“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ৯ অক্টোবর, ২০১৬

সুরমা গাঙর পানিঃ উজান পর্ব ৩৫

(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই  উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার  উজান  পর্বের  অধ্যায়  পঁয়ত্রিশ    ---সুব্রতা 
মজুমদার।)   

পঁয়ত্রিশ

     বৈতল এক আকাশ থেকে আর এক আকাশে ঢোকে । ইটখোলা ঈদগার পুকুরে ভাসে মকা পুঁটি আর দাঁড়কিনার ঝাঁক । বালিগড়া কাশখাউরি, পুকুরের পারে দূর্বাঘাস আর কলমিলতার ফাঁকে ফাঁকে ইচা । ইচা মানে ছোট চিংড়ি । পুকুর ছেঁচতে বলেছে মসজিদ কমিটি, বৈতল দরদাম করেছে বিস্তর । বলেছে,
--- মানু লাগব তিনজন । মাছ দিবা না টেকা দিবা ।
--- মাছ উছ পাইতে নায় । টেকা নিবে, আর অতা দারকিনা উনা ইতা নিবেগি ।
--- ইতা লাগত নায় । দাড়কিনা কাশখাউরি ইতা হিন্দুয়ে খায় না । রউ ঘাঘট দিবানি ।
--- না নু কইলাম । কমিটির মানুর অউ অইত নায়, ইমামও আছইন সবে চাই রইছইন । মাছ এমন জিনিস, আনমিলার চান্দ । দশ টেকা দিমু, অইলে ছেচ ।
--- তিন মাইনষর খুরাকি হয় নি দশ টেকা । পইঞ্চাশ দিবা ।
--- বিশ টেকা দিমু ।
--- পারছি না । আপনে দেখইন ভালা মাইমল পাইবা, দাড়কিনারও নিব গজারও নিব ।
   ত্রিশ টাকায় জাল ফেলে বৈতল । তিনজন তো কথার কথা দাম বাড়িয়েছে । বৈতল একাই তিনজন । বড়ো বড়ো দিঘী হলে ভিন্ন কথা, ছোট পুকুরে বৈতল পেলইন দিয়েই ধরতে পারে বড় মাছ । বৈতলের মাছ ধরার প্রক্রিয়ায় সবাই হাসে । যেমন হেসেছিল হরিৎবরণের জমিদার যম । যমুনাপ্রসাদ সিং । বৈতলকে তাচ্ছিল্য করলে রক্ষা নেই । কমিটিপ্রধান খরিচ আলির দিকে মাছের চোখে তাকায় বৈতল । বলে,
--- দেখইন না, চেমছাও দিমু পরে । অখন আপনার পুকইরর কাম অই যাইব পেলইনেউ ।
--- তে কমরো খলই বান্দিলা বেটা । আর খাড়লা চেফা নাইলে পারং বওয়াই দে । ইগু কিগুরে আনচছ বা দুখু ।
    দুখুও হাসে । বৈতল দুখুর দিকে কটমটিয়ে তাকায় । বলে,
--- কই দে তানে, বৈতল অইল পানির পুক, একবার পানিত নামলে ছানি রাখি দিমু, পনাও নু পাইতা নায় এরপরে ।
--- হাচানি ।
  খারিচ আলি তাও অবজ্ঞা করে বৈতলকে । দুখুকে উদ্দেশ্য করে বলে,
--- না রেবা তানে কও ইতা করতা না । আমরার গজার টাইন মারতা না । ছিলট থাকি আনছিলা আমরার ইমামে । হজরত শাহজালালর দরগা থাকি জিয়ল আনছিলা । তানে দেখিয়া যে ডর লাগের রেবু । তাইন নি রুস্তমর বাপ ।
  এসব মস্করা তামাসার মধ্যেই ষোল সতের বছরের এক কিশোরের পুকুরপারে প্রবেশ । মাথায় সাদা তকি, সবুজ নীলের চেক লুঙি গোড়ালির উপর উঠানো, আর গায়েও হাঁটুর নিচে নামানো দীর্ঘ জামা । পাঞ্জাবির মতো কিন্তু পাঞ্জাবি নয় । বৈতল দেখে বেশবাস কেমন মানুষের পরিচয় নির্দিষ্ট করে দেয় । তবে নবীন পড়ুয়াকে দেখে বৈতলের মন প্রসন্ন হয়ে যায় । এ তো কুতুবউদ্দিন, একে চেনে বৈতল । শিলচর টাউন মাদ্রাসায় পড়ে । ওর রিক্সার নিয়মিত সওয়ারি । বৈতলের খুব পছন্দ ছেলেটিকে । কুতুবকে দেখে তার শৈশব মনে পড়ে, মনে পড়ে কৈশোরের দিনগুলি, তার বন্ধু লুলার কথা বড় বেশি করে মনে হয় এরকম একটা লুঙি পাঞ্জাবি আর একটা সাদা তকি বাঁধা থাকে লুলার পুটলির মধ্যে । কিন্তু সর্বক্ষণের পরার জন্য তার ভিন্ন সাজ, গামছার মতো ছোট লুঙি আর নিমা । পুটলির সাজ ইদের দিন নামাজ পড়ার জন্য । ইদের সময় নতুন জামা কাপড় দেয় মসজিদ থেকে, লুলারও আত্মসম্মান জ্ঞান খুব টনটনে, নেয় নি কোনোদিন । বৈতলের ওসব বাছবিচার নেই, বস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠানে ঢুকে যায় এখনও । শীতের সময় বন্যার সময় কম্বল বিতরণ হয় । বৈতল নাম লিখিয়ে আসে ইস্কুলের ক্যাম্পে । বৈতল খয়রাতের মাল পরে না কোনোদিন । বিক্রি করে দুপয়সা হয়ে যায় । সেই পয়সা সম্বল করে দুই বন্ধু বেরিয়ে পড়ে ভ্রমণে, পিরথিমপাশা, শ্রীমঙ্গল না হয় আনারসের দেশ জলঢুপ । লুলার মতো একটা বন্ধু হয়নি বৈতলের, লুলার পায়ে ধনিয়ার বিচি, চল বললেই চল । কোথায় যাবে জানে না, বেরিয়ে পড়েছে বারবার । আর উল্টো হয়েছে এই দুখু, এক বাঁধের নীচে গাঁজার আসর পরিচালনা কিংবা রাতের কুটুম্বিতায় বেরনো ছাড়া নড়তেই চায় না । জন্মের মধ্যে কর্ম আপদ বছই আর তার সম্মিলিত সিদ্ধান্তে দুখু বাধ্য হয়ে বেরিয়েছে মাটিজুরি । মামুও যে বেড়াতে ভালবাসে । তবে দুখু নিরাশ হয়নি, মাটিজুরি গিয়ে বাট্টিবেটা খুব খুশি । দুখুকে বলেছে মামুকে নিয়ে ওরা এবার বেড়িয়ে আসবে এখানে ওখানে, মাঝে মধ্যেই । বৈতল জানে মামু রাজি হলে দুখুর কোনও ক্ষমতা নেই না করার । বেড়ানোর কথা শুনলেই মামুর মুখ আনন্দে উদ্‌ভাসিত হয়ে ওঠে । কুতুবের মুখেও বৈতল মামুর সারল্য খুঁজে পায় । শুধু চোখমুখে নয় তার হাঁটাচলায়ও অনেকখানি মামু । কুতুবও বৈতলকে দেখে, দেখে খারিচ আলি সেক্রেটারিকেও । বৈতলের হেনস্থায় দুঃখিত হয় সে । সে খারিচ আলির দিকে তাকিয়ে বলে,
--- আরে, এইন তো মিয়াসাব । খুব বালা মানুষ, আমারে মাগনা রিক্সা চড়াইন । বউত সাহস তান । একদিন দেখছি এক আলদর বাইচ্চারে এক হাতে ধরিয়া ফালাই দিছইন গাঙো । অলা তেজ !
---তেজ  কার দেখলায় রেবা আলিম, সাপর বাইচ্চার না অউ পাটকাঠির ।
   খারিচ আলি সেক্রেটারি কিছুতেই বৈতলের উপর ভরসা করতে পারে না । তার তৈলাক্ত ক্ষীণদেহ নিয়ে এর আগেও ঠাট্টা করেছে যমুনাপ্রসাদ জমিদার । এদিকে দুখু, যে এতক্ষণ খারিচ আলি আর বৈতলের তরজা উপভোগ করছে নীরবে, কোনো কথা বলেনি । দুখু চেনে তার দোস্তকে, ওরকম সেক্রেটারি কাত করা বৈতলের কাছে কিছু না । কিন্তু আসরে নতুন খেলোয়াড়ের উদয় হয় কী করে গূঢ় তথ্য নিয়ে । বর্ষাসন্ধ্যায় বৈতলের সাপ ধরার চতুর্থ সাক্ষী থাকার তো কোনও সম্ভাবনাই নেই । এমন দুর্যোগের বিকেলে বাঁধের উপর তখন আপদ বছই আর দুখই সঙ্গী বৈতলের । বাকি চরাচর তো বন্যার জলে থৈ থৈ । তাই দুখু অবাক চোখে ইটখোলা মসজিদের অস্থায়ী আবাসিক ছাত্রকে প্রশ্ন করে,
--- তুমি কেমনে জান রেবা ।
--- গুলার সময় নানি । আমি গেসলাম কবরো ।
--- আমার নানার কবর জিয়ারত করাত যাই আমি ।
--- ফ্লাডর সময় নি মনো পড়ল তুমার নানারে ।
--- আমি তো রুজ অউ এখবার তানে দেখিয়া যাই ।
--- তুমার বাড়ি ত রেবা বাশকান্দিত, তে ।
--- তে আর কিতা, নানা থাকতা ঘনিয়ালার ভাড়াবাড়িত, আমিও থাকতাম । তান এন্তেকাল অইলে আমারও পড়া শেষ, খারিচ চাচায় লই আইলা মজিদো, এর লাগি পড়িয়ার অখনও ।
--- হি তো বুঝলাম, হাপ ইগু দেখলায় কেমনে আন্দাইরো ।
--- কেমনে কিতা, কবর কই । সব পানির তলাত, খালি শিকল একছার লাখান বন্দর মাটি দেখা যায় । গেলাম, ইপার হিপার গুলা দেখিয়া আইলাম । আপনারা আমারে দেখছইন না, আপনারা তো...
--- অইছে বা বুঝছি ।
   দুখু কুতুবের মুখবন্ধ করে । আর বৈতল কিশোর কুতুবের মুখে তাকিয়ে সব ভুলে যায় । ভুলে যায় খারিচ মিয়ার প্রতি বৈরিতা, তার উল্টোপাল্টা কথাবার্তা । বৈতল ভেবেছে আজ পুকুরের সব মাছ বের করে দেবে খোড়লদিয়ে । কিন্তু কুতুবকে খুশি করতেই বৈতল পুকুরের জল তোলপাড় করে, কথার অতিরিক্ত মাছ তোলে । বৈতল অবাক হয়ে কুতুবের চোখমুখের আনন্দ দেখে । কিশোর বয়সের সারল্যে সব কটু কাঁটা সরে যায় । বিদ্রূপ করা সেক্রেটারি মানুষটিও হয় আনন্দিত ও লজ্জিত যুগপৎ । এত বড় মানুষটি এসে বৈতলের হাত ধরে মাপ চায় । বৈতল বিব্রত হয় । বৈতলের মনে পড়ে তার গুরুর উপদেশ । গুরু সৃষ্টিধর বলেন,
--- গুসা অইল চন্ডাল । গুসা অইলেউ ফুল গাছো চাইও । গুসা থাকত নায়, তখন হউ ফুলো দেখবায় নে মিঠা ফল ধরব ।
    গুরুবাক্য সব শুনে গেছে বৈতল । সব কি আর মান্য করতে পেরেছে । কিন্তু আজ কুতুবের মতো ফুলগাছে তাকিয়েছে বলেই না মানী মানুষটাও তার আঁশটে শরীরে হাত দিয়ে ক্ষমা চায় । ত্রিশ টাকার উপর দশটাকা বেশি দেয় । বলে মাছ নিয়ে যেতে । বলে,
--- নেও রেবা । তুমার যেটা ইচ্ছা, সব থাকি বড় অটাউ নেওগি যাও । তেও আমারে গুনাগারি রাখিও না ।
   বৈতলও তার বাপের বেটা । মাছ নেয়, সের খানেক মৌরলা মাছের দিকে চোখ রাখে । বলে,
--- দিলাইন অউ মকা ইটাইন । আমার মামুর খুব পছন্দ । মামুর বাড়ি পাঠাই দিমু, অউ দুখুইয়েউ লই যাইব । আমিও রাখমু দুইটা, আপনারেও দেওয়া লাগব । নে গিরে দুখু, কী ঝলঝলা নানি ক ।
   ঝলঝলা মাছ দেখে দুর্গাবতীরও আনন্দ ধরে না । বলে,
--- কিতা খাইতায় । ঝিঙ্গা দিয়া কড়ু না এমনে কালিজিরার দরো ।
--- ঝিঙ্গা কেনে গো, কচি পুরইল আছে দেখছি বিছারার মাচাঙ্গো । মিঠা মিঠা ঝাল ঝাল অইব ।
    সেই ঝাল মিঠে ব্যঞ্জনের জন্য তেল কিনতে থামে বৈতল সেন্ট্রাল রোডের গোবর্দ্ধন বনিকের দোকানে । রিকশার সিটের নিচে তেলের শিশি গড়াগড়ি খাচ্ছে রিক্সার গতির সঙ্গে তাল রেখে গড় গড় গড় গড় গড় । ঘনিয়ালা ঢুকতেই বৈতলের গা ছমছম করে । তেলের বোতলের শব্দ মাথায় ওঠে । বৈতলও চুপচাপ; দুখুও চুপ । শুধু শিশি যায় এদিকে গড়গড়, যায় ওদিকে গড়গড় । এমন তো হয় না বৈতলের, বৈতল দুখু একঙ্গে মানেই বোতলে বোতলে টক্কর, বাসনে বাসনে ঝনঝনানি । দুখুই বা কেন এমন চুপচাপ পিছনের সিটে বসে, বৈতলকে একটাও চিমটি কাটছে না, হুল ফোটাচ্ছে না । তিন পোয়া মৌরলা মাছ যে নিয়ে গেল সকালে, মামুর মুখের হাসির কথা তো বলে না । তাহলে কি সত্যি সত্যি দুখুর মনে অন্য, তাকে মারবে । বৈতলের ওসব ভয় ডর নেই, মানুষকে ভয় পায় না । জলের জন্তুর সঙ্গে লড়তে লড়তে গুর্দা শক্ত হয়ে গেছেআর ঘনিয়ালার মানুষকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই বৈতলের, ওখানকার সব দুঃখী মানুষরা তার একান্ত আপনজন । বৈতলকে কেউ নামে চেনে না । জানে ওঝা বলে । বৈতল ওঝা । ওঝার আবার জাতপাত কী । কিসের হিন্দু কিসের মুসলমান । ওকে তো মিয়াও ডাকে কেউ কেউ । উরস উৎসবের দুখুর সঙ্গে ছটাফর্দারি করেছে । সৃষ্টিছাড়া বৈতল জানে তার কোনও শত্রু নেই এই দুনিয়ায় একমাত্র যম ছাড়া । যম জমিদার তার লেজে পা দিয়েছে বলে সে কালসর্প । আর দুখুর উপর তার রাগ ঝগড়া চড় থাপ্পড় তো ভরসা থেকে । দুখু ছাড়া তার কে আছে ভরসার স্থল এই নবীন দেশে । সেই দুখুকেই এখন বৈতল বিশ্বাস করতে পারছে না । বৈতল যখন হরিৎবরণে এরকম ঘনিয়ালায় অন্যরকম হয় তখন দুখুও রাগে । বলে,
--- ঘনিয়ালাত ঢুকিয়াই বেটা আল্লা আল্লা করছ আর হিদিকে গেলেউ জয়গুরু । যেদিন পাইব দুগুয়ে লাগাল একলগে তখন দেখিছ কেমনে মরবে । জবাই হইবে না বলিচ্ছেদ অইত তর রে বৈতল ।
     দুখুর বিদ্রূপ গায়ে মাখে না বৈতল । ধর্মকর্ম নিয়ে তার স্পষ্ট দৃষ্টি । হিন্দু মুসলমান আর দুনিয়ার সব ধর্মই মানুষ নিজের সুবিধার জন্য বানিয়েছে । কোনও আল্লা খোদা ভগবানই নিজেকে টুকরো করে বাঁচতে পছন্দ করেন না তাই বৈতল নিজেকে সবার সঙ্গে মিশিয়ে দেয় । আল্লার মানুষ ভগবানের মানুষে দুরকম দেখতে পারে না । এই একটামাত্র জায়গায় বৈতলের সঙ্গে দুখুর ফারাকআবার বৈতল এও অনুভব করে কোথাও না কোথাও দুখুর মধ্যেও একটা মানুষ আছে যে কখনও কখনও পেরিয়ে যায় লক্ষ্মণের গন্ডি । ধর্মের রাজনীতিতে থেকেও সে এক বেদুইন, দেশহীন ধর্মহীন মানুষ । তাই বৈতল দুখুকে বলে,
--- জবাই অউ বালা, কিতা কছ । বাঙালবাড়িত মাছ উছ থাকি আসল খানি খায় গোস্তে ।
--- তে অছ না কেনে বেটা, অইলে অউত্ত আর আতান্তর থাকে না । আর হালাল খাইয়া তো বেটা এমনেউ তর জাত গেছে ।
--- তর লাখান ছলা কাউয়ায় কইলেউ জাত যায় না । বেশ মাতিছ না, যা ।
   মামুর চেলা বৈতলের কোনও বাছবিচার নেই । ছোটবেলা থেকেই খাদ্যাখাদ্যে কোন বিভেদ নেই বন্ধু লুলা বলে,
--- গরিবর পুয়া অত মানলে চলত নায় । আমরার হক্কলতাউ হালাল কেউরে না কইলেউ অইল । আল্লায় মাপ করি দিবা গুনা অইলে ।
   লুলার এই কথায় আল্লা আল্লা করা ভাল লাগে না । বলে,
--- তুই আচছ বেটা তর আল্লা নিয়া । আল্লায় কিতা করতা আবার । তর আরিপরি আছে নানি, নানা আছইন নানি, মজিদর ইমাম আছইন নানি তারারে মানিছ, তেউ আল্লারে মানা অইব । মানুষ না থাকলে বেটা কিওর খোদা কিওর ভগবান আর মা মনসা ।
    লুলা ও দুখুর মধ্যে পার্থক্যও অনেক । লুলা বৈতলের বাল্যবন্ধু, ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে থেকেছে, কোনও ভেদাভেদ করেনি । আর দুখু বয়সকালের বন্ধু, মনের মিল আছে কিন্তু ধর্মকর্ম নিয়ে কট্টর । হালাল মানে হালাল, লুকিয়েও হালাল সামনাসামনিও তাই । বৈতল সবসময় বোঝেও না দুখুকে, মনে হয় দুখু সব সম্পর্কের হিসাবই কোরান আর হাদিস দিয়ে করে । মনের মিল শুধু ওপর ওপর, যে-কোনও সময় ভেঙে যেতে পারে শিববাড়ির বাঁধের মতো । তাই গিলানি সাহেবের আহত হওয়ার খবরে থম মেরে-থাকা শহর, আর ইটখোলা ইদ্গার সামনে থেকে দুখুর তার রিক্সার উঠে বসা ইস্তক এক আতান্তর বৈতলের । এখন যদি সত্যি রায়ট লেগে থাকে, কী হবে তবে দুখুর ভূমিকা তাকে মারবে, ধরিয়ে দেবে দাঙ্গাবাজদের হাতে । বৈতল তার গুরুকে স্মরণ করে, বিয়ানিবাজার রইদপুয়ানির সৃষ্টিধর ওঝাকে ডাকে প্রাণপণ । গুরুর সঙ্গে বৈতলের দেখা হয়নি সেই জৈন্তিয়ার পাহাড়তলি ছাড়ার পর থেকে । গুরুর ইচ্ছাকে সম্মান দিতে পারেনি বৈতল, শুধু কালো বলে, গুরুকন্যা চায়নাকে ফিরিয়ে দিয়েছে । কোনমুখে এরপর গুরুর সঙ্গে দেখা করে । তবে লুলার মুখে শোনে অন্য এক বৃত্তান্ত । বিয়ানিবাজার রইদপুয়ানি আর পন্ডিতপারা তখনও হিন্দুপ্রধান । রইদপুয়ানির গ্রামপুরুষেরা রামদা নিয়ে সারারাত গ্রাম পাহারা দেয় । গণভোট হয়ে গেছে, সিলেট যাবে পাকিস্তানে । এর মধ্যে পঞ্চখন্ডর হিন্দুদের মনে আনন্দ । করিমগঞ্জ মহকুমা সিলেট থাকবে না, যাবে ইন্ডিয়ার কাছাড় জেলায় । সীমানা নির্ধারণের সুবিধা হবে বলে । পঞ্চখন্ডও আর পাকিস্তান হবে না, ঢাকা দক্ষিণে ঠাকুরবাড়িও থেকে যাবে হিন্দুস্থানে । হিন্দুদের মনে আনন্দ, মুসলিমরাও রাগে ফুসছে, মুসলিম লিগ গুজব কান না দিতে বলছে । বৈতল যে কিছুদিন ছিল বিয়ানিবাজার, মানুষে মানুষে কোনও অসদ্ভাব দেখেনি । গুরু সৃষ্টিধরের বাড়ির উত্তরেই দুঘর মুসলমান ; কেরামত আলি আর মুরশেদ মিয়া । একজন মাটি কামলা আর একজন গাড়োয়ান । মুরশেদ আলির নিজের গরুর গাড়ি বাঁশ মাটি বালু বওয়াজ কাজ, আনারসের সময় চলে যায় জলঢুপ, অনেক দিন ফেরে না, গাড়ি বোঝাই আনারস নিয়ে যায় সিলেট, শিলচর । মুরশেদ আলির অনুপস্থিতিতে গুরু সৃষ্টিধরের উপর দায়িত্ব থাকে ওদের পরিবারের দেখাশোনার । ফেরার পথে মুরশেদ আলি গুরুর বাড়িতে দিয়ে যায় এক হালি গুড়ের মতো মিস্টি আনারস । সেই দুই ভিন্নধর্মী মানুষকে প্রাণে মারার চক্রান্ত হয় রইদপুয়ানির কালিবাড়িতে । আসলে তখন দাঙ্গা লেগে যায় কথায় কথায় । কে যেন বলে সুনামগঞ্জের জয়মঙ্গলে এক সঙ্গে দশজন হিন্দুকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে । ব্যস, যে যেখানে সংখ্যায় বেশি সেখানেই প্রতিহিংসা । বৈতলের গুরু সৃষ্টিধর ওঝা তা হতে দেননি, দুই বিধর্মী পরিবারকেই তার বাড়িতে পঞ্চকন্যার হাতে দিয়ে ছুটেছেন কসবা, বিয়ানিবাজারের লিগ অফিস । সৃষ্টিধর ওঝা মানুষের ভাল করতে প্রাণের মায়া করেন না । তাই তিনি পঞ্চখন্ডর এক অবিসংবাদী মানুষ, হিন্দু মুসলমান সবাই সম্ভ্রম করে কাঠমিস্ত্রিকে । কসবা পাড়ায় লিগের নেতা সাত্তার মিয়ার বাড়িতে উপস্থিত হতে পারেন অকুতোভয় । কী কথা হয় কে জানে, সাত্তার মিয়ার লোকজন রাতের অন্ধকারে গিয়ে বিপন্ন দুই পরিবারকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে সব শুনে বৈতল লুলাকে বলে,
--- ইতা মাতন লাগত নায় বেটা, আমার গুরু অলাখান অউ, জান দিলাইবা চুকতা নায় ।
--- ঠিক অউ কইচছ, এক্কেবারে ফকিরর লাখান মানু । কিচ্ছু নাই বেটা । কে কইব এক কাঠমেইস্তরর অলা তেজ । তরে যেদিন দিয়া আইলাম, মনো আছে নি তর আমার নাম রুল আমিন জানিয়াও কইলা খাইয়া যাওয়ার লাগি ।
--- তুই ত খাইলে না ।
--- আমারে তুইন খেদাই দিলে মুখপুড়া মনো নাইনি । অতদিন একলগে ঘুরলাম আর তুইন এক পুঁথি হিকার লাগি দুস্তরে ছাড়ি দিলে । বহুত দুখ আছিল দিলো । তান উপরেও গুসা আছিল । তাইন তরে নিলা গি । এর লাগি ।
--- জয় গুরু । অখন ক ইতা যে কইলে, মুরশেদ চাচা আর কেরামত আলির কথা, তুই কেমনে জানলে, তুই নি লিগর লগে আচছ তলে তলে ।
--- ইতো আছে হক্কলেউ । অখন ত থাকবউ, পাকিস্তানো থাকিয়া কংগ্রেসি করতাম নি ।
--- না, হুনলাম নু করিমগঞ্জ যাইব গি হিন্দুস্থানো । গুরুর বড় হাউশ আছিল দেশভাগ অইত না । তাইন কইতা হক্কলরে নিয়া থাকার কথা কমুনিস্ট আছলা নানি ? তান পকেটো আমি দেখছি কাচি দাও আর ধানর ছড়ার ছবি । তাইন শুদ্ধ বাংলাত কইতা কাস্তে ধানের শিসকমুনিস্ট পার্টির চিন । তারার বউত বুকর পাটারে । আর অততা জানইন ।
--- জানিয়া কিতা অইল । জানছছনি, হউ যে দুই বাঙাল পরিবাররে বাচাইলা, লিগর মাইনষে আইয়া লই গেল ।
--- ভালাউত্ত করলা, বাঁচাইলা ।
--- তাইন বাচলানি ।
--- কেনে কিতা অইছে, তানে মারি লাইছেনি ।
--- না জানে মারছে না, কিন্তু মারার লাখান অউ ।
--- কিতা করছে কছ না বেটা ।
--- ছাত্তার মিয়া তো খুব ধুরন্দর । হে ভাবল অউ মউকা । হিন্দুর মাড়ইল হাড্ডি ভাঙ্গি লাওয়ার । কাঠমেইস্তর অইলে কিতা অইব সৃষ্টিধর উঝারে সবে মানে । অউ বেটারে দাগি বানাই লাইলেউ অইল । তাইন বাচাইলা অউ দুইঘর মানুষরে, আর ছাত্তার মিয়ায় মিটিং করিয়া কইল উঝায় কেরামত আর মুরশিদরে বান্দিয়া রাখি দিছলা । তারা গিয়া ছাড়াইয়া আনছইন
--- কইলেউ অইল নি । মুরশিদ চাচায় কিতা কইল । আমি চিনি তানে, বউত ভালা মানুষ, মিছা মাত মাততা নায়জলঢুপ থাকি আনারস আনিয়া খাওয়াইতা ।
--- আর তর আনারস । তখন কিগুয়ে কইত লিগর ফয়সালার উপরে ।
--- তাইন অখন কই । আমার গুরু । তান বড় বিপদের সময় ।
--- আছইন রইদপুয়ানিত অউ । সব গেছেগি ইন্ডিয়াত, পন্ডিতপাড়াত দুই একঘর আছইন, রইদপুয়ানিত তাইন । তাইন কইছইন যাইতা নায় ।
--- তাইন যাইতা নায়, শেওলার পারউ মরবা কইছইন ।
--- পুড়িনতর বিয়া অইছে নিবে ।
--- অত জানার অইলে যাছ না কেনে ।

   বৈতল যায়নি । অপমানিত গুরুর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারেনি । শুধু লুলার কাছ থেকে খবর জেনেছে । শেষদিকে লুলাও কিছু বলতে পারেনি । দেশভাগ বন্ধুকেও বদলে দিয়েছে ।





চলবে  
< উজান পর্ব ৩৪ পড়ুন                                                                                           উজান পর্ব ৩৬ পড়ুন >

কোন মন্তব্য নেই: