“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ১৫ এপ্রিল, ২০১৭

প্রজাতির উৎস সন্ধানে (একাদশ পর্ব) - উপসংহার

।। রজত কান্তি দাস।।

বারে একাদশ পর্বে উপসংহার লিখে এই ধারাবাহিককে আপাতত শেষ করব। এর উপসংহার লিখতে গিয়ে প্রথমেই যে কথাটা মনে আসছে তা হলো এই বিবর্তনবাদের সঙ্গে মানব সভ্যতার সম্পর্ক কি? আমি বলব বিশাল সম্পর্ক। কারণ এদিকে ডারউইনের তত্ত্বের সহায়তায় জীববিজ্ঞানে যে পরিবর্তন এসেছে তা বৈপ্লবিক। চিকিৎসা বিজ্ঞানেও ডারউইনের তত্ত্বের বিশাল প্রয়োগ কারণ আমাদের শরীরে এমন বহু ধরণের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আছে যেগুলোর কার্যকারিতা ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছে এই বিবর্তনবাদের আবিষ্কারের ফলে। এছাড়াও একটি যুক্তিবাদী সমাজ গড়ে তুলতে ডারউইনের বিবর্তনবাদ অসীম সহায়তা করেছে। মানুষকে স্বর্গলোক থেকে নামিয়ে এনে প্রকৃতিতে তার সঠিক অবস্থান নিরূপণে এই তত্ত্ব যে বিশাল ভূমিকা পালন করেছে তা অনস্বীকার্য। কারণ মানব সভ্যতা ততদিন উন্নতির শিখরে পৌঁছতে পারবে না যতদিন পর্যন্ত তার স্বপ্নের সৌধ থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তবের জমিতে পা রাখতে সক্ষম হচ্ছে না। এছাড়াও জন্মগত আভিজাত্যের খোলসকে ভেঙ্গে দিয়ে বিবর্তনবাদ মানুষকে যে ৩৫০ কোটি বছরের বিবর্তনের সম্মান এনে দিয়েছে এই সম্মান সমগ্র মানব জাতির যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। তাই বিবর্তনবাদের বহুল প্রচার আমাদের সকলেরই কাম্য। যারা সমাজের পশ্চাদপদতাকে হাতিয়ার করে নিজেদের রুটি সেঁকতে উদ্যোগী তাদের কথা আলাদা।
          এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায় যে চার্লস ডারউইন তো বেঁচে থাকার সংগ্রাম ও যোগ্যতমের টিকে থাকার কথাই বলেছেন। তাহলে কি জোর যার মুলুক তার’-এর মতো একটি বর্বর প্রথার জন্ম এই ডারউইনিজম থেকেই বেরিয়ে যাবে। বলা যায় যে এর আশঙ্কা অবশ্যই ছিল এবং এর চেষ্টাও হয়েছে। ডারউইনের মতবাদকে কাজে লাগিয়ে সাম্রাজ্যবাদ ও দাসত্ব প্রথার ন্যায্যতা প্রমাণ করার প্রচেষ্টা যে একেবারেই হয় নি তা নয়। আফ্রিকার দেশগুলিকে জবরদস্তি দখল করার পেছনেওসোশিয়েল ডারউইনিজমনামের একটি আদর্শের জন্ম দেওয়া হয়েছিল যা ভয়ানক ও বিপজ্জনক। উনবিংশ শতাব্দীতে ডারউইনিজমকে হাতিয়ার করে হারর্বাট স্পেনসর নামের এক ব্যক্তি এই আদর্শের জন্ম দিয়ে বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য ইউরোপীয় জাতিদের প্রোৎসাহিত করেন এবং এই ধরণের মতবাদ থেকে ফ্যাসিজমেরও জন্ম নিয়েছিল। তাই বিজ্ঞানের এই অপপ্রয়োগ যে হবে না তা গ্যারেন্টি দিয়ে বলা যায় না। তবে গণতন্ত্রের প্রসারের ফলে এই সব মতবাদ আজ আস্তাকুঁড়ে ঠাঁই নিয়েছে।
          এই সোশিয়েল ডারউইনিজমের বিরুদ্ধে সবচাইতে যুক্তিপূর্ণ যে লেখাটি আমি পড়েছিলাম তা লিখেছেন মার্ক্সবাদের অন্যতম স্রষ্টা ফ্রেডরিখ অ্যাঙ্গেলস। তিনি লিখেছেন ডারউইনের তত্ত্ব মানব সমাজের জন্য প্রযোজ্য নয়। কারণ ডারউইন যে সমস্ত প্রাণীদের বিবর্তনের কথা লিখেছেন তারা নিষ্ক্রিয়ভাবে (Passive) বেঁচে থাকে। যদি প্রকৃতিতে খাদ্য থাকে তাহলে বাঁচবে নয়ত না খেয়ে মরে যাবে। যদি প্রকৃতিতে বাসস্থানের সংকুলান না থাকে তাহলে ঝড়, জল, বৃষ্টি কিংবা প্রখর রৌদ্রতাপের হাত থেকে বাঁচার জন্য অন্যত্র চলে যাবে। কিন্তু মানুষ এই পৃথিবীতে সক্রিয়ভাবে (active) বেঁচে থাকে। যদি প্রকৃতিতে খাদ্য অপ্রতুল হয় তাহলে সে খাদ্য উৎপাদন করে নেবে। যদি বাসস্থান না থাকে তাহলে সে তা তৈরি করে নেবে। তাই ডারউইনিজমকে আশ্রয় করে প্রকৃতিকে বোঝা যায় ঠিকই কিন্তু মানব সমাজের জন্য এর নিয়ম গ্রাহ্য নয়।
          এখন প্রশ্ন হলো যে তাহলে কি মানব প্রজাতির বিবর্তন হবে না। আমি বলব অবশ্যই হবে তবে তা ডারউইনের তত্ত্ব মেনে হবে না। এর কারণ হলো ডারউইনের তত্ত্বে আমরা পেয়েছি যে প্রত্যেক প্রাণীই প্রচুর পরিমাণে সন্তানের জন্ম দেয় অথচ সমস্ত সন্তানের জন্য প্রকৃতিতে খাদ্য ও বাসস্থান পর্যাপ্ত পরিমাণে না থাকার কারণে প্রকৃতি কেবল যোগ্যতমকেই টিকিয়ে রাখে যাদের বেঁচে থাকার জন্য অনুকূল শারীরিক ও মানসিক গঠন থাকে। কিন্তু মানব সমাজ তার পশুবৃত্তিকে ত্যাগ করে জন্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে খাদ্য ও বাসস্থানের উপযোগী করে সন্তানের জন্ম দেয় এবং শিক্ষাদীক্ষার অগ্রসরতায় এই প্রবণতা বাড়ছে ও আরো বাড়বে। একটা সময়ে এই পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার প্রায় শূন্যের কাছাকাছি এসে ঠেকবে বলে সমাজ বিজ্ঞানীদের ধারণা। এক্ষেত্রে ডারউইনের থিওরি কাজে আসছে না।
          এছাড়া ডারউইনের মতবাদ থেকে আমরা জেনেছি যে যারা অধিক পরিমাণে খাদ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম তারা অধিক সন্তানের জন্ম দিতে পারে তাই পরবর্তী প্রজন্মে অনুকূল শারীরিক গঠন সম্পন্ন সন্তানের সংখ্যা বাড়তে থাকে। কিন্তু মানব সমাজে এর বিপরীত চিত্রই চোখে পড়ে। এখানে যাদের কাছে খাদ্য সংগ্রহের সুযোগ কম তাদের সন্তানের সংখ্যা বেশি। যাদের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ আছে তাদের সন্তানের সংখ্যা কম। তাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে প্রতিটি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি নানা ধরণের সমস্যায় ভুগছে। এই শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের দায়িত্ব তাদের মা-বাবারা নিতে না পারায় সরকারকে নিতে হচ্ছে। সরকারের হাতেও পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থের জোগান নেই। থাকলেও নানা কারণে তা যথাযথভাবে খরচ হয় না। তাই প্রতিকূল স্বাস্থ্য ও পরিবেশের মধ্যেই অধিক পরিমাণে মানুষকে বসবাস করতে হচ্ছে। অর্থাৎ প্রকৃতিতে যা ঘটে মানব সমাজে তার বিপরীতটাই ঘটছে।
           মানব সমাজ খাদ্য উৎপাদনের উপর ভরসা করে যেখানে পশু সমাজ খাদ্যের জন্য প্রাকৃতিক জোগানের উপর। তাই ডারউইনের তত্ত্বের ভিত্তিতে মানব প্রজাতির বিবর্তন হয়ে মনুষ্যতর প্রজাতির জন্ম নেবে এটা আশা করা যায় না ঠিকই কিন্তু বিবর্তন তো হবেই। এই বিবর্তন হবে উৎকর্ষকে কেন্দ্র করে, শুধুমাত্র টিকে থাকার জন্য নয়। পশুপাখি কিংবা গাছপালার লড়াই যেখানে শুধুমাত্র টিকে থাকার জন্য সেখানে মানুষের টিকে থাকার সংগ্রামকে জিতে নেওয়ার পর এই সংগ্রাম হবে উৎকর্ষের জন্য। এছাড়াও বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে মানুষ আজ জিনতত্ত্বকে জেনে নিয়ে জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিঙের সাহায্যে মানুষের জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে সুপার রেসের কথা ভাবছে। আগামী একশ বছরের মধ্যে এই কাজে সাফল্য আসার সম্ভাবনা প্রবল। তাই ৩৫০ কোটি বছরের প্রচেষ্টায় প্রকৃতি যে মানব প্রজাতির জন্ম দিয়েছে সেই মানব প্রজাতি হয়ত তার নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী এমন প্রজাতির জন্ম দেবে যাদের মনুষ্যেতর প্রজাতি হিসেবে কল্পনা করা যেতে পারে।
           পরিশেষে একটা কথাই বলব যে বেঁচে থাকার লড়ায়ে শুধুমাত্র যোগ্যতমের টিকে থাকাটা হলো প্রকৃতির নিয়ম। এই নিয়মের বিরুদ্ধে লড়াই করার অন্য নাম হলো সভ্যতা। (শেষ)

কোন মন্তব্য নেই: