লিখেছেন অভিজিৎ দাস
হেলেন বাবুর জন্মদিন আজ । চল্লিশটা বছর বেঁচে আছেন পৃথিবীর গায়, প্রত্যেক বছর আজকের দিনটাতে
নিজের উপর বেশ গর্ববোধ করেন তিনি, গর্বেরই বিষয় বটে, পৃথিবীতে বেঁচে থাকা কি আর চাট্টিখানি কথা? কিন্তু,
এ বারের জন্মদিনটা আর পাঁচটা জন্মদিনের মত নয়, আজ তিনি মরবেন বলে ঠিক করেছেন । নির্ধারিত বয়স যদিও পঞ্চাশ, কিন্তু দশ বছর আগেই বিদায় নেবেন বলে পরিকল্পনা করে রেখে ছিলেন বেশ ক-বছর
আগে থেকেই । আজ সেই দিন চলে এসেছে । শহরের সকলেই উনার জন্যে গর্বিত । সকলের এত
ভালবাসা দেখে অবাক হচ্ছেন খুব হেলেন, সত্যি, লাভ ছাড়া কেউ গর্বিত বোধ করেনা !
আরশি জগতে দেখা দিয়েছে জনবিস্ফোরণ, তাই মৃত্যু নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে এসেছে বহু রাষ্ট্র । ভি,আই,পি নামের কতক জীব ছাড়া পঞ্চাশ বছরের বেশি বেঁচে থাকার অধিকার নেই কারো । এ নিয়ে আন্দোলন কম হচ্ছেনা, মানুষ ক্ষুব্ধ খুব । গদি হারানোর চরম সম্ভাবনা রয়েছে শাসক দলের । হেলেনবাবু কখনো এক কলমও লেখেননি এসব নিয়ে, জীবন-মৃত্যু নিয়ে কোনও লেখাই তাঁর কলমে উঠে আসেনি কখনো । স্থানীয় একটা কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি লেখালেখি ছিল উনার সখ, গোটা দশেক বই লিখেছেন, পাণ্ডুলিপি তৈরি আরও দুটোর । এমনি করে ভালোই চলছিল হেলেন সাহেবের একার জীবন, হুট করেই যেন চলে এলো মৃত্যু দিনটা ।
সারাদিন ধরেই লোকজন আসা যাওয়া করছেন । অন্যদের মত কোনও জাঁকজমক চাননা মৃত্যুর অনুষ্ঠানে, বরং সেরে ফেলতে চান একান্ত ঘরোয়া ভাবেই । তবুও আসছেন লোকেরা উপহারের ডালি সঙ্গে নিয়ে । এই মাত্র বেড়িয়ে গেলেন দুই সহ-অধ্যাপক, দুজনেই খুব ভাল উপহার এনেছেন । উনারা না আনলে হেলেনবাবুর কখনো জানাই হতনা এভাবেও মরা যায় । একজন এনেছেন একটা সূচ । এই সূচ শরীরের যেকোনো কোথাও ১ সেমি প্রবেশ করালেই মৃত্যু নিশ্চিত, এমনকি গোড়ালিতেও । পছন্দ হয়েছে উনার খুব এটা । অপরজনেরটা আরও চমৎকার, একটা ডি,ভি,ডি, । ডি,ভি,ডি-তেই মৃত্যু ।
উপহারের স্তুপ নেহাত ছোট নয় । ডেথ টুলই অধিকাংশ । ডেথ টুল ছাড়া শুধু রয়েছে একটা মাত্র চকোলেট । পাশের ফ্লাটের লোকটার সাথে এসেছিল উনার ছ-বছরের মেয়েটি, বাবা দিলেন ডেথ টুল, দেখাদেখি মেয়ে দিল চকোলেট । ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বেশ একটু ধমকেও দিলেন পিতা কন্যাকে, “অসামাজিক, অসভ্য মেয়ে ! আজকের দিনে চকোলেট দিতে আছে?”
যখনই একা হচ্ছেন স্মৃতিতে ডুবে যাচ্ছেন যেন । কত কত স্মৃতি এই চল্লিশ বছরের । মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে বারবারই, খুব ইচ্ছে করছে মাকে জড়িয়ে ধরে একটু কাঁদতে, একটু হাঁসতে, মা মা বলে ডাকতে । ভাবতে ভাবতে মনে পরে গেল সেই ছোট্ট বেলার কথা, যখন বিশ্বাস ছিল পৃথিবীর সব কিছু তিনি পারবেন । তখন মৃত্যুকে খুব ভয় করত তাঁর । মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়াতেন কল্পনায় । যেমন করেই হোক, তিনি অমরত্বলাভ করবেনই । নিজেই একটা কিছু আবিষ্কার করবেন যা দিয়ে মৃত্যুকে এড়ানো যাবে, পৃথিবী ধংস হয়ার আগেই কিছু একটা করে চলে যাবেন অন্য একটা গ্রহে...ওসব কথা ভেবে বড় হাঁসি পাচ্ছে আজ । যে মানুষটা মৃত্যুকে এত ভয় করত সেই মানুষটাই আজ দশ বছর আয়ু রেখে মরতে যাচ্ছে !
জীবনটা আসলে বিষিয়ে উঠেছিল কেমন... কিছুই আর ভাল ছিলনা, কিছুই ভাল লাগতনা । একটা মানুষের মধ্যে দুটো মানুষ বেঁচে আছে বহুদিন । মা ছাড়া জীবনে কাউকে কখনো পাননি, অথচ মায়ের মৃত্যুর পর থেকে গতকাল পর্যন্ত মাকে খুব মনে পড়েছে এমন হয়নি । বরং কল্পনার স্ত্রী, কল্পনার প্রেমিকা, কল্পনার সন্তান, কল্পনার বন্ধু এদেরকেই মিস করতেন একেকসময় ।
অতিথি আসা বন্ধ হল রাত নটার দিকে । শেষদিকে বেশ হাঁপিয়ে উঠেছিলেন । হাঁসি মুখে কথা বলতে পারার একটা সীমা আছে সবারই, আর তাছাড়া আজকের দিনটা জীবনের শেষদিন, ইচ্ছা ছিল নিজেকে নিয়ে কাটাবেন – পারা গেলনা । আজ রাতেই মরতে হবে, ইচ্ছেটা কখন যেন দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে । মরতেই হবে । আগামিকাল ভোর ভোর মেডিকেল কলেজ থেকে লোকেরা আসবে দেহটা নিয়ে যেতে, ওদের জন্যে হলেও মরতেই হবে । শেষবারের মত একটু ঘুমাতে ইচ্ছে হল । রাত এগারটার অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন তাই, এটাই তাঁর জীবনের অন্তিম সাধ ।
পরদিন সকাল ছটায় এসেই মেডিকেল কলেজের অ্যাম্বুলান্স উপস্থিত হল । দরজা সাধারণত ওরা ভাঙে, ভাঙতে ভাঙতে দরজা ভাঙাটাও একটা প্রথা এখন । কিন্তু দরজাটা ভাঙতে হলনা, খোলাই ছিল । মৃত্যুই যখন জীবনের উদ্দ্যেশ্য তখন এমন সুরক্ষার কথা ভাবা মূর্খতাই বটে ! কিন্তু লাশ বাহকরা অবাক হলেন যথেষ্টই এতে, কিন্তু তারও চেয়ে অধিক অবাক হলেন সারা ঘর তন্ন তন্ন করে খোঁজেও কোনও মানুষের দেহ না পেয়ে । ‘ডেথ টুল’ গুলোর স্তুপ পড়ে আছে, লেখার টেবিলে খাতা, ল্যাপটপ, রেফ্রিজারেটরে খাদ্য, নেই শুধু সেই জন্মদিনের উপহার চকোলেট আর গতকালকের ‘ডেথ্ ডে বয়’ ।
আরশি জগতে দেখা দিয়েছে জনবিস্ফোরণ, তাই মৃত্যু নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে এসেছে বহু রাষ্ট্র । ভি,আই,পি নামের কতক জীব ছাড়া পঞ্চাশ বছরের বেশি বেঁচে থাকার অধিকার নেই কারো । এ নিয়ে আন্দোলন কম হচ্ছেনা, মানুষ ক্ষুব্ধ খুব । গদি হারানোর চরম সম্ভাবনা রয়েছে শাসক দলের । হেলেনবাবু কখনো এক কলমও লেখেননি এসব নিয়ে, জীবন-মৃত্যু নিয়ে কোনও লেখাই তাঁর কলমে উঠে আসেনি কখনো । স্থানীয় একটা কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি লেখালেখি ছিল উনার সখ, গোটা দশেক বই লিখেছেন, পাণ্ডুলিপি তৈরি আরও দুটোর । এমনি করে ভালোই চলছিল হেলেন সাহেবের একার জীবন, হুট করেই যেন চলে এলো মৃত্যু দিনটা ।
সারাদিন ধরেই লোকজন আসা যাওয়া করছেন । অন্যদের মত কোনও জাঁকজমক চাননা মৃত্যুর অনুষ্ঠানে, বরং সেরে ফেলতে চান একান্ত ঘরোয়া ভাবেই । তবুও আসছেন লোকেরা উপহারের ডালি সঙ্গে নিয়ে । এই মাত্র বেড়িয়ে গেলেন দুই সহ-অধ্যাপক, দুজনেই খুব ভাল উপহার এনেছেন । উনারা না আনলে হেলেনবাবুর কখনো জানাই হতনা এভাবেও মরা যায় । একজন এনেছেন একটা সূচ । এই সূচ শরীরের যেকোনো কোথাও ১ সেমি প্রবেশ করালেই মৃত্যু নিশ্চিত, এমনকি গোড়ালিতেও । পছন্দ হয়েছে উনার খুব এটা । অপরজনেরটা আরও চমৎকার, একটা ডি,ভি,ডি, । ডি,ভি,ডি-তেই মৃত্যু ।
উপহারের স্তুপ নেহাত ছোট নয় । ডেথ টুলই অধিকাংশ । ডেথ টুল ছাড়া শুধু রয়েছে একটা মাত্র চকোলেট । পাশের ফ্লাটের লোকটার সাথে এসেছিল উনার ছ-বছরের মেয়েটি, বাবা দিলেন ডেথ টুল, দেখাদেখি মেয়ে দিল চকোলেট । ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বেশ একটু ধমকেও দিলেন পিতা কন্যাকে, “অসামাজিক, অসভ্য মেয়ে ! আজকের দিনে চকোলেট দিতে আছে?”
যখনই একা হচ্ছেন স্মৃতিতে ডুবে যাচ্ছেন যেন । কত কত স্মৃতি এই চল্লিশ বছরের । মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে বারবারই, খুব ইচ্ছে করছে মাকে জড়িয়ে ধরে একটু কাঁদতে, একটু হাঁসতে, মা মা বলে ডাকতে । ভাবতে ভাবতে মনে পরে গেল সেই ছোট্ট বেলার কথা, যখন বিশ্বাস ছিল পৃথিবীর সব কিছু তিনি পারবেন । তখন মৃত্যুকে খুব ভয় করত তাঁর । মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়াতেন কল্পনায় । যেমন করেই হোক, তিনি অমরত্বলাভ করবেনই । নিজেই একটা কিছু আবিষ্কার করবেন যা দিয়ে মৃত্যুকে এড়ানো যাবে, পৃথিবী ধংস হয়ার আগেই কিছু একটা করে চলে যাবেন অন্য একটা গ্রহে...ওসব কথা ভেবে বড় হাঁসি পাচ্ছে আজ । যে মানুষটা মৃত্যুকে এত ভয় করত সেই মানুষটাই আজ দশ বছর আয়ু রেখে মরতে যাচ্ছে !
জীবনটা আসলে বিষিয়ে উঠেছিল কেমন... কিছুই আর ভাল ছিলনা, কিছুই ভাল লাগতনা । একটা মানুষের মধ্যে দুটো মানুষ বেঁচে আছে বহুদিন । মা ছাড়া জীবনে কাউকে কখনো পাননি, অথচ মায়ের মৃত্যুর পর থেকে গতকাল পর্যন্ত মাকে খুব মনে পড়েছে এমন হয়নি । বরং কল্পনার স্ত্রী, কল্পনার প্রেমিকা, কল্পনার সন্তান, কল্পনার বন্ধু এদেরকেই মিস করতেন একেকসময় ।
অতিথি আসা বন্ধ হল রাত নটার দিকে । শেষদিকে বেশ হাঁপিয়ে উঠেছিলেন । হাঁসি মুখে কথা বলতে পারার একটা সীমা আছে সবারই, আর তাছাড়া আজকের দিনটা জীবনের শেষদিন, ইচ্ছা ছিল নিজেকে নিয়ে কাটাবেন – পারা গেলনা । আজ রাতেই মরতে হবে, ইচ্ছেটা কখন যেন দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে । মরতেই হবে । আগামিকাল ভোর ভোর মেডিকেল কলেজ থেকে লোকেরা আসবে দেহটা নিয়ে যেতে, ওদের জন্যে হলেও মরতেই হবে । শেষবারের মত একটু ঘুমাতে ইচ্ছে হল । রাত এগারটার অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন তাই, এটাই তাঁর জীবনের অন্তিম সাধ ।
পরদিন সকাল ছটায় এসেই মেডিকেল কলেজের অ্যাম্বুলান্স উপস্থিত হল । দরজা সাধারণত ওরা ভাঙে, ভাঙতে ভাঙতে দরজা ভাঙাটাও একটা প্রথা এখন । কিন্তু দরজাটা ভাঙতে হলনা, খোলাই ছিল । মৃত্যুই যখন জীবনের উদ্দ্যেশ্য তখন এমন সুরক্ষার কথা ভাবা মূর্খতাই বটে ! কিন্তু লাশ বাহকরা অবাক হলেন যথেষ্টই এতে, কিন্তু তারও চেয়ে অধিক অবাক হলেন সারা ঘর তন্ন তন্ন করে খোঁজেও কোনও মানুষের দেহ না পেয়ে । ‘ডেথ টুল’ গুলোর স্তুপ পড়ে আছে, লেখার টেবিলে খাতা, ল্যাপটপ, রেফ্রিজারেটরে খাদ্য, নেই শুধু সেই জন্মদিনের উপহার চকোলেট আর গতকালকের ‘ডেথ্ ডে বয়’ ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন