“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বুধবার, ২০ জানুয়ারী, ২০১৬

আয়স কাল ১৮


(দক্ষিণ আফ্রিকীয় লেখক জে এম কোয়েটজি-র লেখা 'এজ অব আয়রন'- উপন্যাসের  বাংলা অনুবাদের ৩য় অধ্যায়ের শেষ     ভাগ: -- শিবানী দে)
(C)Image:ছবি

ভারকুয়েইল দরজায় টোকা দিল । জিগ্যেস করল, “তুমি কি কিছু খাবে ?”

আমার খিদে নেই । কিন্তু তুমি দেখ কিছু আছে কিনা, থাকলে খেয়ে নাও ।

আমি একা থাকতে চাইছিলাম, কিন্তু সে দাঁড়িয়েই রইল, কৌতূহলভরা চোখে আমাকে দেখতে থাকল । আমি বিছানাতে বসেছিলাম, হাতে গ্লাভ্‌স, হাঁটুর উপর রাখা লেখার কাগজ । আধঘণ্টা ধরে আমি খালি পাতার দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে আছি ।

আমি  অপেক্ষা করছি কখন আমার হাত গরম হবে ।আমি বললাম ।

কিন্তু ঠাণ্ডা হওয়া আঙ্গুলের জন্যই আমি যে লিখছি না তা নয় । এটা হল পিলের ফল, যা আমি এখন আরো বেশি সময়, এবং সংখ্যায়ও বেশি করে খাই । এগুলো হল ধোঁয়া ওঠানোর জিনিষ । আমি এগুলো গিলি, সেগুলো আমার ভেতরে ধোঁয়ার কুয়াশা ছাড়ে, বিনষ্টির কুয়াশা । পিল খেলে আমি আর লিখতে পারি না ব্যথা ছাড়া লিখা হয় না----- একটা নতুন ও ভয়ানক নিয়ম হয়েছে । তা ছাড়া যখন আমি পিল খাই, কোনো কিছুই ভয়ানক থাকে না, সব কিছুই উদাসীন, সব কিছুই সমান ।

তবুও আমি লিখি । শেষরাতে , ভারকুয়েইল যখন নিচের তলায় ঘুমোয়, আমি এই চিঠিটায় তোমাকে এই ছেলেটা জনের বিষয়ে একটা কথা বলি, সেই যে বিষণ্ণ ছেলেটা যাকে আমার ভাল লাগত না । আমি তোমাকে বলতে চাই যে আমার অপছন্দ সত্ত্বেও সে এখন আমার কাছে আরো পরিষ্কারভাবে, আরো তীব্রভাবে আছে, ভেকিও কখনো এতটা ছিল না । সে আমার সাথে আছে অথবা আমি তার সাথে আছি :  সে অথবা তারই চিহ্ন । এখন মধ্যরাত্রি, এটা তার ধূসর সকালের ধূসরতাও । আমি এখানে আমার বিছানায়, কিন্তু আমি ফ্লোরেন্সের ঘরেও, যে ঘরের একটাই দরজা, একটাই জানালা, আর বাইরে যাবার উপায় নেই । বাইরের দরজায় লোকেরা অপেক্ষা করছে, শিকারির মত গুটিগুটি, ছেলেটিকে মরণ উপহার দিতে । তার কোলে সে পিস্তলটা ধরে আছে, এবং সেই সময়টুকুর জন্য সে শিকারিদের দূরে রাখতে পেরেছে, সেটাই ছিল ভেকি ও তার গোপন রহস্য, যা তাদের পুরুষ বানাচ্ছিল; তার কাছে আমি দাঁড়াচ্ছি কিংবা উড়ছি । পিস্তলের ব্যারেলটা তার দুহাঁটুর মাঝখানে ; সে সেটার উপরে নিচে হাত বোলাচ্ছে। সে বাইরের মৃদুস্বরের কথাবার্তা শুনছে , আর আমি ও তার সঙ্গে শুনছি । সে নিজেকে প্রস্তুত করছে ধোঁয়ার জন্য যা তার ফুসফুস বুজিয়ে দেবে, লাথির জন্য যা তার দরজা ভেঙ্গে দেবে, আগুনের স্রোয় যা তাকে বয়ে নিয়ে যাবে । সে নিজেকে প্রস্তুত করছে সেই মুহূর্তের জন্য যখন সে সময় পাবে আলোর মাঝখানে ঠিক একটাই গুলি করবার জন্য ।

তার চোখগুলোতে পলক পড়ছে না, স্থির তাকিয়ে সেই দরজার দিকে যেখান দিয়ে সে এই জগত ছেড়ে চলে যাবে । তার মুখ শুকনো, কিন্তু সে ভীত নয় । তার হৃদ্‌পিণ্ড সমানভাবে স্পন্দিত হচ্ছে, ঠিক যেভাবে সে তার বুকের কাছে মুঠি একবার বন্ধ করছে, একবার খুলছে ।

তার চোখ খোলা, এবং আমার চোখ, যদিও আমি লিখি, বন্ধ । আমার চোখ বন্ধ দেখবার জন্য ।

এই মধ্যান্তরালে কোনো সময় নেই, যদিও তার হৃদয় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্পন্দিত হচ্ছে । আমি এখানে এই রাতে আমার ঘরে আছি, কিন্তু আমি আবার তার সঙ্গেও আছি সব সময়, যেভাবে আমি সাগর পেরিয়ে তোমার কাছে ও আকাশে ভেসে আছি ।

এই সময়টা একটা ভাসমান সময়, শাশ্বত নয় । যখন দরজা ভেঙ্গে খুলে যাবে, এবং আমরা, প্রথমে ছেলেটা, তারপর আমি, দেখব বিরাট সাদা আলোর ঝলকানি, সেই সময়টার আগের এই সময়টা, যাকে বলে এখনকার মত’, অস্থায়ী

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~০০০০০০০০০০০০০০০০০০~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
*তারা-চিহ্নিত শব্দগুলোর পরিচয় :


উইটডয়েক(witdoeke):  তৎকালীন বর্ণবিদ্বেষী দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের  ভাড়াটে ঠ্যাঙ্গাড়ে-বাহিনী

ঈনিয়াস(Aenius): রোমান কবি ভার্জিলের মহাকাব্য দ্য ইনিড’-এর নায়ক ।

উপন্যাস : এখানে, The Scarlet Letter  আমেরিকান লেখক ন্যাথানিয়েল হথর্ন-এর ১৮৫০সালে প্রকাশিত বিখ্যাত উপন্যাস দ্য স্কার্লেট লেটার

লোটসভোজী( Lotos Eaters): হোমারের মহাকাব্য ওডিসিতে লোটসভোজীদের দেখা পাওয়া যায় । এরা লোটস(পদ্ম নয়) ফল খেয়ে সারাদিন ঝিমন্ত অবস্থায় স্বপ্নের জগতে বাস করত । অলস, দিবাস্বপ্ন দেখা লোক।

বড় মন্দা (The Great Depression): ত্রিশের দশকের পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, যখন বড়বড় খামারে যন্ত্রভিত্তিক কৃষি উৎপাদন শুরু হওয়ায় বেকার কৃষিশ্রমিকের দল গ্রামাঞ্চল থেকে শহরের পথে যাত্রা করত সমাজে  বেকারি, তৎসহ দারিদ্র্যের বৃদ্ধির ফলে  দেশে দেশে বাজারের পতন ঘটে । মূলত: আমেরিকা থেকে ইউরোপ হয়ে এই মন্দার ঢেউ সারা পৃথিবীতে প্রভাব ফেলেছিল ।

অ্যাল্‌বাট্রোস (Albatross): বৃহৎ সামুদ্রিক পাখি, মূলত: দক্ষিণ মহাসাগরে এদের দেখা মেলে, নাবিকের পথপ্রদর্শক বন্ধু বলে বিশ্বাস করা হয় । কোলরিজের বিখ্যাত কবিতা দ্য রাইম অব অ্যানশ্যান্ট মেরিনার’ –এ আছে, এক নাবিক বন্ধুরূপী অ্যাল্‌বাট্রোস পাখি হত্যা করায় তাদের জাহাজ সমুদ্রেই আটকে যায় । তখন রাগে হতাশায়  সহকর্মী অন্য নাবিকেরা মৃত অ্যাল্‌বাট্রোসের শরীর তার গলায় বেঁধে দিয়েছিল তদবধি, অ্যাল্‌বাট্রোস গলায় বাঁধা মানে পাপের বোঝা বহন করাঅর্থে ব্যবহৃত হয় ।

রোজারিও (Rosario): আর্জেন্টিনার শহর, যেখানকার ব্যাঙ্কগুলোতে অভিবাসীরা ছেড়ে আসা দেশ থেকে আনা  বিপুল অর্থ জমা রাখত ।

বার্বি(Barbie): সাজানোগোছানো মেয়ে পুতুল ।

আইখম্যান( Adolf Eichmann 1906-1962): হিটলারের ইহুদি-নিধন নীতির সহযোগী, নাৎসি সরকারের গোয়েন্দা-অধিকর্তাদ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষে অস্ট্রিয়া হয়ে দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেণ্টিনাতে পালিয়ে যায় । ১৯৬০সালে ইস্রায়েলের গোয়েন্দাপুলিশের হাতে ধরা পড়ে ফাঁসি হয় ।

সেণ্ট এল্‌মোর আলো (St Elmo’s fire): বজ্রবিদ্যুৎসম্পন্ন ঝড় অথবা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময় আবহাওয়াতে তড়িৎচুম্বক ক্ষেত্রের উৎপত্তি হয় । অনেক সময় তখন লম্বা, তীক্ষ্ণ অথবা ধারালো বস্তুর চারদিকে, বিশেষত: অগ্রভাগে হালকা নীল অথবা বেগনি অস্থায়ী এবং কম্পমান আলো দেখা যায় । জাহাজের মাস্তুল তার সবচাইতে উঁচু বিন্দু হওয়াতে সেখানে এই আলো অপার্থিব দেখায় । নাবিকদের আরাধ্য সেন্ট এল্‌মোর নামে জাহাজীরা এই আলোর নামকরণ করেছে । নাবিকদের মধ্যে বিশ্বাস আছে যে এই আলো ঊর্ধ্বমুখী হলে মঙ্গল, বিপরীতে অমঙ্গল ।

ম্যাথু প্যাশন(Mathew Passion): জার্মান সঙ্গীতস্রষ্টা বাখ-এর অমর সৃষ্টি ।

জীল্যান্ড(Zeeland): হল্যান্ডের পশ্চিম ভাগে অবস্থিত সমুদ্রতল থেকেও নিচু ভূভাগ । বাঁধ(dyke) দিয়ে অগভীর সমুদ্রকে আটকে এখানে জনপদ গড়ে তোলা হয়েছে । ১৯৫৩ এর ভয়ঙ্কর সামুদ্রিক বন্যায় বাঁধগুলোর অধিকাংশই ভেঙ্গে গিয়ে বহু জীবন ও সম্পত্তিহানি ঘটে ।

মার্কাস অরিলাস(Marcus Aurilus, c.161-180): রোমান সম্রাট ও দার্শনিক ।

বোরোদিনো(Borodino): ৭ সেপ্টেম্বর, ১৮১২, মস্কোর কাছে বোরোদিনো নামক গ্রামের মাঠে নেপোলিয়নের নেতৃত্বে ফরাসি সেনাবাহিনী ও জেনারেল কুটুজভের নেতৃত্বে রাশিয়া সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীর মধ্যে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয় । দুপক্ষের প্রায় আড়াই লাখ সৈন্যের মধ্যে সত্তর হাজার সৈন্য নিহত হয়, আহতও হয় অনেক । একই দিনে এত হতাহত আর কোনো যুদ্ধে কখনো হয় নি ।

অ্যানাগ্রাম (Anagram): কোনো শব্দের অক্ষরগুলোর স্থান পরিবর্তন করে নতুন যে শব্দ গঠিত হয় ।

ওডিসিউস(Odyssius): হোমারের ওডিসিমহাকাব্যের নায়ক । ট্রয়যুদ্ধের পর গ্রিক বীর ওডিসিউস নানা দেশ ভ্রমণ করে ১৭ বৎসর পর দেশে পৌছেছিলেন । তাঁর ভ্রমণের অভিজ্ঞতাই এই মহাকাব্যে বিধৃত ।

হারমিস(Harmes): গ্রিক পুরাণে বর্ণিত দেবদূত ।

শাকা (Shaka), ইম্পি : শাকা দক্ষিণ আফ্রিকার জুলু উপজাতির রাজা (১৭৮৭-১৮২৮)। পিতা সেনজাংগাখোনা, মাতা নান্দি । অবৈধ সন্তান হবার জন্য তিনি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী বিবেচিত হন নি । পিতার মৃত্যুর পর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত বৈমাত্রেয় ভাইকে অন্যান্য ভাইদের সাহায্যে হত্যা করে নিজে রাজা হন । বিবদমান উপজাতিগোষ্ঠিগুলোকে কিছু ক্ষেত্রে যুদ্ধে বিধ্বস্ত করে ও কিছু ক্ষেত্রে শান্তিপ্রচেষ্টা দ্বারা বশীভূত করে নিজের শক্তিবৃদ্ধি করেন । জুলু উপজাতিকে শক্তিশালী এবং সংগঠিত করবার জন্য নানারকম নিয়ম পালন অবশ্যকর্তব্য করেন । আদেশ না মানার শাস্তি ছিল মৃত্যু । জুলু ভাষাতে যোদ্ধাদলকে ইম্পি বলা হয় ।

আর্কাডি(Arcady) : গ্রিসদেশের একটি পার্বত্য স্থান ।(গ্রিক পুরাণে) সরলতা ও সন্তুষ্টিতে ভরপুর একটা কাল্পনিক স্থান ।

কোন মন্তব্য নেই: