।। শিবানী ভট্টাচার্য দে ।।
সেই
দিনগুলোতে রাত হলেই রুমনদের বাড়িতে ইঁদুরের নাচন কোদন শুরু হয়ে যেত। চাল রাখবার টিনের ঢাকনা একটু আলগা থাকলেই সকালে দেখা যেত অর্ধেক
চাল সাবাড়, বাকী চাল ইঁদুরের নাদিতে ভর্তি । কাঁচা তরকারির ঝুড়িতে আলুগুলো বেবাক গায়েব । ডাইনিং
টেবিলে ফলের ট্রে-তে কলাগুলো আধখাওয়া । রুমনের বই খাতা মাঝে মাঝেই ঠিক জায়গায় নেই । যখন পাওয়া
যেত, কোন বইএর পাতা কুটিকুটি, কোন
বইএর কোনা কাটা । সব কিছু
ভারি বাক্সে বা আলমারিতে তুলে রাখতে হত । শেষে একদিন
গভীর রাত্রে কিছুক্ষণ ধরে একটা শব্দ পেয়ে যখন রুমনের বাবা কুণাল করাত দিয়ে
চোর দরজা কাটছে ভেবে লাঠিসোটা খুঁজছিল, আর রুমনের মা স্বাতী আলো
জ্বালতেই একটা ধেড়ে ইঁদুরকে দরজার ধার থেকে পালিয়ে যেতে দেখল, তখন তারা ঠিক করে ফেলল, ঢের হয়েছে, এবারে একটা বিহিত করতেই হয় ।
কুণাল বলল, কালকেই বাজার থেকে ইঁদুরের বিষ
আনতে হবে । স্বাতী বলল, না না, বিষ খেয়ে ইঁদুর যেখানে সেখানে মরে পড়ে থাকবে, পচে
গন্ধ হবে, পোকা হবে । তুমি বরং একটা ইঁদুর মারা কল নিয়ে এস । আয়ামাসি
দুটো প্রস্তাবই বাতিল করে দিল । বলল, রুমন দিদিভাই ছোট মানুষ,
কখন কলে আঙুল ঢুকিয়ে দেবে, কলে পড়া ইঁদুর
কামড়াবে । বিষে কাজ নেই, কলেও কাজ নেই । তার চাইতে বৌদি,
তোমরা একটা বেড়াল পোষ । রুমনের সঙ্গে খেলবে, ইঁদুর
ও পালাবে ।
রুমনদের
বাড়ির মেঝে কাঠের, দেওয়ালে সিমেন্টের পলেস্তারা, উপরে
টিনের চাল, চালের নিচে পাতলা প্লাই-এর সিলিং । অরুণাচলপ্রদেশের পুরনো সরকারি বাড়িগুলো এরকমই । এধরণের ঘরে থাকতে ভাল, তবে ইঁদুরদের পোয়াবারো। কাঠের
মেঝের নিচে মাটিতে ওদের গর্ত । রাতের বেলা সেখান থেকে বেরিয়ে দেওয়ালের গা বেয়ে
ছাদের উপরে উঠে দৌড়ে বেড়ায়, শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় । সেখান
থেকে আবার দেওয়াল বেয়ে নিচে নামে, সারা ঘরময় ঘুরে বেড়ায়,
যা পায় খায়, নষ্ট করে । দরজা বন্ধ করে রাখলে
আজকাল কাঠের উপর দাঁত চালানোর চেষ্টা করছে ।
রুমনের মা
স্বাতী স্কুলে পড়াত । পরদিন স্কুলে গিয়ে
অবসর সময়ে বাড়িতে ইঁদুরের উৎপাত নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করছে, স্কুলের
পিয়ন নরবাহাদুর কাছেই ছিল। সে বলল, ম্যাডাম,
আমার বাড়িতে দুটো বেড়ালছানা আছে, এই ছ’মাসের মত বয়স । নিয়ে আসব ?
স্বাতী বলল, দুটো
লাগবে না, একটাই নিয়ে এসো ।
ম্যাডাম, একসঙ্গে
দুটো থাকলে ওরা নিজেদের মধ্যে খেলা করবে, খুশি থাকবে ।
দুটোকেই নিয়ে নিন না । কাল নিয়ে আসব, আপনার বাড়িতে পৌছে দেব
।
স্বাতী বলল, ঠিক
আছে, তাহলে দুটোকেই নিয়ে এসো ।
পরদিন
রবিবার ছিল, নরবাহাদুর সকালবেলাই রুমনদের বাড়ি নিয়ে এল। হাতে একটা বড়
ঝোলা। দরজার কাছে রুমন দাঁড়িয়েছিল, রুমনকে জিগ্যেস করল,
বলতো, ঝোলার মধ্যে কী ?
রুমন বলল, কী?
কী নিয়ে এসেছ? দেখাও?
নরবাহাদুর
নিচে বসে ঝোলা খুলে দিল। তুরতুর করে দুটো বেড়ালছানা ব্যাগ থেকে বেরিয়ে এল।
রুমন
হাততালি দিয়ে উঠল । চেঁচিয়ে ডাকল, বাবা, মা,
এসো এসো, দেখে যাও । নরবাহাদুরদাজু দুটো বেড়াল এনেছে ।
রুমনের বাবা, মা, আর আয়ামাসি
সবাই বেরিয়ে এল । কিন্তু বেড়ালছানাদুটো ততক্ষণে সোফার তলায় লুকিয়ে পড়েছে । রুমন হামাগুড়ি দিয়ে সোফার তলায় ওরা কী করছে
দেখতে লাগল, ওরা গোল গোল চোখে রুমনকে দেখল । রুমন বলল, আয়, বেরিয়ে আয়, তোদের মারব না।
নরবাহাদুর বলল, এখন তোমাকে ভয় পাচ্ছে, কালকে
দেখবে ঠিক ভাব হয়ে যাবে।
বেড়াল দেখে
সবাই খুশি । নরবাহাদুর রুমনের মাকে বলল, ম্যাডাম, বেড়ালছানা দুটো এখন মাছ মাংস ভাত সবই খেতে পারে । রুমনের মা বলল, তাহলে তো ঠিকই আছে। নরবাহাদুর বলল, তবে ওরা ছোট তো, ওদের মার কাছে থাকছে না,
তাই রোজ অল্প দুধ দেবেন, ওরা ভাল থাকবে ।
চা খেয়ে
নরবাহাদুর চলে গেল । আয়ামাসি বাচ্চাগুলোর জন্য বাটিতে করে দুধ নিয়ে এল । ওরা বাটির
দিকে তাকাল, কিন্তু বেরোলো না । আয়ামাসি বলল, নতুন
লোক দেখেছে, তাই ওরা ভয় পাচ্ছে । পরে ঠিক বেরোবে । চল রুমন,
আমরা এখন সরে যাই । রুমনের সরতে
ইচ্ছে করছিল না, সে একটু পিছিয়ে গিয়ে দরজার আড়ালে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। রুমনের মা
বাবাও সরে গেল । সবাই চলে যাবার পর বাচ্চাগুলো বেরিয়ে এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে দুধের
বাটিতে মুখ দিল। রুমন ছুটে রান্নাঘরে গিয়ে আয়ামাসিকে ফিসফিস করে বলল, দেখ’সে,
ওরা দুধ খাচ্ছে । আয়ামাসি রুমনের সঙ্গে পা টিপে টিপে এসে দেখল,
দুটো বেড়ালই বাইরে এসেছে, একটা গুটিসুটি মেরে
বসে রয়েছে, অন্যটা দুধ খাচ্ছে। যে দুধ খাচ্ছে, সেটা একটু ছোট, হালকা ছাই রঙের, যেটি বসে
রয়েছে সেটি সামান্য বড়, গায়ে হালকা ছাইয়ের উপর কালো কালো ডোরাকাটা।
মানুষের
সাড়া পেয়ে দুটোতে আবার সোফার তলায় লুকিয়ে পড়ল। দুধও শেষ
হয়ে গিয়েছিল। আয়ামাসি রান্নাঘরে
চলে গেল। রুমন মার কাছে গিয়ে সব কথা বলল। ওর মা স্কুলের খাতা দেখছিল।বাবাও কিছু
কাজ করছিল। মা বলল, বেড়ালছানাগুলোকে বিরক্ত করো না। তাহলে ওরা ভয় পেয়ে পালিয়ে
যাবে।রুমন বলল, আমি কিছু করিনি তো। ওরা মিছিমিছি ভয় পাচ্ছে।
খালি লুকিয়ে আছে। বাবা বলল, আজকে আমরা বল কিনে আনব। দেখবি,
ওরা তোর সাথে খেলবে ।
দুপুরবেলা
আয়ামাসি ওদের মাছভাত খেতে দিয়েছিল । মাছের কাঁটা ছাড়িয়ে ভাতের সঙ্গে মাখিয়ে
দিয়েছিল ঠিক যেমন করে রুমনকে খেতে দেয়। সবাই সরে গেলে
ওরা সোফার তলা থেকে বেরিয়ে এসে খেতে থাকল, এবারেও বড় ছানাটা পেছনে থাকল,
ছোটটা আগে এসে খেতে শুরু করে দিল। রুমনের খুব
কৌতূহল, চুপি চুপি দাঁড়িয়ে ওদের কাণ্ড দেখতে থাকল। দেখল, ছোট ছানাটা সব খেয়ে ফেলেছে, বড়টা চুপটি করে বসে আছে
। রুমন আয়ামাসিকে ডেকে বলল, দেখ দেখ, ছোট
বেড়ালটা বড় বেড়ালটাকে খেতেই দিচ্ছে না। তখন আয়ামাসি আরও কিছু খাবার প্লেটে ঢেলে বড়টার দিকে প্লেটটা
ঠেলে দিল । একটু পরে বড় বেড়ালছানাটা উঠে এসে আস্তে আস্তে খাবার খেল, যেন
তার তেমন খিদে পায়নি, ছোটটা আগে খেয়েছে দেখেই তার শান্তি
হয়েছে ।
সন্ধ্যেবেলা
রুমন বাবার সঙ্গে বাজারে গিয়ে একটা রঙচঙে বল নিয়ে এল। বলটা গড়িয়ে গড়িয়ে
বেড়ালছানাদের দিকে দিতে থাকল।প্রথমটা ওরা একটু ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছিল, তারপর
সোফার তলা থেকে বেরিয়ে এসে থাবা দিয়ে ধরে খেলতে লাগল ।
রাতে ওরা
কোথায় ঘুমোবে ? রুমন বলল । ওদের বিছানা করে দেবে না ?
আয়ামাসি বলল, ঠিক
আছে, ওদের বিছানা পেতে দিচ্ছি। একটা
পিচবোর্ডের বাক্সে চট ও পুরোনো
কাপড় বিছিয়ে ওদের বিছানা করে দিল আয়ামাসি। কিন্তু ওরা কিছুতেই বাক্সে আসবে না, সোফার
তলা থেকে বেরিয়ে ফুড়ুত করে বেডরুমে রুমনদের খাটের নিচে ঢুকে গেল। আয়ামাসি ওদের
বিছানাটা বেডরুমেই দিয়ে গেল ।
রুমন মাকে
বলল, ওরা আমাদের ঘরে শোবে। খুব মজা। মা বলল, ওরা এখন শোবে
না, ইঁদুর তাড়া করে বেড়াবে ।
আমি ওদের সঙ্গে খেলব, রুমন
বায়না ধরল ।
তুমি এখন
ঘুমোও,
তোমাকে কাল স্কুলে যেতে হবে । ওরা তো থাকছেই । কালকে আবার খেলবে ।
রুমন আর কী করে।
খানিকক্ষণ উসখুস করে শুয়ে পড়ল ।
রুমন আর ওর
মা দুজনেরই স্কুল সকালবেলায়। রুমন কেজি স্কুলে বি ক্লাসে পড়ে। সাতটায় স্কুলে যায়, এগারোটায় স্কুল শেষ হলে
আয়ামাসির সঙ্গে ফেরে। আজ রুমন স্কুলে গিয়েই বন্ধুদের কাছে বেড়ালের গল্প করল। ওর বন্ধু আঙ্গা বলল, দু-দুটো বেড়াল? আমিও মাকে বলব আমাকে
দুটো বেড়াল এনে দিতে ।
তোর মায়ের
স্কুলে কি নরবাহাদুর দাজু আছে? কী করে বেড়াল পাবে ?
আঙ্গা বলল, তাহলে
আমার মা বাজার থেকে আনবে ।
রুমন বলল, বেড়াল
বাজারে পাওয়া যায় না ।
আঙ্গা বলল, আমার মা
বেড়াল আনবেই আনবে ।
স্বাতী অন্য
স্কুলে পড়ায়, ফিরে দুটোয় । মা যতক্ষণ
না ফিরে, রুমন ততোক্ষণ বেড়ালগুলোর সঙ্গে খেলতে থাকে । আস্তে আস্তে
ওদের ভয় অনেকটা কেটে গিয়েছে, রুমনের কাছে আসছে । তবে ছোটটা কাছে এলেও বড়
বেড়ালটা কিন্তু একটু দূরে দূরে থাকে, চটকালে ভালবাসেনা । রুমন
অনেকবার ওদেরকে কোলে নিতে চেয়েছে, ও উসখুস করে নেমে যায় ।
রুমন বলল, মা,
এদের নাম কী হবে ? স্বাতী ইতিহাস পড়ায়,
ঐতিহাসিক নাম ভালবাসে । স্বাতীদের গ্রামের বাড়িতে একটা চাঁদকপালে
ষাঁড় ছিল, তার নাম ছিল চন্দ্রগুপ্ত, আর
একটা লালসাদা মারকুটে গোরু ছিল, তার নাম ভিক্টোরিয়া। বলল,
বড় বেড়ালটা ছেলে বেড়াল, ওর নাম হোক নেপোলিয়ন ।
ছোটটা মেয়ে বেড়াল, ওর নাম থাক পলিন।
নেপোলিয়ন আর
পলিন নাম কেন রাখলে, মা ?
বড়
বেড়ালটাকে দেখেছিস, কেমন রাজা রাজা চালচলন? খাওয়াদাওয়াতে
কোন লোভ নেই, রয়ে সয়ে খাচ্ছে ? নেপোলিয়ন
ছিল রাজা, বড় বীর । পলিন তার বোনের নাম ।
কদিনের
মধ্যে বেড়ালদুটো বেশ জমে গিয়েছিল। ওদের ভয়ে ইঁদুর আর
আসত না। রাত হলে ওরা ঘরের মধ্যে দাপিয়ে বেড়ায়। দিনের বেলা
বেশিরভাগ সময় ঘুমোয়, রুমন স্কুল থেকে ফিরলে ওর সঙ্গে খেলা করে। রুমন পড়তে বসলে ওরা কাছে এসে ঘুর ঘুর করে, মাঝে
মাঝে চেয়ারের পেছনে, টেবিলের উপর উঠে যায়। যেন বলে, পড়াশুনো
তাড়াতাড়ি শেষ করে আমাদের সঙ্গে খেলবে এস । রুমন ওদের মাথায় আদর করে দেয়, কিন্তু ওর মা ওদের বকে দেয়, স্কেল হাতে নিয়ে বলে,
নাম, নেমে যা। তখন ওরা ভয়
পেয়ে নেমে যায় । রুমন বলে, ওদেরকে
বকো কেন মা ?
মা বলে, না
বকলে বেড়ে যাবে । বইপত্র ছিঁড়ে দেবে, নিচে ফেলবে ।
কয়েকমাস পর রুমনদের বাগানে কেউ আরো দুটো বেড়ালছানা ফেলে
গেল । সেগুলো আরোও ছোট। রুমন সেগুলোকেও তুলে নেয়ে এলো। ঘরে এখন চারটে বেড়াল, রুমন
স্কুলে গিয়ে গল্প করল । আঙ্গা ওর মায়ের কাছে বেড়ালের জন্য বায়না ধরেছিল, কিন্তু ওর মা বেড়াল আনতে রাজি হয়নি । রুমনের এতগুলো বেড়ালের কথা শুনে তার
খুব লোভ হয় খুব। সে বলল, আমায় একটা দিবি? কিন্তু ওর মা বলে দিল, বেড়াল ঘর নোংরা করবে, ঘরে
আনবি না । শুনে রুমনের রাগ হল । সে বলে দিল, আমাদের
বেড়াল নোংরা নয় । তবে মাঝেমাঝে যখন আঙ্গা রুমনের বাড়িতে খেলতে আসত, সারাক্ষণ বেড়ালের
সঙ্গেই খেলত ।
আয়ামাসি সব
কটা বেড়ালকেই দুধ খাওয়াত । মাছ, শুকনো
মাছ, মাংস, যখন যা থাকে, তা দিয়ে মেখে ভাত খেতে দিত । কিন্তু সব
চাইতে বড় বেড়ালটা সেই আগের মতই ছোটদের খাবার পর নিজে খায় । কিন্তু
একদিন হল কি, অন্য পাড়ার একটা হুলো বেড়াল
চুপিচুপি এসে খাবারে মুখ দিয়েছে, বড় বেড়ালটা এমন ফ্যাঁস ফ্যাঁস
করে তেড়ে উঠল যে সে পালিয়ে গেল তক্ষুনি । বড় গোঁফ, হলদে চোখ, ডোরাকাটা
গায়ে সে দেখতেও বেশ ভারিক্কি হয়ে উঠছিল।
কুণাল বলল, এবার
নতুন বেড়ালগুলোর জন্য কি ঐতিহাসিক নাম বাছাই করলে ?
স্বাতী বলল, এবারে
সাধারণ নামই রাখব । নতুন বেড়ালদুটোর নাম হবে কিটি আর স্নোয়ি ।
ওদের একটা
কালোসাদা আর অন্যটা পুরো সাদা ।
তখন থেকে
নেপোলিয়ন, পলিন, কিটি, স্নোয়ি
বলেই বেড়ালগুলোকে ডাকা হত । কিন্তু আয়ামাসিকে
নিয়ে হল মুস্কিল। সে কিছুতেই অতবড় নাম বলতে পারে না, শেষ অবধি নেপোলিয়ন তার
কাছে হয়ে গেল ন্যাপলা । পলিন নামটা তার কাছে হয়ে গেল পলানি, শেষঅবধি
পালানি, কারণ সে প্রায়ই পালাত । কিটি হল কুটি, স্নোয়ি হয়ে গেল সনি ।
রুমন, তার
মা, বাবা, যেই যখন ঘরে ফিরত, আয়ামাসি বেড়ালদের গল্প করতে থাকত । ন্যাপলা কী
করেছে,
পালানি কোথায় গেছে, কুটি সনি কটা পোকা মেরেছে,
স-ব । ওর মুখে বেড়ালদের
নাম শুনতে শুনতে ওর দেওয়া নামগুলোই থেকে গেল, আসল নামগুলো আর কেউ বলে না । এমন কি স্বাতীও মাঝে মাঝে নিজের দেওয়া নামগুলো
ভুলে ন্যাপলা, পালানি বলে ফেলে। কুনাল হাসতে
হাসতে বলে, আয়ামাসি তোমাকেই তোমার দেওয়া নাম ভুলিয়ে দিল ।
স্বাতী বলে, কী
আর করা, বাসন্তী ওইরকম নামেই অভ্যস্ত । চল, বেড়াল ইঁদুর মারলেই হবে ।
ন্যাপলা
ছাড়া বাকি বেড়ালগুলো একটু বড় হতেই পাড়া বেড়াতেও শুরু করল, পালানি
তো একবার কোথাও যায় তো এক দু দিন পরে আসে। শুধু ন্যাপলাই কোথাও যেত না । সে সব সময়
বাড়িতে থাকত । তার জন্য
রুমনদের বাড়িতে ইঁদুরের উৎপাত একেবারে কমে গিয়েছিল । মাঝে মাঝে সে কাক কুকুরকেও
তাড়া করত, অচেনা লোক দেখলেও ফোঁস ফ্যাঁস করত।
খুব বেশি
কারো গা ঘেঁষত না, খিদে পেলেও মিউমিউ
করত না । শিকার করার ইচ্ছে না থাকলে সে খাটের কিংবা সোফার নিচে ঘুমোত । শীতকালে
শোবার ঘরের জানালার ধারে রোদ পড়ে, সেখানে ঘুমোত, রাতের বেলা রান্নাঘরে তার নিজের বাক্সের ভেতরে
। কিন্তু সহজে বিছানায় ওঠত না। বাকি তিনজন বিছানায়
ঘুমোনোর জন্য মুখিয়ে থাকত। নিজেদের জায়গায়
কিছুতেই ঘুমোবে না । রুমন অবশ্য
ওদের নিয়ে ঘুমোতে চাইত, তবে ওর মা বাবা বেড়ালদের বিছানায় তুলতে
মানা করত । তবুও ওরা
লুকিয়েচুরিয়ে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ত । খুব ভোরবেলা দরজা খুলে দিতে হত বাইরে যাবার
জন্য । বাগানে গিয়ে ওরা পটি সেরে আসত ।
পলিন ঘরে
এসেই মিউ মিউ করতে শুরু করত, গা ঘেঁষে বসত, খাবার
দেখলে আগেই খেতে যেত। কিটি
স্নোয়িও তাই। তিনজনের মধ্যে কাড়াকাড়ি, ফ্যাঁস ফোঁস লেগে যেত। পলিন নিজের প্লেটের খাবারটা গবগব করে খেয়ে
অন্যদের খাবারে ভাগ বসাত । তখন আয়ামাসি তাকে
সরিয়ে দিয়ে অন্যদের খাবার সু্যোগ করে দিত । কিন্তু
নেপোলিয়ন একই রকম। তার খাবারে অন্যরা
মুখ বসালেও, তার কোন হেলদোল নেই। আয়ামাসি মাছরাখার বাসন একটু খোলা রাখলেই অন্য বেড়ালছানাগুলো
তার কাছে ঘুরঘুর করত, মুখ দিতে চাইত। কিন্তু ন্যাপলার বেলায় অন্য কথা। সে কখনো চুরি করে খাবার তালে নেই। তাকে তার
নির্দিষ্ট জায়গাতে খাবার দিলেই তবেই খেত। সেজন্যে রুমনের বাবা
কুণাল পর্যন্ত একদিন বলেছিল, বাব্বা, এত ভদ্রলোক
বেড়াল কখনো দেখিনি ।
রুমনদের
বাড়ির পেছনে একটা আমগাছ ছিল, বেড়ালরা গাছের কাণ্ডে নিজেদের নখ শানাত। ন্যাপলাও মাঝে মাঝে গাছে চড়ত । কিটি স্নোয়ি যত বড় হচ্ছিল, গাছে
চড়া শিখছিল । একবার কিটি লাফিয়ে
গাছে ওঠে, গড়িয়ে নিচে
স্নোয়ির উপর পড়ে। স্নোয়ি পরের বার ওঠে, তারপর
কিটির ঘাড়ের উপর পড়ে । ন্যাপলা থাকলে খেলা
আরো ও জমে যেত, দুজনেই ন্যাপলার উপর লাফিয়ে পড়ত । ন্যাপলার ল্যাজে কামড়াত । ন্যাপলা কিছু বলত না, শুধু
ওরা বেশি লাফালাফি করলে একটু সরে বসত, কিন্তু দূরে যেত না।
একদিন হয়েছে কি, স্নোয়ি অনেক কষ্ট করে গাছের উপরে খানিকটা
উঠে দুটো ডালের মাঝখানে আরাম করে বসে ল্যাজ নাড়াচ্ছিল, কোত্থেকে
একটা কাক এসে ঠোট দিয়ে ল্যাজ
টানতে শুরু করল । স্নোয়ি বেচারা ম্যাও ম্যাও করছে, মাঝে মাঝে ঘাড় বাঁকিয়ে
কাকটাকে দেখছে, কাকটা কেয়ারই করেনা । সে একবার ল্যাজ ছেড়ে দিচ্ছে, আবার
টানছে । স্নোয়ি বেচারা ওর
সঙ্গে পেরে উঠছে। ন্যাপলা
নিচে ছিল, উপরের দিকে তাকিয়ে এমন জোরে ফ্যাঁস করে উঠল যে কাকটা উড়ে
পালাল ।
শুধু তাই নয়, ন্যাপলা
যদি কখনো ঘাসফড়িং বা আরশোলা শিকার করত, তখনও ছোট বেড়াল কেউ
কাছে থাকলে তাকেই খেতে দিত । ইঁদুর মারলে
সে নিজে খেত না, ফেলে রাখত, অন্য বেড়ালকে খেতে দিত। ছোটদের প্রতি ওর ভালবাসা দেখে রুমনের মা স্বাতী
পর্যন্ত অবাক হয়ে বলত --- বাব্বা, নেপোলিয়নের কী দাদা দাদা ভাব!
একবার
রুমনদের বাড়িতে সাপ ঢোকার জো হয়েছিল । সেবার ন্যাপলার জন্যেই ঢুকতে পারেনি । কেউ
জানত না ন্যাপলা কেন ফ্যাঁস ফ্যাঁস করছে । তারপর যখন সে তেড়ে যাচ্ছে, তখনই
সবার চোখ পড়ল যে ঘরের পেছনের সিঁড়ির পাশে একটা মাঝারি সাপ । ন্যাপলা তাড়া করায়
সেটা উলটো পথে বাড়ির সীমানার বেড়ার দিকে জঙ্গলে তড়িঘড়ি ঢুকে গেল।
সাপটাকে
ঘরের কাছে দেখে আয়ামাসি, রুমন, এমন কি রুমনের
বাবা পর্যন্ত ভয় পেয়ে গিয়েছিল । রুমনের মা কাছে ছিল না, নাহলে
রুমনকে ঘরের ভেতর তো ঢুকিয়ে দিতই, ওর বাবাকে পর্যন্ত বাইরে
যেতে মানা করত ।
সাপ তাড়িয়ে
ঘরে ঢুকে ন্যাপলা রুমনের চেয়ারের নিচে এমন চুপচাপ শুয়ে পড়ল যেন সে কিছুই করেনি । রুমন তার মাথায় আদর করে দিল। আদর খেয়ে
সে লম্বা হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ।
সেদিন সবাই
বলেছিল বাব্বাঃ, আজ ন্যাপলা আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। ঘরে সাপ ঢুকলে কোথায় যে
ঘাপটি মেরে থাকত, বা
কাকে কামড়ে দিত ঠিক নেই। মা স্কুল থেকে ফিরলে রুমন সব কথা বলল । স্বাতী বলল,
নেপোলিয়নের জন্য আমরা সবাই আজ রক্ষা পেলাম । কুণাল বলল, হাঁ, ও আজ যা করেছে, তাতে তাকে তার আসল নামেই ডাকা উচিত ।
রুমনদের
বাড়িতে কেউ এলেই কথাবার্তার মধ্যে নেপোলিয়নের প্রসঙ্গ আসতই। রুমনের
বাবার বন্ধুরা, মায়ের বন্ধুরা, রুমনের বন্ধুরা, সবাই তার নাম জেনে গিয়েছিল, তাকে চিনে গিয়েছিল ।
অনেকেই বলত, এরকম একটা বেড়াল থাকলে কি ভালোই না হত। কিন্তু
ওরকম ভাল বেড়াল তো সহজে
কোথাও পাওয়া যায়না । যারা তাকে চিনত না, তারাও তার নাম ও কাজের কথা
জেনে গিয়েছিল ।
বেড়ালগুলো
আসবার বছর দুয়ের মাথায় রুমনের বাবার ট্রান্সফার এসে গেল। ওদের কলকাতা চলে যেতে হবে, কারণ
বাবা কলকাতা অফিসে জয়েন করবে । রুমনের মা
এখানের চাকরি ছেড়ে ওদিকে চাকরি দেখে নেবে। সব বাঁধাছাদা চলতে লাগল। রুমনরা চলে
গেলে আয়ামাসিও নিজের দেশের বাড়িতে চলে যাবে ।
রুমন বলল, মা,
বেড়ালেরা কোথায় থাকবে? ওদেরকেও নিয়ে চল না ।
মা বলল, বেড়াল
নিয়ে অতোদূরের রাস্তায় যাওয়া যায়না, রুমন। ওদেরকে ছেড়ে
যেতেই হবে। তবে দেখব, কেউ যদি ওদের বাড়িতে নেয় ।
কিন্তু দেখা
গেল, যারা বেড়াল নিতে আগ্রহী, তাদের কেঊই আবার একটার বেশি
দুটো বেড়াল নিতে চায় না । বেশির ভাগই নেপোলিয়নকেই নিতে চাইছে । ওদিকে তাকে কেউ
ধরতেই পারে না । অন্য লোক তার দিকে আসতে দেখলেই সে ফ্যাঁস করে উঠছে । বাড়ির কেউ
তাকে তুলতে চাইলেও সে চট করে কোল থেকে নেমে যাচ্ছে। পলিনকে তো পাওয়াই যাচ্ছে না,
কিটি স্নোয়িও আজকাল অন্য লোক দেখলেই বারে বারে সরে যাচ্ছে । তারা
যেন প্রতিজ্ঞা করে বসেছে তারা আর কোথাও থাকতে যাবে না ।
রুমন বাবার
কাছে বায়না জুড়ল, বেড়ালগুলোকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাই না, বাবা
?
তা তো পারা
যাবে না রুমন , বাবা বলল ।
শুধু
ন্যাপলাকে নিয়ে যাই তাহলে ? রুমন বলল।
কী করে হবে ? দেখিস
না ন্যাপলা ওদের গার্জেন ? ন্যাপলাকে নিয়ে গেলে ওদের কী হবে ?
বাবা হেসে বলল ।
রুমন বলল, তা
ঠিক। কিন্তু ওর চোখে জল এসে গেল। সে বলল, ন্যাপলা তো আমাদের
ও দেখে রাখত ।
বাবা বলল, কি
করব বল, অনেক দূরের রাস্তা যে । এখান থেকে
গাড়িতে যেতে হবে, তারপর ট্রেনে দুদিনের রাস্তা । অতোটা রাস্তা বেড়াল নিয়ে যাওয়া
যায় না, রুমন ।
রুমন বাবার
সমস্যা বুঝল । কিন্তু তার কান্না পাচ্ছিল । কেন যে বাবার ট্রান্সফার এল !
পলিন, কিটি,
স্নোয়ির অত বোধ বুদ্ধি নেই, তারা নিজেদের মত
খায় দায় পাড়া বেড়ায় । কিন্তু নেপোলিয়ন বাঁধা জিনিষপত্রগুলোর কাছে ঘুরঘুর করছিল।
মাঝেমাঝে রুমন ও তার বাবা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে যেন কিছু একটা বোঝার চেষ্টা
করছিল । যাবার দিন যখন লরিতে মালপত্র চড়ানো
হচ্ছিল, কিটি স্নোয়িদের সাথে বাইরে খেলবার ও তার মন ছিল না । ওরা তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে গাছে চড়ে লাফিয়ে নিচে
নামছিল বারবার । নেপোলিয়ন একবার ও আজ সেদিকে তাকাচ্ছিল না । সে পেছনের সিঁড়িতে বসে
ঘরের ভেতরে তাকাচ্ছিল । খাবার সময় এলে পলিন বাড়ি চলে এল । আয়ামাসি শেষদিনের মত
সবাইকে খেতে দিলে অন্যরা আগেকার মতই খেল, কিন্তু নেপোলিয়ন খাবারের ধারেই
ঘেঁষল না । আয়ামাসি ওকে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, যা,
ন্যাপলা, খেয়ে নে, কিন্তু
সে নিজের জায়গা থেকে উঠল না । যখন বাড়ি
তালা বন্ধ হয়ে যাবে, তখন সবাই বেরোচ্ছে দেখে সে এক ছুটে ঘরের
ভেতর থেকে বেরিয়ে এল । তারপর একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে বাড়ির চৌহদ্দি ছাড়িয়ে বেরিয়ে
গেল, তার জীবনে এই প্রথম । গাড়িতে উঠতে উঠতে রুমন দেখল,
নেপোলিয়নই আগে আগে যাচ্ছে, পেছনে পলিন,
কিটি, স্নোয়ি ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন