।। সুদীপ নাথ।।
(লেখাটি গেলবারে বেরিয়েছিল দৈনিক সংবাদে) |
পুরুষতান্ত্রিক
রাষ্ট্র ব্যবস্থা বারবারই নারীদের কণ্ঠ রোধ করতে চেয়েছে। বলতে চেয়েছে, নারীদের রাষ্ট্রের কাজে হস্তক্ষেপের আকাঙ্ক্ষা
বাতুলতা মাত্র। নারীদের ভোটাধিকারের বিরুদ্ধে অনেক পুরুষ শিল্পী কার্টুন ছবি
পর্যন্ত এঁকেছেন। সমানাধিকারের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম পথিকৃত হিসেবে
বিবেচিত রাষ্ট্র আমেরিকাতেও নারীদের ভোট দেয়ার অধিকার আদায় করে নেয়ার জন্য রীতিমতো
সংগ্রাম করতে হয়েছিল। আমেরিকা নারীদের ভোটাধিকার অনুমোদন করে ১৯২০ সালে, আর ফ্রান্স অনুমোদন করে ১৯৪৪ সালে, ইটালি ১৯৪৬ সালে, গ্রীস ১৯৫২ সালে, সুইজারল্যান্ড ১৯৭১ সালে। ভারতে নারীদের
ভোটাধিকার স্বাধীনতার সময়েই চালু হয়ে যায়। এদিকে সৌদি আরব মাত্র দুই বছর হল ২০১৫
সালে তাদের দেশে মহিলাদের ভোটাধিকার দিয়েছে।
এর থেকে এটা
স্পষ্ট যে, মহিলারা সবেমাত্র
রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ গ্রহণ সুরু করেছে। কিন্তু ইতিহাস অন্য কথা বলে। ইতিহাস
পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, প্রাক-সামন্ততান্ত্রিক
সমাজ ব্যবস্থায় মহিলারা সামাজিক কাজে ভোটাধিকারের ভিত্তিতে অংশ নিতে পারত। এটা
কোনো সুদূর অতীতের কথা নয়। এখনো অজস্র ট্রাইবের সমাজ পরিচালনায় মহিলাদের
সমানাধিকার সমানে চলছে।
ত্রিপুরার ইতিহাস
পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ত্রিপুরায় মিশ্র
জনগোষ্ঠীতে সতিদাহ এবং সহমরণ প্রথার মতো হিংস্র প্রথাও চালু ছিল। সমগ্র ভারতে
সতীদাহ বেআইনি ঘোষনার অর্ধ শতাব্দি পরেও এই রাজ্যে তা চালু ছিল। আর সহমরণ
ত্রিপুরার ভারতে যোগদানের সময় অব্দি বেআইনি ছিল না। তাছাড়া মহিলাদের ডাইনী আখ্যা
দিয়ে হত্যা এখনো সমানে চলছে। ইতিহাস বই ঘাটলে দেখা যায়, অতীতে পুরাতন আগরতলায় ত্রিপুরার রাজন্য শাসকেরা
নাকি মহিলাদের কেউ ডাইনী তথা ছেকাল কিনা তা পরীক্ষা করে দেখার বন্দোবস্ত করত।
ছেকাল সন্দেহভাজনদের হাত পা বেঁধে পুকুরে ফেলে দেয়া হত। যারা এমতাবস্থায় জলে ভেসে
থাকতো, তাদের ছেকাল বলেই
সন্দেহ করা হতো। আর যারা ডুবে যেতো তাদের মুক্তি দেয়া হতো। চাকমা ভাষায় ছেকালকে
‘ভাড়াল’ বলা হয়ে থাকে। এরা নাকি তথাকথিত সপ্ত-ডাইনীর মন্ত্র জানে।
যাইহোক, আসলে পরিবার বা সমাজে নারীর কোন একক মৌলিক
অবস্থান নেই। নেই নিজস্ব ভাবনা চিন্তা, ইচ্ছা অনিচ্ছা প্রকাশ করার সুযোগ ও শক্তি। আজ পর্যন্ত মহিলা সংক্রান্ত যত
সালিশী সভা হয়েছে, সালিশ
কর্তাব্যক্তিদের শাস্তির কালো হাত নারীর দিকেই আগ্রাসিত হয়েছে। নারির চরিত্রে যার
যেমন খুশি রঙ ঢালছে। ইচ্ছে হলে মুছে দিচ্ছে। তাইত সালিশী বিচারের রায়ে নারীর
শরীরকে ভোগে পাঠাচ্ছে, চুল কেটে গ্রাম
ঘোরাচ্ছে, একঘরে করছে,
প্রকাশ্যে পিছমোড়া করে
বেঁধে বেধড়ক পিটিয়ে হাড়গোড় ভেঙ্গে দিচ্ছে। প্রেমের সম্পর্কের শারীরিক উৎসব কিংবা
সন্তানের দায়ভার তথা অপরাধও নারীর। যত পাপ তা কেবল নারীর।
স্বাধীনতার
সুদীর্ঘ সাত দশক পরও নির্মম সত্য হল, আমাদের দেশ এখনো এদিক থেকে একটি পশ্চাৎপদ দেশ। আমাদের এসব পশ্চাৎপদতা
সামগ্রিক। নানা ভাবে পশ্চাৎপদ ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-চেতনা-মূল্যবোধ আমাদের বিশাল
জনগোষ্ঠীকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তাছাড়া ঐতিহ্যগত ভাবেও অনেক কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস আমাদের সমাজে বিদ্যমান। পশ্চাৎপদতার এই দুষ্ঠচক্র ভাঙ্গতে না পারলে আমাদের সামাজিক মুক্তি অসম্ভব ।
আমরা সমাজবদ্ধ
জীব। আমাদের নিরাপত্তা সামাজিক পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। সমাজে যখন প্রতিযোগীতা,
প্রতিদ্বন্দ্বিতা,
স্বার্থ-সঙ্ঘাত বেশি থাকে,
তখন স্বভাবতই মানুষের মনে
ভয় ভাবনা ও নিরাপত্তা নিয়ে নানা দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে। এ ছাড়া যদি ধর্মোন্মাদনা,
জাত্যাভিমান, ভাষা ভিত্তিক আন্দোলন তীব্র হয়, তখন মানুষ অতি
মাত্রায় উত্তেজিত হয়ে থাকার ফলে তার প্রভাব অন্যত্রও পড়ে। তাছাড়া বাড়ি-ঘরে কেউ
নিপিড়নের শিকার হলে, সেই রাগ অন্যের
উপর উষ্মা প্রকাশে সহায়ক ভুমিকা পালন করে। যেমন হোষ্টেলে সিনিয়র ছাত্ররা রিগিং করে
নবাগত ছাত্রদের উপর আরো বেশি করে তাদের অবদমিত জিঘাংসা মেটাতে। এই সব ঘটনা কেবল
এটাই প্রমাণ করে যে, এ সমাজ ভেঙ্গে
যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌছেছে।
অথচ গভীর দুঃখের
সাথে লক্ষ্য করা যায় যে, আইনের এত কড়াকড়ি স্বত্ত্বেও ধর্ষনসহ নানা ধরণের নারী নির্যাতন সামান্যতম বন্ধ তো হয়ই নি, উল্টো ক্রমেই বেড়ে চলেছে। প্রায় প্রতিটি
ক্ষেত্রেই পুলিশের সহযোগিতা পাচ্ছেন না নির্যাতিত মেয়েটি বা তাঁর পরিবার। খবরগুলো
পড়ে রাগ, ক্রোধ আর নিজের
সমাজের প্রতি আক্রোশই কেবল বাড়ছেই বাড়ছে সবার। এমতাবস্থায়, কোথায় গিয়ে
দাঁড়াবে আমাদের এই দেশ ? ভাবতে গেলে কেমন যেন, একটা অনিশ্চয়তা মনে দানা বাঁধে।
আমাদের দেশে নারী
নির্যাতন ও তার প্রতিকার নিয়ে প্রকাশিত নানা প্রবন্ধ-নিবন্ধ, টক্-শো, সভা-সেমিনারের পাশাপাশি প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক
মিডিয়াতে যে সব আলোচনা হচ্ছে, সেখানে অধিকাংশ
আলোচনাতে বিষয়টাকে কেবল আইন-শৃঙ্খলাজনিত সমস্যা হিসাবে দেখানো হচ্ছে। নির্যাতনের
ধরণ, সংখ্যা, তা অবদমনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর
ভূমিকা ইত্যাদি বিষয়ই আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে। কিন্তু বিষয়টিকে মনস্তাত্ত্বিক ও
সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে, অর্থাৎ
সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে দেখার প্রবণতা তেমনটি দেখা যাচ্ছে না।
সরকার ফলাও করে প্রচার করেছে যে, আমাদের দেশের
প্রতি পাঁচ জনে একজন করে মানসিক ভারসাম্যহীন। তাই অনেক ঘটনার পিছনে যে মানসিক
রোগের কারণে উদ্ভ্রান্তের মত আচরণ ক্রিয়াশীল নয় তার গ্যারান্টি কোথায় ? পশ্চিমা দেশে যেকোন অপরাধের পিছনে মনরোগ আছে
কিনা তা খতিয়ে দেখা বাধ্যতামূলক। সেখানে “ফরেনসিক সাইকিয়াট্রি” একটি অতি
গুরুত্ত্বপূর্ণ সাবজেক্ট হিসেবেই বিবেচিত হয়।
সমাজে এখনও
মহিলারা পুরুষের সম্পত্তি বলেই বিবেচিতা হয়। কোথাও কোথাও বিবাহিত মহিলাদের
হাসবেন্ডকে মালিক বলা হয়। আমাদের সমাজে কর্তা, পতি, স্বামী এইসব শব্দেই হাজবেন্ডদের বোঝানো হয়। মহিলারা পুরুষের নিকট নৈবদ্য ছাড়া
আর কি ? বিয়ে যে একটা
সামাজিক সম্পর্ক, তা এখনকার
বুদ্ধিজীবীরা ভেবেও দেখেনা। বলতে গেলে অনেক কথাই বলতে হয়। ধর্ষন থেকে শুরু করে
যেকোন নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে যততুকু না আমরা গর্জে উঠি, ঠিক ততটুকুই আমরা নীরব নিষ্ক্রিয় থাকি এই
মালিকানার প্রশ্নে। মহিলারা তাই আক্রান্তের দলেই থেকে যাচ্ছে সুদূর অতীত থেকে।
আমাদের সমাজে
নারী এখনো পিতা-স্বামী-পুত্রের উপর চুড়ান্তভাবে নির্ভরশীল। তাই তাদের সিংহভাগ
একবার শোষিত-নির্যাতিত হচ্ছে শ্রেণীগত ভাবে, আবার হচ্ছে লিঙ্গ বৈষম্যের ভিত্তিতে। লিঙ্গ
ভিত্তিক শোষণ থেকে ধনাঢ্য পরিবারের নারীরাও কিন্তু মুক্তি পাচ্ছে না। শ্রেণীগত
শোষণের কারণ আর্থ-সামাজিক, যা নির্ভর করে
একটি শ্রেণী বিভক্ত সমাজের উপর, আবার
লিঙ্গভিত্তিক শোষণ-নির্যাতনের কারণ সামাজিক সাংস্কৃতিক, যার মূলে রয়েছে আমাদের চিন্তা চেতনা মূল্যবোধের
দৈন্যতা। আমাদের এ দৈন্যতা কিন্তু আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে অঙ্গীভূত হয়ে গেছে।
ধর্ম এখনো আমাদের
সংস্কৃতিতে একটি নির্ধারক শক্তি হিসাবে বিরাজমান। বিশেষভাবে লোকজ সংস্কৃতিতে
ধর্মের প্রভাব সর্বগ্রাসী। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃস্টান সব ধর্মের লোকদের ব্যাপরে এ বক্তব্য সমানভাবে প্রযোজ্য এবং এটা আমাদের
সুদীর্ঘ দিনের পারিবারিক ও সামাজিক ঐতিহ্য। পরিবারের অভ্যন্তরে শিশুর জন্মের সাথে
সাথে সদ্যজাত শিশুটির সামনেই সজোরে বারংবার সজোরে উচ্চারিত হতে থাকে নানা ধর্মীয়
বাণী-দোয়া-দুরুদ-মন্ত্র পাঠ। পরম আত্মীয়দের তৈরী নানা জামা কাপড়ের মত
বিশ্বাস-চিন্তা-চেতনা-মূল্যবোধের অদৃশ্য এক তকমাও নবজাতক-জাতিকার জন্য তৈরী হয়ে থাকে
জন্মের আগেই, যা তেদের শরীরে এঁটে দেওয়া হয় জন্মক্ষণেই। এই চিন্তা-চেতনা-মূল্যবোধের
সে তকমায় আবৃত থেকে তারা কালক্রমে বেড়ে ওঠতে থাকে। সেখান থেকে মুক্তি পাওয়া সবারই এক দু:সাধ্য
ব্যাপার। বরং কালক্রমে তার অন্যান্য চিন্তা-চেতনা-মূল্যবোধের সাথে তা মিশে একাকার হয়ে যায়।
এমতাবস্থায়,
কৌশল হতে পারে পশ্চাৎপদ
ধারণা বা মূল্যবোধের বিপরীতে আধুনিক মূল্যবোধ ও চেতনাকে ‘সহনীয় মাত্রায়’ উপস্থাপন
করে পশ্চাৎপদ ধ্যান-ধারণার য়ুক্তিহীনতা তুলে ধরা। বিজ্ঞানে এমন কিছু সত্য আছে,
যার সাথে ধর্মীয়
বিশ্বাসের সংঘাত প্রত্যক্ষ নয়। কার্য-কারণ সম্পর্ক বাখ্যা করে আমাদের সেই সকল সত্য
তুলে ধরতে হবে । ধীরে ধীরে বৈজ্ঞানিক চেতনার প্রতি আসক্ত বা বিশ্বাসী করে তুললে
অবচেতন মনেই সে গ্রহণ করতে থাকবে যুক্তিপূর্ণ সত্যকে। জনগণকে বিজ্ঞানমনস্ক করার
একটি সচেতন প্রয়াস চালাতে হবে বিরামহীন ভাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন