“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৭

যৌন-নির্যাতন বনাম নারীর জীবন-সংগ্রাম


 ।। শিবানী দে।।

যোরহাটের মেয়ে শুভলক্ষ্মী তার নির্যাতনের কাহিনী ফেসবুকে প্রকাশ  করে আধুনিক সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছিল । এইধরনের ঘটনা বেশির ভাগ মেয়েদের জীবনে ঘটে, কিন্তু খুব বেশি সাড়া ফেলে না । এরকম তো কতই হয়জাতীয় দার্শনিকতায় লোকে পাশ কাটায় । ফেসবুকের মত মাধ্যম থাকাতে শুভলক্ষ্মী (অবশ্যই তার সাহস প্রশংসনীয়) যা পেরেছে, তা ফেসবুকের আগের যুগের মেয়েদের সম্ভব ছিল না । গ্রামে গঞ্জে শহরে মেয়েরা সর্বক্ষেত্রে এগোচ্ছে বটে, কিন্তু তাদের বেশির ভাগকেই প্রতিনিয়ত এই ধরনের অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং হচ্ছে । শ্লীলতাহানি এবং ধর্ষণের ভয় মেয়েদের জীবনসংগ্রামের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ  

অনেকবছর আগে কলেজ থেকে বাসে গ্রামের বাড়িতে ফিরবার পথে আমারও শুভলক্ষ্মীর মতই এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়েছিল ভিড়ের বাসে নির্ভয়ে পরিচিত লোকেদের মধ্যে কোনোরকমে বসেছি, এমন সময় হঠাৎ বাসের আলো নিভে গেল। আর তখনি ভিড়ের মধ্য থেকে বেরিয়ে এলো লোমশ হাত আমার বুকের উপর, আঙ্গুল চলতে থাকল, চটকাতে থাকল শাড়ি ব্লাউজের উপর দিয়ে, আমি ব্যাগ বুকের উপর চেপে ধরার চেষ্টা করতে লাগলাম, লোমশ পরুষ হাত সরিয়ে দেবার চেষ্টা করতে থাকলাম। ভিড়ের ঠেলা চারদিক থেকে, একটু নড়বার উপায় নেই, দুজনের সিটে তিনজন বসা, নিরুপায় হতাশ লাগছিল, হাতটা আমার বুকের উপর যা ইচ্ছে করে যাচ্ছিল । পুরো চল্লিশটা মিনিট এভাবে কাটার পর যখন নামলাম, তখন প্রায় বিধ্বস্তবাসস্টপে দশ  বছর বয়সের ছোটভাই হারিকেন নিয়ে এসেছে এগিয়ে নিয়ে যেতে, বড় ভরসা মনে হল তাকেও, যদিও এতদিন তার এগিয়ে আসাকে আমি আমার মায়ের উদ্বেগের বাড়াবাড়ি বলেই ধরতাম । এর আগে অবধি ভাবতেও পারিনি এমন হতে পারে---- বাসে বেশির ভাগ লোকই পরিচিত, তাদের কেউ আমার শ্লীলতাহানি করতে পারে। ও, শ্লীলতাহানি শব্দটাই তখন অপরিচিত । বাড়ি ফিরে কাউকেও বলতে পারিনি, মাকেও নয়, কোনো সহপাঠী বান্ধবীকেও নয়,  লজ্জা--- লজ্জা--- কী করে বলব আমার শরীর কেউ লালসায় ছুঁয়েছে, ভোগ করার চেষ্টা করেছেআরেকটা কারণেও মাকে বলতে পারিনি কথাটা, বাবার কানে উঠলে বাবা যদি কলেজ যাওয়া বন্ধ করে দেয়----বড় জেদ করে কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম কিনা।  সেই সময়ে গ্রামের মেয়েদের স্কুলের দোর পেরোনোই অনেক বড় ব্যাপার ছিল, কলেজে তো অনেক কম মেয়েই যেতে           পেত। আমি সেই সুযোগ  পেয়েছি, সেটাকে হারাতে চাই না্‌, নিজের সমস্যা নিজেকেই বুঝে নিতে হবে, তাই ভয়াবহ হলেও সেই অভিজ্ঞতার কথা বলে নিকটজনদের উদ্বেগে, সমস্যায় ফেলতে চাইছিলাম না। পরেও এই ধরনের ঘটনা আরো কয়েকবার ঘটেছে, তবে অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হচ্ছিলাম । কিন্তু উপদেশের জন্য, সাহায্যের জন্য বলতে পারিনি কাউকে, সেই যুদ্ধ ছিল একান্তই নিজস্ব । মেয়েরা সংখ্যায় কম বেরোত, সংঘবদ্ধ হবার উপায় ছিল না । অভিভাবকরা ছিলেন বড় দুর্বল, থানাপুলিশ করা সম্ভব ছিল না, জানাজানি হওয়া মানেই সম্মানহানি । বন্ধ করে রাখাই মেয়েদের বাঁচানোর ও পরিবারের সম্মানরক্ষার একমাত্র পথ বলে ভাবতেন ।
 আমার মেয়েরা যখন নাবালিকা, তাদের ক্ষেত্রেও এধরণের ঘটনা কিছুকিছু ঘটেছিলতারা স্কুল থেকে ফিরে এসে আমাকে বলেছে তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথাতাদের তো আমার মত পড়া বাদ যাবার ভয় নেই । আমি স্কুলের কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি, নিজে ওদের সঙ্গে গিয়েছি । সাবধান করেছি আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে । কিন্তু তারপরও  স্কুলের পর বাড়ি ফিরে খেলার মাঠে  ঘটেছে, সন্ধ্যায় প্রাইভেট ট্যুইশানে যেতে, সাইকেল চালাতে গিয়ে  ঘটেছে কত দেখে রাখব ? গায়ে হাত দিয়ে ঠেলে সাইকেল থেকে ফেলে দেবার পর বড় মেয়ে  সাইকেল চালাতে যেতে ভয় পেত । সেই অপেক্ষাকৃত আধুনিক সময়ে  আমাদের  ছোটবেলার সময়কার মা-বাবাদের মত তাদের বাড়িতে আটকে  রাখার প্রশ্ন ছিল না তাই তাদের সাবধান করেছি, কিন্তু সাবধান করাও তো আরেকরকমের আটকে রাখা, নির্ভার আনন্দময় জীবন উপভোগ করা থেকে বিরত থাকতে বলা, কারণ তারা মেয়ে!
একসময় ভাবতাম, রাস্তায় চলতে থাকা মেয়েদের দিকে অশ্লীল কথা ছুঁড়ে দিয়ে,  মেয়েদের শরীরে হাত দিয়ে, যারা আনন্দ পায়, তারা অসভ্য, সমাজবিরোধী । কিন্তু ব্যাপার হল, যাদের আমরা শিক্ষিত সভ্য বলি, তাদের মধ্যেও অনেককে  প্রায় এই ধরণের আচরণ করতে দেখেছি। মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকা, কিছু দেওয়া নেওয়ার অছিলায় তাকে ছুঁয়ে দেওয়া, সুযোগ পেলেই গা ঘেঁষে দাঁড়ানো কিংবা গায়ের উপর ঢলে পড়া, এইধরনের ছোঁকছোকানি আমি আমার পুরুষ আত্মীয়, সহকর্মী,পরিচিত, অনাত্মীয় সহযাত্রী অনেকের মধ্যেই পেয়েছি,দেখেছি। এইধরনের আচরণের পর তাদের চোখে দেখেছি উদ্ধত উল্লাস।এইসব পুরুষের নিজস্ব কথাবার্তা যদি কখনো কানে এসেছে, বোঝা গেছে এরা সাধারণত মেয়েদের সমালোচক, বিশেষ করে যে সমস্ত মেয়ে বাইরের কর্মক্ষেত্রে এসেছে তাদের, এবং কম ক্ষেত্রেই সহায়ক । যদি কখনো সহায়তা করে, তার বিনিময়ে শরীর  চায়। এদেরই  অনেকে আবার মনে করে, পুরুষমানুষ গায়ে হাত দিলে নাকি মেয়েটির সুখ হয় ! মানে এদের ধারণায়, মেয়েরা সব পুরুষের কাছেই শুধু যৌনসুখ চায়, শুধু লজ্জা সংকোচের ভান করে না না করে  ---- মেয়ে মাত্রই ছেনালি (অমার্জিত ভাষা মাফ করবেন) করে ! নামানে না এই দৃঢ় প্রত্যয়ী উচ্চারণ তখনো শোনা যায়নি, কারণ নারীর কণ্ঠস্বর ছিল ক্ষীণ । 

তবে আগে মেয়েরা যেহেতু কম বেরোত, সমাজ ছিল আবদ্ধ, মেয়েদের প্রতি যৌন অত্যাচারের ঘটনা শোনা যেত  কম । চার-দেওয়ালের ভেতরে ঘটনা বড় কম ঘটত না,মাসিপিসিদের ফিসফিসানি কথাবার্তার মধ্যে টের পাওয়া যেতকিন্তু সবই ঢাকাঢাকি চাপাচুপির ব্যাপার।নালিশ সালিশি থানাপুলিশ কিছুর ব্যাপারই ছিলনা, অত্যাচারিত মেয়েরা, ঘরে হোক বা বাইরে, দীর্ঘশ্বাস, চোখের জল ফেলে সহ্য করত, না পারলে  গলায় দড়ি কিংবা পুকুরে ডুবে মরত, কিন্তু বিদ্রোহ করলে অভিভাবকরাই পুকুরে ডোবানো, গলায় দড়ি বা গায়ে আগুনের ব্যবস্থা করে দিত, কেউ তার আঁচ পেলেও প্রতিবাদ বড় একটা উঠত না, কারণ অনুরূপ পরিস্থিতিতে যে কোনো জনকেই পড়তে হতে পারে,আর সকলেরই ইজ্জতের ভয় আছে!আর,তখন গোটা দেশেই সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা ছিল নগণ্য । যেটুকু ছিল, তার সবটাই  শহরে, এবং তা ছাপার মাধ্যমে;  বৈদ্যুতিন মাধ্যমের ব্যাপারই ছিল না । 
           আমাদের সমাজের চিরকালীন ধারণা হল, নারীর জীবনে ইজ্জতএর বাড়া আর কিছুই নেই । ইজ্জতমানে  যৌন শুদ্ধতা । নারীকে শরীর রাখতে হবে পবিত্র, তার যোনি অক্ষত রাখতে হবে যতদিন না তার সঙ্গে বিয়ে হওয়া স্বামী এসে তার কুমারীত্ব ভঙ্গ করে।বিবাহিত হলে তার শরীরের মালিক তার স্বামী । পরিবারের পক্ষে, সমাজের পক্ষে সেটা-ই সম্মান।কিন্তু সেই ইজ্জত,সেই সম্মান রাখার দায়িত্ব  নারীরই। নষ্ট হওয়া মানে পুরো পরিবারের সম্মান নষ্ট হওয়া।তাই তাকে বাড়াবাড়ি করতে নেই, তাকে গণ্ডির মধ্যে ঘোরাফেরা করতে হয়।বাড়াবাড়ি করলে  ইজ্জত নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া হতে পারে।সেইজন্য অনেক সমাজে তাকে হত্যা করাতেও দোষ নেই--- এমনই সেসব সমাজের বিধান।আবার,ব্যক্তি,পরিবার,সমাজ,গোষ্ঠী, রাষ্ট্র ----এদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ঘটলেই বিপক্ষকে পর্যুদস্ত করার অন্যতম প্রধান অস্ত্র হল বিপক্ষের নারীর ইজ্জতহরণএকক ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র--- কেউই এই অস্ত্র ব্যবহার করতে কুণ্ঠিত হয় না । নারীধর্ষণ মানে বিপক্ষের সম্মানের মূলে কুঠারাঘাত ।
সেজন্য সমাজের নিদান হল  সম্মান রক্ষার জন্য মেয়েটিকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেওয়া, তাকে ঘরে আটকে রাখা, বাইরে বেরোতে হলে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়া, যাতে তৃতীয় কারো আওতায় নারীটি না চলে যায়; আর এতো ঝামেলায় কাজ কি বাপু! কন্যাভ্রূণ হত্যা করলে তো সব ল্যাঠা চুকে যায়তাই দেশে পুরুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে, মেয়ের সংখ্যা দিন দিন কমতে থাকে ।  যৌনবুভুক্ষু পুরুষেরা শ্লীলতাহানি, ধর্ষণে মাতে  
 একটি মেয়েকে তো সারা জীবনই সতর্ক থাকতে হয় কখন কোথা থেকে মাংসলোলুপ হায়নার দল তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে  সে সারা গা ঢাকা পোশাক পরুক আর ফ্যাশনেবল খোলামেলা পোশাকই পরুক, তার বয়স চার বছর হোক বা চার কুড়ি । সবসময়ই সে ভোগ্যবস্তু! ভোগ শেষ হলে  হয়তো  তার গলায় নেমে আসবে আততায়ীর আঙ্গুল, গলা টিপে খুন করে রাস্তার ধারে বা আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে তার নগ্ন নিথর দেহ। পুলিশ,নেতা,অভিভাবক সকলেই বলবেন, ভাববেন, মেয়েটি কি নির্দোষ ছিল ? সে কি ঠিকঠাক পোশাক পরেছিল ? সে কেন নির্জন রাস্তা দিয়ে একা একা যাচ্ছিল? সে কেন রাতে বেরিয়েছিল? সে নিশ্চয়ই বেশি কথা বলেছিল, টিটকিরি বা ছুঁড়ে দেওয়া কথার জবাব দিচ্ছিল, মাথা নুইয়ে চলে এলে এমনটা ঘটত না । মানে, শ্লীলতাহানি বা ধর্ষিত হবার জন্য দোষ মূলত তারই । সে-ই গণ্ডী অতিক্রম করেছিল তবে শিশু বা বৃদ্ধা যখন ধর্ষিতা হয় তখন এই জ্ঞানীরা মুখে কুলুপ আঁটে । এইসব লোকই তখন দেখে নেয় নির্যাতিত শিশু বা বৃদ্ধাটি কোন জাত গোষ্ঠী বা ধর্মের, যেন অন্য জাত গোষ্ঠী বা ধর্মের হলে নারীনির্যাতনকারীর অপরাধ কম হয়ে যায় ! 
সেই কারণেই দেখা যায় যে শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণ হলে পুলিশের কেস নিতে অনীহা, উলটে নির্যাতিতাকেই অপমান করা নেতাদের অমৃতবচন--- মেয়েটির চরিত্র ঠিক তো ? অমুক সময় অমুক জায়গায় একা (কিংবা বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে হলে দোকা ও) যাওয়া উচিত হয় নি একবার তো এক ধর্মগুরু মেয়েদের ধর্ষকের হাত থেকে বাঁচবার জন্য বিশেষ মন্ত্র উচ্চারণের নিদান দিয়েছিলেন, উক্ত মন্ত্রটি বললে নাকি ধর্ষকের মনে ভ্রাতৃভাব জেগে উঠত নিশ্চিত ---- (মেয়েটি দুর্ভাগ্যবশত সেই মন্ত্র জানত না) মেয়েটি তা জানত না কেন?!  অন্যদিকে, পশ্চিমবাংলায় কোনোও নেতা বিরোধীদলকে সবক শেখানোর জন্য নিজের দলের ছেলেদের বিরোধীঘরে ঢুকিয়ে দেবার হুমকিও দিয়েছিলেন । এইজন্য তাঁর কোনো শাস্তি হয়নি। 
 যতই আইন কানুন থাক, মেয়েদের উপর অত্যাচারের প্রতিকারের ক্ষেত্রে তার সিকিভাগও লাগু হয় না । যতই থানার সংখ্যা বাড়ুক, পুলিশের সংখ্যা বাড়ুক, কেস নেওয়া হয়না, অপরাধী ধরা পড়েনা, আদালত পর্যন্ত পৌছা তো দূরস্থান । মেয়ে মানেই পরিবার, সমাজ, প্রশাসন----সকলের কাছেই ঝামেলা, মজাটুকুর সময়টা ছাড়া । 
পুরুষ জানে, সংসারে তাকে ছাড়া চলবে না, সে যত অপরাধ করে আসুক না কেন, সে তার মা-বাপের বংশধর, তাদের ভবিষ্যৎ । কাজেই সে অপরাধী হলেও মাফ পেয়ে যাবে । বিবাহিত হলে, তার উপার্জনে সংসার চলে, কাজেই তার বিয়ে করা বৌ যে হয়তো এক বা একাধিক সন্তানের মা, তাকে সহজে ছাড়তে পারবে না । সেজন্য ন্যক্কারজনক অপরাধ করেও  সে তার পরিবারের সমর্থন পায় । প্রাথমিক সমর্থনটুকু পেয়ে তার মনের জোর বাড়ে, সে থানা কোর্টের মোকাবিলা করে, অনেক সময় ছাড়ও পেয়ে যায় ।
আর আমাদের দেশে ঘরে ঘরে পুরুষ সন্তানের  জন্য কি আকুলতা ।  ছেলে জন্মের পর মা-বাবা পরিজন নিজেদের কি ভাগ্যবান মনে করে, পরিবারের মেয়েটির তুলনায় তার যত্ন বেশি, খাদ্য বেশি, আদর বেশি দেওয়া হয়, ফলে কথায় কথায় তার বায়নাক্কাও বেশি । যেখানে খাওয়াদাওয়া বা শিক্ষার পার্থক্য করা হয়না, সেখানেও  মেয়েটির চালচলনের, চলাফেরার গণ্ডি বেঁধে দেওয়া হয় ।  পরিবারে, সমাজে, সবসময়ই ছেলেটি  প্রশ্রয় পায়, অনেক সময়ই তার মারাত্মক দুষ্টুমিও মাফ করে দেওয়া হয়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মায়েরা নিজেকে ছেলের জন্ম দিয়ে পরম সৌভাগ্যবতী মনে করেন, ছেলেটির জন্মের পর মা বংশজননী হয়ে ওঠেন কিনা । মেয়েটি যেমনই হোক পরের ঘরে যাবে । স্বাভাবিক ভাবে ছেলেটি নিজেকে সব কিছু পাবার অধিকারী ভাবে।  মেয়ের তুলনায় তাকে বেশি প্রশ্রয় দেবার জন্য সে নিজেকে মেয়েদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ভাবে । গায়ের জোর যেহেতু তার জন্মগত ভাবেই বেশি, সে সবকিছুকেই জোর করে পেতে চায় । বয়ঃসন্ধিতে যখন তার যৌন চেতনা জেগে ওঠে, তখন নীতিশিক্ষা না থাকলে, সুস্থ সঙ্গ না পেলে সে উদ্দাম হয়ে ওঠে ।  বয়সের ধর্মে বিপরীত লিঙ্গের শরীরের প্রতি কৌতূহল স্বাভাবিক। কিন্তু স্বভাবকে বশীভূত করার, অনুচিত-উচিতের শিক্ষা না পাওয়ায়  সে নারীশরীর গায়ের জোর খাটিয়ে দখল করতে চায়   আমাদের বাজারচলতি সিনেমাগুলো বা আজকালকার টিভি সিরিয়ালগুলোতে সব সময়ই মেয়েদের যৌনতার প্রতীক বলেই দেখানো হয়, দেখানো হয় যে প্রেমের ক্ষেত্রে পুরুষের কথাই প্রথম, পুরুষ চাইলে  মেয়েটিকে কোনো না কোনোভাবে বশীভূত করে । এইধরনের সিনেমা-সিরিয়ালের উদাহরণ ও  ছেলেটির মনে প্রভাব ফেলে । সে সেভাবেই একটি মেয়েকে প্রেম নিবেদন করে, নিজের যোগ্যতা হয়তো তার তথাকথিত পুরুষত্বটির বেশি নয়। কিন্তু মেয়েটি তাকে গ্রাহ্য না করলে তার পৌরুষিক অভিমান মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, সেই অভিমানের মূল কথাই হল মেয়েটিকে তাকে অবহেলার জন্য উচিত শিক্ষা দেওয়া । তখন তার মত  আরো দুচার জন সহচর জুটলে তারা শ্লীলতাহানি, অ্যাসিড ছোড়া, গণধর্ষণের মত  দুষ্কর্ম করতে ও পিছপা হয় না । বাধা দিলে পৈশাচিক অত্যাচার, প্রমাণ লোপাটের জন্য খুন সবই এদের দ্বারা হতে পারে । 
এই ক্রমবর্ধমান শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণের ঘটনার ফলশ্রুতিতে আইন বানানো  হচ্ছে কঠিন থেকে কঠিনতর পুলিশের দায়বদ্ধতা বাড়ানো হচ্ছে  কিন্তু পুলিশ দিয়ে সমাজের ক্রমবর্ধমান এই অপরাধের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কি সম্পূর্ণ সম্ভব ? পুলিশ তো এই সমাজেরই লোক । দরকার হল মানসিকতার পরিবর্তন । ঘরে ঘরে মা-বাবা  পরিবার যদি পুত্রসন্তানের জন্য কন্যাসন্তানকে অবহেলা না করেন, শিশুবয়স থেকেই পুত্র ও কন্যাকে একই মাপকাঠিতে মানুষ করেন, বাড়ির,  সমাজের, এবং তার বাইরেরও অন্যান্য মেয়েদের যথোচিত সম্মানজনক ব্যবহার করেন, তা হলে ছেলেটির মেয়েদের অসম্মান করার মন তৈরি হবে না । স্কুলের শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য ।  পাঠ্যপুস্তকে যেন নারীদের হেয় করে দেখানো বন্ধ হয় । সহশিক্ষার স্কুলের সংখ্যা বাড়ানো উচিত, যাতে শিশুবয়স থেকেই ছেলেমেয়েরা পরস্পর মেলামেশা করতে পারে । তাহলে বিপরীত লিঙ্গ সম্পর্কে অনাবশ্যক কৌতূহল কম হবে । 
আর সমাজে তথাকথিত ইজ্জতকে নারীর আত্মসম্মানের একমাত্র মাপকাঠি বলে দেখানো বন্ধ হোক শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণকে হত্যা বা অঙ্গহানিকারক শারীরিক নিপীড়নের মানদণ্ডে বিচার করা হোক, কিন্তু সম্মানকে আলাদা রেখে । ধর্ষণকে নারীর আপন, বা পারিবারিক বা সামাজিক সম্মানের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার কারণে পৃথিবীজুড়ে মেয়েদের প্রতি অত্যাচার বেড়ে যাচ্ছে বলে আমার মনে হয় ।  ধর্মশাস্ত্রগুলোতে  মেয়েদের ক্ষেত্র বলা হয়, আর পুরুষ বীজদাতা । তাই আগেকার যুগে পুরুষ যত ক্ষেত্র অধিকার করে তার বীজ বপন করতে পারত, ততই তার প্রতিপত্তি, এবং সেই থেকেই যৌন নিপীড়ন নারীর বিরুদ্ধে পুরুষের সর্বশেষ অস্ত্র । এখনকার উন্নত চিকিৎসাশাস্ত্রের যুগে সেই প্রোথিত বীজকে যখন নষ্ট বা উপড়ে ফেলা যায়,  তখন ধর্ষণকে সম্মানহানির আলাদা গুরুত্ব না দিয়ে  অঙ্গহানিকর অপরাধের সমানতায় ফেললে ধর্ষকের  ক্ষেত্র-অধিকারের অহংকার থাকবে না । ধর্ষিতাও  স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে, যেভাবে কোনো ডাকাতের ভোজালির কোপে জখম হওয়া বা সন্ত্রাসীর বোমার আঘাতে হাত-পা উড়ে যাওয়া গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত জনও যেভাবে জীবন যাপন করতে পারে, কোনো অসম্মানের ভয় ছাড়াই । 


কোন মন্তব্য নেই: