“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৭

৬ ডিসেম্বর: বাবরি মসজিদে কি ঘটেছিল সেদিন?

           পঁচিশ বছর আগের একদিন। ভারতের উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যার ফৌজাবাদ জেলায় জড়ো হয়েছে হাজার হাজার হিন্দু ধর্মাবলম্বী করসেবক, দেশের নানা প্রান্ত থেকে রামমন্দিরের সমর্থনে এখানে জড়ো হয়েছে ওরা। মাথায় লাল ফেট্টি, গায়ে গেরুয়া বসন, হাতে জপমালা আর গলায় ভক্তির গান। ওরা আসছে দলে দলে, হাজার ছাড়িয়ে লাখের বেশী হয়ে গেছে সংখ্যা। অযোধ্যার যে জায়গাটায় বাবরি মসজিদ, সেখানটাই ওদের গন্তব্যস্থল। সেখানে পূজাপাঠ হবে, রসেবা হবে রাতে। সেসবে যোগ দিতেই ওদের আগমন, অন্তত মোটাদাগে জানা গিয়েছিল এটুকুই।
কিন্তু এই মানুষগুলোর হাত ধরেই যে রচিত হবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সবচেয়ে ন্যক্কারজনক নজিরগুলোর একটি, এক রাতের কীর্তিতেই ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়বে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, যে দাঙ্গা কেড়ে নেবে হাজারো নিরীহ প্রাণ- সেটা বোধহয় কল্পনাতেও ছিল না কারো। প্রশাসন কিংবা পুলিশ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিল, শঙ্কা তাদের ছিল খানিকটা, কিন্তু সেই বালির বাধের নিরাপত্তার ঘেরাটোপ যে করসেবকেরা পেরিয়ে যাবেন বিনা বাধায়, সেটাই বা কয়জনে ভেবেছিল?

বিতর্কটা অনেক পুরনো। বাবরি মসজিদ না রামমন্দির? মোঘল সম্রাট বাবরের সময়ে বানানো এই মসজিদের নিচেই নাকি চাপা পড়ে আছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের হাজার বছরের পুরনো মন্দির, এমন দাবী তুলে সেই মসজিদের জায়গায় মন্দির নির্মাণের দাবী ছিল অনেক আগে থেকেই। ১৯৪৯ সাল থেকে মসজিদে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল বিতর্ক আর দাঙ্গার আশঙ্কায়। সেবার কে বা কারা মসজিদের ভেতরে ঢুকে দেয়ালে এঁকে গিয়েছিল রাম আর সীতার ছবি। আদালতের রায়ে হিন্দুদের পূজার জন্যে মসজিদের তালা খুলে দেয়া হয় ১৯৮৬ সালে, আর ১৯৮৯ সালে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর অনুমতি নিয়ে সেই জায়গায় বাবরি মসজিদের পাশেই রাম মন্দির স্থাপনের শিলান্যাস করে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ।
ভারতের কট্টরপন্থী রাজনৈতিক দল বিজেপি, ভোটের রাজনীতিতে সুবিধা পেতে রামমন্দির ইস্যুটাকে পাকড়াও করেছিল তারা। আবার কংগ্রেস সরকারও সেখানে মন্দির নির্মাণের অনুমতি দিয়ে হিন্দু নেতাদের হাতে রাখতে চাইছিলেন। এই দুইয়ে মিলিয়ে নিজেদের প্রবল পরাক্রমশালী ভাবা শুরু করেছিল কট্টরপন্থী কিছু ধর্মীয় নেতা। ১৯৯০ সালে বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানী যখন রামমন্দিরের সমর্থনে গুজরাট থেকে রথযাত্রা শুরু করলেন, এদের অনেককেই দেখা গেল ভদ্রলোকের মুখোশ পরে সেখানে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে।
১৯৯২ সালের ৫ ডিসেম্বর লক্ষ লক্ষ করসেবক জড়ো হয়েছিল সরযু নদীর তীরে, অযোধ্যা তখন গেরুয়া বসনের সেবকদের দখলে চলে গেছে মোটামুটি। এর আগেও দলে দলে রামমন্দিরের দাবিতে ওরা হাজির হয়েছেন এখানে, কিন্তু কোনবারই খুব বাড়াবাড়ি কোন ঘটনা ঘটেনি, বা ঘটতে দেয়া হয়নি। সেবকদের ওপরে কর্তৃত্ব বজায় ছিল রাজনীতিবিদ বা ধর্মগুরুদের। শহরে পুলিশ নামানো হয়েছে, যদিও সেটা সংখ্যায় অপ্রতুল, তবে বাবরি মসজিদ আর রামমন্দিরের বিতর্কিত জায়গাগুলো তখনও বেহাত হয়ে যায়নি। কর্মকর্তারা বারেবারেই সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘এভরিথিং ইজ আন্ডার কন্ট্রোল’!

      সেই কন্ট্রোল ভেঙে পড়লো পরদিন সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ। লালকৃষ্ণ আদবানী বা মুরলিমোহন যোশী মতো নেতারাও তখন উপস্থিত। কিন্তু তাদের বক্তব্য শোনার আগ্রহ দেখা গেল না কর্মীদের মধ্যে, আগের দিন বিকেল থেকেই তেঁতে আছে তারা, ওদের উসকে দেয়ার লোকেরও অভাব ছিল না। দলীয় বা ধর্মীয় ক্যাডারেরা ওদের বুঝিয়েছে, প্রতিবার ওদের দলে দলে এখানে নিয়ে আসা হয়, তারপর নামকাওয়াস্তে একটা সমঝোতা করে বুঝিয়ে শুনিয়ে ফেরত পাঠানো হয়- সেই রীতি আর চলবে না! যা হবে, এবারই হবে, এবার না হলে কোনোবার নয়। তাঁতিয়ে দেয়া হয়েছে এই বলে যে, এতকিছুর পরেও যার রক্ত জেগে উঠবে না সে আসলে হিন্দুই নয়! বকধার্মিকের দল এভাবেই সেবকদের উত্তেজিত করে তুলেছে, মগজটাকে ইচ্ছেমতো তালগোল পাকিয়ে খিচুড়ি বানিয়েছে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির আকাঙ্ক্ষায়। মুম্বাই থেকে আসা কয়েকশো জনের একটা দল তো নিজেদের সঙ্গে শাবল-গাঁইতিও নিয়ে এসেছে!
সকাল থেকেই নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে কয়েক দফায় ঠোকাঠুকি হয়েছে ওদের, হুট করেই তরুণ এক সেবক বেষ্টনী ভেদ করে ঢুকে পড়লো কর্ডন করে রাখা সীমানার ভেতরে, দৌড় দিলো মসজিদের মিনারের দিকে। আশ্রমের সাধু স্বামী ধরমদাস আগে ছিলেন পালোয়ান, ওই তরুণকে এক হাতে ধরলেন তিনি, তারপর সীমানার কাছে গিয়ে মাথার ওপরে তুলে ছুঁড়ে দিলেন সেবকদের জমায়েতের দিকে। অগ্নিস্ফুলিঙ্গ এতক্ষণ ভেতরে ভেতরে ফুটছিল, এবার দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো। স্বেচ্ছাসেবকদের বেষ্টনী, নিরাপত্তাকর্মীদের ঘেরাটোপ, কোনকিছুর পরোয়া করলো না সমবেত জমায়েত, প্রাচীর ভেঙে সোজা দলে দলে গিয়ে চড়তে লাগলো বাবরি মসজিদের মিনারের ওপরে। শাবল-গাঁইতি-রড দিয়ে ভাঙা শুরু হলো মিনারের একাংশ।
মাইকে তখন হিন্দুত্ববাদের পোস্টারবয় লালকৃষ্ণ আদবানীর গলা শোনা যাচ্ছে, সেবকদের শান্ত হতে বলছেন তিনি। কে শোনে কার কথা! মসজিদ ভাঙার নেশা তখন চড়ে বসেছে সবার মাঝে। হাজারে হাজারে মানুষ চড়ে বসেছে মিনারের ওপরে, মসজিদ ভাঙছে লোকে, নিরাপত্তা-কর্মীরা তাকিয়ে দেখছেন, অনেকেই প্রাণ নিয়ে ভেগেছেন ততক্ষণে। উন্মত্ত এই স্রোতকে সামলানোর শক্তি তাদের নেই। সাংবাদিকেরাও নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ক্যামেরায় বন্দী করছেন সেসব দৃশ্যকে। উমা ভারতী, সাধ্বী ঋতম্ভরার মতো ব্যক্তিরা নীচে থেকে নেচে নেচে গাইছেন, গান নয়, শ্লোগান- এক ধাক্কা অউর দো, বাবরি মসজিদ তোড় দো! উল্লাস করতে করতে ওপরের দিকে উঠছে করসেবকদের আরও কয়েকটা দল!
বেলা পাঁচটা নাগাদ ভেঙে পড়লো বাবরি মসজিদের তিনটে মিনারই। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতৃত্বে অযোধ্যায় মিছিল বের করা হলো, যে হিন্দু পরিষদের নেতারা এতক্ষণ করসেবাস্থলে মাইকে গলা ফাটিয়েছেন সবাইকে শান্ত হবার আহ্বান জানিয়ে! পুরোটাই যে একটা আইওয়াশ ছাড়া আর কিছুই নয়, সেটাই বোঝা গেল এই ঘটনায়। মিছিল থেকে হামলা চালানো হলো মুসলমান পাড়ায়, তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। দাঁড়ি-টুপিতে কাউকে দেখলেই তেড়ে গেল হিন্দু পরিষদের কর্মীরা, মোটামুটি আরও চব্বিশ ঘণ্টা সময়-জুড়ে এই ত্রাসের রাজত্ব চলেছে অযোধ্যাজুড়ে, ধীরে ধীরে ছড়িয়েছে পুরো উত্তরপ্রদেশে, সেই সাম্প্রদায়িকতার বারুদ সমগ্র ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশ আর পাকিস্তানেও। তিনটে দেশেই সংখ্যাগরিষ্ঠদের হাতে নির্যাতিত হয়েছে ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘুরা, কোথাও তাদের পরিচয় মুসলিম, কোথাও বা হিন্দু। তারাও যে মানুষ’, সেই পরিচয়টা মনে রাখেনি কেউ!


বাবরি মসজিদ ভাঙার পরেই বেঁধে গিয়েছিল সাম্প্রদায়িক দাঙা, সেটাই অবশ্যম্ভাবী ছিল। গুজরাটের দাঙ্গাতেই প্রাণ হারিয়েছে দুই হাজারের বেশি নিরীহ মানুষ, ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলোতেও বিনষ্ট হয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। হিন্দু-মুসলিমের পাশাপাশি সহাবস্থান ভেঙে গিয়েছে, তথাকথিত সেক্যুলারিজমের অস্তিত্ব ভারতে নেই- এটাও প্রমাণ হয়ে গিয়েছে সেই সময়ে। দাঙ্গাবাজদের কোন নির্দিষ্ট দেশ নেই, ভূখণ্ড নেই, সীমানাও নেই। ওপাড়ের মুসলিম ভাইদের ওপর নির্যাতনের খবর শুনে যেমন বাংলাদেশের কারো কারো ঈমানী জোশ জেগে উঠেছিল, মন্দির ভাঙা কিংবা ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের। সেই ধারাটা বজায় আছে এখনও।
           সেই ভাঙা মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণ এখনও হয়নি, তবে ২০১৯ সালেই কাজ শুরু হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। তবে এমন ঘোষণা এর আগেও একশোটা এসেছে অন্তত। শুধুমাত্র ধর্মীয় কিছু কট্টরপন্থী মানুষের অযথা আস্ফালন আর নেতাদের স্বার্থসিদ্ধির কোপানলে পড়ে সাধারণ সেবকদের উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়েছিল আজ থেকে ঠিক পঁচিশ বছর আগে, যে ঘটনা প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল হাজার হাজার নিরীহ মানুষের। তাতে কার কি লাভ হয়েছে সেটা জানা যায়নি আজও!
তথ্য - সূত্র দৈনিক আনন্দবাজার, কলকাতা। 


কোন মন্তব্য নেই: