(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার উজান পর্বের অধ্যায় বাইশ ---সুব্রতা মজুমদার।)
বাইশ
রথযাত্রার দিন বৈতল মামুর রিক্সা করে শহরের এ
মাথা থেকে ও মাথায় ঘোরে । তিনসন্ধ্যার সময় বৈতল দুখুকে নামায় রিক্সা থেকে, মামুকেও নামায় হরিৎবরণ জমিদার বাড়ির সামনে ।
নতুন রিক্সার সিট উঠিয়ে বের করে কলার কাঁদি বাতাসা আর একগুচ্ছ ভুবি ফল । জমিদার
বাড়ির বড় রথের সামনে গিয়ে মনিপুরী পুরুতের হাতে দেয় উপাচার, রথের রশি ধরে টানে, রথের উপর থেকে লুট হয় কলা বাতাসা নারকেল আনারস ভুবি । বৈতল আনারস তাক করে দেয়
লাফ, জাপটে ধরে আনারস অক্ষত । তেলাল
শরীরের ধারে কাছেও কেউ নেই । লুটের প্রসাদ নিয়ে ফিরে আসে রিক্সার কাছে । মামু পির
বৈতলের কাণ্ডকারখানা দেখে হেসে কুটিকুটি । বৈতল পিরের হাতে দেয় আনারস । দুখু বাধা
দেয় । বলে,
--- নিও না মামু । ইগু কাফের ।
পিরের তখন মজা । বৈতলের মতো দুহাতে জাপটে ধরে
আছে আনারস । ওদিকে এক লালপাগড়ি পুলিশ সব লক্ষ রাখছে, বৈতলের কাছে এসে ধমক দেয় । বলে,
--- ইতা কিতা করবায় । হিন্দুর লুট হর তুমি কেনে
ধরলায় রেবা, থানাত যাওন লাগব তুমার । রায়ট
লাগাইতায় নানি ।
বৈতল কিছু বোঝার আগে ইটখোলা তেমাথা থেকে আরো
কয়েকজন পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে এগিয়ে আসে । বৈতলের গায়ে লাঠির ঘা পড়ার আগেই দুখু
ঝাঁপিয়ে পড়ে লাঠির সামনে । বলে,
--- ইতা কিতা কররা । কারে মাররা, ইগু কুনু বাঙ্গাল নি ।
--- তে ।
আসলে মহরম আর রথযাত্রা একদিনে হওয়ায়
উত্তেজনাপ্রবল এলাকা ইটখোলা ঘনিয়ালার মোড়ে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে । ভিড়ের জটলা
এবং লালপাগড়ি দেখে দুখু মামুপিরের জন্য চিন্তিত হয় । আবার বিনা কারণে বৈতলকেও
বাজারি মার খেতে দেওয়া যায় না । দুখু জানে একা তার কথায় পুলিশও ভুলবে না মানুষও
মানবে না । তাহলে উপায় । একটুকরি রথের প্রসাদ সহ যুবা জমিদার যমুনা সিং-এর উদয় হতেই দুখু উপায় খুঁজে পায় । বৈতল
বলেছে এই জমিদারকে সে বাঁচিয়েছে সাপের কামড় থেকে । জমিদার বাড়ির সিংদরজা আগলে
দাঁড়ায় বেঁটে মানুষটি । বলে,
--- অউ এইন চিনইন তারে । হে উঝা, সিস্টিধর উঝা ।
দুখু নতুন বন্ধুর জন্য
কাকুতিমিনতি করে । বলে,
--- মালিক, কইন না । চিনইন নানি । হে ত মেহেরপুর কেম্পো থাকে ।
এদিকে বৈতল থেকে জমিদারে নজর পুলিশ আর জনতার
। তেলাল শরীর বৈতলও বিপদের গন্ধ পেলে বিচলিত হয় না । সে জানে হরিৎবরণ আর ইটখোলা
ঘিরে আছে অনেক জলাশয়, আছে বরাক নদী । মানুষ আর পুলিশ
ধরার আগেই সে পালাবে, গিয়ে পড়বে জলে । কিন্তু এবার
বৈতলের ধান্দা ভিন্ন, সে নিজেকে বাঁচাতে তৎপর হয় না ।
সে পিরবাবাজির জন্য উৎকণ্ঠিত হয় । একা মামুকে আনারস হাতে রিক্সায় বসিয়ে দুখুও চলে
গেছে জমিদার বাড়িতে । অকুতোভয় বৈতল পুলিশ কিংবা মারমুখি জনতাকে ভয় করে না । সোজা
গিয়ে রিক্সার হাতলে হাত দেয়, কিরিং কিরিং বেল বাজায়, রাস্তা পরিষ্কার করে সে দিব্যপুরুষ নিয়ে
বেরিয়ে যাবে । বৈতল জানে মামু সঙ্গে থাকলে তার কোনও ভয় নেই । রিক্সার প্যাডেলে পা
রেখে দুখুকে ডাকে,
--- অই বেটা আয়, ঘনিয়ালার তাজিয়া দেখাইতাম মামুরে ।
ওদিকে জমিদার যম সিং তখন একবার
বৈতলকে দেখে আর একবার ভিড়ের ভিতর মণিপুরি পুরোহিতের মাথার উপর দিয়ে রথারূঢ়
জগন্নাথদেবকে দেখে । আনন্দে ভরে যায় মুখ, প্রসাদী ফলের ঝুড়ি আবার মাথায় ঠেকায় । এগিয়ে যায় পুলিশ ও জনতার দিকে । কথা
বলতে বক্তৃতা দিতে হাত খালি রাখতে হয় শিখেছে যমুনা প্রসাদ । ভোলার হাতে টুকরি দিয়ে
সামাল দেয় পরিস্থিতি, শান্তি রক্ষা করে । কিন্তু যার
জন্য যা, সে কোথায় । বৈতল ততক্ষণে
ঘনিয়ালার মিছিলে মিশে গেছে মামু আর দুখুকে নিয়ে ।হায় হাসান হায় হুসেন করে দুখুকে
বুক চাপড়ায়, মামুও বুকে হাত দেয় । কালো
পোষাকের মিছিলকারিদের হাতে লাঠি ও তরোয়াল । নিজেরাই নিজেদের মারে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে
। বৈতলও বলে হায় হাসান, হায় হোসেন । মহরমের উৎসবে এত
মারামারির উন্মত্ততা দেখে বৈতলে গুরু সৃষ্টিধরের শেখানো উৎসবের সত্যে বিভ্রান্ত হয়
। গুরু বলেন রথযাত্রা আনন্দেরই উৎসব । সমুদ্রপারের দারুপ্রতিমা জগন্নাথদেব সুভদ্রা
আর বলরামের রথে চড়ে মাসীর বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার উৎসব । আবার পনেরো দিন পর ফিরে আসার
দিনও হয় উৎসব, নাম উল্টোরথ । কিন্তু গুরু যে
বলেন মহরমে আনন্দের লেশমাত্র নেই, মহরম শোক পালনের উৎসব । গুরু
বলেন,
--- অখন যে রেবা দেখরায় লাঠি বল্লম তরোয়াল লইয়া
যুদ্ধ কররা রাস্তাত কালা কাপড় পিন্দিয়া, ইতা কিন্তু ধর্ম নায় । ধর্ম অইল শহিদ দিবস পালন করা । শহিদর আত্মার শান্তি
কামনা ।
--- কে শহিদ, মহরম কথার অর্থ কিতা ।
--- অর্থ না বা । আরবি বছরর পয়লা মাস অইল মহরম ।
আর শহিদর ও আছে এক কিচ্ছা, হজরত মহম্মদর দুই নাতি, পুড়ির ঘরর নাতি হাসান আর হোসেনে নানার কাছে
কান্দতে কান্দতে কইল তারার পিন্দার কাপড় নাই, কাপড় লাগে । হজরত মহম্মদে কইলা কও কী রঙর কাপড় লাগব । একজনে
কইলা সবুজ আর একজনে হোসেনে কইলা লাল । তাইন ত কইলা আইচ্ছা, তখন আকতা স্বর্গ থাকি জিব্রাইলে তান কানে কানে কিতা কইয়া
গেলা আর নবি দাদুর মন খারাপ অই গেল । আসলে তান দাদুভাই হাসান মরবা বিষ খাইয়া এর
লাগি সবুজ রঙ আর হোসেন মরবা ফুরাত নদীর পারো কারবালার মাঠো এজিদর সৈন্যর অন্যায়
যুদ্ধত । কল্লা দুই ফাঁক করি লায় শয়তানে । নবিয়ে ইতা সব আগেউ জানি লাইছলা । এর
লাগি মহরমর দিন খালি কোরান পাঠ করা হয়, দান দেওয়া হয় । শহিদর আত্মার শান্তি কামনা করা হয় ।
--- ই তো বুঝলাম, কিন্তু সবুজ আর লাল রঙর অর্থ কিতা কইন । সবুজ তো বাঙ্গাল
হকলে ঝাণ্ডা থাকি শাড়ি কাপড় হক্কলতাত পছন্দ করে । মুসলিম লিগর পতাকার রঙও সবুজ ।
আমি এক সবুজ তফন পিন্দিছিলাম, আপনার বাড়ির হক্কলে কইলা আমি
বাঙ্গাল হই গেছি । আর লাল তো দেখি অনন্ত সাধুর পার্টির রং । লালও আমি পিন্দতাম
পারি না, মাইনষে কয় কমুনিস্টর রঙ । রং
দিয়া কিতা হয় বুজি না ।
--- আছে রঙর অর্থ আছে । তে রং দিয়া পরিচয় সহজ হয়
অনেক সময় ।
বৈতল গুরুকে প্রণাম করে মনে মনে । গুরুর
আশীর্বাদে ষে কারবালার প্রান্তর থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে । যম এজিদের হাত
থেকে রক্ষা পেয়েছে । ঘনিয়ালা পুকুরের পারে রিক্সা দাঁড় করিয়ে বৈতল দুখুর কাঁধে হাত
দেয় । আসলে দুখু সময়মতো ঝাঁপিয়ে না পড়লে বাজারি মারের হাত থেকে বৈতল বাঁচত না ।
দুখুকে বলে,
--- এজিদ ইগুর হাত থাকি বাচি গেলাম । নাইলে তো
সবে আইজ হায় বৈতল হায় দুখু করলে নে ।
--- অই বেটা খবিছর খবিচ নিজেরে ইমাম হোসেন ভাবরে
নি । জমিদার বেটাও কুনু শয়তান এজিদ নায়, তোরে বাচাইত আইছিল । আমি তো দেখলাম হে তরে খুজের । তুইন কানোর লাটসায়েব, বেটার তর লগে বউত মাত আছে, তোরে কিচ্ছু দিত । আর তুইন ভাগরে ।
--- ভাগিয়ার না বেটা খেলাইয়ার । খেউড় খেলাইয়ার ।
বরির আগাত টুপ লাগাইয়া রাখছি হে আইব । ইতা তুই বুঝতে নায় বেটা বাট্টি ।
জমিদারের সঙ্গে লুকোচুরি খেলায় বৈতল জমিদারের
হাতে দেখে নিয়েছে নতুন আংটি । মানে ধরতেই পারে নি তার হাতের কাজ । প্রফুল্লমনে
সেদিন বৈতল মামুর মোকামে দুখুর সঙ্গে খায় বিরিয়ানি । মামুও খায়, মামুকে কেটে দেয় লুটের আনারস । গভীর রাতে উৎসব সমাপন করে
বৈতল পক্ষীরাজ নিয়ে ফিরে আসে মেহেরপুর । ক্যাম্প বাড়ির বাঁশের খুঁটিতে পাটের দড়ি দিয়ে
রিক্সা বাঁধতে বাঁধতে দু-বার দৌড়য় পায়খানায় । বৈতল বোঝে জ্বর এসেছে, হাত পা মাথা গরম । উৎকণ্ঠায় দুর্গাবতী কী করে
শুশ্রূষা করবে ভেবে পায় না, একটু পরপরই যে দৌড়চ্ছে ।
দুর্গাবতীকে বলে,
--- আটু কাপের ।
--- কাপব । বুঝছি লবণ জল খাও খালি ।
--- দেও ।
এত রাতে ডাক্তার নেই কবিরাজ নেই হোমিওপ্যাথি
নেই, দুর্গাবতীর হেকিমিতে নুন জল খেতে
আপত্তি করে, পেট গুলোয় । চিৎকার করে বাধা দেয়
। ভোররাতে চিৎকার করার শক্তিও হারিয়ে যায় । একদিন না দুদিন কে জানে ঝোলভাত খেতে
খেতে চোখ খোলে । তৃপ্তি নিয়ে তাকায় দুর্গাবতীর সেবাপরায়ণ মুখে । দুর্গাবতীর হাতের
শাঁখায় আদরের মুখ লাগায় । বলে
--- ইটাইন হাচারির নি ।
--- কিতা হাচারির আর মিছারির । শাঁখা সিন্দুর
আবার মিছা অয় নি ।
--- না কইয়ার ।
--- কিতা কইরায় ।
--- পাকিস্তানো যাওয়ার গির ডর দেখাও কেনে তে ।
--- আড়ুয়া বেটারে দেখানি লাগে ।
--- আড়ুয়া নানি । দেখবায় একবার সোজা অইয়া উঠি ।
তুমার ইতা কয়ফল আর রুজন্ট পাতার ঝোলে অইত নায়, মাইমলর লাগে মাছ । কাইল অউ পলো আর পেলইন লইয়া বার অইমু ।
আমার দেখার হাওরর মতো মাছ ভর্তি না থাকলে কিতা অইব চাতলাতও মাছ আছে নানানি বিনানি
। চেঙ মাছর ঝোল খাইলে দেখবায় নে কিলা ফালাইয়া উঠব ।
--- আর ফালানি লাগত নায় । যে ভব দেখাইছ । আর
লড়াচড়া না, বিছনা থাকি উঠবায় না এক্কেবারে ।
যেলাখান আছলায়, হতেড়ার লাখান পড়ি থাকো ।
--- আমি কুনু পুয়াতি নি বেটি ।
--- অয় তুমার পুয়া অইব । খালি হিকড় মাটি খাইবায় ।
--- পুয়া নায়, আমার পুড়ি অইব । পয়লা ঝি অইলে ছিকি বাইয়া ঘি পড়ে । হাচাউ
কইয়ার ঢঙ নায়, দিবায় নি এগু পুড়ি ।
দুর্বল শরীরের বৈতল আবেগে আরো দুর্বল হয় ।
দুর্গাবতীর হাত ছেড়ে পায়ে হাত দেয় । কাতর কণ্ঠে বলে,
--- দিবায় নি । কও না ।
--- ই রিফ্যুজি বস্তিত নি তুমার পুড়ি মানুষ অইত ।
--- না, কেনে অইত । তাইরে আমি ইস্কুলো পড়াইমু । মুক্তারর মরির বানাইমু । সিলেটো দেখছি
টাউনি পুড়িন্তর কী ফুটানি । ঠিক অউ কইছ । আমার পুড়ি রাজার লাখান মানুষ অইব । ইবার
দেখ আমার কেরামতি ।
বৈতল কেরামতির কথা বললেই দুর্গাবতী শঙ্কিত
হয় । মনে হয় গ্রামের সাদাসিধে পরোপকারী মানুষটা যে অচেনা হয়ে যাচ্ছে । শুধু
ধান্দাবাজির ফন্দি মাথায় । কিছুদিন থেকেই এক জমিদার বাড়ির কথা বলেছে বৈতল । বলেছে
আর বস্তির নোংরা বাড়িতে থাকতে হবে না । রাজবাড়িতে চলে যাবে । জাল নিয়ে বেরিয়েও
গেছে, ফিরে এসেছে দশ টাকা নিয়ে, যেদিন খালি হাতে হাসি মুখে ফেরে সেদিন সন্দেহ
হয় । দুর্গাবতী জানে শহরে এসে বদলে গেছে মানুষটা । দশ টাকা পাঁচ টাকার খেপ মারতে
যায় না নরসিংটোলা সাপনালা মালিনীবিল নসিবালি হাকিমের দিঘী কিংবা পদ্মবিলে । জালের
সঙ্গে একদিন বিষধর সাপও ভরে নিয়ে যায় থলিতে । বলে বেঙ্গল কেমিকেল থেকে সাপের বিষ
কিনবে, জ্যান্ত সাপ চাই । অনেক পয়সা
দেবে । যেদিন বিষধর সাপ নিয়ে বেরোয় বৈতল তার পর থেকে জাল নিয়ে বেরোনোও প্রায় বন্ধ
। মুসলমান মিস্ত্রির কাছে রিক্সার বরাত দিয়ে এসে বলে নাম রেখেছে এলাহি ভরসা ।
দুদিন পড়ে নাম পাল্টে হয় পক্ষীরাজ । বৈতল কথা লুকিয়ে রাখতে জানে না, দুর্গাবতীকে সব কথাই বলে, কিন্তু কিস্তিতে বলে । দুর্গাবতীও এক কিস্তি
শুনেই আঁচ করে নেয় পুরো কাহিনি ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন