।। চিরশ্রী দেবনাথ।।
পৃথিবীর কিছু মানুষ কবিতা
লেখে কারণ পৃথিবীর বাকি মানুষ কবিতা লেখে না। তবে পৃথিবীর প্রায় সব মানুষই কখনো
কখনো কবিতা শুনেছে, বলেছে বা পড়েছে।
একটি
অটোর পেছনে দেখলাম লেখা আছে,“আবার আসিব ফিরে মনুনদীর তীরে”এই অটোচালক খুব রসিক।সে কোন
এককালে জীবনানন্দ পড়েছিল,তার অন্তঃস্থলে লেগে আছে লাইনটি,“আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির
তীরে”।একটু খানি নকলই তো করেছে মাত্র। এই নকলটি
সহস্রাধিক বার যেন হয়। কবিতা তুমি সেই যুবকের নারী হয়ে থাকো।
আবার নেট ঘাটতে গিয়ে একটি
প্রবন্ধ পেলাম তাতে আছে,চিলির
সান্তিয়াগো শহরের রাস্তায় একটি ছোট ছেলে কবিতা বলতে বলতে তরমুজ বিক্রি করছিল,এখন একজন ভ্রমণকারী ও পাবলো
নেরুদার কবিতার অনুরাগী,যে কিনা ওনার কবিতা অনুবাদ করতে চায়,এই লাইনগুলো শুনে সে আরো কাছে গেলো,তরমুজ কিনলো,আরো দু একবার কবিতাটি শুনল।
অবশেষে সেই অনুবাদক যখন পাবলো নেরুদার কবিতা অনুবাদ করতে যান তখন আবিষ্কার করেন এই
দুটো লাইন পাবলো নেরুদার, ‘ওড’ কবিতা থেকে নেওয়া। কীভাবে যেন লাইনগুলো ঢুকে গিয়েছিল
ছেলেটির বিক্রিবাটায়।
কবিতার সবচেয়ে নিজস্ব গুণটি
হলো কবিতা একইসঙ্গে ভীষণ মহৎ,দুর্দান্ত ধ্রুপদী,কবিতা পড়ার আগে নিজেকে সব দিক থেকে প্রস্তুত করে আস্তে আস্তে চিক্কন
আলোর মতো ঢুকে যেতে হবে এই আভিজাত্যে। আবার একই সঙ্গে কবিতা মাঠে পরে থাকা পাখির পালক,করুণ চোখে চেয়ে আছে পৃথিবীর
যাবতীয় ধূসরতা নিয়ে।
কবিতা সেই মাদক,যে সব আভিজাত্যকে তুড়ি মেরে
উড়িয়ে দিয়ে বলে,
“তুমি আমায় অবজ্ঞাতে উড়িয়ে দিলে,ফুউউউ ...
তবুও
শালা হতচ্ছাড়া কোকিল ডাকে কুউউউ”
....কবি
সালেহীন শিপ্রা ( বাংলাদেশ)।
কবিতা কবির চিরকালীন কলঙ্করচিত কল্পনা,দ্বিতীয় নারী বা পুরুষ যার
সঙ্গে সহাবস্থান কেবল অভিমান আর মিলনের।
কবিতা কি
কেউ পড়ে এখন,সাধারণ মানুষের প্রশ্ন।
পাঠ্যপুস্তকের
বাইরে ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কিংবা ‘বিদ্রোহী’ কিংবা ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’ইত্যাদি ইত্যাদি,যেহেতু বাচ্চারা
আবৃত্তিশিল্পের চর্চা করছেন তাই অভিভাবকদের কানে পৌঁছে যাচ্ছে জবরদস্তি করেই।আবৃত্তি
শিখতে আসা শিশু বা কিশোর কিশোরীদের
কাছে এইসব কবিতা একটি বোধের সূচনা ঘটায় মনে। পরবর্তীতে তার কবিতাপ্রেম,কবিতাকে চেনা,কবিতাকে ভালোবাসা কীরকম হবে তা নির্ভর করে ছেলে
বা মেয়েটির চেতনা এবং মনোজগতের উন্নতির ওপর।
কবির
মনোজগত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অলৌকিক জায়গা। এখানে তিনি সমস্ত দুর্বোধ্যতা নিয়ে বসে
থাকেন। এই আঁধারের ধার নেই, দান আছে, এক কবি থেকে অন্য কবিতে,এজন্যই কবিতা সংক্রামক এবং
না সারাইযোগ্য ব্যাধি।
“কিছুলোক
তার মানে
সবাই নয়,
এমন কী
অধিকাংশও নয়,সামান্য কয়েকজন,
স্কুল
পড়ুয়া ছাড়া,তারা পড়তে বাধ্য হয়,
আর কবিরা
ছাড়া,
তুমি যদি
গোনো হয়তো এক হাজারে দু জন।
..................
কবিতা
যা হোক
কিন্তু কবিতা কী?
অনেক
উত্তর
প্রথম
দিনের প্রশ্নটির পর থেকে,
কিন্তু
সে সব আমি না জেনেই থাকি।”
এই কবিতাটি লিখেছেন ভিসলাওয়া সিমব্রসকা,পোল্যান্ডের কবি।১৯৯৬ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।উপরে
উদ্ধৃত অংশটি অমিতাভ চৌধুরী কৃত অনুবাদ থেকে নেওয়া।
এটা তেমন কোন উল্লেখযোগ্য
কবিতা নয়। পৃথিবীতে আরো বহু সুন্দর কবিতা লিখিত হয়েছে। আমার কাছে আকর্ষণীয় কবিতায়
উল্লিখিত ঐ রেলিঙটি। অবলম্বন। বেঁচে থাকার অবলম্বন। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের পর কবিতা একটি
বেঁচে থাকার উৎস হতে পারে, যার কিনারায় দাঁড়িয়ে কবি নীচের দিকে তাকিয়ে থাকেন আর তার চোখ থেকে
এক ঝলক ‘বেঁচে থাকা’ প্রবাহিত হয় বহু দূর অব্দি।
কেনেডি এবং চার্চিল দুজনেই বলেছেন, “পোয়েট্রি ক্লিনস,পলিটিক্স পল্যুটেড।” অথচ কবিতা এবং রাজনীতি একজন
আরেকজনকে জড়িয়ে আছে খুব বেশি করে। কোনদিনই হাজার হাজার মানুষ কবিতা পড়ে না,একটি সীমাবদ্ধ বিশেষ
বোধসম্পন্ন মানুষের কাছে কবিতা চর্চিত হয় তার যাবতীয় মায়াকুশলতা,সৌন্দর্য আর মেধাবী লাইন
নিয়ে,কিন্তু এই কবিতাই পৌঁছে গেছে এক লহমায় হাজার হাজার মানুষের কাছে যখন
যুদ্ধ,রাজনীতি আর মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করেছে কবিতা।
১৯৭১,বাংলাদেশ যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের
রক্তক্ষরা দিনের মধ্য দিয়ে।চলছে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা।অ্যালেন
গিন্সবার্গ কলকাতায় এলেন, সুনীল গাঙুলির বাসায়,তাঁকে নিয়েই দেখলেন যশোর
রোডে নেমে আসা উদ্বাস্তুদের ঢল,বন্যা,ঘর বাড়ি দেশ হারানো মানুষ। পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত,সবচাইতে প্রভাব বিস্তার করা
সমকালীন এবং চিরকালীন একটি কবিতা রচিত হয়েছিল তখনই, ‘সেপ্টেম্বর ওন যশোর রোড’ । এই কবিতায় সুরারোপ হলো,গাইলেন আর এক জগত কাঁপিয়ে
দেওয়া গায়ক বব ডিলান।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের
সাহায্যার্থে যে কনসার্ট হয় তাতে রবি শঙ্কর থেকে শুরু করে ছিলেন আরো বহু শিল্পী, অর্থ সংগৃহীত হয়েছিল ঠিকই,তবে তার চাইতেই যা বেশি
পাওয়া গেলো তা হলো কবিতা আর গানের মাধ্যমে,‘সেপ্টেম্বর ওন যশোর রোড’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে
পৌঁছে দিয়েছিল বিশ্বের দরবারে আরো বেশি করে এবং আন্তর্জাতিক মহল বুঝতে পেরেছিল
একটি স্বাধীনতাকামী দেশের হৃদয়কে। কবিতা সবকিছুকে ছাপিয়ে এইভাবেই সময়ের ভাষ্য হয়ে
ওঠে বার বার বহুবার।
কবিতাটির একটি অংশ,
“শত শত চোখ আকাশটা দেখে,শত শত শত মানুষের দল,
যশোর
রোডের দুধারে বসত বাঁশের ছাউনি কাদামাটি জল।
কাদামাটি
মাখা মানুষের দল,গাদাগাদি করে আকাশটা দেখে,
আকাশে
বসত মরা ঈশ্বর,নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে।
ঘরহীন
ওরা ঘুম নেই চোখে,যুদ্ধে ছিন্ন ঘর বাড়ী দেশ,
মাথার
ভিতরে বোমারু বিমান,এই কালোরাত কবে হবে শেষ।
শত শত
মুখ হায় একাত্তর যশোর রোড যে কত কথা বলে,
এত মরা
মুখ আধমরা পায়ে পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে।
সময়
চলেছে রাজপথ ধরে যশোর রোডেতে মানুষ মিছিল,
সেপ্টেম্বর
হায় একাত্তর,গরুগাড়ি কাদা রাস্তা পিছিল
লক্ষ
মানুষ ভাত চেয়ে মরে,লক্ষ মানুষ শোকে ভেসে যায়,
ঘরহীন
ভাসে শত শত লোক লক্ষ জননী পাগলের প্রায়।"
অনেকেই বলবেন এটাই হচ্ছে
আসলে মানুষের কবিতা,কত সহজে বোঝা যাচ্ছে লাইনগুলো। চিন্তাজগতের কোন পূর্ব
প্রস্তুতি ছাড়াই কবিতার অন্তঃস্থলে ঢোকা যাচ্ছে। কবিতা বলে দিচ্ছে একটি দেশের
স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা, দুর্দশার কথা। আমার কাছে এই কবিতাটির আসল রচয়িতা সময়,অ্যালেন গিন্সবার্গ হলেন
বিশেষ সময়টিকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার সেই অলৌকিক মাধ্যম ।
একইভাবে আমাদের স্বাধীনতা
সংগ্রাম,দুর্ভিক্ষ,স্বাধীনতা উত্তর ভারত, নকশাল আন্দোলন সমস্ত
রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিক্ষেপণ রচনা করেছে বহু বহু কবিতা,লোকের কণ্ঠে কণ্ঠে ফিরেছে, এখনও ধ্বনিত হচ্ছে।
তাহলে
বলে দেওয়া যায়, যখনই কোন বিরাট অস্থিরতার সৃষ্টি হবে তখনই আমরা কবিতার কাছে যাবো।
সেইদিক দিয়ে দেখতে গেলে ভারত
কিংবা
বাংলাদেশ কবিতার উর্বর ক্ষেত্র। সবসময় কিছু না কিছু হয়েই চলেছে। আর এইসব
ঘটনাপ্রবাহ কবিতাকে প্রাণ দেয়,জীবন্ত করে তোলে।রিয়ালিজম, ন্যাচারালিজম্,সুররিয়ালিজম তিন মিলে
কবিতাকে আরো সমৃদ্ধ হবার জনপদ তৈরি করে দেয়।
মানুষের মনোভূমির তিনটি
স্তর, ইদ, ইগো ও সুপার ইগো। এই ইদ ( Id) বা অবচেতন মনই
সুররিয়ালিজমের উৎসভূমি।
“কেরোসিন, কাঠ, গালা, গুণচট, চামড়ার ঘ্রাণ
ডাইনামোর
গুঞ্জনের সাথে মিশে গিয়ে
ধনুকের
ছিলা রাখে টান” (‘রাত্রি,’জীবনানন্দ দাশ) ,
সাধারণ মানুষের কাছে
সমস্যাটি তৈরি হয়েছে এখানেই,এইসময়ের সবচেয়ে প্রচলিত বিতর্কিত শব্দ ‘জীবনমুখী’ ব্যবহার করবো, বলবো যে জীবনমুখী সহজ
কবিতার বিরাট জনপ্রিয়তার পর, হঠাৎ করে গভীরতম বোধের কবিতাগুলো এলেই, কবিতা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।কারণ
পাঠক তৈরি হয়নি।পাঠক তৈরি করার দায়িত্বও কবির।একটি বিশাল পাঠকশ্রেণি তৈরি করতে, বাংলা কবিতার বিপুল বৈভব
বোঝার বোধ জাগ্রত করতে আরো দীর্ঘ সময় দরকার।আস্তে আস্তে এই মনোভূমি সবুজ হবে। খুব স্বাভাবিক ভাবে মানুষ
বলে দেয় এইসময়ের কবিতা বুঝি না। এই ‘বুঝি না’ জিনিসটাকে গুরুত্ব দেওয়ারই দরকার নেই।
কবিতা সবসময় দুই ভাষ্যেই রচিত হয়। সরল এবং কঠিন।
মানুষের বোধকে উচ্চতর
মাধ্যমে নিয়ে যাওয়াটা কবিতার অন্যতম কাজ।কবি তার নিজস্ব বোধ বুদ্ধি মেধা দিয়ে
কবিতা রচনা করবেন।আমাদের দায়িত্ব কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে মহীনের ঘোড়াগুলোর
কাছে পৌঁছে যাওয়া,প্রস্তর যুগের ঘোড়াগুলো এখনও ঘাসের লোভে চরে কেন,এ সম্পর্কে ভাবা।
পরক্ষণেই বলব কেন ভাবব,এই চিন্তা ভাবনা আমার
দৈনন্দিন জীবনের স্নান,খাওয়া,মৈথুন পেরিয়ে কোন কাজে আসবে?ভাববো,প্রবলভাবে ভাববো,নাহলে থেমে যেতে হবে।কবিতা
নিয়ে না ভাবলে,কবিতা না লিখলে,কবিতার চর্চা না হলে সাহিত্য থেমে যায়। সময় স্থবির হয়ে যায়।
স্থবিরতার কাছে পৌঁছে গেলে মানুষ যেতে থাকে পেছনের দিকে, অন্ধকারের দিকে, কুসংস্কারের দিকে।
যাপনের সব অন্ধকারই কবি বমন
করেন,আর তার মাধ্যমেই আলো ফোটে।
“একটি সতেরো বছরের মেয়ের
পায়ের তলায়
লুটিয়ে
পড়তে পারে না একবার একবারো তাবৎ সংসার? ...” (কবিতা সিংহ)
কবিতা আসলে সেই সতেরো বছরের
মেয়ে,যার গর্ভ শূন্য,সহস্র সন্তান ধারণ করবে বলে উদাসীন জ্ঞানের মতো বসে আছে।
ভীষণ অশুভ আর কুৎসিত থেকে
কবিতা তুলে আনে সেই খন্ডচিত্র যা বিশ্বজনীন।গ্রীষ্মের দুপুরে মৃত কুকুরের দেহ দেখে
বোদলেয়ার লিখলেন,
“আর্দ্র নারীর ধরনে শূন্যে
পা দুটি তোলা,
তাপে,ঘামে বিষ কীর্ণ,
লজ্জাবিহীন, উদাসীন ভাবে উদরখোলা,
বিকট
বাষ্পে পূর্ণ” ( অনুবাদক : বুদ্ধদেব বসু)
কুকুরটি এখানে নারীর রূপ।পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে থাকা অজস্র যুদ্ধ
ক্লান্ত নারী বললেও কবিতাটি এর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে।
শিল্পকে কোনদিনও আঞ্চলিক
দৃষ্টি নিয়ে দেখতে নেই। খুব ক্ষুদ্রভাবে কখনো শিল্প চর্চা হয় না। বিশ্বের
সর্বশ্রেষ্ঠ সৃজনসমূহকে যত বেশি স্পর্শ করা যায় তত মানসিক উত্তরণ ঘটে। কবিতার কাছে
যাবো, তাহলে আগে যাবো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোর কাছে। তবেই এক মুহূর্তে
বুঝে যাবো, কেন যেতে হয় কবিতার কাছে।
“শিশুর প্রথম হাসি শুরু হলে
তেতো ও
মিঠা ছেড়ে যায় একে অন্যকে,
মহাসাগরীয়, অরাজকতার মধ্যে
খোলা সেই
হাসির প্রশান্ত সীমা।
সবকিছু
অপরাজেয় সুন্দর তার কাছে
খেলে সে, গরিমা নিয়ে ঠোঁটের কোনায়
বস্তুর
অমেয় প্রকৃতিকে জেনে নেবে বলে
ধরে ফেলে
রামধনুর প্রান্তের জোড়।”
( ওসিপ মান্দেলস্তামের কবিতা, অনুবাদ অমিতাভ কর)
কবিতা একটি অপরাজেয় শিশু,যাকে আমরা প্রত্যেকেই নিজের
ভেতর বহন করে চলেছি। খুব ছোট থেকে ছড়া আমাদের হৃদয়ের তন্ত্রীতে আঘাত করে। এই যে
খুব প্রচলিত ছড়াগুলো, কিন্তু ব্যাপক অর্থ নিয়ে বিরাজমান।
“খোকা ঘুমুলো পাড়া জুড়ালো
বর্গী
এলো দেশে
বুলবুলিতে
ধান খেয়েছে
খাজনা
দেবো কি সে”
পরবর্তীতে শিশুটি বড়ো হয়ে
গেলে যদি তাকে ছড়াটির সঠিক অর্থ ধরিয়ে দেওয়া যায়,যা একটি চূড়ান্ত অরাজক অন্ধকার
সময়ের সুচিন্তিত সুলিখিত প্রতিফলন তবে সে ছড়ার প্রেমে পড়তে বাধ্য,সহজেই বুঝে যাবে কবিতা কতটা
সর্বগ্রাসী ভাবে আশ্রয় করতে পারে সময়কে।
কিংবা,“আগডুম বাগডুম ঘোড়া ডুম সাজে”,এখানে ‘আগডুম বাগডুম’মানে হচ্ছে, আগে ডোম,পরে ডোম। ডোম,যারা সেইসময় ( এইসময়ও কি? )সামাজিক ভাবে অচ্ছুৎ,তারা কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে অচ্ছুৎ
ছিল না,আগেও তারা,পরেও তারা। একটি তীব্র সামাজিক বিভাজনতার শিকার সেই জনগোষ্ঠীকে,হয় তো কোন এক ছড়াকার অবচেতন ভাবেই ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন ছড়ায়।
সোনালী কাবিনের কবি আল মাহমুদ কিছুদিন আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন না
ফেরার জগতে,তিনি আকতার হোসাইনকে দেওয়া তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,আত্মগোপন কবির কাজ নয়,আত্মপ্রকাশই কবির কাজ। যদি
আপনি ভালো লিখেন,তাহলে আপনি জানান দিন ...আছেন। তিনি আশাবাদী ছিলেন যে এখন একজন বড়
কবির আত্মপ্রকাশের সময় ও ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে, তবে একসঙ্গে যদি সব তরুণই
একই ধরনের ভালো লেখেন, তবে কবিতায় পুনঃপৌনিকতার সৃষ্টি হয়, মনে হয় একটি কবিতাই সবাই
লিখছেন। তবে এর মধ্য থেকেই কেউ হয়ে উঠবেন ব্যতিক্রমী, আর সেই ব্যতিক্রমী কবিতাকে
জানার জন্য আমরা কবিতার কাছে যাবো।
“রাত্রির গান গেয়েছিল এক
নারী
আমার
সাথেও ছিল কিছু পরিচয়,
এক হাতে
রেখে আগুনের মতো শাড়ি
বলেছিল, ভীতু তোমারও কি আছে ভয়?”( আল মাহমুদ )
লাইন চারখানি বার বার পড়ি। কেন পড়ি, তার উত্তরে বলি তারা সুন্দর।
“পুরুষ পাথর বটে কিন্তু যদি
দশটি চুম্বনে
পাষাণ
বিদীর্ণ হয়ে ভাস্করের কান্না হয়ে যায়
শিলার কাঠিন্য
নিয়ে তবে আর স্বপ্নে জাগরণে
বলো কোন্ নদী আর প্রস্তরের
বদনাম গায়...”
(আল
মাহমুদ )
পড়লে একটি দৃঢ় নিস্তব্ধতা নেমে আসে তাই কবিতার কাছে যাই চুপ করে
থাকার জন্য।
কবিতা
আত্মক্ষরণের মর্মান্তিক কাটাকুটি।
প্রতিটি মানুষ সারা জীবন ধরে নিজের মধ্যে একটি দীর্ঘ কবিতা লিখতে থাকেন,
এই
কবিতাটিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না, শুধু বলা যায়,
“কী খুঁজে বেড়াচ্ছ তুমি
সারাদেশ জুড়ে?
রুটি,শুধু রুটি।
দিন নেই
রাত নেই ঘুম নেই
খোঁজা
শুধু খোঁজা
কী খুঁজে
বেড়াচ্ছ তুমি সমস্ত জীবন?
ভালোবাসা
শুধু।” ( ভাস্কর চক্রবর্তী)
এই অমৃত শ্লোকগুলো পড়বার জন্য আমরা কবিতার কাছে যাবো।
বসন্তসময় চলছে,একটি প্রেমের কবিতা ছুঁয়ে
যাই,সোশ্যাল মিডিয়া থেকে
পেয়েছি। কবির নাম অনুত্তমা ব্যানার্জি।
“প্রথমে নাকাল হবো,ধুলোবালি ঢুকে যাবে চোখে
নির্বুদ্ধিতা
নিয়ে রসিকতা করে যাবে লোকে
কপালে
দু:খ আছে - ইংগিত দেবে ঠারেঠোরে
মান
সম্মান সব একে একে খোয়াবো বেঘোরে
শাস্তি
ঘোষণা হবে, গর্দান যাবে রাজদ্রোহে
তবে না
এসেছো প্রেম!
এসেছো
তবে না
সমারোহে…”
ফেসবুক থেকে আমরা আজকাল
প্রাণভরে টেনে নেই এভাবেই কবিতার অক্সিজেন।আমাদের মনে একটি মাটির উঠোন আছে,টুকরো জ্যোৎস্না,নিমগাছ রচিত ছায়া,তুলসীতলা,শঙ্খ আর আজানের ধ্বনি,সেখানে এক কথকঠাকুর বাস
করেন, যিনি দুলে দুলে কৃত্তিবাসী রামায়ণ পড়েন,মেঠো সুরে,
“সূর্য্যবংশে দশরথ হবে
নরপতি।
রাবণ
বধিতে জন্মিবেন লক্ষ্মীপতি।।
শ্রীরাম
লক্ষ্মণ আর ভরত শত্রুঘ্ন।
তিন
গর্ভে জন্মিবেন এই চারি জন।।
সীতাদেবী
জন্মিবেন জনকের ঘরে।
ধনুর্ভঙ্গ
পণে তাঁর বিবাহ তৎপরে।।
পিতার
আজ্ঞায় রাম যাইবেন বন।
সঙ্গেতে
যাবেন তাঁর জানকী লক্ষ্মণ।।”
আর তা ছড়িয়ে যেতে থাকে
আমাদের
রক্তমাংসে
ছোট থেকেই। সেজন্য কোনজীবনই কবিতাহীন
নয়।
আমার
মাঝে মাঝে মনে হয়,আমার শহরের হোটেল গুলোর নাম হোক, ‘ডহরের ঘোর’ বা
‘গহনের টানে’, রেস্টুরেন্টের নাম হোক
‘সাতনরী হার’,লন্ড্রিটির নাম হোক, ‘রাজহাঁসের পালক’।
হতে পারে
না কবিতায় বসবাস ! কিংবা কবিতার সঙ্গে বারোমাস?
****
প্রকাশিত, ‘দৈনিক সংবাদ পত্রিকা, ত্রিপুরা’
তথ্যসুত্র
: বিভিন্ন বই, আন্তর্জাল এবং ফেসবুক