।। অর্জুন শর্মা।।
(C)Image:ছবি |
বড় রাস্তার বাঁকের ভিতরের দিকে
রাজাদের ‘বস্তি’ । পলিথিনের ছাউনি, সরষের তেলের পুরোনো টিনের ঢাকনা এবং খড় বা ছনের বেড়া দিয়ে যে যেভাবে
পারে নিজেকে আড়াল করে রেখেছে । ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এলে ভিজে,কাঁপে,জ্বরজারি হয়,ওষুধ খায়,সেরেও যায় । এসব কেউ গা করে না । একটা হাতচাপা কল আর লুঙ্গার মাথায়
একটা ডোবা আছে । জলের চিন্তা নেই । মহিলাদের অনেকে গঞ্জে গিয়ে
বাবুদের বাড়িতে কাজ করে । কেউ রাজমিস্ত্রির যোগালি, ফেরিওলা , মাটিকাটার
কাজ বা অন্য কিছু করে। পুরুষরাও সকালে খাবারের পুঁটুলি নিয়ে বেরিয়ে কাজ খোঁজে । না পেলে বস্তিতে ফিরে আসে । এছাড়া প্রায় সব ঘরেই আছে চোলাই
মদের ঠেক । রাস্তা দিয়ে যেসব গাড়ি যায় তার
ড্রাইভার ও সহযোগীরা বস্তিতে এসে গলা ভিজিয়ে যায়, জিরিয়ে নেয় । এসবের কোন দিনরাত নেই । ছোট বড়ো যে যখন ঘরে থাকে চোলাই
সাপ্লাই করে । গাড়িওয়ালার কারণে এবং নিজেদের
মধ্যে হরঘড়ি খিস্তি খেউড়ের কারণে বস্তি দিনরাত মুখরিত থাকে ।
রাজার কাছে জায়গাটা এমনিতে ভালই
লাগে । শুধু মা তিরিক্ষি মেজাজে থাকলে তার খুব
ইচ্ছে করে এ জায়গা ছেড়ে চলে যেতে । ভয়ও করে । তবে সপ্তপর্ণীর কাছে গেলে ভয়টা চলে যায় । সপ্তপর্ণীর যখন ফুল ফোটে তখন
বস্তির চোলাইয়ের গন্ধ ছাপিয়ে যায় সেই সুগন্ধে । সপ্তপর্ণীই তার বন্ধু । বস্তির লোকেরা হরদম তাকে দুচ্ছার
করে , খারাপ
খারাপ কথা বলে । বিশেষ একটা কথায় সে একা একা কাঁদে । তখন একমাত্র সপ্তপর্ণীই তাকে
সান্ত্বনা দেয়, আদর করে, চোখের জল মুছিয়ে দেয় । ভালো ভালো কথা বলে ।
কোন কোন রাতে ট্রাক থামিয়ে ঐ
লোকগুলো যখন মাকে খারাপ কথা বলে তখনো তার যেদিকে খুশী চলে যেতে ইচ্ছে করে । তাড়াতাড়ি বড়ো হতে পারলে মাকে নিয়ে
চলেই যাবে । কিন্তু সে তো বড়ো হচ্ছে না । এই দশ বছর বয়সেও মা যখন তাকে বুকে
জড়িয়ে ঘুমোয় তখন সে সারা দুনিয়ার রাজা হয়ে যায় । দিদা বলেছে দুনিয়া নাকি অনেক বড় । এইরকম কোটি বস্তির সমান । ‘কোটি’ শব্দটা সে শুনেছিল তারক মাস্টারের ইস্কুলে । তারক মাস্টার বলেছিল কোটির চেয়ে
বড় আর কিছু হয় না । এখন সে আর তারক মাস্টারের ইস্কুলে
যায় না।
দিদা তাকে কত ভয় দেখিয়েছে, শেষ শরতে সপ্তপর্ণীর
ফুলের গন্ধে সাপেরা নাকি গাছের কাছে চলে আসে। গাছে পেঁচিয়েও থাকে । গাছে ভুতেরও বাস । কিন্তু রাজাকে নিরস্ত করতে পারে
নি । সে রোজ সপ্তপর্ণীর তলায় গিয়ে হেলান দিয়ে
বসে । লুঙ্গাটার শেষ প্রান্তে ঝোপের
ভিতর সপ্তপর্ণী দাঁড়িয়ে । কেউ পারতপক্ষে সেদিকে যায় না । এই এলাকায় এত বড় গাছ
আর নেই । মা কাজে চলে গেলেই সে চলে আসে সপ্তপর্ণীর কাছে । কত কথা যে বলে সপ্তপর্ণীর সঙ্গে
তার ঠিক নেই । দুপুর রোদে ঘুমিয়েও পড়ে সপ্তপর্ণীর তলায় । তখন সপ্তপর্ণী তার গায়ে হাওয়া করে, ছায়ার আড়াল দেয় । একদিন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এল । সপ্তপর্ণী বলল, আমাকে জড়িয়ে ধর । সপ্তপর্ণীর গা-চোঁয়ানো জলে তার
খোলা বুক ভিজে গেল। সপ্তপর্ণী বলল, আমিও তোর মতো, আমারও জামা নেই । তার মন ভাল হয়ে গেল ।
সে ঝোপ থেকে বন কূল ,আমলকি পেড়ে এনে খায় । বুনো জাম, টেকরই, কাউ, লাল গোটা, কটকি ফুলের
গোটা, আরো কত কী খায় ! তেষ্টা পেলে জল-গাছে’র আগা চিবোয় । সপ্তপর্ণী খিল খিল করে হাসে, খা খা, তোর জন্যই তো
গাছে গাছে ফল ধরে আছে । তুই খেলে গাছেরা কত খুশী হয় দেখেছিস । কালুর দাদুর উপর খুব রাগ হয় রাজার। সপ্তপর্ণীর ফুল ফুটলেই বুড়োটা
খেপে যায় । বুড়োটা বলে ‘ছাইত্যান’গাছ । একবার একটি পাতা তারক মাস্টারকে
সে দেখিয়েছিল । তিনি বলেছেন, এর নাম ‘সপ্তপর্ণী’, দেখেছিস কেমন সাতটি পাতা সুন্দর করে
সাজানো। ডালগুলো
ছাতার মতো চারিদিকে ছড়িয়ে আছে । তাই একে ‘ছাতিম’ গাছও বলে । দেখেছিস বনের মাঝে সব গাছ ছাপিয়ে রাজার মতো দাঁড়িয়ে থাকে ।
শুনে রাজার খুব ভাল লেগেছিল । আরো বলেছিল, এই গাছের ছাল, মূল, পাতা থেকে নাকি অনেক ওষুধ বানানো
হয় । ‘সপ্তপর্ণী’ নামটা বেশ লাগে । দক্ষিণী হাওয়ায় যখন ফুলের গন্ধ বস্তিতে আসে তখন বুড়োটা নাক
ধরে বলে, কী
বাজে গন্ধ ! এত দুরেও থাকা যায় না ! গাছটাকে একদিন কেটেই দেব । রাজার খুব ভয় করে । অথচ গাছে যখন থোকায় থোকায় হাজার হাজার ফুল ফোটে তখন রাজার
কাছে মনে হয় পুরো এলাকাটা যেন আলোকিত হয়ে যায় ।
রাজাকে দেখলেই বুড়ো একটা না একটা
কাজ করাবেই । একদিন সে সবেমাত্র সপ্তপর্ণীর দিকে হাঁটা
দিয়েছিল । বুড়ো বলল, কী হে রাজা বাহাদুর,
কোথায় চললি ? আমার সঙ্গে আয় তো । রাজার রাগ হল । বুড়ো তাকে দিয়ে খাটিয়ে নেবে, আর খারাপ কথা বলবে । সে পাশ
কাটিয়ে চলে যেতেই খিস্তি, এই নবাবের বাচ্চা, গায়ে যে দেখছি বাতাস লেগেছে । রাজা থামে না। বুড়ো চেঁচাচ্ছে, হবেই তো যার বাপের ঠিক
নেই তার তো দেমাক হবেই । কথাটা কানে যেতেই রাজা ছুট লাগায় । এক দৌড়ে সপ্তপর্ণীর তলায় গিয়ে হু
হু করে কাঁদতে থাকে । তখনই সপ্তপর্ণীর গলা শোনে, আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখ । সেও তাই করে । একটা বাতাস এসে গায়ে লাগে । সে শীতল হয় । কান্না থেমে যায় । চোখের জল মুছে যায় বাতাসে ।
এই কারণেই তো সে তারক মাস্টারের ইশকুলও
ছেড়ে দিয়েছে । দুই ক্লাস পর্যন্ত পড়েছিল । বহু অপমান সে সহ্য করেছে । অপমান বলতে সে বুঝে সেই বিষয়টা যা
তার মনের খুব ভিতরের একটা জায়গায় খুব কষ্ট
দেয় । কালু, দুলু, রকেট, দেবা সবাই তাকে কষ্ট দিতো ইশকুলের দিনগুলোতে । যখনই ঝগড়া হতো তখনই ঐ কথাটা বলে
দিত যা শুনলে তার ছোট্ট মাথাটার ভিতরে আগুন জ্বলে উঠতো । তখন মনের গহীনে কী যে কষ্ট হতো তা
সপ্তপর্ণী ছাড়া আর কেউ বুঝে না । সেই কষ্টটা বাঘকাঁটার খোঁচার থেকেও কোটি কোটি গুণ বেশী । রাজার সঙ্গে কেউ কুস্তিতে পারে না, বল লাথি দিয়ে এত দূরে
নিতে পারে না, ডাংগুলি খেলায় পারে না, এত
সুন্দর ধনুক বানাতে পারে না, লাটিম ঘোরাতে পারে না, পাতার বাঁশী বানাতে পারে না,
ডোবার জলের এপার ওপার করতে পারে না । যখন তাকে কিছুতেই হারাতে পারে না
তখনই ঐ খারাপ কথাটা বলে দেয় । রকেট আর দেবাটাই বেশী করে । মুখ ভেংচিয়ে বলে, এই বেজম্মা, আমাদের সঙ্গে তোর কীসের মিল ? আমাদের বাপ আছে,
আর তোর ? সে কুঁকড়ে যায় ।
মাকে একদিন রাগ করে বলে দিল, মা আমি কি বেজম্মা ?
বেজম্মা মানে কী ? বেশ, মা’র মুখটা মুহূর্তেই মেঘের মতো ঘন কালো হয়ে গেল । কালুর দাদুটার মুখেই প্রথম সে ঐ
শব্দটা শুনেছিল । মানে না বুঝলেও কথাটা যে খুব খারাপ সেটা সে বুঝতে পেরেছিল । মা সেদিন কাজে যায় নি, রান্না করে নি । দিদা তাই মাকে আরো খারাপ খারাপ
কথা বলল । ভয়ে সে মার কাছে ঘেঁষে নি । দুপুর
রোদে সপ্তপর্ণীর তলায় গিয়ে কেঁদেছে । কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে । স্বপ্ন দেখেছে । সপ্তপর্ণী তার শিয়রে বসে মাথাটা
কোলে নিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে দিয়েছে , ঠিক মা’র মতো । সেদিন রাতে ঘুমুতে গিয়েও মা’র থেকে দূরে শুয়েছিল । ঘুম আসছিল না । হঠাৎ মা
তাকে বুকে টেনে নিয়ে সপ্তপর্ণীর মতো আদর করে দিল । চুলে আঙ্গুল ঢুকিয়ে বিলি কেটে দিল । সে মা’র বুকে মুখ গুঁজে টের পেল
মা’র বুকে খুব কান্না জমেছে । তারক মাস্টারের কাছে শোনা সাগরের মতো ঢেউ উঠছে মা’র বুকে । কিন্তু ঢেউগুলি থমকে আছে । মাকে সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, যেমনটা সপ্তপর্ণীকে ধরে । তার কষ্ট কমে যায় । বুঝতে পারে মা’র বুকে একটা বড় পাথর জমে
আছে ।
আরো ছোটবেলায় যখনই বাবার কথা
জিজ্ঞেস করতো, মা তখন দূরের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে দিয়ে বলতো, ওই দিকে
চলে গেছে । আসবে একদিন । ইশকুলের খাতায় লিখে দিয়েছিল আর
তাকে শিখিয়ে দিয়েছিল বাবার নাম রবি দাস । সেই রবি নামের লোকটাকে দেখতে তার খুব
ইচ্ছে করে । বাবা ডাকতে ভারী ইচ্ছে করে দুলু রকেটদের মতো । তখনই মনের সেই জায়গাটায় টনটন করে
ওঠে । লোকটা একবার এলেই তার কষ্টটা চলে
যেত । দুলু, রকেট আর ঐ দুষ্টু বুড়োটাও খুব জব্দ হয়ে
যেত । বস্তির সকলের থোঁতা মুখ ভোঁতা হয়ে
যেত । সেও আবার তারক মাস্টারের ইস্কুলে যেত । লোকটা কি সেকথা বুঝে না ? তারক মাস্টারের সামনেই
জোরে জোরে বলতো, আমি রবি দাসের ছেলে । আমার বাবা
রবি দাস । কতবার যে ‘বাবা’ শব্দটা উচ্চারণ
করত ঠিক নেই । কোটিবারই করত !
দিদাটা কেমন যেন বদলে গেল । আরো ছোটবেলায় কত কত রাজপুত্তুরের গল্প
শোনাতো । অথচ এখন সে দিদাকে সহ্যই করতে
পারে না । দিদার কাছে শোনা ডাইনী বুড়ির মতোই
লাগে দিদাকে । মাকে প্রতিদিন খারাপ কথা বলে । সন্ধ্যের পর মা তাকে নিয়ে ঘুমুতে
গেলেই বুড়ির চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায় । বলে, এই নবাবের ঝি, মদের গেলাসগুলো
রেডি করে রাখ । আমি একা পারি ?
কাল রাতেও এই নিয়ে তুমুল ঝগড়া করল
বুড়ি । মাকে যা তা বলে গালাগাল করল । মা বলল, আমি এখন উঠতে পারব না,
রাজাকে ঘুম পাড়াবো । বুড়ি এবার রাক্ষুসীটার মতো রেগে গেল , সোহাগ দেখে বাঁচি না । কত দেখলাম ! যার জন্মের ঠিক নেই তার জন্য এতো ? তখন কতবার বলেছি, এসব
আপদ খালাস কর । শুনলে তো আমার কথা ? এখন ঐ কাঁটাই বয়ে যা সারা জীবন । আরো খারাপ কথা বলছিল । মা তার দুই কানে দুই আঙ্গুল
ঢুকিয়ে চেপে ধরেছে । সেও বেশ জোরে সপ্তপর্ণীর মতো মাকে
জড়িয়ে ধরেছে । কিন্তু টের পেল মাথার রক্তটা গরম
হয়ে যাচ্ছে। পরে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে মনে নেই । সকালে ঘুম থেকেই উঠতেই বুড়ির
গালাগাল মনে এল আর মাথার রক্তটা আবার গরম হয়ে গেল । মাথাটা দুই হাতে চেপে ধরল । কাজ হল না । চোখ বুজেও দেখল দুলু, রকেট, দেবারা হাসছে হি হি করে, বুড়োটা হাসছে খ্যাক খ্যাক করে, বাবুদের বাড়ির লোকেরা
কেমন করে তার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে, ইস্কুলে সবাই
আঙ্গুল তুলে বলছে , এই বেজম্মা, তোর
বাপ কে রে ? সব এক সঙ্গে মাথার ভিতর কিলবিল করে উঠল । রাজা দুই হাতে মাথা চেপে ধরে ছুট
দিল । সপ্তপর্ণীর তলায় গিয়ে হেলান দিয়ে
বসে শব্দ করে কাঁদতে থাকল । একসময় ঘুমিয়ে পড়ল ।
সপ্তপর্ণী তাকে হাওয়া করল, চুলে হাত বুলিয়ে দিল । শেষে বলল, তুই তো রাজা । রাজাদের কোন দুঃখ থাকতে নেই । রাজা বলল, দুনিয়াতে আমার বাবা নেই, এটাই কষ্ট । সবাই যে আমাকে ঐ খারাপ কথাটা বলে তাতেই তো
দুঃখ । সপ্তপর্ণী বলে, দূর বোকা, কে বলেছে তোর বাবা নেই ? আমিই তোর বাবা । আমার কত সন্তান আমি নিজেই জানি না । আর একজন বাড়ল । তবে তোর মতো বোকা সত্যিই নেই রে ! আমিই তো জানি না আমার বাবা কে । এই যে চারপাশে শত শত গাছ, এদের বাবা কে ? এই যে পাখি,
ফুল এদের বাবা কে বল ? এত বড়ো যে আকাশ,
তার বাবা কে ? আমাদের কারো কোন দুঃখ তো নেই । তাহলে তোর কেন থাকবে ? কতগুলো বোকার কথা শুনে
তুই শুধু শুধু কষ্ট পাবি কেন ?
সপ্তপর্ণী তার চোখের জল মুছিয়ে
দিয়েছে । চুলে বিলি কেটে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে । সে আরো জোরে সপ্তপর্ণীকে জড়িয়ে
ধরেছে । মনের সেই জায়গাটার টনটন করাটা কমে গেছে । মাথার রক্তের টগবগ কমে গেছে । সে আবার তারক মাস্টারের ইস্কুলে
যাবে । দুনিয়ার গল্প শুনবে । পাশ ফিরতেই অবাক হল । মা সপ্তপর্ণীর গায়ে হেলান দিয়ে
বসে আছে আর তার মাথাটা মা’র কোলে । মা’র হাতের আঙ্গুল তার চুলে ঘুরছে । সে নিঃশব্দে মাকে আরো জোরে জড়িয়ে ধরল । গনগনে রোদ উঠে গেলেও সপ্তপর্ণীর
ছায়ায় রাজার গায়ে রোদের আঁচ লাগছে না ।
উদয়পুর,গোমতী,ত্রিপুরা ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন