।।পার্থ প্রতিম আচার্য।।
এই বিষয়ে আমার মত হোল যা বস্তুগত ভাবে আছে তাই দেখা
দরকার। কোন ব্যক্তি কি বলেছেন তার থেকে ও
গুরুত্বপূর্ণ হল ইতিহাস ও বর্তমান কি বলে । এই দুই দিক থেকে দেখলে দেখা যায় কাস্ট বা ক্লাস কোনটাই
উদ্ভাবন(invention)নয়
এগুলো আবিষ্কার(discovery) মাত্র । অর্থাৎ যা ছিল/আছে তারই নামকরণ মাত্র ।মানুষের
লিখিত ইতিহাস শুরু দাস আমলে ।উৎপাদন করতে যা লাগে যেমন জমি , চাষের হাতিয়ার সবই ছিল দাস মালিকের। দাসেরা শুধু
শ্রম দিত।এ তো বানানো গল্প নয় । ইতিহাস ।ভারতে
বর্ণবিভাজন ছিল। শূদ্ররা ক্ষত্রিয় , ব্রাহ্মণ
, বৈশ্যদের সেবক হিসেবে চিহ্নিত ছিল । ইতিহাসে/
প্রাচীন সাহিত্যে তা স্পষ্ট । প্রকৃত উৎপাদকের ভূমিকায় তারাই যে ছিল তাতে তাই
সন্দেহ নেই।অন্যদিকে শ্রেণি (class) শব্দটি যখন থেকে ব্যবহৃত হতে শুরু হয় তার দ্যোতনা
কি ?
শ্রেণি(CLASS) মানে কদাপি urban dictionary এর মতে
যা আছে মানে কেতাদুরস্ত কিছু নয় ।আজকালকার অনেকেই যা ভাবেন । উদাহরণ-He is so classy. বরং ক্লাস একটি আদ্যোপান্ত অর্থশাস্ত্রের ব্যবহৃত শব্দ।
উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে ব্যক্তি যে সম্পর্কে জড়িত তা
দিয়ে নির্দিষ্ট হয় তার শ্রেণি।মোটা দাগে শ্রেণি
বিভাজন করলে বলা চলে উৎপাদনের উপায় উপকরণ (আগের উদাহরণে যেমন জমি, কৃষি
কাজের হাতিয়ার ইত্যাদি) এর যারা মালিক তারা হোল মালিক/ শাসক শ্রেণি, অন্যদিকে যাদের এইসবের মালিকানা নেই শুধু আছে
শ্রম তারা হল দাস/শোষিত শ্রেণি।(এর
ভেতরে অনেক শ্রেণি বিভাজন থাকলেও মোদ্দা দুটো বিভাজনই এই আলোচনায় আনলাম) যদি বর্ণ ব্যবস্থা
থেকেও থাকে ( ১০০% ছিল ) তবু দেখা
যায় শ্রেণি বিভাজনের ভিত্তিতেই ঐ ব্যবস্থাকে ব্যাখ্যা করা যায় ।ঐ দাস সমাজকেও বিশ্লেষণ করা যায়। ইতিহাস দেখায় ঐ পর্যায় (ভারতেও দাস ব্যবস্থা যে ছিল তা শূদ্রকের নাটক মৃচ্ছকটিকম পড়লেই জানা
যায়)এবং তার পরবর্তী সামন্তীয় ভারতে ও
প্রধানত: বেদ , মনুসংহিতায় বর্ণিত শূদ্ররাই
ছিল শোষিত শ্রেণি।সেদিক দিয়ে ঐতিহাসিক বর্ণনাকার ক্লাস ও কাস্ট কে ভারতে একটা
পর্যায় পর্যন্ত এক করে দেখালে আপত্তি তেমন নেই।
কিন্তু সমাজ বিকাশের স্বাভাবিক নিয়ম হল সমাজ
কখনই স্থবির নয়।দাসরা কালের নিয়মে ভূমিদাস থেকে মজুরী দাসে বিবর্তিত হচ্ছে / হয়েছে।এই মজুর মালিক আর মজুরদাস এর
সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে যে সমাজ আমাদের
সামনে এখন আছে সমাজবিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছে পুঁজিবাদী সমাজ।এই সমাজে উৎপাদনের লক্ষ্য হল মুনাফা করা।এই সমাজে ভূমিদাসরা
দেখে ভূমি ছেড়ে কারখানায় এসে মজুরী করাটাই
অপেক্ষাকৃত আকর্ষণীয়।যারা বা ভূমি রেখে দেয় তাদেরও
উৎপাদনের মুল লক্ষ্য হয়ে উঠে উৎপাদন কে নিজস্ব ভোগের জন্য না রেখে বাজারজাত করা ।আমাদের চারপাশেও আমরা তাই দেখছি ।
বর্তমান ব্যবস্থা ক্রমশ: মুষ্টিমেয় মালিক আর ব্যাপক
মজুর দাসে সমাজকে বিভক্ত করে দিয়েছে/ দিচ্ছে ।এই প্রক্রিয়ায় সে ভেঙ্গে দিচ্ছে পূর্বের সমস্ত
সামাজিক রূপকেও। আঘাত
করেছে বর্ণ ব্যবস্থাকেও।পূর্বেকার
তথাকথিত উচ্চবর্ণের লোকদেরও প্রতি নিয়ত: টেনে নামাচ্ছে মজুরি দাসত্বে ।(মজুরী দাস মানে আপনার
আমার মত লোকেরা। উৎপাদকের কাছে আমাদের শ্রমশক্তি হল আলু
পটলের বা মোবাইল ফোনের মত পণ্য ।এখানেও সেই চাহিদা
যোগানের সূত্র ক্রিয়াশীল । বাজারে আলু বেশি থাকলে আলুর দাম কমে আবার উলটো পরিস্থিতিতে দাম বাড়ে ।আমাদের শ্রমশক্তিও
একই নিয়মে হরদম বিক্রি হচ্ছে ।) এই মজুর বাজারের পরিসংখ্যান তথ্যে একটু চোখ
রাখলেই দেখা যায় হর-বর্ণের মহাসমারোহ এই বাজারে
– ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়, বৈশ্য শূদ্রের মেলবন্ধন ঘটেছে মজুরী দাসত্বে ।উলটো দিকে মালিকের
শিবিরেও একই রূপ মেলবন্ধন।আপনার আমার চারপাশের
বাস্তব ছবিটা স্মরণ করুন কিম্বা নিদেন পক্ষে আপনি যেখানে কাজ করছেন তাকেই একটু বিশ্লেষণ করে
নিন । উপরের বক্তব্য কি সত্যি নয় ?
এবার বর্ণ প্রথা দিয়ে এটাকে আর খাপ খাওয়ানো যাচ্ছে না।বর্ণ
অনুযায়ী কর্মের যে প্রকার ভেদ তার সঙ্গে বর্ণ
ভুক্ত মানুষের কর্ম কে আপনি মেলাতে পারবেন না । অথচ শ্রেণি ভিত্তিক ভাবে সবাই কে অন্তর্ভুক্ত করতে
পারবেন । শ্রেণির মধ্যে সমাজের সকল মানুষকে স্পষ্ট
আত্তীকরণ সম্ভব কারণ এটা একটা All INCLUSIVE পদ্ধতি
।
তাহলে
কি বর্ণ শোষণ নেই ?
লক্ষ্য করবেন উপরের আলোচনায় আমি অনেকবার / চিহ্ন ব্যবহার করে হয়েছে / হচ্ছে ইত্যাদি
লিখেছি। এর মানে আমি ভারতীয় সমাজকে দেখছি একটা ‘গতির’ মধ্যে ।গতি হল সুতীব্র ভাবে পুঁজিবাদ অভিমুখে।পুঁজিবাদে
উৎপাদন হয়, যা আগেই বলেছি, মুনাফার লক্ষ্যে ।আজ পুঁজিবাদ সারা বিশ্ব
ব্যবস্থা। তার সামগ্রিক উৎপাদনের তুলনায়
ক্রয়ক্ষমতা সম্পন্ন ক্রেতা কম । এই অবস্থাকে বলে অতি উৎপাদন সংকট । ফলে পুঁজি বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে তাদের গতি শ্লথ।সকল
জায়গায় একই রকম বিকাশ পুঁজিবাদ করতে পারে না।
তাই কিছু অংশে সামন্তীয় অবশেষ রয়ে যায় ।কিন্তু সামগ্রিক গতিমুখ যেহেতু পুঁজিবাদের দিকে
ফলে সেই গুলো বিকাশের নিয়মে ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।পিছিয়ে
পড়া ঐ সব অঞ্চলের মানুষরাও ক্রমশ: মিশে যায় বাকিদের
সাথে।শহরমুখী যাত্রা তাকেই দেখায়।ফলে বর্ণ শোষণের বস্তুগত ভিত্তি নাই (objective
condition) থাকলেও তা অতি নগণ্য ।
কিন্তু বর্ণবাদ সম্পূর্ণ পিছু ছাড়েনি ।সমাজ বিজ্ঞানের
একটা অন্যতম দিক হল পরিকাঠামো ও উপরিকাঠামোর
সম্পর্ক।দেখা যায় পরিকাঠামোতে (মানে অর্থনীতিতে )পরিবর্তন
হয়ে গেলেও উপরিকাঠামো ( যার মধ্যে ব্যক্তি মানসিকতা ,আচার আচরণ ও রয়েছে) তে পরিবর্তন কিছু সময় নেয় ।উদাহরণ হিসেবে
বন্ধু নিলয় সরকারের ব্রাহ্মণের মড়া নামাতে গিয়ে
সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার কথা বলা যায়।এগুলি হল ফেলে
আসা সংস্কৃতির বিকৃত অবশেষ । শেষ বিচারে তার বন্ধু টি আর নিলয় একই শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে।এই অভিব্যক্তি গুলি এখন
ক্ষয়িষ্ণু অথবা টিকে আছে কেবল বৃদ্ধ পুরানো কিছু
মানুষের মধ্যে অবশেষ রূপে।
আর একটা কারণেও
বর্ণবাদ কে জেগে উঠতে দেখি আমরা।সেটার হোতা রাষ্ট্র এবং অনেক ক্ষেত্রেই তথাকথিত নিম্নবর্ণের উচ্চ স্তর (upper strata)।রাষ্ট্র কাজটা করে শ্রেণি ঐক্যে ভাঙ্গন আনতে আর ঐ বিশেষ
স্তরটি করে এটাকে কাজে লাগিয়ে সমাজে বিশেষ সুবিধা
নিতে ।শাসক শ্রেণির স্বার্থের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় শাসকরাও এতে ইন্ধন দেয়।উদাহরণ স্বরূপ শাসকের
রাজনৈতিক দলগুলো বেছে বেছে নির্দিষ্ট
অঞ্চলে কোন বর্ণের লোক বেশি সেই বর্ণের প্রার্থী দাড় করান , সে যে
শ্রেণিরই হোক না কেন । অথবা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে জনগণনায় কাস্ট এর ভিত্তিতে গণনা হয় ।ভারতে অর্থনৈতিক ভিত্তিতে কোন সংরক্ষণ
নেই; আছে জাত পাতের
নিরিখে ।
শেষ বিচারে বর্ণের কোন বস্তুগত ভিত্তি নেই দরকার
শ্রেণি চেতনার বিকাশ । যে সব বন্ধুরা
বলেছেন কাস্ট বা ক্লাস দুইটাই মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে তারা সকলেই আসলে মনে মনে চান এমন একটা সমাজ যেখানে
সবার পরিচয় মনুষ্যত্ব দিয়ে।কিন্তু যতদিন এক শ্রেণি উৎপাদনের উপায় উপকরণের উপর
মালিকানা বঞ্চিত থেকে যাবে ততদিন সাম্য আসতে পারে কি
? একই বনে বাঘ আর হরিণ সম অধিকারে বাঁচে ? “থাকিলে ডোবা খানা হবে কচুরি পানা/ বাঘে গরুতে
খানা একসাথে খাবে না”- তাই সাম্যবাদী ভাবনা ইউটোপিয়া দিয়ে বাস্তব হবেনা।এর
জন্যে দরকার নিজের শ্রেণি অবস্থানকে চেনা ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন