।।
সুমন দাস ।।
সকালবেলা জল আনতে গিয়ে পুকুর পাড়ে পড়ে মায়ের কোমরের স্পাইনালকর্ড ভেঙে
চলাফেরা বন্ধ।
দুদিন হল ব্যাঙ্গালোরে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি ছেড়ে বাড়ি ফিরে
এসেছে সুমিত।
নিজের জমানো টাকা যা ছিল সেইগুলো দুই বোনের বিয়েতে শেষ হয়ে গেছে। বাবা মারা যাওয়ার পর
মা ও দুই বোনের ভার পড়ে সুমিতের উপর। বড় দুই চাকুরিজীবী ভাই স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে শহরের
ফ্লাটে থাকেন। পৈতৃক সম্পত্তি বলতে আধবিঘা জমি জুটেছিল সুমিতের ভাগে। মা ও বোনেদের দায়িত্ব
নিতে দাদা অনীহা
প্রকাশ করেন। বিবেকের তাড়নায় ওদেরকে নিজের কাছে সে রেখে দেয়।
দুই বোনের বিয়েতে নিজের ভাগের পনের কাঠা জমিও বিক্রি করে দেয়। পাঁচ
কাঠার মধ্যে
বাঁশ বেত দিয়ে মোটামুটি মাকে নিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই বানায় সে। স্নাতক উত্তীর্ণ সুমিত
সরকারি চাকুরি না পেয়ে ব্যাঙ্গালোরে
গিয়েছিল মাস কয়েক আগে।জুটিয়ে
নেয় সিকিউরিটি গার্ডের
চাকুরি। মায়ের কথা খুব বেশী মনে পড়াতে বাড়ি ফিরে আসে। ফলে বর্তমানে হাত প্রায় শূন্য। হাতে বেশী টাকা
না থাকলেও সুমিত
মাকে ভর্তি করে সরকারি কোন
হাসপাতালে নয় - শিলচরের নামী নার্সিংহোমে। পাঁচদিনেই খরচ এক'লক্ষ দশ হাজার টাকা। যদিও পকেটে তেমন টাকা ছিল না তাই পুকুর পাড়ের দুই কাঠা
জায়গা পাশের বাড়ির কাকুর কাছে এক লক্ষ টাকায় বিক্রি করে দেয়। তা দিয়ে মায়ের অপারেশনের টাকা
মিটায়। বর্তমানে ছোট্ট পুকুর ও কুঁড়ে ঘর নিয়ে সাকুল্যে তিন কাঠা জমি রয়েছে। বাবা বেঁচে থাকতে
সুমিত ছিল সকলের
নয়নের মণি। সামাজিক ও পরোপকারী, ক্রিকেট
থেকে ফুটবল সব খেলাতেও ছিল নামডাক। কলেজ জীবনে বাবার কাছ থেকে টাকা আবদার করে নিয়ে কত
বন্ধুর ফি সহ বই
খাতা কিনে দিয়েছে তার কোন হিসেব নেই। এখন বন্ধুরাও খবর রাখে না।
এদিকে কয়েকমাস কেটে গেলেও মায়ের অবস্থার তেমন কোন উন্নতি নেই,
কোমর থেকে নিম্নাংশ পুরোপুরি অচল। পাড়ার লোকেরা
বলছেন, ভেলোর কিংবা অ্যাপেলো
হাসপাতালে ফিজিওথেরাপি
করালে হয়ত ধীরে ধীরে হাঁটার ক্ষমতা ফিরে পেতে পারেন।
মাঝে মধ্যে বোনেরা দেখে গেলেও ভাইয়েরা একটি দিনের জন্য মাকে দেখতে
আসেননি। কাজের
চাপ বলে এড়িয়ে যাচ্ছেন। টাকা দিয়ে সাহায্য করা তো দুরের কথা। কাম ছেড়ে মায়ের সেবায়
ব্যস্ত সুমিত। শুধু ভাবতে থাকে কিভাবে মাকে সুস্থ করা যায়। শেষমেশ পরিকল্পনা করে বাকি থাকা
তিন কাঠা জমি ঘর সহ বিক্রি করে দেবে। প্রয়োজনে ঘর ভাড়া করে মাকে নিয়ে থাকবে। ছোটবোন বলে আর চিকিৎসার
দরকার কি যতদিন
বাঁচবেন এভাবেই থাকুন। সুমিত রেগে বলে, তোদের
কথায় চললে আমার হবে ; আমাকে আমার মতো ভাবতে
হবে। যেমনি ভাবা তেমনই কাজ। পাশের বাড়ির কাকুর কাছে জমি বাড়ির বায়না করে চেন্নাই এর টিকিট
কাটে সুমিত। সঠিক দিনে গুয়াহাটি থেকে ট্রেনে চাপে। এর আগে জমি-বাড়ি বিক্রির পুরো টাকা সমঝে
নেয়। তার মনে আজ
খুব আনন্দ। দিন কয়েকের মধ্যে মাকে সুস্থ করে নিয়ে আসবে। নাই বা থাকল ঘর-বাড়ি মা তো পাশে
থাকবেন। নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছার পর সুমিত মায়ের জন্য খাবার আনতে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে
সুমিতের মা হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে ট্রেনের সিটে লুটিয়ে পড়েন। সুমিত ফিরে এসে দেখে সিটে পড়ে রয়েছে
মায়ের নিথর
দেহ। বাকরুদ্ধ হয়ে যায় সে। সম্বিত ফিরতেই হতভাগ্য সুমিতের একই প্রলাপ কি দোষ ছিল
আমার? মা কেন চলে গেলে?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন