“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

সাকিন আসাম, ১৯৮৩



ঊর্ধ্বেন্দু দাশ
(C)Image:ছবি
 ( সুপরিচিত, বহুপঠিত এই কবিতাটি ঊর্ধ্বেন্দু দাশের 'এই লজ্জা তোমার আমার' কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। পরে 'নাইন্থ কলাম' প্রকাশিত 'নির্বাচিত কবিতা'-তেও সংকলিত হয়। আসাম আন্দোলন এবং সম্পর্কিত পরবর্তী রাজনীতির আবর্তে কবিতাটি এখনো সমান প্রাসঙ্গিক ভেবে আমরা ঈশানের পাঠকদের জন্যে তুলে দিলাম। ---সুশান্ত কর)







 
 
 
 
 
 
 
গ্নস্তূপের মাঝে আজ এই পরিত্যক্ত গাঁয়ের চাতালে
আশি বছরের পোড়া রূপের দেমাক নিয়ে শুয়ে আছে আমার নানিমা,
হন্তারক মানুষের জান্তব পদচ্ছাপ বুকে নিয়ে শস্যহীন বসন্তের মাঠ,
রক্তাক্ত পাঁকে দ্যাখো মুখ গুঁজে পড়ে আছে আমার হানিফ চাচা, তার
বাষট্টির পোড় খাওয়া, গুলিতে ঝাঁঝরা-হওয়া শরীর জুড়িয়ে।---
খোদার মসজিদ আর ঈশ্বরের নামঘর, মাঝে শতাব্দীর টানা অন্ধকার পথ,
পথের দুধারে ছিন্ন শরীর, ভিন্ন
            প্রৌঢ়ের শির, দীর্ণ জননীর যুগল উরোজ।---
ওদিকে ভরলি আর এধারে কলঙসুঁতি, কপিলি, দিখৌ---
লুইতের পার ধরে জলের উজানে যাও, জলের ভাটায় যাও,
শ্মশান, ---শ্মশান। ...
চাপরি, লাহরিঘাট, গোড়েশ্বর, চাউলখোয়া, নেলি,
চামগুড়ি,গহপুর, মাজুলি, শিলাপাথার, নওজান, নিয়ামাটি, হাজো---
সর্বত্র চিতা জ্বলছে : ‘ এই জুই জ্বলিছে , জ্বলিব।’---

কারা বলে এ-আগুন জ্বলছে, জ্বলবে---ওরা কারা?---
ওরা কি মানুষ? না-কি মানুষের শব ঘিরে অশরীরী প্রেত বা পিশাচ?---
কারা  বলে ‘এই যুঁজ মানুহর অস্তিত্বর যুঁজ’?---
বুলেট ও তিরের মুখে,ছোরা- ভোজালির কোপে
                        ভূলুণ্ঠিত তামাম নসিব।–
বুনো উলুখড় আর হোগলাপাতায় ছাওয়া অগণন আশ্রয়- শিবির,
সেখানে চোখের জলে ভেসে চলেছে স্বামীহারা, পুত্রহারা, জায়া ও জননী,---
এধারে ভৈয়াম আর ওদিকে ডুয়ার্সের শরণার্থী-শিবিরে আমারই
তেত্রিশের সোনাবৌদি, তেরোর কিশোরী বোনটি, একান্ত পেটের জ্বালায়
গতর বিকোতে, দ্যাখো, দাঁড়িয়েছে টানা রাজপথে। ...
এই লজ্জা, হে স্বদেশ! শতাব্দীর ঘৃণ্যতম হে মশান,
                                    তোমার, আমার!
এই পাপ, হে মানুষ! ভাষা-ধর্ম-প্রজাতির প্রেত অন্ধকারে মগ্ন
হে পিশাচ, তোমার—আমার। ...

তিন সমুদ্রের জল, সাতাশ নদীর ঢল, এসেছিল পেরিয়ে সেবার
গুটিকয় ধড়িবাজ লালমুখো দানো,---
বাঁহাতে তাদের টানা ফিরিস্তি, ডানহাতে রঙিন আতস কাচ; বলে
ওরা নাকি এদেশের মানুষের নিরঙ্কুশ ভালো করতে চায়। ----
বরফের অভ্রছোঁয়া দেওয়াল ডিঙিয়ে আসে, সেই শীতে, দানোর দোসর
হলুদ-ছোপানো-মুখ আরো কিছু শিকারি শ্বাপদ, ---
পকেটে তাদেরো চড়া ইস্তাহার : ওরা নাকি মানুষের তামাম নসিব
বদলে দিতে চায়। ...
কোথাও মানুষ ছিল, --- মানুষের বুলে ভালোবাসা;
কোথাও অরণ্য দূর,---ন্যগ্রোধের পল্লবিত হাত;
কোথাও পুষ্পিত পথ, ---কুসুমের চোখে দীপাবলি । ---
মানুষের সব গিয়ে, হিংসা ও হনন আজ হয়েছে পাথেয়;
মানুষের চোখ থেকে বহুদিন নিভে গ্যাছে মহাবোধি আলো;
মানুষের সবই গ্যাছে। --- আছে শুধু পতন ও বিনাশের এক
প্রাতিস্বিক ভয়। ...

অথচ এসবই নিয়ে গান বাঁধে, ছবি আঁকে ভাড়াটে শিল্পীরা। ...
কুকুর-কেত্তন হয়। সংবিধান-মতে ঢের ঢলাঢলি, মাতামাতি হয় ।---
দিল্লি থেকে ছুটে আসে হিন্দুর গার্জেন, কিংবা মোসলেমের ফুফা :
তান্ত্রিক হুল্লোড়ে কাঁপে অহর্নিশ বুক নিঝুম শিশুর,
কেঁপে ওঠে মাদার টেরেসা। ---

হাজার বছর ধরে তবু এই পথ দিয়ে হেঁটে গ্যাছে মানুষের মুখ,
হাজার বছর ধরে এ পথে এসেছে ফিরে অন্তহীন মানুষের মুখ,
হাজার বছর ধরে এই পথে উদয়াস্ত মানুষের মুখের মিছিল। ...
গাঁয়ের ঝিঊড়ি যাবে বধূ হয়ে, চোখ মুছে, ভিন জনপদে;
রূপমতী কনেটির হাত ধরে ঘরে ফিরবে এগাঁয়েরই দামাল ছেলেটি;
নামঘরে চাকি জ্বলে, মাজারে মোমের শিখা; ‘কে যায়? কে যায়?’---
‘মই হে আসাদ ভাই, পানিরাম বরা।’ ---
‘কেনি যোয়া?’--- ‘এ-রা!
নামঘরলৈ যাম। ককাদেউতা হলোঁ।’
‘দাঁড়াও হে বরাভাই! আমিও হয়েছি নানা, ---দামাদের খৎ দেখে যাও।’
ভস্মস্তূপের মাঝে এ মহার্ঘ ছবিখানি
আজ এই পরিত্যক্ত গাঁয়ের চাতালে
কোথায় হারিয়ে গ্যাছে! হন্তারক মানুষের জান্তব পদচ্ছাপ বুকে
বীজ-পত্র---শস্যহীন, নদীও---নক্ষত্রহীন, আদিগন্ত বসন্তের মাঠ---
লুইতের পার ধরে জলের উজানে যাও,জলের ভাটায় যাও,
সর্বত্র চিতা জ্বলছে; শ্মশান, ---শ্মশান; ...

হাজার বছর ধরে যদিও এপথ দিয়ে শোনা গ্যাছে
কল্লোলিত জীবনেরই গান। ---

কোন মন্তব্য নেই: