“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ৩ মার্চ, ২০১৭

শিল্প বনাম বিজ্ঞানঃ সৃষ্টি বনাম নির্মাণ


 ।। মৃন্ময় দেব।।
(C)Image:ছবি
শিল্পীসাহিত্যিকদের পাড়ায় যাদের নিত্য আনাগোনা তারা নিশ্চয় সুন্দরের ধ্যান’ ‘সুন্দরের আরাধনাইত্যাদি শব্দবন্ধের সঙ্গে সুপরিচিত। এবম্বিধ বাক্যাংশের সাথে পরিচয়ের সূত্রে অনেকেই পুলকিত বোধ করে থাকেন। এতে অবশ্য দূষণীয় কিছু নেই । কথাটা এখানে তোলা হল একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে, ভিন্নতর  আলোচনার স্বার্থে। সুন্দরের প্রতি আকর্ষণ মানুষের সহজাত। আহারের নিশ্চিতি পেলে সে আহার্যের পাত্রটিকেও রমণীয় করে তোলার চেষ্টা করে। প্রয়োজনের অতিরিক্তের প্রতি এই আগ্রহ থেকেই নাকি আসে সৃষ্টিকর্মের অনুপ্রেরণা। শিল্পসাহিত্য সৃষ্টির এটাই হচ্ছে গোড়ার কথা। আমরা কিন্তু এ বিষয়ে কোন অযথা  বিতর্কে প্রবেশ করার বদলে ভিন্ন এক সমস্যার দিকে দৃষ্টিপাত করার চেষ্টা করব। কথাটা হচ্ছে এই যে, সভ্য  সমাজে মানুষের বৌদ্ধিক চিন্তা-চর্চার ক্ষেত্র যদিও বিবিধ এবং বিস্তৃত তা সত্ত্বেও একমাত্র শিল্পীসাহিত্যিকরাই  সুন্দরের পূজারীএরকম একটা ধারণার পৃষ্ঠপোষকতা করতে দেখা যায় অধিকাংশকে। বিজ্ঞান সহ বৌদ্ধিক চর্চার অন্যান্য ক্ষেত্রে নিয়োজিত মানুষদের সরাসরি অসুন্দরের পূজারীবলা না হলেও তাদের কাজকর্মকে জড়ের সাধনাহিসেবে সংজ্ঞায়িত করে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রচেষ্টা যে হয় না তাও নয়।

        সৃষ্টি আর নির্মাণ এ দুয়ের পার্থক্য নির্দেশ করেই ক্ষান্ত হন না অধিকাংশ সমালোচক, দুয়ের মান নির্ধারণেও তারতম্য করে থাকেন। এই বিভাজনের প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হয়ে যায় স্কুলের গণ্ডী অতিক্রম করতে না করতেই। দু দলে, দুটো শিবিরে ভাগ করে ফেলা হয় শিল্পী ও বিজ্ঞানীদেরঅঙ্ক আমার মাথায় ঢোকে না’, ‘আমি শিল্প-টিল্প ঠিক বুঝি নাগোছের বাক্যালাপের অভিজ্ঞতা ও অভ্যাস আমাদের মধ্যে অনেকেরই আছে। লক্ষণীয় বিষয় এটাই যে অক্ষমতা(!) প্রকাশের এজাতীয় বয়ানে আক্ষেপের ছিটেফোঁটাও কিন্তু থাকে  না, বরং এক ধরনের শ্লাঘাই অনুভব করেন বক্তা। অর্থাৎ, নিজস্ব ধারণা ও বিশ্বাস অনুযায়ী এক বিশেষ শিবিরের অন্তর্ভুক্ত হয়ে শ্লাঘা বোধ করেন। এই শিবির বিভাজনের প্রেক্ষিত ও প্রক্রিয়াটিকে আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নিয়ে আমরা বুঝতে চাইব এটা কতটা সঙ্গত কিংবা যুক্তিসম্মত।
এখানে আরেক রকম সমস্যার সূত্রপাতও ঘটতে পারে। শিল্পসাহিত্য ঠিক যুক্তি-বুদ্ধির আওতাধীন নয়, এমন কথা বলার লোকেরও অভাব হবে না। শিল্পবস্তুর শিল্পত্ব হৃদয় দিয়ে উপলব্ধির জিনিস, গুরু মস্তিষ্কের কূট-কচালি এক্ষেত্রে কোনও কাজে আসে না। ‘Beauty lies in the eye of beholder’-এ তো প্রায় আর্ষ বাক্যে পরিণত। আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ...’ – এর মধ্যে কতটা সার সত্য, কতটাই বা আত্মপ্রবঞ্চনা তারও হিসেব করা যেতেই পারে। শিল্পের অন্দরমহলেও কেউ কেউ যে সে অঙ্ক কষায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে চাইছেন সে খবরও চাউর হয়েছে বেশ কিছুদিন। সৃষ্টিকর্মে জড়িতদের অনেকেই ইদানীং নির্মাণ-কুশলতার দিকে ঝুঁকেছেন দেখতে পাই। শিল্প বিচারে আবেগসর্বস্বতা (কিংবা মননের দৈন্য) দোষ হসেবেই বিবেচিত হচ্ছে ইদানীং। তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি / বিচিত্র ছলনাজালে, হে ছলনাময়ী। -এই রহস্যঘন উচ্চারণের কাছে আত্মসমর্পণই কি শেষকথা? এ প্রশ্ন উঁকি দেয় এই অভাজনদের মনের আনাচে কানাচেও!     
সৌন্দর্যের কিংবা শিল্পের যথার্থ সংজ্ঞা নিরূপণ এক দুরূহ কর্ম। মানবমনে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়ার নিরিখেই মূলত সৌন্দর্য তথা সৃজনশীলতার অস্তিত্ব কবুল করে নেওয়া হয়। কবি কীটস যত সহজে ‘Beauty is truth, truth is beauty’ বলে ল্যাঠা চুকিয়ে দিতে চেয়েছেন তত সহজে ঝামেলা মেটার নয়। তিনিই (জন কীটস) কিন্তু রামধনুর সাতটা রঙের রহস্য উদঘাটন করায় নিউটনের ওপর বেজায় চটেছিলেনতাঁর বক্তব্য ছিল যে, এই উন্মোচনের দরুন রামধনুর রহস্য (সৌন্দর্য) নাকি হারিয়ে গেছে এবং তা নিয়ে নাকি আর কবিতা লেখা যাবে না। কথাটা মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে, যেহেতু রামধনু নিয়ে তার পরেও কবিতা লেখা হয়েছে, হচ্ছে। রামধনুর সাত-রঙা (বৈজ্ঞানিক) সত্যের ধাক্কায় তাঁর নিজের মন্তব্য ও সত্যের উপলব্ধি হোঁচট খেয়েছে। তর্কের  একগুঁয়েমিতে কিংবা চাতুর্যের চূড়ায় বসে হয়ত বলা যায় যে, এ হচ্ছে বস্তুর সত্য’, শিল্পের সত্য ভিন্ন বস্তু (?) বোঝা যায় না, উপলব্ধির জিনিস। অর্থাৎ, ব্যক্তিগত বোধের নৈপুণ্য কেবল? বিষয়ীগত ব্যাপার! কিন্তু সত্যিই কি তাই?
(C)Image:ছবি
শিল্পসৃষ্টির মূলে  বহুদিন যাবত একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে শিল্প ও সৌন্দর্যবোধের সঙ্গে বিজ্ঞানের সম্পর্কটি বুঝি বৈরিতারএরকম ধারণা প্রচলিত হওয়ার মূলে বহু জ্ঞানী-গুণী মানুষের ধারণা, মতামত এবং মন্তব্য  বহুলাংশে দায়ী। কবি-সাহিত্যিক, সঙ্গীত কিংবা চিত্রশিল্পীদের অনেকেই এমন ধারণা পোষণ করেন যে শিল্প ও বিজ্ঞান হচ্ছে দুটো সম্পূর্ণ আলাদা এবং পরস্পরবিরোধী এলাকাইংরেজিতে যাকে water-tight compartment বলা হয় সেরকম বদ্ধ কক্ষ যেন, একটি থেকে অন্যটিতে প্রবেশের পথ প্রায় রুদ্ধ। ঘটনা কিন্তু আসলে তা নয়। অভিজ্ঞতাও সে সাক্ষ্য দেয় না। বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি বিষয় সাধারণের পক্ষে (শিল্পী-সাহিত্যিকরাও এক্ষেত্রে সাধারণ বর্গেরই অন্তর্ভুক্ত) বুঝে ওঠা হয়ত সম্ভব নয়। একই ভাবে শিল্পবস্তুর খুঁটিনাটি বিষয়ে সবার অভিজ্ঞতা সম পর্যায়ের না হতেই পারে। কিন্তু একজন বিজ্ঞানীর সৌন্দর্যবোধ বা শিল্পবোধ থাকা সম্ভব নয় এমন কথা আহাম্মকেও নিশ্চয় বলবে না। আইনস্টাইন থেকে শুরু করে আমাদের জগদীশ চন্দ্র বসু-মেঘনাদ সাহা চন্দ্রশেখর-রামানুজন-এর মত বিজ্ঞানীরা তার দৃষ্টান্ত।
আমরা এ নিয়ে সেরকম কোনো গূঢ় তর্কে সময় নষ্ট না করে বরং মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ফুল-পাখি-গাছ-লতা-পাতা-নদী-পাহাড়-সমুদ্র সদৃশ যে সমস্ত মূর্ত বস্তু কিংবা কবিতা-গান-ছবি-নাচ ইত্যাদি যেসব বিমূর্ত বস্তু আমাদের কাছে সুন্দর বলে প্রতিভাত হয় তার মধ্যে একটা বিশেষ বিন্যাস (pattern) লক্ষ্য করা যায়, সাংগঠনিক এক সুষমতা (harmony) দৃষ্টিগোচর হয়। অর্থাৎ, আকার ও বিন্যাসগত বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায়। প্রথম ক্ষেত্রে বস্তু সমূহের বর্তমান রূপ বিবর্তিত রূপদ্বিতীয় ক্ষেত্রে আয়ত্ত  করে নেওয়ার একটা  ব্যাপার রয়েছে যদিও এই আয়ত্ত করে নেওয়ারও এক বিবর্তন মূলক ইতিহাস রয়েছে গুহা চিত্র থেকে আধুনিক চলচ্চিত্র অবধি যার বিস্তার। একই ভাবে রঙ-বেরঙের ফুলও যে বেঁচে থাকার ও প্রজাতি সংরক্ষণের তাগিদেই বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে রঙিন হয়ে কীট-পতঙ্গকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা লাভ করেছে সে তথ্যও আর অজানা নয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে ব্যাপারটা আদৌ বিষয়ীগত কিছু নয়। একটা বিষয়গত দিকও রয়েছে। সেই যে এক শিল্পী বন্ধু একটা সুন্দর ফুল দেখিয়ে বিজ্ঞানীকে বলেছিলেন, ‘দেখুন, কী সুন্দর ফুল! কিন্তু আপনি তো (কৌতূহল মেটানোর জন্য) এক্ষুনি এর পাপড়িগুলোকে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে এর সৌন্দর্য নষ্ট করে ফেলবেন উত্তরে, মৃদু হেসে বিজ্ঞানী বলেছিলেন, ‘আপনি এখানেই ভুল করছেন, বাইরের এই সৌন্দর্যটা আপনার মত আমিও দেখছি, কিন্তু আমি/আমরা আরো গভীরে, অণু-পরমাণু স্তরে পৌঁছে এর এক একটা কোষ কীভাবে বিন্যস্ত হয়ে পাপড়িগুলোর সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে তাও দেখি। আমরা এর ভেতরের সৌন্দর্যটাও দেখতে পাই, আপনি যা কল্পনাও করতে পারেন নাধ্রুপদী সঙ্গীতের সাধারণ মুগ্ধ শ্রোতা ও সুর-তাল-লয় ইত্যাদির জ্ঞানসম্পন্ন শ্রোতার মধ্যে যে পার্থক্য এও সেরকম।
সৌন্দর্যের প্রতি, শিল্প-বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট হওয়া এবং বস্তুতে সৌন্দর্য আরোপ করা এক মানবিক প্রবণতা। যে কোনো সুন্দর বস্তু, মূর্ত কিংবা বিমূর্ত যাই হোক না কেন, মানুষের (মস্তিষ্কের) ওপর অনিবার্য  প্রতিক্রিয়া করে। আনন্দের উপলব্ধি ঘটে। এবারে আত্মা’, ‘ঈশ্বরগোছের বিশ্বাসের (যার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই) বশবর্তী না হলে এরকম প্রতিক্রিয়া কেন হয়, কিভাবে হয় ইত্যাদি প্রশ্নের সম্মুখীন না হয়ে গত্যন্তর নেই। আর ঠিক এখানেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে শিল্পবস্তুর কিংবা সৌন্দর্যের আবেদন সৃষ্টিতে মস্তিষ্কের ভূমিকার বিষয়টি। প্রাণের উদ্ভব থেকে শুরু করে সমাজ বিকাশের ধারা তথা মানবিক বৈশিষ্ট্য ও বৃত্তি সমূহকে (শিল্প ও সৌন্দর্যের প্রতি অনুরাগও তার অন্তর্গত) বিবর্তনের নিয়ম গুলোর সাহায্যে বহুদূর অব্দি অনুধাবন ও ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এবং বিবর্তনের প্রক্রিয়াটি যে বস্তুত পদার্থবিদ্যার নিয়মগুলোকে (laws of physics) অনুসরণ করে সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ মাত্র নেই। কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য কেবল এটা দেখানো যে আমাদের সৌন্দর্যের ধারণা (sense of beauty) আকাশ থেকে পড়াকিংবা প্রদত্তবস্তু নয় আদৌ।  বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্য দুই মেরুতে অবস্থান করে না, এবং সম্পর্করহিতও নয়। অথচ এই মিথ তৈরিতে আজও ইন্ধন যুগিয়ে চলেছেন বহুজনশ্রদ্ধেয় গুণী জনেরাও অজ্ঞানে অথবা সজ্ঞানে।  
 কবি-শিল্পী মানুষেরা মেধার সঙ্গে কল্পনাশক্তির মিশেল দিয়েই শিল্প সৃষ্টি করে থাকেন, এবং তার জন্য তাদের অহমিকাও বর্তমান। তাই বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তারা নির্মাণকথাটা ব্যবহার করেন এবং শিল্পের বেলায় সৃষ্টিকথাটা ব্যবহার করতে পছন্দ করেন। বাস্তবে কিন্তু একজন বিজ্ঞানীকেও প্রাথমিক ভাবে কল্পনায় ভর করেই এগোতে হয়, কল্পনাশক্তি বিহনে কোনো আবিষ্কারই বোধহয় সম্ভব হত না, সম্ভব নয়। রাতের আকাশে যে তারাটির দিকে তাকিয়ে গবেষণায় মগ্ন হন জ্যোতির্বিজ্ঞানী, তাকে কিন্তু কল্পনা করে নিতে হয় যে ওই তারাটি থেকে পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছতে কেটে গেছে কত লক্ষ লক্ষ বৎসর! তাহলেই বুঝুন, যেমন ভাবা হয়, শিল্প আর বিজ্ঞান তেমন কোন বিভাজিত জল-আঁট (water tight) কক্ষ  নয় মোটেই। আকাশে ওড়ার অদম্য স্বপ্ন যদি না থাকত উড়োজাহাজের নির্মাণ কি বাস্তবে সম্ভব হত! আসলে সাহিত্য-সঙ্গীত-চিত্রকলা ইত্যাদি শিল্পকলার বিভিন্ন শাখার ক্ষেত্রে যে সৃষ্টিশীলতা ক্রিয়াশীল থাকে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পেছনেও সেই একই মানবিক সৃষ্টিশীলতা বর্তমান। এটা বুঝতে না-পারার ফলেই ভুল ধারণা ঘাঁটি গেড়ে বসে মনের কোণে   
      এবারে বক্তব্যের সপক্ষে কিছু সাক্ষী-সাবুদ পেশ করা যাকগর্ভস্থ ভ্রূণেও সঙ্গীতের (music)মূর্ছনা যে সাড়া জাগায় তা আজ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায়ও প্রমাণিত (এবং সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠতা বোঝাতে এ দৃষ্টান্ত সঙ্গীতপ্রেমীরাই প্রায়শ হাজির করেন)। বিবর্তনবাদ ছাড়া এর অন্য কোনো ব্যাখ্যা সম্ভব? বিশ্বেরবিখ্যাত ও জনপ্রিয় ধ্রুপদী এবং আধুনিক সঙ্গীতের স্বর-বিন্যাস বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে গাণিতিক নিয়মানুসারে সেগুলোকে সূত্রবদ্ধ করা সম্ভব। বস্তুত সঙ্গীত এবং কোলাহলের মধ্যে পার্থক্য তো এই যে প্রথমটি সুশৃঙ্খল ও সুবিন্যস্ত; আর দ্বিতীয়টি অবিন্যস্ত, বিশৃঙ্খল। নিসর্গ-চিত্র আমাদের সবাইকে আকৃষ্ট করেআনন্দ দেয়। তা কি জীবনধারণের প্রশ্নে নিরাপদ স্থলভূমির নির্বাচন ও অভিযোজনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়হিংস্র শ্বাপদকুলের হাত থেকে বাঁচতে প্রজাতি হিসেবে মানুষ যে সমতল ভূমিকেই বাছাই করেছিল সে তো দিনের আলোর মত স্পষ্ট। এই সাক্ষীসাবুদ পেশের অর্থ অবশ্য এ নয় যে শিল্প উপভোগের জন্য এসব বিষয়  জানা জরুরি। স্বাদু আহারের স্বাদ গ্রহণের জন্য রসনার অস্তিত্বই যথেষ্ট, রন্ধনপ্রণালী সম্পর্কে জ্ঞান অপরিহার্য নয়। যেমন, স্পর্শের অনুভূতি আমাদের ত্বকে সাড়া জাগায় স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমেসে তথ্য জানা না থাকলেও সাড়া জাগে। নদীতে অবগাহনে যে আনন্দ তা যদি কোন অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিকে নদীর উৎস-সন্ধানে অনুপ্রাণিত করে তাতে অবগাহনের আনন্দ মাটি হয় না নিশ্চয়। একজন বিজ্ঞানী এই অনুসন্ধিৎসা নিয়েই সুন্দরের প্রতি নিবিষ্ট হন, সৌন্দর্যের ঘাতক হিসেবে
নয় যেরকম ভাবা হয়ে থাকে বহুক্ষেত্রে আইনস্টাইন তাই ভায়োলিন বাজান, বলতে পারেন‘Pure mathematics is, in its way, the poetry of logical ideas.’ জগদীশ চন্দ্র বসু কবিতা ও বিজ্ঞান’ নামে প্রবন্ধ লেখেন, এমন কি একালের বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখরও ‘Truth and Beauty’ গ্রন্থ রচনা করেন।
       তাহলে দেখা যাচ্ছে যে সৌন্দর্যবোধ (এবং শিল্পবোধও) সম্পূর্ণ বিষয়ীগত (subjective) ব্যাপার নয়, যেমনটা ভাবা হয়একটা বিষয়গত (objective) দিকও বর্তমান রয়েছে। আপাতভাবে বিষয়ীগত মনে হলেও তার মূলে রয়েছে কার্য-কারণ সম্পর্ক (cause -effect relation)এই দিকটা খেয়াল থাকে না বলেই বহু  মানী-গুণী মানুষও ভুল বোঝেন, ভুল বোঝান। যুক্তির বদলে আবেগকে বেশি প্রাধান্য দেবার জন্যই এমনটা ঘটেএও ঠিক যে নিরেট যুক্তি দিয়ে জীবন চলে না, আবেগেরও প্রয়োজন আছে। তবে যে আবেগ বেগ কেড়ে নেয় তা নয়, বরং যে আবেগ জীবনপ্রবাহকে সমাজকে সজীব ও সতেজ রাখে সেই আবেগ প্রয়োজন। যুক্তির, বৈজ্ঞানিক যুক্তি পরম্পরার অবিহনে সে সজীবতা সতেজতা লভ্য নয়। মানবেতর জীব আবেগ-সর্বস্ব, কিন্তু  মানুষের চেতনা আছে। মানবিক আবেগ তাই যুক্তি বর্জিত নয়, মানবিক যুক্তিও আবেগশূন্য নয়। বিজ্ঞানে যদি যুক্তির প্রাধান্য, শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীতে-চিত্রকলায় তবে আবেগের অগ্রাধিকারদুয়ে মিলেই  সম্পূর্ণ সত্তা। শিল্প ও বিজ্ঞান তাই একে অন্যের পরিপূরক, পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়। বিজ্ঞান রহস্য-উন্মোচন করে সৌন্দর্য হরণ করে না, বরং এক পা এগিয়ে নতুন রহস্যের দুয়ারে এনে দাঁড় করায়সৃজনশীল মনের জন্য, শিল্পীর তুলির জন্য যেমন, বিজ্ঞানীর গবেষণাগারের জন্যও নতুন রসদ যোগায়। কেননা, জানার তো শেষ নেই, এক জানা অনেক অজানাকে সামনে নিয়ে আসে।  

(C)Image:ছবি
পৃথিবী জুড়ে আজ চারুকলা ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক নিয়ে, সৌন্দর্যবোধ তথা শিল্পবোধ নিয়ে চিন্তা উদ্রেককারী নানান ভাবনা-চিন্তা, গবেষণা চলছে। যেসব তথ্য উঠে আসছে তাতে সৌন্দর্য বোঝার নয়, উপলব্ধির বিষয়’ –Beauty is to be perceived, not understood জাতীয় উক্তির ক্লিশে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছেবিজ্ঞানের নয়া শাখা Computational Aesthetics তৈরি হয়েছে এই বিষয়ে  অধ্যয়নের জন্য। Science of Aesthetics আজ বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের এক স্বীকৃত ও জরুরি বিষয় হিসেবে মান্যতা পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ, কবি, লেখক, নাট্যকার, আবিষ্কারক, ‘The Ascent of Man’ গ্রন্থের রচয়িতা বিজ্ঞানী Jacob Bronowski-র অসাধারণ একটি মন্তব্য উদ্ধার করার লোভ সম্বরণ করা গেল না কিছুতেই  – ‘‘We re-make nature by the act of discovery, in the poem or in the theorem. And the great poem and the deep theorem are new to every reader, and yet are his own experiences, because he himself re-creates them. They are the marks of unity in variety; and in the instant when the mind seizes this for itself, in art or in science, the heart misses a beat.”      

বিবর্তনমূলক মনোবিজ্ঞানের অগ্রগতি এমন স্তরে পৌঁছেছে যে মানুষের আবেগ-অনুভূতি ও প্রবৃত্তিগুলি, যেমন নৈতিকতা-যৌনতা ইত্যাদি বুঝতে এবং ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। সৌন্দর্য, শিল্প, নীতিবোধ ইত্যাদির আবির্ভাব মানুষের মনে (মস্তিষ্কে) এবং সর্বাঙ্গীণ মানুষ যেহেতু বিবর্তনের ফসল কাজেই এই প্রবৃত্তিগুলোও তাই। এগুলো (ঈশ্বর)প্রদত্ত নয়। প্রেম-ভালোবাসা, ফুল বা নারীর সৌন্দর্যকে স্বর্গীয়আখ্যা দিতেই পারি, কিন্তু তা শিল্প ও সৌন্দর্যের প্রতি আমাদের অনুরাগ প্রকাশের ভাষাগত কারুকার্য কেবল। ভাষিক অলঙ্কার মাত্র। দেশ-কাল-পাত্র নির্বিশেষে এই সাধারণ অনুরাগ জন্মানোর পেছনে বিবর্তন ছাড়া আর কোনও কারণ কি থাকা সম্ভব! এখন আত্মায় পুরোপুরি আত্মস্থনা হলে মানুষ (এবং মানুষের মস্তিষ্কও) যে বিবর্তনের ফসল সেই অবিতর্কিত ঘটনার বিরুদ্ধাচরণ করা অসম্ভব। আর বিবর্তন যেহেতু প্রকৃতির মৌলিক নিয়মগুলির (মূলত পদার্থবিদ্যার) ফল কাজেই মানবিক প্রবৃত্তি ও বৈশিষ্ট্য সমূহও তাই। শিল্প ও সঙ্গীত এবং তার প্রতি আকর্ষণের উৎসের সন্ধানে আমাদের পদার্থবিদ্যার নিয়মগুলির কাছেই শেষ পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়াতে  হয়। কিন্তু শিল্প উপভোগের জন্য তার প্রয়োজন নেই, অত গভীরে যাবার। একটা সফটওয়্যারের কর্মপদ্ধতি যেমন ব্যবহারিক সঙ্কেত থেকেই বুঝে নেওয়া যায়, অন্তর্গত সংগঠনের বিশ্লেষণ আবশ্যক হয় না; ঠিক সেরকম মানবিক বৈশিষ্ট্য ও প্রবৃত্তিগুলিকেও বিবর্তনের নিয়মগুলির (প্রাকৃতিক নির্বাচন, অভিযোজন ইত্যাদির)  সাহায্যেই বোঝা সম্ভব।     
পদার্থবিদ্যার নিয়মগুলো মানুষের সৃষ্ট নয়, সে কারণে কেউ যদি স্বর্গীয়আখ্যা দিতে চান তো  আলাদা কথা। মূর্ত ও বিমূর্ত বস্তুতে সৌন্দর্য আরোপ এক সর্বজনীন মানবিক প্রবণতা। ফুল-পাখি মনি-মাণিক্য  কিংবা কবিতা-গান-ছবি সে যাই হোক না কেন এদের মধ্যে সাধারণ ব্যাপার হচ্ছে যে এরা কিছু তথ্য, আদল  বা বিন্যাসের মাধ্যমে একটা অর্থ প্রকাশ করে এবং পরিণতিতে আমাদের মস্তিষ্কের আনন্দের কেন্দ্রটিকে উত্তেজিত করে। এর শেকড় নিঃসন্দেহে রয়েছে বিবর্তনের প্রক্রিয়ায়। সুকুমার বৃত্তিগুলি হয় সরাসরি বিবর্তনমূলক অভিযোজনের ফল, নতুবা জীবন-সংগ্রামের ক্ষেত্রে গৃহীত অভিযোজন-কৌশলের পার্শ্বক্রিয়া মাত্র। Evolutionary psychology-র ভাষায় একে বলা হয় spandrel effect - Spandrel হচ্ছে কোন খিলানের থামগুলোর অন্তর্বর্তী শূন্যস্থান (space) যা খিলানের নক্সার অভিপ্রেত অংশ নয় অথচ এক অনিবার্য পরিণতি যা এড়ানো সম্ভব নয়। বিবর্তনমূলক অভিযোজনের ক্ষেত্রেও এরকম পার্শ্বক্রিয়ার ঢের দৃষ্টান্ত রয়েছে।
বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণের মূলে যে কারণ তাকে যৌন-সৌন্দর্য বলা যেতে পারে। এই সৌন্দর্য বস্তুত যৌনস্বাস্থ্যের সূচক। নারীর যৌন-সৌন্দর্য (আবেদন!), যাকে অবলম্বন করে রচিত হয়েছে অবিস্মরণীয় সব শিল্পকর্ম, তা আসলে যৌনসক্ষমতার বা উর্বরতার প্রতীক ছাড়া কিছু নয়। জীবনের প্রবাহকে সচল রাখার জন্য যা অপরিহার্য এবং বিবর্তনের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বেঁচে থাকা বা উদ্বর্তনের (survival) মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জিনগত সংকেত (genetic code) পরবর্তী প্রজন্মে স্থানান্তরিত করা। সন্তানের জন্ম দিয়ে অর্থাৎ জিনগত সংকেত প্রসারিত করে কেউ মারা গেলেও বিবর্তনবাদের বিচারে সেই ব্যক্তি বেঁচে থাকে। শারীরিক  ভাবে বেঁচে থাকা গুরুত্বপূর্ণ নয় এখানে, জিনগত সংকেত -পার্থিব দেহ যার অস্থায়ী আস্তানা মাত্র চালান করাই মুখ্য। মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব বেঁচে থাকেসে প্রক্রিয়ায়, আর সে কারণেই জীবনানন্দের এই পঙক্তিও বেঁচে আছে, বেঁচে থাকবে। আমাদের নান্দনিক বোধেরও যে বিবর্তন আছে, ক্রমবিকাশের ধারাটি যে অব্যাহত সে তো বিভিন্ন শিল্প-আন্দোলনের মাধ্যমে উদ্ভূত শিল্পতত্ত্বের দৃষ্টান্ত থেকেই স্পষ্ট। এবং এই বিবর্তন যে জৈববিজ্ঞানের পরিভাষায় প্রাকৃতিক নির্বাচন ও অভিযোজনের সঙ্গে সম্পর্কিত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ কথা স্বীকার করে নিতে পারলে নিবন্ধের শিরোনামে বিভাজন সংক্রান্ত যে মিথ’-এর ইঙ্গিত সেই মিথটিকে ভেঙ্গে আমাদের বৌদ্ধিক চর্চা অন্যতর মাত্রা লাভ করতে পারে।   
*********
বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন ২০১৭-এর স্মরণিকায় প্রকাশিত

কোন মন্তব্য নেই: