“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ২ অক্টোবর, ২০১৬

সুরমা গাঙর পানিঃ উজান পর্ব ২১

(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই  উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার  উজান  পর্বের  অধ্যায়  একুশ  ---সুব্রতা মজুমদার।)  

                                                       একুশ

   বৈতল কোনও গভীর চিন্তাভাবনায় স্থির থাকে না বেশিক্ষণ । খাও দাও নৃত্য কর মনের আনন্দে, দুর্গাবতীর উপর রাগ করে মাঝে মধ্যে একটু উল্টোপাল্টা । মনের সুখে গান গায়, মন্দ ভাবনায় জুড়ে যায় । ভাল থাকতে চাইলেও বৈতলকে ঠেকায় কে, বৈতলের মনে তখন গুরু মুখ আর তার মুখের কথা । গুরু সৃষ্টিধর তাকে পুঁথি শেখাতে শেখাতে বলেন,
--- যারা হুনের তারা তুমারে দেখের রেবা । তুমারে দেখিয়া যদি তারার ভক্তি না হয় তে কিওর গান আর কিওর নাচ । গাইবায় যখন বিভোর হইয়া গাইবায় । ঘর সংসার ভুলি যাইবায় । শত্রুতা উত্রুতা মনো রাখবায় না । দুইশ তিনশ জন মাইনষে তুমারেউ দেখের খালি, সবেউ তুমার মতো অইত চার, তুমার মাঝে মিলার নিজেরে । তোমার মতো বালা, তুমার মতো সুন্দর । দেখ পারবায় নি ।
    বৈতল পারেনি । বৈতল তো আর গুরুর মতো মিষ্টভাষী নয়, দেখতেও সুন্দর নয় । তাই গুরুকে বলে,
--- আমি তো সুন্দর নায় । কালা, চেংড়ার লাখান দেখাত ।
--- ই কিতা কও বাবাজি, তুমি কিতা তুমি অউ জানো না দেখিয়ার । তুমি যখন গাও তখন তুমার ধারো বওয়া যায় না, এক আলেদা জ্যোতি বারয় রেবা । আমি যেতা পারছি না তুমি পার । এর লাগিউ যেতা জানি সব তুমারে দিলেউ আমার সার্থক ।
   গুরু সৃষ্টিধর কী জানি কী দেখেছেন বৈতলের মধ্যে । গুরু বলেছেন বৈতলের অনেক নাম হবে । বৈতল নামের কিছুই বোঝে না, বৈতল টার কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক কিছুই বোঝে না । তবে সে যা করে সব কিছুই হয়ে যায় । ভাল মন্দ সকলই সে মনের আনন্দে করে । বৈতল চেষ্টা করে কিছুই করে না । শত্রুর মুখোমুখি হয়েও সে জানে না তার ভূমিকা । তবে কাউকেই বৈতল ছাড়ে না । দোস্তি যেমন তার জীবন জোড়া, শত্রুকেও সে পাশ কাটিয়ে যায় না । শত্রুর শেষ না দেখে বৈতলের শান্তি নেই । বৈতল ইচ্ছে করে কারো সঙ্গে শত্রুতা করে না । কিন্তু কেউ জড়িয়ে নিলে সে পিছপা হয় না । হরিৎবরণের জমিদার প্রথম দিনই তাকে উস্কে দেয় । বলে তার পুকুরের মাছের ওজনও বৈতল থেকে বেশি । বৈতলের রক্তে জোড়াফনা তখন থেকেই ফুঁসছে । তখনই মনে পড়েছে সিলেট দাড়িয়াপাড়ার এক কিশোরীর কথা । বৈতলও কাছাকাছির বয়সের কিশোর, তাকে চাকর বলার দুঃসাহস করে মেয়েটি । এই বিরোধিতার সূত্র এখনও বৈতল খুঁজেই চলেছে, কেন সে ঐ মেয়েটিকে এখনও ভুলতে পারে না । কেন শত্রু ভাবতে পারে না । চোখ বুঁজলে চোখ খোলা রাখলে যখন তখন সেই মেয়েটি তার চোখের উপর পুকুরপারের গল্প বলে । রাগের মাথায় কানের লতি ছিড়ে মাকড়ি নিয়ে পালালেও বৈতল কেন আজও নিজেকে অপরাধী ভাবতে পারে না । আবার যে খুব সাহসের কাজ করেছে তাও নয় । এ যেন এক অভিজ্ঞান, নিয়ে আসার দিয়ে আসার । আবার সেই বুড়ি কন্যার মুখটি চোখের উপর ভাসতেই বৈতলের মুস্কিল আসান হয়, অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায় । তবে বৈতল দৌড়েছিল, সেই দৌড় এখনও থামেনি তার । সেই মায়ামুখ কেন যে আবার কায়া হয়ে দেখা দেয় কাকাবাবুর বাড়িতে । রিফিউজি নেতা হরিমাধব ভট্টাচার্যর স্ত্রী আর দাড়িয়াপাড়া কন্যা যে এক সে-সত্যে ভুল ধরিয়ে দিতে বিভ্রান্ত করতে কেন যে এত তৎপর জনতার মানুষ বৈতল বোঝে না । তাই হয়তো পারিবারিক প্রশ্নের সদুত্তর দিতে এত রহস্য কাকাবাবুর । তাই আবার বেরিয়ে ফেরা বৈতলের, আবার ঠিকানা দুর্গাবতী । মেহেরপুরে ফেরার পরই বৈতল তার অব্যবহৃত সম্পত্তি, তার উড়াল জাল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে রোজগারের খোঁজে । শহরের আর এক মাথায় ইটখোলা, ইটখোলার হরিৎবরণের জমিদার বাড়ি । বিশাল বাড়ির সিংহতোরণের সোজাসোজি রাজবাটি, ডানদিকে বিশাল পুকুর, নাম পদ্মদিঘী । মাছ ধরে মাছ চায়নি মাছুয়া বৈতল । বলেছে আট আনায় এক খেপ । তাতেই রাগ যুবক জমিদারের । চেংড়া জমিদার বয়সে তেমন বড় নয়, বৈতলেরই সমবয়সী । বলে তার পুকুরের রুই-এর ওজন অনেক বেশি বৈতলের তেলাল শরীর নিয়ে কটাক্ষ করলে তাকে সামলানো দায় । গুরুর নাম জপ করেও বৈতল রাগ সামাল দিতে পারে না । ঝুলির ভিতর থেকে বের করে বিষদাঁত ভাঙা আলদ । কেউ দেখে না বৈতলের চাতুর্য । যথাসময়ে বৈতলের দুর্বুদ্ধির শিকার হয় জমিদার । সাপ দেখে ভিরমি খেয়ে পড়ে পুকুর পারে বৈতলের কোলেই ঢলে পড়ে ভিতু জমিদার যমুনাপ্রসাদ সিং । বৈতলও ততক্ষণে সেরে ফেলেছে তার কাজ । সোনার আংটি সরিয়ে নিয়েছে স্বর্ণবর্ণ আঙুল থেকে । হতভম্ব এবং কৃতজ্ঞ জমিদার পরিকরেরা বৈতলকে পারিশ্রমিক দিতে ভুলে যায় । বৈতলও জনসমক্ষে ঋণী রেখে চলে আসে । বৈতলের মুচকি হাসিতে এক নতুন যুদ্ধের সূচনা হয়, যার জন্য আগে ভাগে বৈতল কোনও প্রস্তুতি নেয়নি । বাস্তুহীন এক শরণার্থী বসতগড়ার কৌশলের সূচনা হয় । তবে এমন সাপের খেলার চালাকি সে দেখায়, দুপয়সা রোজগারও হয় মন্দ না । তবে ঐদিনের খেলায় যে বৈতল নতুন বসতের ভিত দিতে পারবে ভাবেনি । পরপর বুদ্ধির জট খুলেছে বৈতল । আর তাই জিয়ানির আগেই অকুস্থল থেকে সরে পড়েছে । ভয়ের মূর্ছা থেকে জেগে উঠবে জানে বৈতল, কিন্তু বৈতল ওর মনে যে ঢলানির দংশন দিয়েছে তার থেকে জিয়ানির মন্ত্রও সে ছাড়া কেউ দিতে পারবে না ।
    সোনার আংটির দাম সত্তর টাকা দিয়ে কী করবে ভেবে পায় না বৈতল । দুর্গাবতীকেও বলা যায় না । তাই আপাতত একা একাই ঘুরে বেড়ায় ইতিউতি । যদিও বৈতল জানে তার জীবনে সব কিছুই পূর্বনির্ধারিত । তবু কটুমিয়ার সাইকেল রিক্সা মেরামতির দোকানে গিয়ে বসে থাকে । অখিল পালের চা-দোকান থেকে চা খায় এক গ্লাস, কটুভাইকেও খাওয়ায় । টুসু খায়, কটুমিয়াকেও দেয় । কটু মিয়ার দোকানে অনেক কাজ । বৈতল হাত লাগায় । লিক সারাই, পাম্প দেওয়া, ভুসিং, রিমের টাল ঠিক করা, ফিরিউলে তার ভরে গ্রিজ লাগানো, সব দেখে আর শেখে । কটুমিয়াও অবাক হয়ে দেখে বিনি পয়সার সহযোগীকে ফুরসত হতেই প্রশ্ন করে,
--- তুমি কে রেবা কও চাইন ।
--- আমি বৈতল ।
--- বৈতল কিতা ।
--- বৈতল আবার কিতা । নাম ।
--- না, কইয়ার তুমার মজব কিতা ।
 বৈতলের হাতের কাচের গ্লাসে বাদামি রঙের চা । বলে,
--- আমি অউ গল্লাসর চা ।
--- অ ।
--- চা দিলে আমি চা, হোয়াইট দিলে সাদা । মদ এক গল্লাস দিলাও আমি তুমার বাপ তুমি গাইল্লাইমু, মদে যেতা করে । অখন কও কটুভাই, আমারে একখান রিক্সা বানাই দিবায় নি ।
--- দিমু, দিতাম পারতাম নায় কেনে । দাম পড়ি যাইব লেকিন বাক্কা ।
--- কও না কত ।
--- বেশি কইতাম, না কম কইতাম কও ।
--- আমারে কিতা আউয়া পাইছনি, ঠগাইতায় ।
--- নারে বা না । আমার এক গপ মনো পড়ল এর লাগি কইলাম ।
--- তে কও, আগে গপ অউ কইলাও ।
--- এক ভকা বেটা আইছে গাউ থাকি । হিপারো দুধপাতিলর লাখান এক গাউ থাকি উঠছে নাওও । ইটখলা ঘাট থাকি উঠিয়া আইছে অখিলর দোকানো । চা খাইত । ইবায় চায় হিবায় চায়, তিনচাক্কার রিক্সা দেখিয়া কয়, ই কিতা । কইইয়াউ হাগে দি চায়, দেখে বিজলিবাত্তির ভার, টরেটক্কার তার । ইটা দেখিয়া অখিল ইগুতো বিটলা, জিগায় কিতা দেখরায় বাছাই । ভকায় কয় কাউয়া দেখিয়ার । অখিলে কয় ঘাট আলারে পয়সা দিয়া আইছনি । হে কয় দিছি । অখিলে কয় অখন কাউয়া আলারে দেওন লাগব । কতটা গনছ কও কাউয়া । ভকায় ইবায় চায় হিবায় চায়, কাউয়া দেখে না কুনুখানো, তেও কয় গনছি ত বাক্কাউ, ধরি লাও বিশটা । অখিলে কয় তে দিলাওপাচ আনা । হে কয় কেনে ? অখিলে কয় এক কাউয়াত এক পয়সা । কম অইত নায় ।
  কটুমিয়ার গল্প বলার বৈঠকি ঢঙে বৈতলের কৌতুক হয় । কিন্তু হাসে না । কটুমিয়া একটু ক্ষুণ্ণ নয় । বলে,
--- তুমি হাসলায় না দেখি । ইগপ হুনিয়া আমরার গাউআলা মাইনষে খুব হাসইন । তুমি কুনু বাবু নি রেবা । হাসলায় না যে । আইচ্ছা তুমার লাগি কম করি দিমু নে । কত পারবায় কও । ষাইট বাষট্টি লাগি যাইব ।
   পক্ষীরাজ সাজাতে ষাট টাকাই লাগে । ধরম পাটোয়ার দোকান থেকে বেল হর্ণ কেরোসিন ল্যাম্প কিনে আনে কটু মিয়া । রিক্সা বানানোয় জাদুকরি হাত কটুমিয়ার । সিটের উপর আবার একদিকে অশোক কুমার অন্যদিকে কাননবালার ছবি লাগিয়ে দেয় । ইদের দুদিন আগে মিয়া বৈতলকে বলে,
--- এক চিলিম তামাইক বানাইবায় আইজ সেন্টেলরোডর খাম্বিরা দিয়া, সেনবাবুর দোকান থাকি আনবায় । ইফতার করিয়া টানমু ।
--- কেনে গাড়ি বনি গেছে নি ।
--- অয়, দেখবায় নে কিলাখান দৌড়ে । খালি রং করা বাকি । বৈকুন্ঠরে কইছি করি দিব । গাড়ির পিছে কিচ্ছু লেখতায় নি ।
--- অয় তুমার নাম লেখি দেও, কটু মিয়ার গাড়ি ।
--- ছি ছি রেবা ইতা কিতা কও । তুমার পয়সা, তুমার গাড়ি আর নাম লেখতাম নি আমার । এর থাকি আল্লার নাম লেখি দেও, এলাহি ভরসা ।
    বৈতলের মন খুঁতখুঁত করে । আজন্মের সংস্কার, বিশ্বাস । বৈতল ভাবে মনসার পট আঁকবে । এখন কটুভাইকে না করলে মনে দুঃখ পাবে । তাই কটুমিয়ার দোকানে স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে ষোল খুঁটির ঘর বানায়, নালার পার থেকে কচু গাছের ডাটা কেটে আনে ষোলটা ঘুঁটি বানায় । অখিলের বারান্দা থেকে নেয় ষোলটা তেতুল বিচি । কটু ভাইকে বলে,
--- আও খেলি । অখন আর ই মাদানি বেলাত ঘুমাইও না ।
--- ষোলগুট্টি খেলতে নি, এর থাকি অখিলর শেলেট পেন্সিলটা লইয়া আয় মঙ্গল কাটাকাটি খেলি ।
    বৈতলের এই খেলাটাও মন্দ লাগে না । শূন্য আর পূরণ চিহ্নের খেলা । যখন আর পথ থাকে না শেলেট মুছে ফেলা, আবার ঘর বানিয়ে রাখা । তবে বৈতল এখন রিক্সার নামকরণ নিয়ে বিপাকে । কটু মিয়াকে এলাহি ভরসার বিকল্প থেকে সরিয়ে দিতে হবে । তাই আবার অন্য কথায় যায় । বলে,
--- তামাক খাইতায় নি এক চিলিম ? তুমি কওয়ার আগেউ খাম্বিরা আনিয়া রাখছি । আইজ ইফতারর পড়ে দেখবায় নে কিলাখান চিলিম জ্বলে । আইচ্ছা বা দাদাভাই একখান পই ভাঙ্গাইতায় পারবায় নি কও ।
--- পারমু ।
--- তে কও, পুয়া নায় পুড়ি নায়, মুখো দেয় চুমা, উন্দাল নায়, চুলা নায়, তেও বারয় ধুমা । কও দেখি ।
--- হুক্কা ।
   না । কটুমিয়া জবাব দেয়নি । তার আগেই অখিলের দোকান থেকে লুঙি পরা এক বেঁটে লোক গুড়ুক গুড়ক শব্দ করে ভাঙিয়ে দেয় পইর ধাঁধা । বৈতলের রাগ হয় যারপর নাই । ধাঁধা কখনও কেউ ভাঙিয়ে দিলে রাগ হয়, পই হলো তার নিজের, প্রশ্ন করবে, ঠেকাবে, বলে দেবে জবাব, আত্মপ্রসাদ পাবে । এর মধ্যে সবজান্তা দু একজন আছে তাদের মেরে ফেলতে ইচ্ছে হয় । বৈতল তাও, কটুমিয়াকে সালিশি মানতে গিয়ে দেখে সেও মিটিমিটি হাসছে । বৈতলের ক্রোধ বাড়ে । বলে,
--- তুমি হাসরায় নানি, আমার গা জ্বলি যার, কিগু ইগু । ইগুরে নি জিগাইছি আমি । হালার হালা বাট্টি, হারামজাদার লাট্টি ।
   বৈতলের অচেনা নয় বেঁটে মানুষটি । সে দুখু মিয়া, বরাক নদীর অর্ধসমাপ্ত পুলের উপর দেখা হয় একরাতে । গাঁজার আসরের পান্ডা, নিজে খায় না, কিন্তু আসর পরিচালনা করে দুই বন্ধুকে নিয়ে, বছই আর আপদ ।
   বৈতলকে নিয়ে এক দুরন্ত খেলায় মাতে তিনজন । ভরপুর নেশা করিয়ে বৈতলকে বলে ঝাঁপ দিতে, ঝাঁপ দিলেই নদী, নদীর মাছ রুই কাতলা চিতল । হাওরের প্রাণী বৈতলকে নেশার ঘোরে জল ধরিয়ে দেয় তিন ভূত, শয়তানের দূত । নেশাহীন বাট্টি লোকটাই আবার বাঁচিয়ে দেয় শেষ পর্বে । বন্ধুতের কথা বলেই কিন্তু সখ্যের ভরসা হয় বৈতলের । বাঁচিয়ে দিয়েও লোকটা বৈতলের সঙ্গে সরাসরি মিত্রতা করে না । বোকা বৈতলকে লাথি মেরে ফেলে দেয় । নেশার ঘোর ভেঙেছিল বলে উল্টে চড়চাপড় কষায়নি বৈতল । যেমন করেছে সে লুলার সঙ্গে । লাগালাগিতেই খুশি সে, লাগালাগিতেই দোস্তি । বৈতলের পই ভাঙিয়ে দেওয়ার আগে, আবার ডাকে লড়াইএ । বৈতল বলে,
--- আছ না বেটা দেখি তর কত পই ভাঙানির শখ । ক দেখি তিন কুনা মাজে গাত, না ভাঙাইলে খাইবে লাথ ।
   অখিলের চায়ের দোকান থেকে কোনও আওয়াজ আসে না । আটকে গেছে দুখু মিয়া । তাই ইটখোলা ঘাটের দিকে যাওয়া গরুর গাড়ির গাড়োয়ানের সঙ্গে অকারণ কথা বলে, যেন শুনতেই পায় নি বৈতলের ধাঁধা । এদিকে সাইকেল মিস্ত্রি কটুমিয়াও মজা পায় । বলে,
--- হুঁ । ছুটি গেছে বেটার পাদুমপুদুম নদীর পারো থাকে তেও হেওত চিনে না ।
   নৌকোর জল সেঁচার এরকম তিনকোণা পাত্র । দুখু মিয়াও এত সহজ জবাবে অবাক হয় । বলে,
--- দেখতাম না কেনে । হে কুনু আমারে জিগাইছে নি । আর ইতা কুনু এক পই অইল নি । তার পই হুনিয়া দেখো অউ হুকনো মাঠো পুয়াইন্ত হকলেও আছাড় খাইয়া মররা হে নি পারব একখান ভাঙাইত জিগাও । ক ছাইন বেটা, বড়য় খায় শরম পায়, কিতা ।
--- ইতা হক্কলেউ জানে । তরটার দিমু পরে, আগে আমারটা ক হুনি । কেউ খায় না, হক্কলেউ খায়, আমি কিতা খাইলাম একদিন ইটখলা ঘাটো, মুর্খে ভাঙ্গাইবা কিতা পণ্ডিতর অউ গাইড় ফাটে ।
    দুখুমিয়া কিন্তু মুরব্বি মানুষ । পিরের সাকরেদ বলে মানুষ পছন্দ করে । কী জানি কেন বৈতলকে দেখলেই তার ভিতর একটা খুনসুটির মানুষ বেরিয়ে পড়ে বৈতলও তার সঙ্গে সমানে পাল্লা দিয়ে যায় । রাগে, আবার হজমও করে । বৈতল বোঝে দুখু তাকে অপছন্দ করে না । অর্দ্ধেক পুলের উপর থেকে তাকে যেভাবে রক্ষা করেছে, তাতে দুখুরও প্রাণসংশয় হতে পারত । ওর বন্ধু দুটোও দুখুর উপর নির্ভরশীল । বৈতলও বোঝে কিছু একটা আছে নির্ভর করার বছই রিক্সা চালায় সারাদিন মামুকে নিয়ে ঘোরে ইটখোলা ঘনিয়ালা সেন্ট্রাল রোড । মামুর সর্বক্ষণের সঙ্গী হয় দুখু । সন্ধ্যার পর মোকামে পিরকে পৌঁছে দিয়ে ভাইয়াপি । এসে মিলিত হয় আপদ, ইদানীং বৈতলকেও সঙ্গী নিচ্ছে । পিরের চড়থাপ্পড় খাওয়ার জন্য ভক্তজন অপেক্ষা করে থাকে অখিলের দোকানের সামনে, পঞ্চম সিং-এর গ্যারেজের ভিতর, মঞ্চু সিং-এর আনাজপাতির আর জমিদার যমুনাপ্রসাদ সিং-এর বাগান এর এদিক-ওদিক পিরের মার খাওয়ার সৌভাগ্য যার হয় সে আনন্দে দুখুর হাতে আনি দু আনি সিকি আধুলি দিয়ে যায় । জানে এ মারের সুফল ফলবেই, তখন আনি দুআনিই লাখ দুলাখ হয়ে ফিরে আসবে । খুশি গোয়ালার দুধের ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠতেই মামুর মোকাম নতুন করে গড়ে দেয় । সাইকেলে করে বাড়ি বাড়ি দুধ পৌঁছে দেওয়ার কাজ খুশিরমামুর মার খাওয়ার পরই মাছিমপুর থেকে ডাক পড়ে, সেনাছাউনিতে দুধ সরবরাহের বরাত পায় অন্য এক দেশোয়ালি আত্মীয় মারফত । অন্যের নামে কাজ করেও বেশ দুপয়সা হয় । খুশি দুধের ব্যবসাও গুটিয়ে নেয় । ঔষধের ব্যবসায় অনেক লাভ । সেন্ট্রাল রোডে দোকান খুলতেই শহরের কেন্দ্রীয় ঔষধালয় গোয়ালা মেডিকেল হল । মালুগ্রামের দেশবন্ধু বোসও গাগলাছড়া পুল-এর বরাত পাওয়ার পর পাকা করে দেয় পিরের মাটির বাড়ি । এরকম অনেক মার খাওয়া ভক্তজন আছে মামুপিরের । সেই সূত্রে শহরবাসী জন দুখুকেও চেনে, দুখুর নামে অনেক বদনাম, তবু সবাই দুখুর মারফতেই মামুর কাছে পৌঁছয় । দুখুও যতক্ষণ মামুর সঙ্গে থাকে সাধুর মতো থাকে, কোনও শয়তানি ধান্দামি করে না । মামুকে দেওয়া লিল্লার পয়সা সে জমা করে মামুর বাক্সে । মামু টাকাপয়সা ছুঁয়েও দেখে না, খরচ হয় দুখুর তত্ত্বাবধানে । ঘনিয়ালার মানুষ, দুখুর নিজের ধর্মের মানুষই তাকে ভাল চোখে দেখে না । পিরের খাদিম বলে ভয় করে, লোকমুখে প্রচলিত তার পাকিস্তানপন্থী ভাবমূর্তি, পনেরোই আগস্ট পাকিস্তানের চাঁদ তারা ওঠায় সে বাড়িতে । বৌকে গলা টিপে মারার গল্পটাও বেশ মুখরোচক । সব মিলিয়ে দুখু একটা রহস্যময় চরিত্র । সাধু সাধু ভাব আছে, মামুর একনিষ্ঠ চেলা যে, তারও আছে দুই চেলা বছই আর আপদ । বাড়িঘরও নেই আত্মীয়স্বজনও নেই । নদীর পারে মামুর নামে দখল করা মাটিতে ঘর বানিয়ে থাকে । পুলিশের খাতায় নাম ছিল এককালে । পিরের সঙ্গত করায় এখন সে নামকাটা দাগি । বৈতল মন্দ নিয়ে মাথা ঘামায় না, সে আর কোন দেশের ভালমানুষখুনের আসামি সেও প্রাণের বন্ধুকে খুন করে ফেরারি হয়েছে । সামাজিক অনুশোচনার ধার ধারে না বৈতল । তবে ব্যক্তিগত শূন্যতার জায়গা তো অনুতাপে ভরাট হয় না । দুখুকে দেখে তাই বৈতল হাসে, বুকে বল পায় । মনে হয় লুলার শূন্যস্থানে ঢুকতে পারবে বেঁটে লোকটা । তাই পই চালাচালি শেষে হতেই কটু মিয়ার বানানো রিক্সা দেখায় । বলে,
--- কটু ভাই-এ কইরা পিছে এলাহিভরসা লেখতাম । কিতা করি ক চাইন । বাট্টি বেতাইনতর মুড়িত বউত হারামজাদি বুদ্ধি থাকে ।
--- কেনে ভালাউত কইছইন ভাইছাবে । আল্লার নামে লেখি দে ।
--- তর আল্লা কুনু আমার ভগবান নি বেটা ।
--- বুজুর্গ মাইনষর কথা যখন রাখতে নায় তখন আর জিগার কররে কেনে ।
--- আইচ্ছা বেটা বাঙ্গাল, বুঝছি, তর পুটকিত পেচ । সিদা রাস্তাত হাটতে নায় তুই । অখন আমার একখান হাউস পুরাইবে নি ক ।
--- পুরাই লা । আমি কিগু পুরানে আলা ।
--- তুই না কইলে অইত নায় । আমি পয়লা দিন মামুরে চড়াইতাম আমার রিক্সাত । তুই রাজি ত ।
--- চড়াইছ ।
--- কইরে তো । বছইরে কই দিছ, রথর দিন আমার রথযাত্রা শুরু অইব । মামুরে চড়াইমু আমার রথ ।
--- দুয়া করতা তো এমনেউ করবা, দুই লাথ মারি দিবা নে, তাইন না মারলে আমারে কইছ মারি দিমু । চড়ানি লাগত নায় ।
--- কেনে, হিন্দুর রথো চড়াইতে নায় নি মামুরে । আমি চড়াইমু, তুই কিগুরে ।
    বৈতলের রাগ দেখে দুখু হাসে । হাসতে হাসতে লুঙ্গি উঠিয়ে চলে যায় নালার পারে । দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মোতে । ফিরে এসে বলে ।
--- কটুভাই, ইবার মহরম নানি কুনদিন ।
--- অউ জুম্মার পরর জুম্মার দিন
--- ইগুরে কই দেও মহরমর দিন হে চাইলে মামুরে চড়াইতে পারব । বৈতল তাতেই খুশি । বলে,
--- ঠিক তো । আমি সকালে যাইমু গি মকামো । হারাদিন কিন্তু মামু আমার ।









 চলবে  
< উজান পর্ব কুড়ি পড়ুন                                             উজান পর্ব ২২ পড়ুন > 

কোন মন্তব্য নেই: