(দক্ষিণ আফ্রিকীয় লেখক জে এম কোয়েটজি-র লেখা 'এজ অব আয়রন'- উপন্যাসের বাংলা অনুবাদের ৩য় অধ্যায়ের শেষ ভাগ: -- শিবানী দে)
(C)Image:ছবি |
ভারকুয়েইল দরজায়
টোকা দিল । জিগ্যেস করল, “তুমি কি কিছু খাবে ?”
“আমার খিদে নেই ।
কিন্তু তুমি দেখ কিছু আছে কিনা, থাকলে খেয়ে নাও ।”
আমি একা থাকতে
চাইছিলাম, কিন্তু সে দাঁড়িয়েই রইল, কৌতূহলভরা চোখে
আমাকে দেখতে থাকল । আমি বিছানাতে বসেছিলাম, হাতে গ্লাভ্স, হাঁটুর উপর রাখা
লেখার কাগজ । আধঘণ্টা ধরে আমি খালি পাতার দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে আছি ।
“আমি অপেক্ষা করছি
কখন আমার হাত গরম হবে ।” আমি বললাম ।
কিন্তু ঠাণ্ডা
হওয়া আঙ্গুলের জন্যই আমি যে লিখছি না তা নয় । এটা হল পিলের ফল, যা আমি এখন আরো
বেশি সময়, এবং সংখ্যায়ও বেশি করে খাই । এগুলো হল
ধোঁয়া ওঠানোর জিনিষ । আমি এগুলো গিলি, সেগুলো আমার
ভেতরে ধোঁয়ার কুয়াশা ছাড়ে, বিনষ্টির কুয়াশা । পিল খেলে আমি আর
লিখতে পারি না ।
ব্যথা ছাড়া লিখা হয় না----- একটা নতুন ও ভয়ানক নিয়ম হয়েছে । তা ছাড়া যখন আমি
পিল খাই, কোনো কিছুই ভয়ানক থাকে না, সব কিছুই উদাসীন, সব কিছুই সমান ।
তবুও আমি লিখি ।
শেষরাতে , ভারকুয়েইল যখন নিচের তলায় ঘুমোয়, আমি এই চিঠিটায়
তোমাকে এই ছেলেটা জনের বিষয়ে একটা কথা বলি, সেই যে বিষণ্ণ
ছেলেটা যাকে আমার ভাল লাগত না । আমি তোমাকে বলতে চাই যে আমার অপছন্দ সত্ত্বেও সে
এখন আমার কাছে আরো পরিষ্কারভাবে, আরো তীব্রভাবে
আছে, ভেকিও কখনো এতটা ছিল না । সে আমার সাথে আছে অথবা আমি তার
সাথে আছি : সে অথবা তারই চিহ্ন । এখন মধ্যরাত্রি, এটা তার ধূসর
সকালের ধূসরতাও । আমি এখানে আমার বিছানায়, কিন্তু আমি
ফ্লোরেন্সের ঘরেও, যে ঘরের একটাই দরজা, একটাই জানালা, আর বাইরে যাবার
উপায় নেই । বাইরের দরজায় লোকেরা অপেক্ষা করছে, শিকারির মত
গুটিগুটি, ছেলেটিকে মরণ উপহার দিতে । তার কোলে সে
পিস্তলটা ধরে আছে, এবং সেই সময়টুকুর জন্য সে শিকারিদের
দূরে রাখতে পেরেছে, সেটাই ছিল ভেকি ও তার গোপন রহস্য, যা তাদের পুরুষ
বানাচ্ছিল; তার কাছে আমি দাঁড়াচ্ছি কিংবা উড়ছি ।
পিস্তলের ব্যারেলটা তার দু’হাঁটুর মাঝখানে ; সে সেটার উপরে
নিচে হাত বোলাচ্ছে। সে বাইরের মৃদুস্বরের কথাবার্তা শুনছে , আর আমি ও তার
সঙ্গে শুনছি । সে নিজেকে প্রস্তুত করছে ধোঁয়ার জন্য যা তার ফুসফুস বুজিয়ে দেবে, লাথির জন্য যা
তার দরজা ভেঙ্গে দেবে, আগুনের স্রোয় যা তাকে বয়ে নিয়ে যাবে ।
সে নিজেকে প্রস্তুত করছে সেই মুহূর্তের জন্য যখন সে সময় পাবে আলোর মাঝখানে ঠিক
একটাই গুলি করবার জন্য ।
তার চোখগুলোতে
পলক পড়ছে না, স্থির তাকিয়ে সেই দরজার দিকে যেখান দিয়ে সে এই জগত ছেড়ে
চলে যাবে । তার মুখ শুকনো, কিন্তু সে ভীত নয় । তার হৃদ্পিণ্ড সমানভাবে স্পন্দিত
হচ্ছে, ঠিক যেভাবে সে তার বুকের কাছে মুঠি
একবার বন্ধ করছে, একবার খুলছে ।
তার চোখ খোলা, এবং আমার চোখ, যদিও আমি লিখি, বন্ধ । আমার চোখ
বন্ধ দেখবার জন্য ।
এই মধ্যান্তরালে
কোনো সময় নেই, যদিও তার হৃদয় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্পন্দিত হচ্ছে । আমি
এখানে এই রাতে আমার ঘরে আছি, কিন্তু আমি আবার
তার সঙ্গেও আছি সব সময়, যেভাবে আমি সাগর পেরিয়ে তোমার কাছে ও
আকাশে ভেসে আছি ।
এই সময়টা একটা
ভাসমান সময়, শাশ্বত নয় । যখন দরজা ভেঙ্গে খুলে যাবে, এবং আমরা, প্রথমে ছেলেটা, তারপর আমি, দেখব বিরাট সাদা
আলোর ঝলকানি, সেই সময়টার আগের এই সময়টা, যাকে বলে ‘এখনকার মত’,
অস্থায়ী ।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~০০০০০০০০০০০০০০০০০০~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
*তারা-চিহ্নিত
শব্দগুলোর পরিচয় :
উইটডয়েক(witdoeke): তৎকালীন
বর্ণবিদ্বেষী দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের ভাড়াটে ঠ্যাঙ্গাড়ে-বাহিনী
।
ঈনিয়াস(Aenius): রোমান কবি
ভার্জিলের মহাকাব্য ‘দ্য ইনিড’-এর নায়ক ।
উপন্যাস : এখানে,
The Scarlet Letter । আমেরিকান লেখক
ন্যাথানিয়েল হথর্ন-এর ১৮৫০সালে প্রকাশিত বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য স্কার্লেট
লেটার’ ।
লোটসভোজী( Lotos
Eaters): হোমারের মহাকাব্য ‘ওডিসি’তে লোটসভোজীদের
দেখা পাওয়া যায় । এরা লোটস(পদ্ম নয়) ফল খেয়ে সারাদিন ঝিমন্ত অবস্থায় স্বপ্নের জগতে
বাস করত । অলস, দিবাস্বপ্ন দেখা লোক।
বড় মন্দা (The
Great Depression): ত্রিশের দশকের পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, যখন বড়বড় খামারে
যন্ত্রভিত্তিক কৃষি উৎপাদন শুরু হওয়ায় বেকার কৃষিশ্রমিকের দল গ্রামাঞ্চল থেকে
শহরের পথে যাত্রা করত । সমাজে বেকারি, তৎসহ দারিদ্র্যের
বৃদ্ধির ফলে দেশে দেশে বাজারের পতন ঘটে । মূলত:
আমেরিকা থেকে ইউরোপ হয়ে এই মন্দার ঢেউ সারা পৃথিবীতে প্রভাব ফেলেছিল ।
অ্যাল্বাট্রোস (Albatross):
বৃহৎ সামুদ্রিক পাখি, মূলত: দক্ষিণ মহাসাগরে এদের দেখা মেলে, নাবিকের
পথপ্রদর্শক বন্ধু বলে বিশ্বাস করা হয় । কোলরিজের বিখ্যাত কবিতা ‘দ্য রাইম অব
অ্যানশ্যান্ট মেরিনার’ –এ আছে, এক নাবিক
বন্ধুরূপী অ্যাল্বাট্রোস পাখি হত্যা করায় তাদের জাহাজ সমুদ্রেই আটকে যায় । তখন
রাগে হতাশায় সহকর্মী অন্য নাবিকেরা মৃত অ্যাল্বাট্রোসের
শরীর তার গলায় বেঁধে দিয়েছিল । তদবধি, অ্যাল্বাট্রোস
গলায় বাঁধা মানে ‘পাপের বোঝা বহন করা’ অর্থে ব্যবহৃত হয়
।
রোজারিও (Rosario): আর্জেন্টিনার
শহর, যেখানকার ব্যাঙ্কগুলোতে অভিবাসীরা ছেড়ে
আসা দেশ থেকে আনা বিপুল অর্থ জমা রাখত ।
বার্বি(Barbie):
সাজানোগোছানো মেয়ে পুতুল ।
আইখম্যান( Adolf
Eichmann 1906-1962): হিটলারের ইহুদি-নিধন নীতির সহযোগী, নাৎসি সরকারের
গোয়েন্দা-অধিকর্তা।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষে অস্ট্রিয়া হয়ে দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেণ্টিনাতে পালিয়ে
যায় । ১৯৬০সালে ইস্রায়েলের গোয়েন্দাপুলিশের হাতে ধরা পড়ে ফাঁসি হয় ।
সেণ্ট এল্মোর
আলো (St Elmo’s fire): বজ্রবিদ্যুৎসম্পন্ন ঝড় অথবা
আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময় আবহাওয়াতে তড়িৎচুম্বক ক্ষেত্রের উৎপত্তি হয় । অনেক
সময় তখন লম্বা, তীক্ষ্ণ অথবা ধারালো বস্তুর চারদিকে, বিশেষত: অগ্রভাগে
হালকা নীল অথবা বেগনি অস্থায়ী এবং কম্পমান আলো দেখা যায় । জাহাজের মাস্তুল তার
সবচাইতে উঁচু বিন্দু হওয়াতে সেখানে এই আলো অপার্থিব দেখায় । নাবিকদের আরাধ্য সেন্ট
এল্মোর নামে জাহাজীরা এই আলোর নামকরণ করেছে । নাবিকদের মধ্যে বিশ্বাস আছে যে এই
আলো ঊর্ধ্বমুখী হলে মঙ্গল, বিপরীতে অমঙ্গল ।
ম্যাথু প্যাশন(Mathew
Passion): জার্মান সঙ্গীতস্রষ্টা বাখ-এর অমর সৃষ্টি ।
জীল্যান্ড(Zeeland):
হল্যান্ডের পশ্চিম ভাগে অবস্থিত সমুদ্রতল থেকেও নিচু ভূভাগ । বাঁধ(dyke) দিয়ে অগভীর
সমুদ্রকে আটকে এখানে জনপদ গড়ে তোলা হয়েছে । ১৯৫৩ এর ভয়ঙ্কর সামুদ্রিক বন্যায়
বাঁধগুলোর অধিকাংশই ভেঙ্গে গিয়ে বহু জীবন ও সম্পত্তিহানি ঘটে ।
মার্কাস অরিলাস(Marcus
Aurilus, c.161-180): রোমান সম্রাট
ও দার্শনিক ।
বোরোদিনো(Borodino):
৭ সেপ্টেম্বর, ১৮১২, মস্কোর কাছে
বোরোদিনো নামক গ্রামের মাঠে নেপোলিয়নের নেতৃত্বে ফরাসি সেনাবাহিনী ও জেনারেল
কুটুজভের নেতৃত্বে রাশিয়া সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীর মধ্যে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয় ।
দুপক্ষের প্রায় আড়াই লাখ সৈন্যের মধ্যে সত্তর হাজার সৈন্য নিহত হয়, আহতও হয় অনেক ।
একই দিনে এত হতাহত আর কোনো যুদ্ধে কখনো হয় নি ।
অ্যানাগ্রাম (Anagram):
কোনো শব্দের অক্ষরগুলোর স্থান পরিবর্তন করে নতুন যে শব্দ গঠিত হয় ।
ওডিসিউস(Odyssius):
হোমারের ‘ওডিসি’ মহাকাব্যের নায়ক
। ট্রয়যুদ্ধের পর গ্রিক বীর ওডিসিউস নানা দেশ ভ্রমণ করে ১৭ বৎসর পর দেশে পৌছেছিলেন
। তাঁর ভ্রমণের অভিজ্ঞতাই এই মহাকাব্যে বিধৃত ।
হারমিস(Harmes):
গ্রিক পুরাণে বর্ণিত দেবদূত ।
শাকা (Shaka),
ইম্পি : শাকা দক্ষিণ আফ্রিকার
জুলু উপজাতির রাজা (১৭৮৭-১৮২৮)। পিতা সেনজাংগাখোনা, মাতা নান্দি ।
অবৈধ সন্তান হবার জন্য তিনি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী বিবেচিত হন
নি । পিতার মৃত্যুর পর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত বৈমাত্রেয় ভাইকে অন্যান্য ভাইদের
সাহায্যে হত্যা করে নিজে রাজা হন । বিবদমান উপজাতিগোষ্ঠিগুলোকে কিছু ক্ষেত্রে
যুদ্ধে বিধ্বস্ত করে ও কিছু ক্ষেত্রে শান্তিপ্রচেষ্টা দ্বারা বশীভূত করে নিজের
শক্তিবৃদ্ধি করেন । জুলু উপজাতিকে শক্তিশালী এবং সংগঠিত করবার জন্য নানারকম নিয়ম
পালন অবশ্যকর্তব্য করেন । আদেশ না মানার শাস্তি ছিল মৃত্যু । জুলু ভাষাতে
যোদ্ধাদলকে ইম্পি বলা হয় ।
আর্কাডি(Arcady)
: গ্রিসদেশের একটি পার্বত্য স্থান ।(গ্রিক পুরাণে) সরলতা ও সন্তুষ্টিতে ভরপুর একটা কাল্পনিক
স্থান ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন