“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৭

অকুলীন


।। 
শিবানী দে।।

         
(C)Image:ছবি
  রই জাম খেয়েছেন কখনও
? ডেউয়া, পিচন্টি, মাঠাং বা টেকাটুকি? লুকলুকি বা কাউ? আমি আমার বরাক উপত্যকা  এবং ত্রিপুরার বন্ধুদের জিগ্যেস করছি, কারণ এই নামগুলো ওদিককারই  আবার ওখানেও যারা জন্ম থেকে শহরে আছেন, তাঁরা মনে হয় না এই প্রশ্নগুলোর হাঁ-বোধক জবাব দিতে পারবেন  যারা গ্রামে থাকেন, বা ছোটবেলায় বেশ কিছুদিন গ্রামে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে হয়তো কেউ কেউ এই নামগুলোর সঙ্গে পরিচিত থাকতে পারেন
         এই সবগুলোই ফল, নিতান্তই জংলি, অকুলীন তো বটেই এর মধ্যে শুধু লুকলুকি ফলটাই কদাচিত বাজারে ওঠে, পাকা ফলগুলো কালচে লাল ছোট গোল গোল ফল, প্লামের মত দুহাতের তেলোতে চেপে  ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নরম করে নিয়ে খেতে হয় স্বাদও অনেকটা প্লামের মত, তবে ভেতরে ছোটছোট কটা বিচি আছে, প্লামের মত একটাই আঁটি নয় আমাদের নিতান্ত আপন একটা জংলি দেশি ফলকে চেনাতে একটা বিদেশি ফলের উদাহরণ দেখাতে হল, কারণ প্লাম বিজাতীয় হলেও বাজারে পাওয়া যায়, বিদেশি হলেও আমাদের কিছুটা ঠাণ্ডা পাহাড়ি এলাকায় এর বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হয় লুকলুকি তো প্রায় দুর্লভ, বাণিজ্যিকভাবে কেউ এর উৎপাদনের কথা ভাবে নি, যদিও স্বাদে লুকলুকি প্লামের চাইতে অনেকগুণ ভাল তবুও এ নিতান্তই  জংলি ফল, বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে এর গাছ থাকে, গাছটা লম্বা, তার গা-ভর্তি লম্বা লম্বা কাঁটা ছোটবেলায় দেখতাম, গাছে চড়ার ওস্তাদরা কোমরে গামছা বেঁধে হাতে কাটারি নিয়ে কাঁটাগুলো কাটতে কাটতে গাছে চড়ত, গামছার কোঁচড়ে ফল পেড়ে রেখে গাছ থেকে নামত আজকাল বেশির ভাগ বন কেটে বসত হয়ে গেছে, তাই ফলটাও দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে   
               বাকি যেগুলো ফলের কথা উল্লেখ করলাম, সেগুলো একান্তই বুনো, আকারে ছোট, এতটাই জংলি যে  তাদের ফল বলে কেউ মর্যাদাই দেয় না এইসব গাছ কেউ লাগাতও না, পাখি, কাঠবেড়ালি বা ভাম, যাকে ওখানে টলা বলে, তারা ফল খেয়ে বিষ্ঠাত্যাগ করলে তাতে  বীজগুলো অবিকৃত  থাকত, সেইসব বীজ থেকেই  পরের প্রজন্মের গাছ গজাত খুব ছোট ছোট গুলোকে যেমন মাঠাং, টেকাটুকি, পিচন্টি---- এইগুলোকে ওখানে গুটা বলা হয়, ‘গুটা মানে ফল হলেও কোনো কুলীন ফল, যেমন আম জাম কাঁঠালকে গুটা বলা হয় না অথচ গুটাগুলোর স্বাদ বেশ ভালোই, বেশির ভাগই পাকলে টকমিষ্টি অন্তত আমাদের ছোটবেলার সেই পাড়ার মোড়ে মোড়ে চকলেট-টফি-চিপস-এর দোকানবিহীন সময়ে সেগুলোকে অমৃত মনে হত, পাখি বাঁদর কাঠবেড়ালি, তাদেরও খাদ্যের কোনো অভাব হত না
           করইজাম কালোজামের জংলি ভাই, সাইজে ছোট, শাঁস কম, স্বাদ প্রায় একই কাউ হল কমলা রঙের বর্ষাকালীন ফল, লটকা(ভুবি)র মত মোটা খোসার ভেতর তিন চার কোয়া থাকে, কিন্তু লটকার মত একই বোঁটাতে নয়, আলাদা আলাদা ধরে, আকার একটা ছোট কমলালেবুর মত স্বাদে টক মিষ্টি, একটা জংলি গন্ধ আছে এ পর্যন্ত একটাই কাউগাছ দেখেছিলাম কাউ ও মাঠাং-এর গাছ বেশ বড় হয় মাঠাং  গাছের ছোট ছোট পেঁপের বিচি থেকে সামান্য বড় কালচে-লাল পাকা রসালো টকমিষ্টি ফল নিচে  ঝরে পড়ে, কুড়িয়ে খেতে হয় পিচন্টি গাছ অনেকটা ঝোপের মত, বেশি উঁচু হয় না মাঠাঙ্গের সাইজেরই ফল, কিন্তু পাকলে পুরোপুরি কালো, খেতে অনেকটা শুকনো মিষ্টি কুলের মত স্বাদ  টেকাটুকির গাছও খুব বড় দেখিনি, এ বোধ হয় সব চেয়ে ছোট ফল, গোলমরিচের থেকেও ছোট একসঙ্গে থোকা থোকা ধরে, টক মিষ্টি ডেউয়ার গাছ খুব উঁচু হয়, কাঠ আসবাবপত্র তৈরিতে লাগে, হলুদ রঙের ফলগুলো স্পঞ্জের মত, স্বাদ পানসে, এগুলো খাবার চাইতে বেশি  ব্যবহার হত স্লেট মুছতে!  
              লটকা ও জংলি ফলই, তবে তার ফলন বেশি, দেখতে সুন্দর, খেতেও ভালো, তাই বোধ হয় বাজারমূল্য বেশি গাছ ও খুব উঁচু নয়, গাছে খুব বেশি উপরে চড়তে হয় না, ফলগুলো হলুদ মুক্তোর মালার মত কাণ্ড থেকে ঝুলতে থাকে, গাছে থাকা পাকা ফলগুলো চমৎকার দেখায় বুনো আমড়া পাওয়া যেত, আঁটিসর্বস্ব, সুগন্ধি, স্বাদে কষায়, টক ও মিষ্টির সমাহার জলপাইও জঙ্গলে হত, সেগুলো নিতান্তই আমাদের নিজস্ব, ভূমধ্যসাগরীয় জলপাইয়ের দূর দূরান্তের আত্মীয় কিনা বলতে পারব না, টক, কিন্তু তেল লবণ লঙ্কা সহযোগে অত্যন্ত মুখরোচক জঙ্গলে আরো হত বেতের ঝোপে বেতের গুটা’, খেতে সুপুরির মত, কিন্তু দাঁতে ভাঙতে ঘণ্টাখানেক লেগে যেত
            এইসব ফল ছিল তখনকার ছেলেমেয়েদের সারাদিনের চিবোনোর জিনিষ, যাকে আজকাল বলে মাঞ্চিং   সারাবছরই কিছু না কিছু থাকত, এই টিলা নাহয় ওই টিলায় মাটিতে ঝরে পড়া ফল তুলে খেতে তখনকার দিনে  কোন অসুবি্ধে ছিল না, কারণ তখন পরিবেশদূষণের বালাই ছিল না এখন অনেক টিলাই তার মাটি শহরের জলায় হারিয়ে সমতল হয়ে গেছে, যেসব টিলা আছে, সেগুলোও পরিষ্কার করে অন্যান্য প্রয়োজনীয় গাছ লাগানো হয়েছে, তাই পুরোনো গাছগুলোও বেশির ভাগই হারিয়ে গেছে, সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছে তাদের ফলের উপর নির্ভর করা জীবন ও  


কোন মন্তব্য নেই: