।। শিবানী ভট্টাচার্য দে ।।
(C)Image:ছবি |
কিছুদিন ধরে সোনার দাম পড়ছে । কদিন ধরেই সুপ্রীতি
কাগজে দেখছেন। যখন প্রতি দশ গ্রামে বেশ চারহাজার টাকার মত পড়ল, তখন সুকান্তকে
বলি বলি করে বলেই ফেললেন, চারগাছি চুড়ি করিয়ে নিই, কি বলো । বালাজোড়া ফেটে
যাচ্ছে। হাতের চুড়িগুলোর সোনা ক্ষয়ে
গেছে। হাতে শুধু শাঁখা পলা পরে আছি। চুড়ি করালে আপাতত: আমি মাঝেসাজে পরব, পরে শ্রবণার বিয়ের সময়
পালিশ করিয়ে ওকে দিয়ে দেওয়া যাবে ।
সুপ্রীতি ভেবেছিলেন, শ্রবণার নাম করলে সুকান্ত আপত্তি করবেন না । মায়ের অলঙ্কার তো মেয়ে স্বাভাবিকভাবেই পায় । ভবিষ্যতে শ্রবণার
রুচি ও প্রয়োজনমত বিয়ের গয়না বানাতে সুকান্ত নিশ্চয়ই রাজি হবেন । আপাতত তাঁর নিজের ও শখ পূরণ হবে ।
কিন্তু সুকান্ত
বললেন, সোনার
দাম যখন কমেছেই, তখন শ্রবণার জন্য পুরো সেট নিয়ে রাখলেই তো
হয় । পুরোনো গয়না পালিশ করালে মিছিমিছি কিছু সোনা নষ্ট হয় । তারপর হাসতে হাসতে
বললেন, তা তোমার তো বিয়ে হয়েই গেছে, তোমার
অলঙ্কার তো শাস্ত্রমতে আমিই । তুমি আবার গয়না দিয়ে কী করবে ?
সুকান্তর কথার প্রথম বাক্যদুটিতেই সুপ্রীতি দমে গেলেন, তার পরের রসের কথায় ভরসা পেলেন না । বুঝলেন, তাঁর কায়দা বিফলে গেল । তবু মুখে একটু হাসি টেনে বললেন, সাধারণ
কনে সাজানো সেট বানাতে গেলে এখনকার দামেও কম সে কম তিনলাখ টাকা লাগবে । এত টাকা
হবে ?
এত লাগবে ? সুকান্তর বিশ্বাস হচ্ছিল না ।
সুপ্রীতি বললেন, দেখ, একটা মাত্র মেয়ে, তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে দিতে হবে তো । আমাদের সময় ব্যাপার ছিল
আলাদা । তা ছাড়া শুধু সোনার দর
দেখলে হয় না, কিসব
ট্যাক্স ফ্যাক্স, মজুরি ইত্যাদি মিলিয়ে গয়নার দাম হয় । বিয়ের
গয়নার সেট করতে কি কি গয়নার দরকার, আর সেগুলো কত ওজনের দিচ্ছ
সেটাও মাথায় রাখতে হবে ।
সুকান্ত বললেন, তাহলে শ্রবণার জন্য গয়না করেই রাখা
যাক । কিছুটা অন্তত ।
ওঁদের মেয়ে শ্রবণা মাত্র বিএ প্রথম বর্ষে পড়ে, গ্রাজুয়েশনের আগে বিয়ের প্রশ্নই নেই । আপাতত সে সোনার গয়নার
কিছুই বোঝে না, ফ্যাশনেবল ইমিটেশনেই তার রুচি । সুপ্রীতির মনে হল, সুকান্ত মেয়ের
নাম করে মাকে ঠেকাচ্ছেন । বিয়ের কুড়ি বৎসর হয়ে গেছে, আজ
পর্যন্ত নিতান্ত প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া কোন সখের কিছু, যা
শুধু সুপ্রীতিরই হতে পারে, একমাত্র কাপড়চোপড় বাদে তেমন কোনো জিনিস সুকান্ত কখনো দেন না । সোনার জিনিস তো নয়ই । এখন সোনার দাম অনেক দিন বাদে
কমেছে, তাই
সুপ্রীতি এই জীবনে প্রথম একটা সখের কথা বলেছিলেন । সুকান্ত মেয়ের কথা বলে বাগড়া
দিয়ে দিলেন । সুপ্রীতি আপত্তি করতেও পারেন না, মেয়ে তো
দুজনেরই । একসঙ্গে মেয়ের বিয়ের গয়না ও নিজের চুড়ি--- এত
টাকা সুকান্ত জোগাড় করতে পারবেন কিনা, সেকথাও তাঁকে
ভাবতে হয়, যাতে স্বামীর উপর চাপ না পড়ে। যদিও সুকান্ত ঘরোয়া
বাজার থেকে শুরু করে সমস্ত আয় ব্যয়ের হিসেব নিজেই রাখেন, সুপ্রীতিকে
হস্তক্ষেপ করতে দেন না ।
সুপ্রীতি আরেকবার চেষ্টা করে দেখলেন। বললেন, শ্রবণার বিয়ের
এখনও অনেক দেরি আছে । ও পড়াশুনো করে চাকরিও করতে পারে, বলা
যায় না । একসঙ্গে না কিনে মাঝে মাঝে অল্প অল্প করে ওর জন্য গয়না কিনলে হয়। পরে
দেখে শুনে সেগুলো ভাঙ্গিয়ে ওর মনের মতো ডিজাইনের গয়না করা যেতে পারে ।
হাঁ, আর মেকিং চার্জগুলো যে মিছেমিছি জলে
যাবে, সে খেয়াল আছে ? পরে সোনার দাম
বাড়লে মেকিং চার্জ ও বাড়বে।তাই যা কিনব, ফাইনাল । সুকান্ত
ফাইনাল বলে দিলেন ।
সুপ্রীতির মন খারাপ হয়ে যায় । নিজের অনেকদিনের সখ আর
পূরণ হল না বুঝি । ওঁর বাপের বাড়ির অবস্থা খুব সচ্ছল ছিল না, তায় ওঁরা তিন
বোন । বিয়ে হয়েছিল সম্বন্ধ করে । বরপক্ষ পণ চেয়েছিল । তাই বাবা অলঙ্কারের
জন্য বেশি খরচ করতে পারেননি । বিয়ের সময় সুপ্রীতি পেয়েছিলেন কানের পাতলা ঝোলানো
দুল, গলায়
হাল্কা নেকলেস, হাতে ব্রোঞ্জের উপর সোনার প্রলেপ দেওয়া
চারগাছা চুড়ি, আর গালাভরা একজোড়া হালকা বালা । শ্বশুরবাড়ি থেকে আশীর্বাদে একগাছা সরু চেন, আর নতুন বঊকে ঘরে তুলতে শাশুড়ি
দিয়েছিলেন সোনা বাঁধানো নোয়া । সেগুলো পরতে পরতে সবই ক্ষয়ে গেছে ।
বৌভাতের দিন শাশুড়ি
একগাছা বেশ ভারি সুন্দর সীতাহার বের করে দিয়েছিলেন নতুন বৌকে সাজাবার জন্য ।
অনুষ্ঠান শেষ হবার পর খুলে নিয়েছিলেন । সুপ্রীতি ভেবেছিলেন কোনও দিন হয়ত সেটা তাঁর
হাতে আসবে । কিন্তু এল না । অবিবাহিত দুই ননদ ছিল । ওদের বিয়েতে শাশুড়ি নিজের সব
গয়নাই দিয়ে দিলেন। কাজেই ছেলের বউয়ের কপালে প্রায় কিছুই জুটল
না। সুপ্রীতি সব সময়ই
সিঁথিভর্তি সিঁদুর, পায়ে আলতা আর গায়ে গয়না পরে থাকতে ভালবাসেন । তাই যা ছিল, প্রায় সবসময়ই
পরতেন, তোলা করে রাখতেন না । ভয়ও ছিল, গয়নাগুলো
যদি না পরে রেখে দেন, তবে বেদখল হয়ে যেতে পারে । সুকান্তর সাধারণ চাকরি । বাবা বোনেদের বিয়ের জন্য সংস্থান কিছু রেখে গেলেও বড়
ভাই হিসেবে তাঁর ও দায়িত্ব রয়েছে । সুকান্ত সেকথা হামেশাই শোনাতেন । তাই সুপ্রীতি নিজের
জন্য কোন গয়না কখনো করতে পারেন নি । যদিও কখনো সকনো সুকান্তকে ঠারেঠোরে বলেছেন, সুকান্ত সেসব
ইঙ্গিতের ধার দিয়েও যান নি । বোনেদের বিয়ে হবার পর আস্তে
আস্তে পরিবারের দায়িত্ব কমেছে ।
এখন ননদরা যখনই বাপের বাড়িতে আসে, নতুন
নতুন ডিজাইনের গয়না পরে আসে । তিনি ওদের গয়না দেখেন ঠিকই, তবে
একটু তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে, যাতে নিজের হতাশা প্রকাশ না পায় । দুজনেরই মোটামুটি ভাল ঘরে বিয়ে হয়েছে, বরেদের দায়দায়িত্ব কম, রোজগার বেশি । সেবার বড় ননদ
চওড়া একজোড়া চূড় পরে এলো । বলল, এবার পুজোয় নিলাম ।
তারপর বরকে কিরকম
টাইট দিয়ে গয়নাটা আদায় করেছিল, তার বিস্তারিত গল্প শুনিয়ে ছাড়ল । সব শুনে সুপ্রীতি বললেন,
ভারি গয়না নিয়েছ ঠিকই, আজকাল কিন্তু অত ভারি
গয়না পরলে লোকে গেঁয়ো বলে ।
ছোট ননদ তো বোধ হয় প্রতি মাসে না হোক, দুমাসে নতুন
কিছু গয়না বানায়, নাহয় পুরোনো গয়না পালটে হাল ফ্যাশানের কিছু
নিয়ে আসে । সুপ্রীতি বলে দিলেন, তোমার বরের কাঁচা পয়সা আছে,
গয়না কিনছ হামেশা । কিন্তু দেখো, তোমার চাহিদা
মেটাতে গিয়ে বর যেন ফেঁসে না যায় । আমি কোনদিন তোমাদের দাদাকে চাপ দিই না,তাই ও শান্তিতে আছে ।
ননদদের অহংকারের বেলুন ফুটো করে তৃপ্তিলাভ হয়
সুপ্রীতির । ওরা চলে গেলে নিজের ঘরে গিয়ে একান্তে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন । সোনার দর উঠছে আকাশছোঁয়া । তবুও ওরা পারে ।
সুকান্ত চাকরিতে দুই ধাপ উপরে
উঠেছেন, মাইনে
বেড়েছে বেশ । এখন দায়িত্বের
মধ্যে মেয়ের বিয়ে, কিন্তু তার এখনো অনেক দেরি আছে । এতদিন সোনার দর বেড়েই চলেছিল । তাই আয় কম এবং খরচ
বেশি থাকার সময় বউয়ের সখের জন্য সোনার গয়না কেনার ক্ষমতা ছিল না । কিন্তু এখন তো সে অবস্থা নেই । তায় চার পাঁচ-হাজার টাকা দর কমা কি চাট্টিখানি কথা । বোকা না হলে এমন সুযোগ
কেউ হারায় ? সুপ্রীতি
দেখেন, তাঁর পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন সব মহিলাই এই
সুযোগে নিজের গয়নার সাধ সাধ্যমত মিটিয়ে নিচ্ছে ।
তাঁর কপালেই শুধু ঢুঁ ঢুঁ । সুপ্রীতি বিশ্ব অর্থনীতির ব্যাপার বোঝেন না । তিনি
শুধু দেখছেন সোনার দাম উঠছে পড়ছে । তাঁর
গয়না পরার শখ, কিন্তু কিনতে পারছেন না । অর্থের জন্য তিনি স্বামীর উপর
সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ।
অন্যদিকে সুকান্ত
দেখেন সোনায় লগ্নি করা মানে ডাহা বোকামি । সোনা বিয়ের সময় ছাড়া কোন কাজে
লাগে না । বিয়েতে বরের মায়ের মুখ থেকে বাঁচতে কনেকে সোনার অলঙ্কার দিতে হয়, না হলে
আজকালকার মেয়েরা সোনার গয়না পরে না, সুকান্ত ভালই জানেন ।
গয়না হয়ে একবার মেয়েদের আলমারিতে ঢুকলে মরণ বাঁচনের মতো দরকার না হলে মেয়েরা সোনা
বিক্রি করে না । তাই সুপ্রীতির গয়নার আবদারকে তিনি
কোন দিন আমল দেননি । ওর বাপ মা তেমন গয়না দিতে
পারে নি । তাঁদের পক্ষ থেকেও গয়না দাবি করা হয় নি, পণের টাকা দাবি
করা হয়েছিল । সুকান্তর তখন নতুন চাকরি, ঘরে দুটো অবিবাহিত বোন, পণ না নিলে চলবে
কেন । পণের টাকা দেওয়াতে সুপ্রীতির বাবা সোনায় কম দিয়েছিল, সুকান্ত
তার কি করতে পারতেন! বিয়ের পর ওর মিষ্টি চেহারা, শান্ত ও বাধ্য
স্বভাবের জন্য গয়নার কমতির দোষ
কেউ বিশেষ ধরেনি। এখন বিয়ের এত দিন কেটে গেছে, গয়না বিশেষ না
থাকাতে তিনি তো আর সুপ্রীতিকে কম ভালবাসেন না । সুপ্রীতি তাঁর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে
গেছে । ওর যা দরকার তা তো তিনি এনে দেনই, না করেন না কখনো ।
ঘরের সাধারণ খরচের বাইরে কোন সখের খাবার বানানোর উপকরণ, কোন
আধুনিক বাসনকোসন, কাপড়চোপড়, এমন কি কোন
মেলাটেলাতে ঘুরতে গিয়ে ইমিটেশনের ছোটখাটো গয়না কেনা--- এসবেও আপত্তি করেন না ।
হাতখরচ টরচ অবশ্য কখনো দেন না । গৃহবধুর আবার হাত খরচের দরকার কি । সুপ্রীতি তাঁর উপর নির্ভর করেই চলে এসেছে এত বছর । ও তো একা একা
বাজারেও যেতে পারেনা । তাছাড়া তিনি জানেন, টাকা গয়না হাতে থাকলে মেয়েদের তেজ
বেশি বেড়ে যায়, কারণ গয়না হল স্ত্রীধন, তার উপর পুরুষের অধিকার থাকেনা। তাই গয়নায় কোন দরকার নেই, লাভ ও নেই । শ্রবণার জন্য কিনলে বরং আগামীতে
লাভ আছে ।
একদিন সময় করে দুজনে শ্রবণার জন্য গয়না কিনতে
জুয়েলারির দোকানে গেলেন । সুপ্রীতি সেই ছোট ননদের বিয়ের সময় গয়নার দোকানে শেষ
গিয়েছিলেন । তাই গয়না সম্পর্কে তাঁর বেশির ভাগ জ্ঞান আত্মীয় প্রতিবেশী মহিলাদের
থেকেই লব্ধ । এখন দেখলেন, দোকানগুলো আরো সাজানো, বড় বড় শো-রুম,
কত রকম গয়না থরে থরে শোকেসে সাজানো, চোখ
ধাঁধানো সম্ভার । কত সুন্দর সুন্দর ডিজাইনের কনেসাজানো সেট, কোনটার
হারে চওড়া লকেট, কোনও হার কয়েক লহরের, প্রত্যেকটা
লহরের মাঝখানে ছোট লকেট, কোনোটা পুরোনো দিনের হাঁসুলি । কোনটার পালিশ যেন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, কোনটা ম্যাট
ফিনিশ, অনুজ্জ্বল, কিন্তু নানা রঙের
মিনাকারিতে রঙ্গিন । সঙ্গে মানানসই কানের দুল ।
খুঁজে খুঁজে
শ্রবণার জন্য কানের ও গলার সেট কেনা হল । গলার হারটিতে বুকজোড়া একদিকে
এলানো সূর্যমুখী, সঙ্গে দুদিকে দুটো করে পাতা । উপরের দুটো পাতার
কোণ থেকে দুদিকে চেন চলে গেছে। কানেও
তেমনি ধরণের অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট দুটো সূর্যমুখীর কানপাশা । দোকানের সেলসগার্ল
সামনে আয়না এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, পরে দেখুন ম্যাডাম, আপনাকে খুব মানাবে ।
সুপ্রীতি বলেছিলেন, মেয়ের জন্য নেব, আমি
পরব কি করে । সেলসগার্ল বলেছিল, মেয়ের জন্য নেবেন তো কি হল,
পরে না দেখলে এটার সৌন্দর্য বুঝতে পারবেন না। পাশ থেকে সুকান্ত ও
বলেছিলেন, পরেই দেখো না কেমন দেখাচ্ছে ।
সুপ্রীতি পরেছিলেন । সেলসগার্লের কথাই ঠিক, হারটা তাঁর
ভরাট গলায় কি অপূর্ব লাগছিল । ফুলটা তাঁর বুকের বিভাজিকার
উপর ফুটে রয়েছে, দুপাশের দুটো পাতার থেকে ওঠা চেন নরম লতার মত তাঁর নিটোল
গলাকে যেন জড়িয়ে ধরেছে আদরে । পানপাতার মত মুখের দুপাশে শঙ্খের মতো দুই কানের পুষ্ট লতিতে ভালভাবে মানিয়ে গিয়েছে বড়বড় দুটো কানপাশা, যেন তাঁর জন্যই
ও দুটো তৈরি হয়েছে । সুপ্রীতি আয়নায় যেন নিজেকেই
চিনতে পারছিলেন না। সেলস গার্ল বলছিল, খুব ভাল লাগছে আপনাকে, ম্যাডাম। পাশ থেকে একজন
সেলসম্যান ও সায় দিয়েছিল। সুপ্রীতি আয়নায়
নিজের দিকে মুগ্ধচোখে চেয়ে রইলেন।
সেলসগার্ল বলল, এই সেটটাই নিন,
ম্যাডাম । সুকান্ত বললেন, তোমাকে যখন মানিয়েছে,
শ্রবণাকেও মানাবে ।
সুপ্রীতি সংবিৎ ফিরে পেলেন, গয়নাগুলো খুলে কাউন্টারের
উপর রাখলেন । সেটটা প্যাক করতে বলে তাঁরা অন্য কাউন্টারে গেলেন । একজোড়া মিনাকারি
করা চওড়া চূড় পছন্দ হল । সুপ্রীতি ট্রায়েল দিতে নিজের হাতে পরলেন । তাঁর ফরসা
সুডৌল হাতে চূড়দুটোর নানা রঙের মিনে সোনার সঙ্গে মিলে যেন রঙবাহার ছড়িয়ে দিল ।
অতএব সুকান্ত সেগুলোই প্যাক করতে বললেন । সব শেষে কিনলেন একজোড়া কঙ্কণ । কব্জির উপর সামান্য ঢিলে হয়ে
গয়নাটা যেন সুপ্রীতির হাতের নিটোল লতানো ভাবকেই ফুটিয়ে তুলছে । এ গয়না অবশ্যই নিতে
হয়। সুকান্ত বিল মিটাতে গেলে সুপ্রীতি পাশে থেকে ভয়ে ভয়ে
দেখলেন, বাজেট
ছাড়িয়ে গেছে অনেক, যদিও সোনার দাম আজকে আরো ও কম । কিন্তু সুকান্ত
তৈরি হয়েই এসেছিলেন । চারটে ডেবিট কার্ড থেকে বিলের টাকাটা মিটিয়ে জিনিসগুলো নিয়ে
বাইরে চলে এলেন ।
বাড়ি ফিরে সুকান্ত বললেন, বাজেট দিয়েছিলে
তিন লাখের, খরচ হল সাড়েতিন লাখের ও বেশি । আরো কমের মধ্যে
দেখতে পারতে ।
সুপ্রীতি বললেন, কমের মধ্যে তো এত ভাল হত না । আর
টাকা তো দেখলাম তোমার কাছে ছিলই ।
টাকা থাকলেই সব খরচ করে ফেলতে হয় না ।
তা হলে দোকানেই বলতেই পারতে, নিতে না ওগুলো
। আমার জন্যে তো আর নাও নি, নিয়েছ মেয়ের জন্য । তাও এত হিসেব
?
সুপ্রীতির গলার স্বরের ঝাঁঝে সুকান্ত একটু চমকালেন ।
তবে কিছু বললেন না । আসলে গয়না বেশি কেনায় লাভই হয়েছে । কিন্তু সেকথা ওকে বলা
যায়না ।
এতগুলো গয়না বাড়িতে রাখা নিরাপদ নয়, সুকান্ত ব্যাঙ্কের সেফ ভল্টে রাখার ব্যবস্থা করে এলেন । পরে একদিন নিয়ে যাবেন ঠিক হল ।
সেদিন বিকেলে কেউ বাড়িতে ছিল না, শ্রবণা কোচিং-এ
গিয়েছে, সুকান্ত অফিস থেকে ফিরতে দেরি হবে বলে জানিয়েছেন ।
সুপ্রীতি একা । ভাবলেন গয়নাগুলো আরেকবার দেখি । ভল্টে চলে গেলে আর চট করে দেখা হবেনা ।
সুপ্রীতি গয়নার বাক্সগুলো খুললেন । একে একে বেরিয়ে
এলো চুড়, কঙ্কণ,
হার, কানপাশা । নতুন সোনার গয়নার দ্যুতি চারপাশে আলো ঠিকরাচ্ছে । তিনি মুগ্ধচোখে
খানিকক্ষণ চেয়ে রইলেন ।
আপনা থেকেই, যন্ত্রচালিতের মত তাঁর হাত কানে উঠে
গেল । পুরোনো দুল খুলে নিল । খুলে নিল গলার পুরোনো ক্ষয়া চেন, হাতের ময়লা রংচটা শাখা পলা চুড়ি । তার জায়গা নিল সূর্যমুখী কানপাশা,
মিনাকারির চওড়া চুড়, কঙ্কণ, গলা বেড়িয়ে সুর্যমুখীর লতার চেন, বুকের বিভাজিকার
উপরে প্রস্ফুটিত সূর্যমুখী যেন তাঁর মুখের পানে চেয়ে রইল । পরনের আটপৌরে তাঁতের
শাড়ী সুতির ব্লাউজ বড্ড বেমানান লাগছিল, সেসব খুলে আলমারি
থেকে বের করে আনলেন বেনারসি, বিয়ের পর থেকে অব্যবহৃত,
বছরে একদিন করে রোদে দেওয়া আর
ন্যাপথালিনের গন্ধমাখা সেই শাড়ি ব্লাউজ । আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সুন্দর করে
সুপ্রীতি ব্লাউজসহ শাড়িখানি পরে ফেললেন।চুল আঁচড়ে খোঁপা করলেন, মুখে অল্প
পাউডার বোলালেন,বড় একটি লাল টিপ পরলেন অল্প পাতলা হয়ে আসা
কিন্তু এখনো কালো ঢেউখেলানো চুলের নীচে ফরসা কপালে। আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকালেন ।
বাইরে কলিং বেলের
শব্দ হল, বোধ
হয় সুকান্ত ফিরেছেন । সুপ্রীতি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেন, দাঁড়িয়েই
থাকলেন------- ।
----------------------------------------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন