।। অশোকানন্দ রায়বর্ধন।।
(C)Image:ছবি |
আমাদের দেশে হাতে গোনা যে কয়টি উৎসব
প্রায় সব প্রদেশেই অনুষ্ঠিত
হয় তার মধ্যে একটি হল দোল উৎসব ৷ এটি প্রদেশভেদে নানা নামে প্রচলিত ৷ তার মধ্যে দোল ও হোলি
সর্বাধিক প্রচলিত ৷ এটি মূলত
রঙের উৎসব ৷ ঋতুর
উৎসব ৷ বসন্তোৎসব ৷ বসন্তের দখিন সমীরণে দোলায় প্রিয়জনকে মনের রঙে রাঙিয়ে দেওয়ার জন্যে
সমাজশৃঙ্খলার কিঞ্চিৎ শৈথিল্যের সদ্ব্যবহার করেন তরুণ তরুণীরা ৷ নবযৌবনপ্রাপ্ত নরনারীর
মদনোৎসবের সমাজস্বীকৃতির নিদর্শন এই অনুষ্ঠান ৷ এক অর্থে প্রাচীন কৌমসমাজের যৌনাচারমূলক অনুষ্ঠানও
এই হোলি ৷ কালক্রমে
রাধাকৃষ্ণের প্রণয়োপাখ্যানে উল্লিখিত অনুষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত হয়ে বৈষ্ণবীয় অনুষ্ঠানে
রূপান্তরিত হয়ে গেছে ৷ দোল বা হোলিকে কেন্দ্র করে দু তিনটি পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত আছে ৷
প্রথমটি দোলযাত্রার পূর্বদিন পালিত বহ্ন্যুৎসব বা হোলিকা দহন ৷ দ্বিতীয়টি ফাল্গুনী পূর্ণিমা
তিথিতে পালিত রাধাকৃষ্ণের
দোলযাত্রা ৷
স্কন্দপুরাণের ফাল্গুনমাহাত্ম্য অংশে হোলিকা ও
প্রহ্লাদের উপাখ্যান রয়েছে ৷ হোলিকা
ছিলেন মহর্ষি কশ্যপ ও তাঁর স্ত্রী দিতির পুত্র হিরণ্যকশিপুর ভগ্নী ৷ দেবতার বরে
হিরণ্যকশিপু দেব ও মানববিজয়ী
হয়ে দেবতাদের অবজ্ঞা করতে শুরু করলেন ৷ তাঁর পুত্র প্রহ্লাদ ছিলেন বিষ্ণুভক্ত ৷তিনি বিষ্ণুকে পিতার
উপরে স্থান দেন ৷ এতে ক্ষিপ্ত হয়ে হিরণ্যকশিপু পুত্র প্রহ্লাদকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার আদেশ দেন
৷ দাদার আদেশে
ভগ্নী হোলিকা প্রহ্লাদকে নিয়ে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করেন ৷ বিষ্ণুর কৃপায়
প্রহ্লাদ বেঁচে যান কিন্তু হোলিকা অগ্নিতে দগ্ধ হয়ে যান ৷ হোলিকার আগুনে দগ্ধ হবার কাহিনি
অবলম্বনে হোলির আগের দিন বহ্ন্যুৎসব ' হোলিকা
দহন' বা 'মেড়া পোড়ানো' হয়
৷
এই উৎসবের উৎস প্রসঙ্গে রাধাকৃষ্ণের কাহিনিটিও
সুপ্রচলিত ৷ শ্রীকৃষ্ণ একদিন বৃন্দাবনে শ্রীরাধা ও তাঁর সখীগণের সঙ্গে খেলা
করছিলেন ৷ সে সময় অকস্মাৎ শ্রীমতী রাধা রজঃস্বলা হয়ে পড়েন ৷ ঘটনার আকস্মিকতায়
রাধা সখীদের ও ব্রজবালকদের সামনে যাতে বিব্রত বোধ না করেন সেজন্যে রাধার লজ্জা ঢাকতে শ্রীকৃষ্ণ
বুদ্ধি করে সখীদের
সঙ্গে আবির খেলতে শুরু করেন ৷ এই ঘটনাকে স্মরণ করে হোলি উৎসব পালন করা হয় ৷এই কাহিনিরই
একটু রকমফের রয়েছে অন্য আর একটি পুরাণে ৷ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে, ব্রহ্মার আদেশে প্রথমবারের মতো কৃষ্ণের
কাছে নিজেকে
সমর্পণ করে রাধা ৷শ্রীকৃষ্ণ রাধার সঙ্গে রতিলীলায় মত্ত হলেন ৷ সারারাত কামসূত্রের
চৌষট্টি কলায় মথিত করলেন শ্রীমতী রাধিকাকে ৷ আবেগঘনাবস্থায় শ্রীকৃষ্ণের দশন ও
নখরাঘাতে এবং কৌমার্যখন্ডনে শ্রীমতী এমন রক্তাক্ত হলেন যে সকালে লজ্জায় কুঞ্জ
থেকে বেরুতে পারছিলেন না ৷ উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে র জন্যে শ্রীকৃষ্ণ উপস্থিত বুদ্ধি প্রয়োগ করে
তাঁর অনুগতদের
রং নিয়ে খেলার আদেশ দিলেন ৷ সকলে যখন রঙের খেলায় মত্ত সেইসময়ে রাধিকা বেরিয়ে এসে
বাড়ি ফিরলেন ৷ রঙের উৎসবের উৎসকেন্দ্রিক আরও একটি মিথ পাওয়া যায় ৷ সেটিও কৃষ্ণকে নিয়েই ৷
ছোটোবেলায় রাক্ষসী পুতনার দুধ পান করে শ্রীকৃষ্ণের গাত্রবর্ণ নীল হয়ে যায় ৷ যৌবনবয়সে শ্রীকৃষ্ণ যখন
দেখলেন তাঁর গায়ের
রঙ নীল আর রাধিকার গায়ের রঙ গৌরবর্ণ ৷ তখন শ্রীকৃষ্ণ হীনন্মন্যতায় ভুগছিলেন ৷ (
স্মর্তব্য: যশোমতী
মাইয়া সে বোলে নন্দলালা /রাধা কিঁউ গোরী, ম্যয়
কিঁউ কালা) ৷ তাঁর এই অবস্থা
কাটানোর জন্যে মাতা যশোদা শ্রীকৃষ্ণকে উপদেশ দিলেন তাঁর ইচ্ছেমতো রঙে রাধাকে রাঙিয়ে দিতে ৷ রাধার
গায়ে মুখে শ্রীকৃষ্ণের
রঙ লাগানো থেকেই হোলির সৃষ্টি ৷ অন্যদিকে বসন্তপূর্ণিমার এই দিনে শ্রীকৃষ্ণ কেশি নামে অসুরকে বধ
করেন ৷ কোথাও অরিষ্টাসুরকে বধ করার কথা আছে ৷কোথাও আবার পুতনা রাক্ষসীকে বধের
কথা উল্লেখ করা হয়েছে ৷ আবার এই তিথিতে চৈতন্য মহাপ্রভু জন্মগ্রহণ করেন বলে এই তিথিকে
গৌরপূর্ণিমা বলে ৷
প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে হোলির বহু
বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে ৷ শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণে বসন্তরাসের বর্ণনা আছে ৷ অন্যত্র 'রঙ্গ' নামক উৎসবের বর্ণনা পাওয়া যায় ৷ হর্ষের প্রিয়দর্শিকা ও
রত্নাবলী এবং কালিদাসের কুমারসম্ভব ও মালবিকাগ্নিমিত্রমে
ও বসন্তোৎসবের উল্লেখ আছে ৷ কালিদাসের ঋতুসংহার এ পুরো একটি সর্গে বসন্তোৎসবের বিবরণ
রয়েছে ৷ ভারবি, মাঘ এবং অন্য কয়েকজন
কবিও কাব্যে
বসন্ত বর্ণনা করেন ৷ নারদপুরাণ, ভবিষ্যপুরাণ
ও জৈমিনী মীমাংসায় রঙের
উৎসবের বিবরণ পাওয়া যায় ৷ তিন শো খ্রিস্টাব্দের এক শিলালিপিতে রাজা হর্ষবর্ধন কর্তৃক
হোলিকোৎসব পালনের উল্লেখ পাওয়া যায় ৷বাৎস্যায়নের কামসূত্র রচিত হয়েছিল তৃতীয়-চতুর্থ শতকে ৷ তাতে
এই উৎসবের উল্লেখ আছে ৷এখানে দোলায় বসে আমোদ প্রমোদের উল্লেখ পাই ৷ চতুর্থ শতকের শেষ দিকে এই হোলি
উৎসবকে শবরস্বামী
তাঁর দর্শনশাস্ত্রে বর্ণনা করে গেছেন 'হোলক
উৎসব' নামে ৷ সপ্তম শতকে রচিত রত্নাবলী
এবং অষ্টম শতকের মালতীমাধব নাটকেও বসন্তোৎসবের বর্ণনা পাওয়া যায় ৷ জীমূতবাহনের কালবিবেক ছাড়া
ষোড়শ শতকের রচিত রঘুনন্দন গ্রন্থেও এই উৎসবের বর্ণনা রয়েছে ৷ আল বেরুনির বিবরণে জানা যায়
মধ্যযুগে কোনো
কোনো অঞ্চলে মুসলমানরাও হোলিকোৎসবে সামিল হতেন ৷
কবি বিদ্যাপতি থেকে শুরু করে সুরদাস, রহিম,পদ্মাকর,জায়সী,মীরাবাই,কবীর এবং বিহারী, কেশব,ঘনানন্দ প্রমুখ অনেক কবির প্রিয় বিষয় ছিল বসন্ত ৷ মহাকবি সুরদাস বসন্ত ও হোলির উপর আটাত্তরটির মতো পদ রচনা করেছিলেন ৷ এ ছাড়া সুফি সন্ত হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া, আমির খসরু এবং বাহাদুর শাহ জাফর প্রভৃতি মুসলমান কবিগণও হোলিবিষয়ক সুন্দর পদ রচনা করেন ৷ এ থেকে অনুভব করা যায় যে দোলযাত্রা একটি ধর্মনিরপেক্ষ অনুষ্ঠানও বটে ৷আর এক্ষেত্রে অনুষ্ঠানটিকে আধুনিকতায় নিয়ে দাঁড় করান কবি সার্বভৌম রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে বসন্তোৎসব পালন প্রবর্তন করে ৷ যৌবনোচ্ছ্বল উল্লাসের পাশাপাশি সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে তুলে ধরার এক অনন্য অনুষ্ঠান ও উৎসব এই হোলি ৷
কবি বিদ্যাপতি থেকে শুরু করে সুরদাস, রহিম,পদ্মাকর,জায়সী,মীরাবাই,কবীর এবং বিহারী, কেশব,ঘনানন্দ প্রমুখ অনেক কবির প্রিয় বিষয় ছিল বসন্ত ৷ মহাকবি সুরদাস বসন্ত ও হোলির উপর আটাত্তরটির মতো পদ রচনা করেছিলেন ৷ এ ছাড়া সুফি সন্ত হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া, আমির খসরু এবং বাহাদুর শাহ জাফর প্রভৃতি মুসলমান কবিগণও হোলিবিষয়ক সুন্দর পদ রচনা করেন ৷ এ থেকে অনুভব করা যায় যে দোলযাত্রা একটি ধর্মনিরপেক্ষ অনুষ্ঠানও বটে ৷আর এক্ষেত্রে অনুষ্ঠানটিকে আধুনিকতায় নিয়ে দাঁড় করান কবি সার্বভৌম রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে বসন্তোৎসব পালন প্রবর্তন করে ৷ যৌবনোচ্ছ্বল উল্লাসের পাশাপাশি সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে তুলে ধরার এক অনন্য অনুষ্ঠান ও উৎসব এই হোলি ৷
তথ্যসূত্র: ১. পূজাপার্বনের উৎসকথা - ড. পল্লব সেনগুপ্ত
২.শ্রীরাধার ক্রমবিকাশ - শশিভূষণ দাশগুপ্ত ৷
৩. সাক্ষাৎকার সংগ্রহ - কবিয়াল শান্তিপদ নাথ ৷বিজয়নগর, সাব্রুম, দক্ষিণ ত্রিপুরা ৷
৪. কিছু হোলিগানের নিজস্ব সংগ্রহ ৷
২.শ্রীরাধার ক্রমবিকাশ - শশিভূষণ দাশগুপ্ত ৷
৩. সাক্ষাৎকার সংগ্রহ - কবিয়াল শান্তিপদ নাথ ৷বিজয়নগর, সাব্রুম, দক্ষিণ ত্রিপুরা ৷
৪. কিছু হোলিগানের নিজস্ব সংগ্রহ ৷
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন