“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৭

গানমেলা ২০১৬-১৭





।। জয়শ্রী ভূষণ ।। 

(লিখেছিলাম গেল বছরের শেষেই। এমনি পড়েছিল। ফলে মূল বিষয়টি যদিও পুরোনো হয়ে গেছে, মানে  "গানমেলা ২০১৬-১৭' হয়ে গেছে, তবু তার কিছু কথা পুরোনো হবার নয় বলে, ব্লগে পড়তে দিলাম।---লেখিকা। )


          গানের ভেলায় বেলা অবেলায় সমকাল শিলচরস্বরলিপি সাংস্কৃতিক সংস্থার যৌথ প্রয়াসে গানমেলা ২০১৬-১৭ এবার গুটিগুটি পায়ে পাঁচ বছরে পা দিল। ২০১২-১৩ তে ৩১ এ ডিসেম্বর ও ১ পয়লা জানুয়ারি ২০১৩ এ দুই দিনের অনুষ্ঠানে , প্রথম গানমেলা আরম্ভ হয়।
             প্রতিবারের মত এবারেও নতুন ঔৎসুকতা নিয়ে একদিন বর্ধিত হয়ে ৩০, ৩১ শে ডিসেম্বর ও ১পয়লা জানুয়ারি ২০১৭ শুরু হতে যাচ্ছে এবারের গানমেলা । প্রতিবারের মত এবারেও সকাল ১০টা থেকে শুরু হয়ে চলবে প্রতিদিন রাত্রি ১২টা পর্যন্ত । সবার খোলা আমন্ত্রণ। এ এক অন্য অনুভূতি। ভিন্ন মাত্রা যোগ করে যেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গান শুধু গান, ভিন্ন স্বাদের গান, জারি সারী, কীর্তন, কোরাস, কচিকাঁচাদের মজার গান থেকে শুরু করে রবীন্দ্র সঙ্গীতের টপ্পাঙ্গের গান - রাগাশ্রয়ী কিছুই বাদ যায় না।
            এ এক অন্য দুনিয়া মনে হয়, সত্যি গানের ভেলায় যেন মন মজে উঠে, অন্য রকম অনুভূতি-- শুধুই একটু অনুররণ , সেভাবে ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। একই মঞ্চে একের পর এক শিল্পী, বিচিত্র শৈল্পিক বিশিষ্টতা নিয়ে সত্যি মনের দুয়ারে এক ভাবাবেগের দোলাচলের সূচনা করে বললে ভুল হবে না। এই মঞ্চ এক বিশাল মাঠ যেন, সত্যি গানের মেলা, আয় কে কোনটা শুনবি, কোনটা ছেড়ে কোনটা শুনি, উঠে আসতে মন চায় না। গতবারও গান শুনে শুনে ভাবছিলাম, এত শিল্পী, এত রকমের গান, শুধু এই অঞ্চলে, তাও আবার একই সাথে। সান্ধ্য অনুষ্ঠান তো এ অঞ্চলের সব বাঘা বাঘা শিল্পীদের জন্য
          একই মঞ্চে একই সাথে, ব্রাত্য বরাকের গুণী শিল্পীদের এরকম একটি মঞ্চ ও এই গানের মিলন যজ্ঞ রচনার জন্য সমকাল ও স্বরলিপির আয়োজন শুধু সাধুবাদ নয়, আয়োজকদের এই প্রয়াস বরাকের বরাকীয়ানার স্বকীয়তা বজায়ের পথে ষোল আনা ভাগীদারের জন্য বরাকবাসী সমকালস্বরলিপির প্রতি চির কৃতজ্ঞ । কৃতজ্ঞ এই জন্য স্রোতের বিপরীতে গিয়ে ৩১ সে ডিসেম্বর ও ১ পয়লা জানুয়ারি এরকম একটি অনুষ্ঠান করার অভিনব উদ্যোগ নেওয়ার জন্য ও অবশ্যই সফলতার জন্য। এই উদ্যম যেন আরও দীর্ঘ স্থায়ী হয়, এবং এই মেলা যেন আরও অনেক অনেক পথ অতিক্রম করে শুভেচ্ছা রইল।
           
       
  ইদানীং কেন জানি না মনে হয়, আমাদের বাংলা প্রীতি যেন এখানকার মনসা পূজার প্রসেসনের মত ...পূজা তো হয়, আর বাদ বাকী সব ককটেল......আমাদের ভাষা প্রীতিটাও যেন কেমন একটা জগাখিচুড়ি গুবলেট ব্যাপার...।বেশীরভাগ অভিভাবকরা আমার ছেলেমেয়েরা তো বাংলা জানে না বলে এমন এক তৃপ্তির শ্বাস ফেলেন, সে দেখে হাসব না কি করব ঠিক বুঝে উঠতে পারি না এখনো......। জন্মের পর কথা শেখার আগেই... অই দেখো পাইন আপেল-অই দেকো বাবা স্কাই অথবা বেনানা শেখানোর প্রচেষ্টা দেখলে ও শুনলে পিত্তি জলে ...কিছুতেই বুঝতে পারি না, আনারস-আকাশ অথবা কলা শব্দগুলো আগে জানলে কি অসুবিধা, বা জীবনে সফলতায় কোন বাঁধা আসবে। এমনকি ঘরে যে মেয়েটি কাজ করত...সে এসে একদিন জানান দিল, ... “দিদি আমার মাইয়ারে ইংলিশ মিডিয়াম ইস্কুলো ৫০০০ টাকা দিয়া ভর্তি করাই দিছি”...... শুনেই রাগে কটমট করে বল্লাম, “ কেনে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়লে কিতা মাথাত মঠ উটবনি”...... । যুগের সাথে হুজুগে তাল মেলাতে আবারও কতগুলি টাকা ধার করল,এ নিয়ে ক্যাঁচক্যাঁচ করলাম ঠিকই,কিন্তু এসবই অরণ্যে রোদন। বাংলা মিডিয়ামে পড়লে ইংলিশ জানবেনা, বা বাংলা মিডিয়ামে পড়া ভালো না, এই উদ্ভট উদ্ভট আইডিয়া গুলো কোথা থেকে যে আমদানি হয় এবং কি করে যে বেশীর ভাগের মস্তিষ্কের চিপ এ সেট হয়ে গেছে, আজও বোধগম্য হল না তবে কেন মহামূর্খের মত নিজের পায়ে কুড়াল মারছি, এনিয়ে ফোরাম ফর সোসিয়েল জাস্টিস রীতিমত গবেষণা মূলক কাজ করছে। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ ছাড়া, এই বিষয়গুলো নিয়ে কারও ভাববার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। কয়েকদিন আগে শিলচরের মহিলা কলেজে খিলঞ্জিয়ানিয়ে সম্মিলিত সংস্কৃতি মঞ্চের ব্যবস্থাপনায় বরাকের প্রায় সমস্ত সংস্থার উপস্থিতিতে একটি গণ- কনভেনশনে শ্রী তপোধীর ভট্টাচার্য বলছিলেন আমাদের চিন্তন শিবিরের আয়োজন করা উচিত। শুনে খুব ভালো লেগেছিল, ঠিকই সাধারণ থেকে অতি সাধারণ যারা আমরা, চিন্তা শক্তি হারিয়ে ফেলেছি, আশেপাশে যা ঘটছে তার নকল করতেই আমরা ব্যস্ত,তা সেই বোকা বাক্সই বলুন বা রুপোলি পর্দা , বলিউড অথবা হলিউড...। নিজেদের সত্ত্বা হারিয়ে আমরা উদ্দাম হয়েছি, কে কার থেকে বেশী আগে নিজেকে অন্য দেশের, অন্য প্রদেশের জন্য পরিণত ভাবে প্রস্তুত করতে পারি... কথায় ,ভাষায়, পোশাকে কিংবা আদব কায়দায় । আমরা যেন ঠিক করে নিয়েছি, কিছুতে আর আমরা আমাতে সীমাবদ্ধ থাকব না...নিজেকে হারানো প্রতিযোগিতায় আমরা মত্ত খেলছি নিজের সত্ত্বাকে-শেকড়কে উপরে ফেলতে । আমার কথাগুলো হেঁয়ালির মত লাগলে ও, কথাগুলি খুবই সত্যি, মানুন চায় না মানুন। আমরা আমাদের ইতিহাস, ১৮৭৪,১৯৪৭,১৯৫২,১৯৬১ ১৯৮৬, ১৯৯৬ এগুলো নিয়ে বিস্মৃতির অতল গভীরে নিমজ্জিত। কিন্তু এই অপ্রতুলতার মাঝেও সূর্যের কিরণের ঝলকের মত আশার কথা যে তিনসুকিয়াতে কিন্তু রীতিমত ষষ্ঠ উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় বাংলা ছোট পত্রিকা (লিটল ম্যাগাজিন) সম্মেলন ২০১৬ মহা ধূমধামের সাথে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল।
            ......যদিও অনেক বছর আগের কথা, মনে হল আপনাদের সাথে ভাগ করে নিই, পয়লা বৈশাখের আগের অফিসে কিছু দিদিরা কেন ছুটি নেই সেই নিয়ে দুঃখ করছিলেন, শুনতে শুনতে মিটি মিটি হাসতে হাসতে দোতলায় একটি কাজে উঠেই সিনিয়র এক দিদিকে আগাম শুভেচ্ছা জানাতেই...পাল্টা শুভেচ্ছা না জানিয়ে তিনি বলে দিলেন, পয়লা বৈশাখ শুধুই আমাদের উৎসব। আমি হেসে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে শেষমেশ এটা আর বোঝাতে পারলাম না, পয়লা বৈশাখ আমাদের সব বাঙ্গালীর উৎসব। এবার বড়দিনে আমি প্রথম শিলচরে চার্চে গেছিলাম, আমার চার্চ গির্জা খুব ভাল লাগে। গিয়ে দেখলাম, জনসমুদ্র সব ধর্মের মানুষই ছিল, ভাল লাগলো খুব। এভাবেই যেন আমরা তোমরা ছেড়ে সবাই নিজের মত করে নিজেদের সত্ত্বাকে বাঁচিয়ে রেখে সবাই পরব পুজো- ফেস্টিভ কে উৎসবে রূপান্তরিত করতে থাকি।
             সব ধরনের উৎসবেই আমরা মাতব, আনন্দ করব, তাতে কারোর আপত্তি করা বা থাকা উচিত নয়, কিন্তু বেশ কিছু বছর ধরে ইংরেজি নববর্ষের আগে উদ্দামতা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল, ... ডিসেম্বর মাস আসলেই নতুন প্রজন্মের উদ্দাম, বেলাগাম, উৎশৃঙ্খল ব্যস্ততা, পিকনিক, লেট নাইট পার্টি,বাইককে রকেট ভেবে উড়তে গিয়ে অকাল মৃত্যুএগুলো কিন্তু চৈত্র মাসে প্রি- পয়লা বৈশাখে আমরা পাই না। ডিসেম্বর এর এই উদ্বেলপনাকে কিছুটা বাগে আনতে সমকাল স্বরলিপি গানমেলায় সবাইকে জড়িয়ে এক নতুন উৎসবের সূচনা এই অকাল বোধন আমার কাছে রীতিমত এডভেঞ্চারাস, রোমাঞ্চকর।
             এই রোমাঞ্চকর অভিযান আরও বৃহত্তর হোক এই কামনা রইল, সবার সাথে দেখা হবে ডি এস এর মাঠে, স্বাদ নেব বিভিন্ন ভাষাভাষীর পিঠেপুলিরও, খাওয়ার স্টল, বিভিন্ন রকমের স্টলও থাকবে, গতবার তো গান শুনতে শুনতে শীতের রাতে খিচুরিও খেয়েছিলাম। বরাকের বিভিন্ন শিল্পীদের সাথে কলকাতা, ত্রিপুরা, আসামের বিভিন্ন স্থান যেমন লামডিং , গৌহাটির ও শিল্পীদের গান শোনা যাবে এবারের গান মেলায়। ২০১৬ শেষ ও ২০১৭ টা গান মেলায় গানের আড্ডা এবারও খুব জমবে ভাল।

কোন মন্তব্য নেই: