“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ৮ মার্চ, ২০১৯

নারী অধিকার দিবস---কারণ ও সাফল্য




 

শিবানী ভট্টাচার্য দে

নারীদের অধিকারের জন্য একটি গোটা দি কেন আলাদা করে রাখা হল তার কিছু ইতিহাস আছে। উনিশ শতকে ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলোতে শিল্পোন্নতির জোয়ার এসেছিল। প্রচুর কলকারখানা স্থাপিত হয়, এবং উৎপাদন ও রফতানির জন্য লক্ষলক্ষ নারীপুরুষকে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। মালিকের হাতে আসে প্রচুর অর্থ, কিন্তু শ্রমিকদের অবস্থা ছিল খারাপখুবই বিপজ্জনক ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এবং কম পারিশ্রমিকে দৈনিক ১৪/১৫ তাদের খাটতে হত। আর নারীশ্রমিকদের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। তাদের একই ভাবে, কিন্তু পুরুষ  শ্রমিকদের থেকে অনেক কম বেতনে খাটতে হত এই শ্রমিকদের শহরের  আলোবাতাসহীন গলিতে ঘুপচি ঘরে বাস করতে হত। পুরুষেরা তবুও অন্যত্র কাজে যেতে পারত, নারীদের উপর সন্তানদের দায়িত্ব থাকাতে তার উপায় ও ছিল না। শ্রমিক মা-বাবার রোজগার এত কম ছিল যে শিশুদের ও কাজে লাগতে হত, এবং তারা আরো বেশি শোষণের শিকার হত এই অবস্থায় ১৮৩৪ সালে নারীশ্রমিকদের বেতনের হার আরো  কমিয়ে দেওয়া হয়।  ম্যাসাচ্যুসেটস এর লোওয়েল শহরের মহিলা শ্রমিকেরা এর প্রতিবাদ করে, কিন্তু  কর্তৃপক্ষের  উদাসীনতায় কোনো সুরাহা হয় নি। মহিলাদের তখনকার দাবি ছিল আটঘণ্টার কাজ, শিশু শ্রমিকদের উপর শোষণ বন্ধ, ও বেতন বৃদ্ধি । ছাঁটাই  ও অন্যান্য শাস্তির ভয় সত্ত্বেও বছরের পর বছর মেয়েদের এই প্রতিবাদ আন্দোলন চলতে থাকে। কারখানাগুলোর ভেতরের অনিরাপত্তা এতই ব্যাপক ছিল যে ১৯১১ সালে এক পোশাক তৈরির কারখানায় আগুন লেগে ১৪৫ জন মহিলা মারা যায়। কারখানার ঠিকমত বেরোনোর রাস্তাই ছিল না।
            শোষণ ও অব্যবস্থার প্রতিবাদে মহিলাদের আন্দোলন চলতে থাকলেও কিন্তু  পুরুষ শ্রমিকদের ইউনিয়ন নারী শ্রমিকদের নিজেদের ইউনিয়নে স্থান বা সমর্থন  দেয় নি, কারণ তারা মহিলাদের নিজেদের থেকে হীন ভাবত, এবং মহিলাদের আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল পুরুষ শ্রমিকদের সমান বেতন, এবং সরকারি সহ অন্যান্য চাকরিতে নিয়োগের দাবিপুরুষ শ্রমিকেরা চেয়েছিল চাকরির ক্ষেত্রে পুরুষদের নিয়োগ হবার পর খালি থাকলে সেই জায়গাতে নারী কর্মী  নিয়োগ করা যেতে পারে। নারী ভোটাধিকারের ও প্রচণ্ড বিরোধিতা করা হচ্ছিল। ততদিনে ইউরোপে পুরুষ নারী নির্বিশেষে শ্রমিকদের সপক্ষে, তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। সমাজতান্ত্রিক ঢেউ আমেরিকায় পৌঁছলে নারীরা  নিজেদের আন্দোলনের পোক্ত প্ল্যাটফর্ম খুঁজে পেল। 
     
প্রথম নারী অধিকার দিবস উদযাপন হয়েছিল জাতীয় নারীদিবস হিসেবে, নিউ ইয়র্কে, ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। এর আহবায়ক ছিলেন আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক দল, সোশ্যালিস্ট পার্টি অব আমেরিকা-র সভানেত্রী থেরেসা মাল্‌কিয়েল। এরপর ১৯১০ সালের অগাস্ট মাসে ডেনমার্কেরকোপেনহ্যাগেনে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক মহিলা কনফারেন্স আহবান করা হয়েছিল। এও ছিল আমেরিকার সোশ্যালিস্ট নারীদের  আয়োজিত, যেখানে জার্মান সমাজতন্ত্রী নারী লুইসি জিট্‌স একটি বার্ষিক নারীদিবসের প্রস্তাব করেন, এবং কম্যুনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেট্‌কিন এবং কেট ডানকার দ্বারা সমর্থিত হন। এই সভায়  নারীদের ভোটাধিকার, রোজগার, সরকারি চাকরিতে নারীদের নিয়োগ, শ্রমের পারিশ্রমিকে নারীপুরুষের বৈষম্যের দূরীকরণ, ইত্যাদি বিষয়ে তুমুল দাবি তোলা হয়। এর পর থেকে শুধু আমেরিকা নয়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নারী অধিকার আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে।
১৯১৪ সালের ৮ মার্চ জার্মানির মহিলারা ভোটাধিকার দাবি করে আন্দোলন গড়ে তোলেন। দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯১৮ সালে তাঁদের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়। ১৯১৭ সালের ৮ মার্চ রাশিয়ার পেট্রোগ্রাডে  নারী বস্ত্রশিল্প শ্রমিকেরা একটি ধর্মঘট ডাকেন। এটাই ছিল রাশিয়ার ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সূচনা। এর রেশ ধরে লেনিনের নেতৃত্বে বিখ্যাত অক্টোবর বিপ্লবে  নারীরা যোগ দেন রুটি ও শান্তিস্লোগান দিয়ে  এবং যুদ্ধের সমাপ্তির দাবি নিয়ে, কারণ প্রথম মহাযুদ্ধ চলছিল, এবং দেশে খাদ্যের দারুণ অভাব দেখা দিয়েছিল । এই সর্বাত্মক আন্দোলনের ফলেই জারতন্ত্রের পতন ঘটে। এইভাবে ঐতিহ্যবাহী এই দিনটি কিন্তু নারী অধিকার দিবস হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিল আরো অনেক পরে, ১৯৬৫ সালে, সোভিয়েত সরকারের নির্দেশক্রমে। এর আগে অবধি দেশে দেশে আলাদা নারীদিবস পালিত হত। স্বীকার করতেই হবে যে আন্তর্জাতিক শ্রমদিবসের মত আন্তর্জাতিক  নারীদিবস ও সমাজতান্ত্রিক ভাবনার অবদান।
 আরো দশ বছর বাদে সারা বিশ্বের নারীদের অবস্থার উন্নতিকল্পে জাতিসঙ্ঘ ১৯৭৫ সালকে আন্তর্জাতিক নারীবর্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় । ১৯৭৭ সালে জাতিসঙ্ঘের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী অধিকার ও শান্তিদিবস হিসেবে উদযাপনের নির্দেশ দেয়।
তার পর ১৯৯৬ সাল থেকে থেকে জাতিসঙ্ঘ প্রতি বছরই নারী অধিকারের লক্ষ্যে কর্মপন্থার দিকনির্দেশের জন্য ভিন্ন  ভিন্ন থিম রাখে। প্রথম বারের থিম ছিলঅতীতের উদযাপন, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা। ২০১০ এ দেশে দেশে  যুদ্ধের পরিণামে নারীর দুরবস্থা, বাস্তু-চ্যুতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। ২০১২ গ্রামীণ নারীর ক্ষমতায়ন, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণ, ২০১৩ তে নারীর প্রতি হিংসার নিরসন ছিল রাষ্ট্রসঙ্ঘের নারীবিষয়ক কর্মসূচীর মূল বিষয়। ২০১৪ তে থিম ছিল নারীর সমান অধিকার---সকলের উন্নতি, ২০১৫তে নারীর ক্ষমতায়ন, মনুষ্যত্বের ক্ষমতায়ন, ২০১৬তে লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ, ২০১৭তে পরিবর্তনশীল কর্মক্ষেত্রে নারী--- ২০৩০সাল পর্যন্ত লক্ষ্য ৫০-৫০ এর পৃথিবী, ২০১৮ সালে মহিলাদের জীবন পরিবর্তনে গ্রামীণ ও নাগরিক কর্মীদের ভূমিকা।
চলতি বছরে থিম হল ‘উন্নতিরজন্য ভারসাম্য’ (Balance for Better)জনসংখ্যার অর্ধেক যেখানে নারী, সেখানে লিঙ্গভারসাম্যহীন পৃথিবীতে মানুষ কীভাবে উত্তীর্ণ হতে পারে? সেজন্য নারীর অর্জনকে মর্যাদা দিতে হবে, তুলে ধরতে হবে। নারীর বিরুদ্ধে অসাম্যের বিষয়ে জাগ্রত থাকতে হবে, লিঙ্গসাম্যের  পক্ষে কাজ করতে হবে।
থিম তো রাখা হয় রাষ্ট্র সঙ্ঘে, দেশে দেশে কিছু কাজ ও হয়। কিন্তু আমাদের দেশে নারীর অবস্থা এখনো খুব বেশি পালটায় নি। 

নারী ও পুরুষ---উন্নত সকল জীবপ্রজাতির দুটো ভাগ। সব জীবপ্রজাতিতেই দেখা যায় বাঁচলে তার সমস্ত সদস্যরাই বাঁচে, ধ্বংস হলে সকলেই ধ্বংস  হয়। উন্নতি অবনতি পুরুষ স্ত্রী সবার ক্ষেত্রেই সমান ভাবে প্রযোজ্য হয়, মানুষ ছাড়া। মনুষ্যসমাজের বিবর্তনের ইতিহাস যত এগিয়েছে, তত নারীদের পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার স্বাভাবিক গতিকে কৃত্রিমভাবে, বলপ্রয়োগ করে।   
নৃতত্ববিদ্‌দের মতে, বিবর্তনের ধাপে নারীর সৃষ্টি হয়েছিল পুরুষের আগে। এবং ঐতিহাসিকদের মতে, সভ্যতার বীজ নারীই প্রথম বপন করে। জন্মদাত্রী নারী তার সন্তানের জন্ম দেবার সময় হলে এমন জায়গা খুঁজত যে জায়গা হবে নিরাপদ এবং যেখানে খাদ্য হবে সহজলভ্য। সন্তানকে বড় করে তোলার সময় তাকে সেই বিশেষ স্থানে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘকাল থাকতে হত। তাই সেই জায়গাটিতে সে হয়ত নিরাপত্তার জন্য একটু আড়াল আবরণ দিত। উদ্ভিদের বীজ থেকে যে নতুন গাছ জন্মায়, বীজ বপন  করলেও গাছ হয়, এবং তার  থেকে সহজে খাদ্য পাওয়া যায়, তাও সে লক্ষ্য করেছিল। এভাবেই কৃষির সূচনা হয় তার হাতে, বসতির  সূচনাও হয় তার চারপাশে। তার সন্তানেরাই গোষ্ঠীর এবং গ্রামের পত্তন করে। নারী ছিল তখন রক্ষয়িত্রী ও অন্নদাত্রী।
পরবর্তীকালে যখন সম্পদ উদ্বৃত্ত হল, তা রক্ষা করার জন্য দৈহিক বলের প্রয়োজন হল, তখন সমাজে পুরুষের গুরুত্ব বাড়ল। পুরুষ তার পুরুষ শত্রুকেই পরাভূত করলই, নারীকেও রক্ষা করার অজুহাতে নিজের কব্জায় নিয়ে এল, নারীর গুরুত্ব মানবসমাজে আগের মত রইল না। স্বাধীন নারীরা পরাজিত অসম্মানিত হতে থাকল। অন্তঃপুরের তথাকথিত সম্মান বাড়ল।
তবুও সেই প্রাচীন যুগে নারীর বিদ্যাশিক্ষায়, স্বামী নির্বাচনে, সম্পত্তিতে, তপস্যায়, বাধা ছিল না।বৈদিক সভ্যতায় অনেক মহিলা ঋষি তপস্যা, বেদপাঠ, বেদমন্ত্র রচনা করেছেন, যজ্ঞের ঋত্বিক হয়েছিলেন। এমন  কি সেই সমাজে নারীর বহুবিবাহেও বাধা ছিল না।
কিন্তু পরবর্তী যুগে দেখি পুরুষের যত প্রতাপ প্রভাব বাড়তে থাকল, নারীর প্রভাব প্রতাপ  তত কমতে  থাকল। সমাজে শৃঙ্খলা রক্ষার নামে নারীর সঙ্গী নির্বাচনে স্বাধীনতা কমতে থাকল। পুরুষের বহুগামিতার যথেচ্ছ অনুমতি ছিল,  কিন্তু ভারতীয় নারীদের স্বামী মারা গেলেও দ্বিতীয়বার বিয়ে নিষিদ্ধ হল।  বালবিধবা পর্যন্ত দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারত না, আমরণ ব্রহ্মচর্য পালন করতে হত। উচ্চবর্ণের নারীদের তো আবার মৃত স্বামীর সঙ্গে সহমরণের প্রথা ছিল।  কৃষি পশুপালনে নারীর কিছু ভূমিকা ছিল, তাই গ্রামীণ ও নিম্নবর্ণ সমাজে নারীর কিছু বেশি স্বাধীনতা ছিল। কিন্তু উচ্চকোটির  সমাজে, ক্ষত্রিয় ও  ব্রাহ্মণদের মধ্যে নারীর ভূমিকা ছিল অধীনস্থের। ক্ষত্রিয়েরা রাজ্যশাসন ও যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকত,  সেখানে নারীর প্রত্যক্ষ কোনো ভূমিকা ছিল না। স্বামী নির্বাচনের নামে প্রাচীন ভারতে যে স্বয়ম্বর প্রথা ছিল, তা একদিকে ছিল কন্যার পিতার অহংকার প্রদর্শন, অন্যদিকে তাতে ক্ষত্রিয়কুমারীকে তার অনিচ্ছাসত্ত্বেও হরণ করে বিয়ে করার প্রথা ছিল,  যা নারীর প্রতি বর্বরোচিত ব্যবহার ছাড়া আর কিছু নয়। মনুসংহিতায় বলাই হয়েছে, স্ত্রী বাল্যে পিতার, যৌবনে পতির এবং বার্ধক্যে পুত্রের অধীন, সে স্বাধীনতার যোগ্য নয়। তার সব চাইতে বড় যোগ্যতা ছিল পুত্রসন্তানের জননী হওয়া, যাতে সে পুত্র বংশ এবং সম্পত্তির রক্ষা করতে পারে।

এই  যে অবস্থা আমরা এখন পর্যন্ত উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয়েছি, তার ফলেই বর্তমান যুগেও নারীর দুরবস্থার সীমা নেই। উনিশ শতকে এদেশে  ইউরোপীয় শিক্ষার হাত ধরে আধুনিকতার ঢেউ পৌঁছোয় । কিছু মনীষীর চেষ্টায় নারীর অবস্থা উন্নয়নের জন্য ও কিছু কিছু কাজ করা শুরু হয়, আমরা সবাই জানি। কিন্তু সেই চেষ্টা শুরু হবার পরবর্তী দেড়শ বছরে যে গতিতে উন্নতি হবার কথা ছিল, তার অর্ধেকেও আমরা পৌঁছোই নি।এদেশে নারী অধিকারের জন্য কোনো সর্বাত্মক আন্দোলন হয় নি। শিক্ষায় নারী এগিয়েছে সত্যিএখন এদেশে নারীর শিক্ষার হার ৬৬%, কিন্তু  নারী কর্মীর হার মাত্র ২৯%। এর মানে হল নারীদের বাইরে বেরিয়ে কাজে যেতে উৎসাহ দেওয়া হয় না, অফিসে কাজের পরিবেশ নেই, এবং কিছু ক্ষেত্রে তার শিক্ষা ও কাজের উপযোগী নয়। অনেক ক্ষেত্রেই তাই দেখি, অনেক শিক্ষিত মেয়েরা বিয়ের পর, বিশেষ করে সন্তানের জননী হয়ে চাকরি ছেড়ে  দেয়। কারণ তার ঘরের কাজের সঙ্গে  নিজের সন্তানকে দেখাশোনা করার দায়িত্ব কখনো কখনো বিবাহসূত্রে পাওয়া বৃহত্তর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের দেখাশোনার দায়িত্ব ও তার উপর। যথেষ্ট ক্রেশ থাকলে হয়তো এই সমস্যার সমাধান হতে পারত। আবার, ভাইবোন দুজনকে শিক্ষা দিতে হলেঅনেক সময়ই দেখা যায় বাবা মা মেয়েটিকে বাড়ির কাছে স্কুল কলেজে পাঠান, যেখানে হয়তো সে যা পড়তে চেয়েছিল, বা যা পড়লে তার কর্মসংস্থান হতে পারত, সেই বিষয়টিই নেই। ফলে তাকে একটা সাধারণ বিষয় পড়েই শিক্ষাজীবন শেষ করতে হয়। ভাবা হয় যে মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেলে আর চিন্তা নেই। 
  
এখনো মেয়েদের জীবনের পরম চাওয়া হল একটি ভাল মানে শিক্ষিত রোজগেরে ছেলের সঙ্গে বিয়ে এবং  সন্তানের বিশেষ করে পুত্র সন্তানের, জননী হওয়া । মাবাবা আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী তো অনেক  কাল থেকে এভাবেই ভেবে আসছে, এমন কি রাষ্ট্র ও তাই ভাবে। তাই সরকার থেকে মেয়েদের বিয়ের জন্য ও অর্থসাহায্যের প্রকল্প হয়, বিয়ের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনার গয়না দেওয়া হয়। এই টাকাটা যদি বিয়ের বদলে শিক্ষার জন্যে দেওয়া টাকার সঙ্গে যোগ করা হতকিংবা মেয়েদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে লাগানো হত, তাহলে মেয়েটি হয়তো নিজের ক্যারিয়ার আরো ভালোভাবে গড়তে পারত।
নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো অনেকটা মধ্যযুগেই আছে। তাই দেখি একটি শিক্ষিত ও চাকুরিরত মেয়ের ও বিয়ের সময় পনের দাবি ওঠে, অনাদায়ে মেয়েটিকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়, নয়তো হত্যাই করা হয়। আইন করেও এই কুপ্রথাকে দূর করা সম্ভব হয়নি। তারপর আছে নারীপাচার, দারিদ্র্যের চাপে খাটতে আসা মেয়েদের বা দুর্বলশ্রেণীর কন্যাশিশুদের পতিতা পল্লীতে যৌনকর্মী হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়। একবার পাচারকারীদের হাতে পড়লে সেই মেয়ে মুক্ত হলেও তার সমাজের মূলস্রোতে ফেরা সহজ হয় না। ভাবা যায়এদেশে বছরে ১১৩৩২ জন নারী পাচার হচ্ছে!   
এদেশে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে একটি মেয়ে শৈশব থেকেই নিজেকে দুর্বল ভাবতে শেখে, অন্যদিকে পরিবারের ছেলেকে নারীদের থেকে বলবান, তাদের রক্ষাকর্তা বলে শেখানো হয়। তাই ছেলেটি  পায় প্রশ্রয়, সে মেয়েদের উপর কর্তৃত্বের অধিকার পায়। মেয়েটি পরিবারের বা সমাজের বেঁধে দেওয়া নিয়ম না মানলে তাকে নানারকম নিগ্রহের শিকার হতে হয়, পরিবারের তথাকথিত  সম্মানরক্ষার্থে তাকে হত্যা করাও কোনো কোনো সমাজে অপরাধ বলে ধরা হয় না। ক্রমবর্ধমান অপরাধপ্রবণতার সমাজে সে ধর্ষিত হলে আগে দেখা হয় তার দোষ ছিল কিনা, সে ঠিকঠাক পোশাক পরেছিল কি না, রাতবিরেতে বেরিয়েছিল কিনা, তার সঙ্গী কে ছিল, ইত্যাদি।

 রাষ্ট্রসংঘ নারী অধিকারের জন্য কী কী প্রকল্প নিয়েছে তার আলোচনা করেছি। আমাদের দেশ এবং রাজ্যেও মহিলাদের অবস্থা পাল্টাতে বেশ কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, আইন করা হয়েছে, টাকার জোগান ও দেওয়া হয়েছে। তবুও খারাপ অবস্থা এখনো চলছে। এর কারণ কী? মহিলাদের সম্মানের কথা খুব  আওড়ানো হয়। সম্মান, আমার মনে হয়, সম মানের কথা বলে। মহিলাকে মানুষ হিসেবে দেখলে, (আলাদা করে সম্মানের দরকার নেই) বাড়ির ছেলে ও মেয়েদের সঙ্গে একই ব্যবহার করলে,  সমান সুযোগ দিলে, গৃহহিংসার নিবৃত্তি ঘটলে শিশু পুরুষটি প্রথমপর্যায়েই নারীকে তার সমমানের ভাববে, তার উপর বলপ্রয়োগের কথা ভাববে না। আমাদের পাঠ্যপুস্তকও নারীকে দুর্বল, কম শিক্ষিত দেখানো হয়। আমাদের সরকার যখন মেয়েদের শিক্ষার জন্য প্রকল্প তৈরি করে আবার বিয়ের জন্যও টাকার যোগান দিতে প্রকল্প বানান, তখনই  সেই অসম্মানে মদত দেন। আমাদের সমাজে ধর্ষণের মত শারীরিক অপরাধকে শিকার মেয়েটির ইজ্জতের  সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। ফলে মেয়েটি আর সহজে সেই মানসিক আঘাত থেকে মুক্ত হতে পারেনা। অথচ তাকে বোঝানো উচিত যে, ধর্ষণ আসলে কোনো খুন বা অঙ্গহানিকারক অপরাধের মতই, যদি কেউ কোনো আততায়ীর আঘাতের পর বেঁচে গিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে, ধর্ষিতা ও পারবে। মেয়েদের বিরুদ্ধে হওয়া অপরাধের দ্রুত বিচার করতে হবে।  কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে চাওয়া মেয়েদের সন্তানের সুরক্ষার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে কর্তৃপক্ষকে।

সংরক্ষণের চাইতে সমান ব্যবহার, সবার জন্য সমান সুযোগের ব্যবস্থা করাটাই বেশী জরুরি ।


কোন মন্তব্য নেই: