“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৭

বুকের ব্যথায় চাপা মলম যেন নাটক 'অগ্নিশুদ্ধি'




।।  জয়শ্রী ভূষণ ।।
      
(সাপ্তাহিক বরাককণ্ঠে প্রকাশিত)
      মার্চ
মাস,দম ফেলার ফুরসত নেই, সারাদিন যে কিভাবে কাটে টের পাইনা। তার মধ্যেই এই বসন্তেই অকাল বর্ষার সাথে ঝড়ের তাণ্ডব শুরু হয়ে গেছে । শিলচরের পথঘাট মিনি বন্যায়, প্রায় নিমজ্জ।
         ৩০শে মার্চ,২০১৭, প্রায় পৌনে সাতটায় কোনমতে, অফিস থেকে ঘরে গিয়ে আমার ছেলেকে বগলদাবা করে, ওকে ছাড়া কোথাও যেতে ভালো লাগে না, নাটক দেখতে তো আরো না,- সাথে ইয়া বড় লম্বা ছাতা, সঙ্গে চাদর ও সোয়েটার নিয়ে মেঘের তর্জন গর্জন অঝোর বৃষ্টি- ঝড় উপেক্ষা করে আমরা অবশেষে শিলচর জেলা গ্রন্থাগারে উপস্থিত হলাম নাটক দেখতে। ততক্ষণে প্রায় ৭টা বাজে বাজে। গিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, যাক নাটকটা শুরু হই হই করছে।ভীষণ রোমাঞ্চকর অনুভূতি নিয়ে অপেক্ষা করলাম, নাটক শুরু হওয়ার, শুরু হল নাটক  "অগ্নিশুদ্ধি'
            নাটক শেষ হওয়ার পরও মনে হচ্ছিল একটা ঘোরের মধ্যে আছি। চিত্রভানু ভৌমিক এবং দশরূপকের নাট্য উপস্থাপন মানেই বিশেষ ভাবে দর্শককে ভাবনার সাগরের ঢেউ এর দোলায় চাপিয়ে নিরুদ্দেশে পাঠিয়ে দেয়া। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। নাটক চলাকালীন বাইরে প্রকৃতির তাণ্ডব, বিদ্যুৎ চমক সহ বজ্রপাত, এবং তার সাথে মুষল ধারে বৃষ্টি, কোন কিছুই নাটক থেকে চোখ ও মন সরাতে দেয়নি।
           প্রায় দেড় ঘণ্টার পূর্ণাঙ্গ নাটক "অগ্নিশুদ্ধি' । অভিনয় করেছেন ২০জন অভিনেতা ও অভিনেত্রী। রচনা ও পরিচালনায় ছিলেন শ্রী চিত্রভানু ভৌমিক, রূপসজ্জায় অভিক সেনগুপ্ত, মঞ্চসজ্জার পরিকল্পনায় ছিলেন চিত্রভানু ভৌমিক এবং মঞ্চ রূপায়ণ ও সহযোগিতায় ছিলেন যথাক্রমে উত্তম ঘোষ ও দেবজ্যোতি রায়,আবহ দিয়েছেন অশোক রাজকুমার , আলোতে ছিলেন দেবজ্যোতি রায় ...প্রযোজনায় দশরূপক সাংস্কৃতিক সংস্থা শিলচর।
         এছাড়া প্রায় চল্লিশটি (৪০) বিভিন্ন চরিত্রায়নে ছিলেন -- মিমি(মেয়ে) নয়না চৌধুরী,বিভাস (ছেলে), মা- মিতালী রাজকুমারী,মিলন/আজাদ/সৈনিক বিনায়ক ভট্টাচার্য, ভজন/বাবু/করবাবু-জয়ন্ত বিকাশ পুরকায়স্থ, সহকারী জেইলার দীপক নাথ, চোর/অনিল সন্তোষ চক্রবর্তী, ডাক্তার/বিচারক- বিধান চৌধুরী, রমণী/মুকুন্দ-নাগশংকর চক্রবর্তী, গাওবুড়া/প্রহরী/প্রতিবেশী চিন্ময় চক্রবর্তী, হরি/পলু/বিশ্বাস বাবু- অশোক দত্ত,কামাল/আদি- অনির্বাণ রায়, বুড়া/চাকর/ গ্রামবাসী/ ব্রাহ্মণ সঞ্জীব দাস, নেতা- কৃষ্ণপদ গোস্বামী, উকিল /ধরবাবু বলরাম দে, ঘোষক/ বন্ধু শিব শঙ্কর দত্ত, বিয়োগ দত্ত/কীর্তি চন্দ্র শুভ্রেন্দু চক্রবর্তী, কৃষ্ণা শর্মা চিত্রাঙ্কনা ভৌমিক এবং প্রভাস দত্ত (বাবা) চিত্রভানু ভৌমিক।
          কোন দিকে যে দেড়টি ঘণ্টা উধাও হল তা আমি বুঝতেই পারিনি, টানটান উত্তেজনায়, ব্যথায়, রাগে ক্ষোভে নাট্যকারের সাথে দর্শকরা একাত্ম হয়ে গেছিলেন আমি নিশ্চিত। বিদেশী নোটিশের নামে যেভাবে সাধারণ মানুষকে হয়রানি, মানসিক ভাবে নির্যাতন, উৎপীড়ন ও হেনস্থা করা হচ্ছে, সেই বাস্তব তথ্য ও আনুষঙ্গিক বিষয়বস্তু নিয়েই লেখা হয়েছে নাটকটি। কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন নাট্যকার চিত্রভানু ভৌমিক নিজেই। দশরূপকের নতুন নাটকের জন্য আমি এবং দর্শকমহল চুম্বকের মত আকর্ষণ বোধ করে, এবং অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকে আমাদের মত নাটক পাগল দর্শক। নাট্যকার-নির্দেশক-পরিচালক-অভিনেতা চিত্রভানু, সামাজিক মূল্যবোধের সূক্ষ্ম সূচ দিয়ে আমাদের আবেগ ও বিবেককে যে ভাবে দংশন করেন, তাতে আমরা আত্মশুদ্ধি ও অগ্নি পরীক্ষার জন্য আমাদের মনের ভাবনার দোলায় সুদূর পথ পাড়ি দেই। চিত্রভানু ভৌমিকের নাটক, দর্শককে ভাবতে বাধ্য করে, এই খানেই দশরূপক ও চিত্রভানু এবং নাটকের যৌথ সার্থকতা। দশরূপক এর নাটকের বিষয়বস্তু এবং প্রয়োগ, এবং সর্বোপরি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নাটকের কথার গাঁথুনি, নাটক শেষে যে বার্তা উপসংহারে উপহার পায় দর্শক, তা আমাদের সমাজের সবার কাছে একটি আশার , নতুন করে বাঁচার, ভাবনার, একাত্ম হওয়ার উপায় যেন বাৎলে দেয়।
         উদ্বাস্তু, দেশভাগ, আসামের ভূমিপুত্র, ডি- ভোটার, খিলঞ্জিয়া, এন আর সি, বাংলাদেশী, ডিটেনশন ক্যাম্প, নির্বাসন, পুনর্বাসন, দেশী, বিদেশী, ইত্যাদি ইত্যাদি ............ইত্যাদি ইত্যাদি......সব কিছুর মুখোশ খুলে তার উপযুক্ত, জবাব, প্রতিরোধ, প্রত্যুত্তর, আমাদের নির্বোধ আবেগ ও রাজনৈতিক ও সামাজিক কুচক্রীদের যেন সজোরে চপেটাঘাত এই নাটক অগ্নিশুদ্ধি
        এই নাটক প্রমাণ করে দশরূপক শুধু মনোরঞ্জনের জন্য নাটক করে না , সামাজিক দায়বদ্ধতার গুরু দায়িত্ব বহন করে চলেছে এবং সসম্মানে সেই দায়িত্ব পালনে বারবার নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে,এই নাটক আবারও প্রমাণ করল, নাটক আমাদের প্রতিবাদের-প্রতিরোধের ভাষা ...হাতিয়ার...। বরাকের ইতিহাসে, নাট্য জগতের ইতিহাসে, ছিন্নমূলের সকল মানুষের জন্য এই নাটক একান্ত নিজের, বুকের চাপা ব্যথার মলম এই নাটক। এই নাটক অগ্নিশুদ্ধিএক অবিস্মরণীয় নাটক। এই নাটক শেষে, আমি নাট্যকার-নির্দেশক চিত্রভানু ভৌমিককে শুধু জোড় হাতে প্রণাম করেছি। তিনি সত্যি প্রনম্য।
         আজকের এই বিবরণ, এই নাটকের শুধু মিনিয়েচার। বিশদ ভাবে পরে আরো লিখবো। কিছুই যেন বলা হল না। শুধু সবাইকে এই অনুরোধ এই নাটকটি দেখুন, সবাই দেখুন। দশরূপকের পথ চলা আরও সুদূর প্রসারিত হোক।

কোন মন্তব্য নেই: