাংস রান্ধে...
--- ভবা তবা তবা । বন্ধ কর হালার হালা । মামুর সামনে, পিরর সামনে নি তুই ইতা গাইরে ।
--- তবা । তর লাগি অউত্ত ।
বৈতল বুঝতে পারে মামুর সামনে নাপাক
কথা বলা যাবে না । মামু কিছু বোঝে না, তবু বৈতল তাকে ধর্মগুরু বলে মানে
। তবে বৈতলের গানের গলার গুণেই হয়তো দুখু বছই আপদ ক্লান্ত হয় না, বরং উপভোগ করে এক অলীক মহাভোজ ।
আর মামু তার জন্য বরাদ্দ জাজিমে শোয় না, ঘরের এক কোনে গিয়ে বসে থাকে আর
বৈতলের গানের সঙ্গে তাল মেলায় । এর মধ্যেই বৈতলের নজর পড়ে উঠোনের ওপারে, ঠিকাদার তার ঘর থেকে বেরিয়ে
এদিকে আসছে । আর তখনই বৈতল তার পরিচয় পাল্টায়, বৈতল দাস শর্মা হয়ে যায় বৈতল
মিয়া, জিগিরে গায়,
‘আলাহামদো লিল্লা, ঠিকাদার ভাইর সব খুয়াইশ পুরা কর
বিসমিল্লা ।’
চোরের মতো নীরবে পা টিপেটিপে ঠিকাদার
এসে প্রবেশ করে অতিথি-নিবাসে ।
দুপুরে যে মানুষটা মামুর হাতে কিল চড় খেয়ে লজ্জায় পালিয়েছে, সেই মানুষ এবার এসে সোজা মামুর
পায়ের উপর পড়ে যায় শরণাগত । কাঁদতে থাকে প্রভাব প্রতিপত্তির বিশাল মানুষটি । বৈতলও
চোখ বন্ধ করে বারবার গাইতে থাকে ‘আলাহামদো লিল্লা...’ । ঠিকাদার খুশি হয় না ।
মামুর পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতেই থাকে ।
বলে,
--- আমার দামা দুইটারে মানুষ করি দেও দাতা ।
মামুর পায়ে লাগে, মামু মারে লাথি । তাও অবিচলিত পা
ধরে থাকে, এখন তো আর গ্রামের মানুষ নেই সামনে, সাজিদ মিয়ার অসম্মানের ভয়ও নেই ।
বলে,
--- তারারে কইছি আইত । আইব, দোয়া দরুদ করি দিবা দাতা ।
প্রথমে আসে শফি । শফিউল্লা, যেন আরব বেদুইন । বাপের ইশারায়
কদমবুসি করে সাধুকে । মামুর মুখে তখন শিশুর হাসি । এমন সুন্দর রাজপুত্রের মতো
যুবকের ব্যবহারে কোন ঔদ্ধত্য নেই । শুধুই বিনয় । মামুর মুখের হাসি দেখে দুখু পিরের
হয়ে আশীর্বাদ জানায় ঠিকাদার তনয়কে । বৈতল তখন দুখুর মুখে তাকায় । অবাক দৃষ্টিতে
একটাই প্রশ্ন । বৈতল দুখুর কানে কানে বলে,
--- কিতার দুঃখ বেটা ইগুর ।
দুখুও ইশারায় থামতে বলে বৈতলকে । বলে,
--- উবা, পয়লা সিন দিখিয়াউ পাগল অই যাইছ না । সব ভালা
ভালা কইছ না ।
শুরু হয় দ্বিতীয় দৃশ্য । দ্বিতীয়
পুত্রের প্রবেশ হয় উদ্ধত । সাজিদ আলিও হয় তটস্ত, পির থেকে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে
বসে । মামুর কিল চড় লাথি থেকে দূরে । আতাউল্লাকে ঢুকতে দেখে কিন্তু মামুর মুখের
হাসি আরো বিস্তৃত হয় । কিন্তু পা চলে শূন্যে । দুখু বুঝতে পারে মামুর ইশারা ।
সাজিদ মিয়াকে অনুরোধ করে বেরিয়ে যেতে । ঠিকাদার গাঁই গুঁই করে, বেরোয়ানা । আতাউল্লা ঝড়ের মতো
ঢোকে ঘরে, যেন সব লন্ডভন্ড করে চলে যাবে । মামু নয়, বাপ নয়, কেউ নয়, ঘরের ভিতর সব জীবন্ত প্রাণীকে
উপেক্ষা করে শূন্যে ছুঁড়ে দেয় ‘আদাব’ । হরির লুটের বাতাসা যেন, একমাত্র বৈতলই লুফে নেয়, মামুকে দেয় । মামু খিলখিলিয়ে
হাসে, শফিউল্লার মুখে মুচকি হাসি ঝিলিক দেয়, আতাও অপ্রসন্ন নয় । এবার টনক নড়ে
ঠিকাদারের, বোঝে সে ঘরে থাকলে আরো উতপ্ত হয়ে উঠবে, বাপের উপর আক্রোশে মেহমানদের
অবজ্ঞা করবে, আল্লার ওলিকে অসম্মান করলে যে তার সর্বস্ব যাবে । তাই নীরবে
বেরিয়ে যায় । ঠিকাদারের বংশের বাতি দুটো দুরকম । বড়টিও বাপকে মানে না, কথা বলে কম, কেউ বোঝে না লড়াই, মিস্টি হাসি আর চারিত্রিক
প্রশান্তি দিয়ে ঢেকে রাখে সব । কিন্তু ছোটটাকে নিয়েই সমস্যা, আবার ছোটটাই তার আশার আলো । একমাত্র
আতাউল্লা পারে সাজিদ মিয়ার উত্তরাধিকার বহন করতে, তার ব্যবসার হাল ধরতে, বেটার ভিতর নেতা হওয়ার সবগুণ আছে, অকারণ শুধু বাপকে শাস্তি দিতে
সাইকেলের খেলা দেখায় । বেরিয়ে যাওয়ার আগে তাই করুণ চোখে মামুর দিকে তাকায় । উৎকোচে
প্রলোভিত করে আল্লার প্রতিভূকে । বলে,
--- তোমার মোকাম দুতলা করি দিমু । সব পাক্কা করি দিমু, সাদা পাত্থর লাগাই দিমু ।
ঐদিকে সাজিদ ঠিকাদার বেরিয়ে যেতেই
হয় চমৎকার । পাথর গলে হয় ঝুরঝুরে বালি, বালি গলে জল । সাজিদ মিয়ার
কনিষ্ঠ পুত্রের মুখে হাসি ফোটে । অবজ্ঞার বদলে শ্রদ্ধা । ঘরের এক কোণে শুয়ে থাকা
পিরকে টেনে ওঠায় । বলে,
--- তুমি মাটিত পড়ি রইছ কেনে । উঠো ।
মামুর জন্য বরাদ্দ জাজিম ঝেড়ে দেয়
মমতায় । ঘরের মাঝখানে এনে জাজিমে শুইয়ে দেয় । মামুও যেন মায়ের কোল থেকে বিছানায়
শোয় । মিটিমিটি চোখে তাকায় আতাউল্লার দিকে । আতা মামুকে বলে,
--- তুমি অইলায় রাজা, রাজার মতো থাকবায় ।
গভীর জল থেকে বুড়বুড়ি ওঠার মতো
মামুও কিছু বলে বিড়বিড়িয়ে । আতাউল্লার সঙ্গে পিরের সংযোগ হয় । আতা বলে,
--- তুমার অউ চেলা ইগুরে ঠিক করি দেও । অখনও সময় আছে, হে মানুষ ভালা নায় । আমি তার
পয়সাত মৌজমস্তি করি, হে কয় চুর । তার ডাকাইতির পয়সা আমি গাউআলারে
দেই । আমার নানা গরিব আছলা, তেও দিতা । আল্লায় সইতা নায় । মাইনষে পয়সা
দিয়া ছিমেন্ট পায় না, ইবাড়িত অত স্টক কিওর । তুমি বিচার করবায় নি ।
দুখু মামুর হয়ে আতাকে প্রতিপ্রশ্ন
করে । বলে,
--- অত বড় পুল অইত, সিমেন্ট লাগব নানি ।
--- অইত কিতা বা বাছাই অই গেছে ছিমেন্ট ছাড়াউ । বালুর পুল ইগু, খালি ঝুরঝুরা বালু । ফিতা কাটবা
আইয়া বিষ্ণুরামে । সব ঠিক অই গেছে ।
এবার বৈতল মুখ খোলে । বলে,
--- সব তো তুমরার লাগিউ কররা ।
--- অয়, কররা । হিন্দুর ডাকাইত সাধু অইতা । তাইন রত্নাকর
। আমরার লাগি ডাকাইতি করবা, মানুষ মারবা । আমরা যেনে কই দিছি আরি । জিগাউকা
গিয়া বাড়ির মানুষরে । দুই বিবি অখনও জিন্দা আছইন । বড় ভাইসাব আছইন, আমি ছোট, ছোট হিতায় কিতা বুঝে, তেও কইব নি । কেউ নিব নি তার
পাপর বাগ । আমরা নিয়ার, আমরা দুই ভাই এ নেকি করিয়ার, তার গুনা কম করি দিয়ার, হে ইতা বুজে না ।
--- কিতা গুনা, কিওর গুনা । আমি তর বাপ না তুইন আমার বাপ ।
ঘরের বাইরে থেকে সাজিদ মিয়ার
পরাক্রমী প্রবেশ দেখে বৈতল প্রমাদ গোনে । এবার লেগে যায় সম্মুখ সমর । পিতাপুত্রের
লড়াই । কিন্তু সাজিদ মিয়া ঘরের মাঝখানে শায়িত প্রশান্তমূর্তি পির দর্শনে অবাক ।
পিরের পায়ের উপর বন্ধুর মতো হাত দেওয়া তার কনিষ্ঠ পুত্রের অবস্থান দেখে ভয় পায় ।
সে তখন মামুর অন্যপায়ের দখল নেয় । পিরের মনেও যে কখন কী কথার খেলা, আবার অতল থেকে বুড়বুড়ি দেওয়া কথা
বেরোয় । আতাউল্লা তাকে সাহায্য করে । শয়ন থেকে ওঠে সাধু । মামু ঠিকাদারের শার্টের
কলার ধরে টানে, কাছে আনে, কিল চড় ঘুষি মারে । নাগাড়ে হাসে সাজিদ মিয়া ।
হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে পিরের পায়ে । বলে,
--- মারো, আরো মারো ।
বরাক উপত্যকার মানুষ জানে, জালাল পিরের মার খেলে কপাল খুলে
যায় । অর্থাগম হয় । মার খেয়ে ঠিকাদারের
তৃপ্তি হয় ।
পরদিন আরো মুরগি জবাই হয় । গ্রামের পুকুরে জাল
ফেলা হয়, মামুর প্রিয় বলে শুধু গুটি কয়েক মৌরলা রেখে বাকি সব ফিরিয়ে
দেওয়া হয় দুখুর নির্দেশে । পেটুক বৈতলকে জব্দ করে দুখু হাসে মিটমিটিয়ে ।
ওরা ফিরে আসার পরদিনই প্রত্যাশা মতো
ঝুরঝুরিয়ে ভেঙে পড়ে মাটিজুরির পুল ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন