“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ১১ জানুয়ারী, ২০১৬

আয়স কাল ১৫

(দক্ষিণ আফ্রিকীয় লেখক জে এম কোয়েটজি-র লেখা 'এজ অব আয়রন'- উপন্যাসের  বাংলা অনুবাদের ৩য় অধ্যায়ের ৫ম    ভাগ: -- শিবানী দে)
মাঝরাতে আমি লাইফ-লাইনে টেলিফোন করলাম, ওপার থেকে একটি মহিলা বলল, “হোম ডেলিভারি ? স্টুট্টাফোর্ডস ছাড়া অন্য কোনো সংস্থা এখন আর হোম ডেলিভারি করে বলে জানিনা । আপনি কি মীল-অন-হুইলসএর খাবার চেখে দেখবেন ? ”
আমি বললাম, “রান্না করা খাবারের প্রশ্ন নয় , আমার নিজের রান্না আমি নিজেই করতে পারি । আমি চাই কেউ মুদিখানার জিনিষগুলো আমাকে এনে দিক । আমার মালপত্র বইতে কষ্ট হয় ।
আপনার ফোন নম্বর দিন, তাহলে আমি কোনো সমাজকর্মীকে বলব কাল সকালে আপনাকে ফোন করতে ।
আমি রিসিভার রেখে দিলাম ।
শেষ যেন দ্রুতগতিতে চলে আসছে । আমি ভাবিনি যে পাহাড়ের নিচে নামতে হলে তাড়াতাড়ি নামা যায়, গতি বেড়ে যায় । আমি ভেবেছিলাম পুরো রাস্তাটাই আস্তে আস্তে যাব । ভুল, সম্পূর্ণ ভুল ।
যখন সব কিছু শেষ হতে চলে, তখন একটা অবনমন হতে থাকে । শুধু নিজেদেরই নয়, কিন্তু নিজের বলে আমাদের যে ভাবটা, সেই মনুষ্যত্বের ভাবের অবনমন হয় । মৃত্যুপথযাত্রী অন্ধকার বিছানায় শুয়ে, নিজেদের নোংরায়, অসহায় অবস্থায় । মুমূর্ষু মানুষ বৃষ্টির মধ্যে ঝোপে শুয়ে । তুমি হয়তো একথা বুঝবে না, ভারকুয়েইল বুঝবে ।
ভারকুয়েইল আবার অদৃশ্য হয়েছে । কুকুরটাকে রেখে গেছে । ওর জন্য করুণা হয় সে কোনো অডিসিউস* নয়, হারমিস* ও নয় । হয়তো কোনো বার্তাবাহকও নয় । চক্রাকারে ঘুরন্ত, রোদ জলে পোড়া শরীর হলেও আসলে এক অদৃশ্য সূত্রে নিজের  চারপাশে ঘোরে, গণ্ডী ছাড়াতে পারে না ।
আর আমি ? ভারকুয়েইল নাহয় ওর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়নি, আমারটা ? মিথ্যের প্রাসাদের সামনে নিজেকে ভস্মীভূত করে দেবার সাহস আমার ছিল কিনা দেখানোর সেই পরীক্ষাটা ? হাজার বার আমি মনেমনে কল্পনা করেছি যে যখন দেশলাইকাঠি ধরাব তখন আমার কানদুটিতে শিখার নরম আঘাত লাগবে, আমি আশ্চর্য হয়ে, এমন কি খুশি হয়ে শিখার মাঝখানে বসে থাকব, ভাবব আমার কিছু হচ্ছে না, আমার কাপড় জ্বলবে, কিন্তু আমার পোড়ার জ্বালা হবে না, শিখাকে দেখব নরম নীল । যতক্ষণ না চোখের পাতা চোখের ভুরুতে আগুন না ধরে, যখন আর কিছু দেখতে পারা যাবে না, তার আগে আগে আমি আশ্চর্য হয়ে খুব দ্রুত ভাবব, জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলা কত সহজ। তার পরে আর কোনো চিন্তা হবে না, শুধুই ব্যথা (কারণ সব কিছুরই মূল্য চোকাতে হয় )।
এই ব্যথা কি দাঁতের ব্যথার চাইতেও বেশি হবে ? প্রসবের ব্যথা থেকে ? আমার নিতম্বের এই ব্যথা থেকে ? দুটো প্রসবের ব্যথা একসঙ্গে উঠলে যেমন ? কতগুলো ডিকোনেল লাগবে এই ব্যথা বোজাতে ?
গভর্নমেন্ট এভিন্যু-এর শিকল লাগানো রাস্তায় ঢাল দিয়ে গড়াবার আগে সব কটা ডিকোনেল একসঙ্গে গিলে ফেলার খেলা খেলা হবে ? মরবার সময় কি পুরো জ্ঞান নিয়ে, আত্মস্থ হয়ে মরতে হবে ? ব্যথাপ্রশমনের ওষুধ ছাড়াই কি মৃত্যুর জন্ম দিতে হবে ?
সত্যি কথাটা হল, প্রণোদনার ব্যাপারে একটা মিথ্যা সব সময়ই ছিল, একটা গভীর মিথ্যা, যদিও কেনএই প্রশ্ন করলে  উত্তর পাওয়া যাবে যে দুর্বিষহ ক্রোধ অথবা হতাশা যদি ব্যথা ও লজ্জার প্রায়শ্চিত্তে আমি বিছানায় সপ্তাহের পর সপ্তাহ বা মাসের পর মাস শুয়ে থাকি, তা তো আমার আত্মাকে শান্তি দেবে না, তাহলে আগুনের শিখার স্তম্ভে দুমিনিটে মরেই আমি কেন শান্তি পাব ? অসুস্থ বৃদ্ধাটি আত্মহত্যা করছে বলে কি মিথ্যা সব বন্ধ হয়ে যাবে ? কার জীবনে পরিবর্তন হবে, এবং  কিভাবে ? আমি  প্রায়ই ফ্লোরেন্সের কথা বলি । যদি ফ্লোরেন্স হোপকে সঙ্গে নিয়ে এবং বিউটিকে পিঠে বেঁধে এই রাস্তা ধরে যেতে থাকে, ও কি এই দৃশ্য দেখে অনুপ্রাণিত হবে ? সে কি এক ঝলক দেখবে ? ফ্লোরেন্স নিশ্চয়ই ভাববে, কোনো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ নয়, একটা জাদুকর, ভাঁড়, একটা মজাদার মানুষ, ভেবে হাঁটা দেবে
ফ্লোরেন্সের চোখে কোন মৃত্যুটা সার্থক বলে মনে হবে ? কোনটা ওর চোখে সমর্থনযোগ্য মনে হবে ? উত্তর হল, সম্মানজনক শ্রমের পর যে মৃত্যু আসে, অথবা যা আপনা থেকেই আসে, যাকে বাধা দেওয়া যায় না, যেমন বজ্র, যেমন দুচোখের মাঝখানে গুলি
ফ্লোরেন্সই বিচারক । চশমার পেছনে তার চোখ শান্ত, সব কিছুকে মাপে । তার শান্ত ভাব সে তার মেয়েদের দিয়েছে । বিচারশালা ফ্লোরেন্সেরই । আমাকেই বিচারের চক্ষুর নিচে ফেলা উচিত । আমি যদি বিচার্য জীবন যাপন করে থাকি, এটা এজন্য যে দশ বছর আমি ফ্লোরেন্সের বিচারশালায় তার নজরের আওতায় ছিলাম ।
তোমার কাছে কি ডেটল আছে ?”
আমি রান্নাঘরে বসে লিখছিলাম, গলার স্বরে চমকে উঠলাম । ওর, মানে ছেলেটার স্বর ।
উপরে যাও, বাথরুমে দেখ, বাথরুমের দরজা ডানদিকে । বেসিনের নিচে কাবার্ডে দেখ ।
জল ঢালার শব্দ শুনলাম । ছেলেটা আবার এল । তার ব্যান্ডেজ খোলা । আশ্চর্য হয়ে আমি  দেখলাম । তার সেলাই এখনো রয়েছে ।
ওরা সেলাই খুলে নি!
সে মাথা নাড়ল ।
কিন্তু তুমি হাসপাতাল ছাড়লে কবে ?”
কালকে । কালকের আগের দিন ।
কেন তার মিথ্যে বলার দরকার ?
তুমি ওখানে থাকলে না কেন ? ওরা তোমার দেখাশোনা করতে পারত
কোনো জবাব নেই ।
তোমার জখমটা ঢেকে রাখতে হবে, নইলে সংক্রমণ হয়ে যাবে, দাগও পড়বে ।
সারা জীবনের মত কপালে চাবুকের মারের মত দাগ নিয়ে ঘুরে বেড়াবে : একটা স্মারক ।
ও আমার কে যে আমি জেদ করতে থাকব ? হ্যাঁ, আমি তার খোলা মাংস বের হওয়া কাটা চেপে রেখেছিলাম, রক্তের ধারাকে বন্ধ করেছিলাম । মাতৃত্ববোধ কত জেদি ! যেমন করে কোনো মুরগি তার বাচ্চা হারালে হাঁসের ছানাকেই তার হলুদ লোম, চ্যাপ্টা ঠোট সত্ত্বেও নিজের বলে গ্রহণ করে,তাকে বালিতে স্নান করায়, পোকা ধরতে শেখায় ।
আমি লাল টেবিলঢাকা কাপড়টা নিয়ে কাটতে আরম্ভ করলাম । বললাম, “আমার কাছে কোনো ব্যান্ডেজ নেই । কিন্তু এই কাপড়টা পরিষ্কার, অবশ্য যদি তোমার লাল রঙে আপত্তি না থাকে ।আমি তার মাথার চারপাশে দুবার করে পেঁচিয়ে একটা গিঁট দিলাম । তোমার সেলাইগুলো কাটবার জন্য ডাক্তারের কাছে বা ক্লিনিকে যাওয়া উচিত । এভাবে রেখে দেওয়া ঠিক নয় ।
ওর ঘাড়টা লোহার শিকের মত দুর্নমনীয় । শরীর থেকে একটা গন্ধ বেরোচ্ছে, এই গন্ধই কুকুরটাকে উত্তেজিত করে তুলেছিল---- একটা অস্থিরতা, ভয়ের উত্তেজনা ।
গলা পরিষ্কার করে সে বলল, “আমার মাথার ঘা অনেকটা সেরেছে কিন্তু আমার হাত”---- সে সাবধানে কাঁধ নাড়াল---- আমার হাতকে নাড়ানো যাবে না ।
বলো তো, তুমি কারো থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছ ?”
সে চুপ রইল ।
আমি বললাম, “আমি তোমাকে সোজাসুজি বলতে চাই, তুমি এই সব করার পক্ষে খুবই ছোট । আমি আগে ভেকিকেও একথা বলেছিলাম, এখন আবার তোমাকে বলছি । আমার কথা তোমায় শুনতে হবে । আমি একজন বয়স্ক মানুষ, আমি জানি আমি কি নিয়ে কথা বলছি । তোমরা এখনো ছোট । জীবন কি সেটা বোঝবার আগেই তোমরা তোমাদের জীবনকে ফেলে দিচ্ছ । তুমি কি বল তো ? মাত্র পনেরো বছর বয়স । পনেরো বছর বয়স মরবার পক্ষে অত্যন্ত কম । আঠারো বছরও কম । একুশ বছরও কম ।
সে দাঁড়াল, আঙ্গুলের ডগা দিয়ে লাল ব্যান্ডেজটার উপর বোলাল । আমাকে অনেক দয়া করল ।
শিভ্যাল্‌রির যুগে শিরস্ত্রাণের উপর নারীর আশিস্‌চিহ্ন ধরে একজন পুরুষ অন্য পুরুষকে যুদ্ধে হত্যা করত । এই ছেলেটাকে উপদেশ দেওয়া শ্বাসপ্রশ্বাসের অপচয় । লড়াইয়ের প্রবৃত্তি তার অত্যন্ত প্রবল, তাকে তাড়না করছে । লড়াই : দুর্বলকে সরিয়ে সবলের সঙ্গিনী জোটানোর জন্য প্রকৃতির উপায় । গৌরব মেখে ফিরে আস, তোমার কামনা পূর্ণ হবে । রক্তাক্ত এবং গৌরব, মৃত্যু এবং কাম আর আমি একটা  মরমর থুত্থুড়ে বুড়ি, ওর মাথায় আমার আশিসপট্টি বাঁধছি !
সে জিগ্যেস করল, “ভেকি কোথায় ?”
আমি তার মুখের দিকে সতর্কভাবে তাকালাম । আমি কি বলেছি তা কি সে বোঝে নি ? সে কি ভুলে গেছে ? “বসো,” আমি বললাম ।
আমি টেবিলের উপর ঝুঁকে বসলাম । বললাম, “ভেকি মাটির তলায় । সে মাটির ভেতরে একটা গর্তের মধ্যে একটি বাক্সে, তার উপর মাটির স্তূপ চাপা দেওয়া । সে সেই গর্ত ছেড়ে আর কোনো দিন আসবে না । কখনো না, কখনো, কখনো না একটা কথা বোঝ । এটা ফুটবল খেলার মত খেলা নয়, যখন পড়ে গেলেও আবার উঠে খেলতে থাক । যে সমস্ত লোকের বিরুদ্ধে তোমরা খেলছ, তারা পরস্পরকে বলে না, “এ একটা বাচ্চা ছেলে, কাজেই ওকে বাচ্চাদের বুলেট দিয়ে বুলেট খেলা করি । তারা কখনো তোমাকে বাচ্চা ছেলে বলে চিন্তা করে না । তারা তোমাকে শত্রু ভাবে, তাই ঘৃণা করে, ঠিক যেমন তুমি তাদের ঘৃণা কর । তোমাকে গুলি করে তাদের কোনো বিবেক দংশন হবে না, বরং যখন তুমি পড়ে যাবে, তখন তারা খুশিতে হাসবে এবং তাদের বন্দুকের ভাঁড়ার আরো বাড়াবে ।
সে আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন আমি তার মুখে চড়ের পর চড় মারছি । কিন্তু চোয়াল শক্ত করে ঠোঁট চেপে সে অনমনীয়ভাবে বসে রইল । তার চোখে সেই ঘোলাটে আবরণ ।
আমি বললাম, “তুমি ভাবছ, ওদের ডিসিপ্লিন জোরালো নয় । তুমি ভুল করছ । ওদের ডিসিপ্লিন খুবই ভাল । যে কারণবশতঃ তারা তোমাদের শিশুসমেত সব পুরুষকে একেবারে শেষ করছে না, তা কোনো করুণা কিংবা সহমর্মিতা নয় । এটা হল সেই ডিসিপ্লিন, আর কিছু নয় । উপর থেকে আদেশ আসে, তা যে কোনো সময় বদলে যেতে পারে করুণা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলা হয় । এ হল যুদ্ধ । আমি কি বলছি শোন । আমি জানি আমি কি বলছি । তুমি হয়তো ভাবছ আমি তোমাকে যুদ্ধ থেকে বিরত করার জন্য চেষ্টা করছি । হ্যাঁ, সেটা সত্যি । আমি তা-ই করছি । আমি বলি, অপেক্ষা করো, তুমি এখনো খুবই ছোট ।
সে অস্থিরভাবে ফিরে বসলকথা, কথা । কথার ওজন তার ঠাকুরদা-ঠাকুরমা, তার বাবা-মায়ের প্রজন্ম হয়ে তার উপর চেপেছে । মিথ্যা, প্রলোভন, চাটুবাক্য, ভয় দেখানো, তারা এই ধরণের কথার ভারে ন্যুব্জ হয়েছে । কিন্তু সে নয় ।  সে কথাকে দূরে ছুঁড়ে ফেলবে। কথার মৃত্যু হোক ।
আমি বললাম, “তোমরা বল এখন লড়াইয়ের সময় । তোমরা বল এখন হয় জিতবার নয় হারবার সময় । এই হারা অথবা জেতার বিষয়ে আমাকে কিছু বলতে দাও । এই আমরাকথাটার উপর কিছু বলতে দাও । আমার কথা শোন ।
তুমি জান যে আমি অসুস্থ । আমার কি হয়েছে তা জান কি ? আমার ক্যান্সার হয়েছে । সারা জীবন ধরে যে লজ্জা আমি সহ্য করেছি, সেই লজ্জা জমে জমে ক্যান্সার হয়েছে । এভাবেই ক্যান্সার আসে : নিজেকে অবমাননা করলে শরীর বিষাক্ত হয়ে ওঠে এবং নিজেই নিজেকে খেতে থাকে । তোমরা বলবে লজ্জা ও ঘৃণায় নিজেকে খেয়ে ফেলার প্রসঙ্গ এখানে টানবার কি দরকার ? তুমি কি অনুভব করেছ তার গল্প আমার শোনবার ইচ্ছে নেই, ওটা অন্য গল্প, কিন্তু তুমি কিছু করছ না কেন ?’ আর যখন তোমরা একথা বলবে, তখন আমি বলি, ‘হ্যাঁ’, আমি বলি হ্যাঁ’, ‘হ্যাঁ
তুমি যদি ওই প্রশ্ন কর, তাহলে আমার হ্যাঁবলা ছাড়া কোন জবাব নেই । কিন্তু আমি তোমাকে বলছি, এই হ্যাঁউচ্চারণ করাটা কিরকম । এটা যেন তোমার জীবনের বিচার, যখন তোমাকে বলা হয় এক শব্দে জবাব দাও, হ্যাঁ অথবা না। যখনি তুমি তার বাইরে কিছু বলার উপক্রম কর, বিচারক তোমাকে সতর্ক করে, ‘হ্যাঁ অথবা না, অন্য কোন কথা নয় ।তুমি বল, ‘হ্যাঁতুমি সব সময়ই পেটে বাচ্চার নড়াচড়ার মত অন্যকথার নড়াচড়া তোমার ভেতরে টের পাও, পেটের ভেতরে বাচ্চার লাথি নয়, কিন্তু তার শুরুটা, যেভাবে কোন নারী অনুভব করে সে গর্ভবতী ।
আমার ভেতরে শুধু মৃত্যুই বাস করে না, জীবনও আছে । মৃত্যু বলবান, জীবন দুর্বল । কিন্তু আমার কর্তব্য জীবনের প্রতি, আমি তাকে বাঁচিয়ে রাখব আমাকে তা করতেই হবে
তুমি কথাতে বিশ্বাস কর না । তুমি ভাব যে মারটাই আসল, মার এবং গুলি । কিন্তু আমার কথা শোন : আমি যে কথাগুলো বলছি তা ঠিক বলে মনে হয় না ? শোন । শব্দ হয়তো বায়ু থেকেই হয়, কিন্তু তারা আমার হৃদয় থেকে, আমার গর্ভ থেকে আসে । তারা শুধু হ্যাঁবা নানয় । আমার ভেতরে যা আছে তা অন্য, অন্য কথা । আমি আমার মত করে সেই কথার জন্য লড়ছি, যাতে তা চাপা পড়ে শেষ হয়ে না যায় । আমি হলাম সেইসব চীনা মায়েদের মত যারা জানে যে তাদের মেয়ে হলে সেই শিশুকে কেড়ে নেওয়া হবে, তারপর মেরে ফেলা হবে, কারণ পরিবারের প্রয়োজন, গ্রামের প্রয়োজন হল শক্তিশালী বাহুর ছেলে । তারা জানে যে জন্ম দেবার পর কেউ একজন ঘরে আসবে, যার মুখ থাকবে লুকোনো, যে বাচ্চাটাকে ধাত্রীর কাছ থেকে নিয়ে নেবে, তার লিঙ্গ যদি স্ত্রী হয়, তাহলে ওদের প্রতি সৌজন্যবশতঃ পিছন ফিরে, চোয়ালটা শক্ত হাতে বন্ধ করে, ছোট্ট নাকটা চিমটি দিয়ে ধরে শ্বাস রুদ্ধ করে দেবে । এক মিনিটেই সব শেষ ।
মাকে পরে বলা হবে, দুঃখ যদি পাও, কাঁদ, দুঃখ তো স্বাভাবিক । কিন্তু প্রশ্ন করো না, ছেলে বলে বস্তুটা কি ? আর মেয়ে বলে বস্তুটাই বা কি, যাকে মরতে হয় ?
আমাকে ভুল বুঝো না । তুমি তো কারো ছেলে । আমি ছেলেদের বিরুদ্ধে নই । কিন্তু তুমি কি কখনো নবজাত শিশু দেখেছ ? আমি তোমাকে বলছি, একটা নবজাত মেয়ে ও ছেলের মধ্যে পার্থক্য চট করে ধরা যায় না । প্রত্যেকটি শিশুরই দুপায়ের মাঝখানে একই রকম দেখতে ফোলা ফোলা ভাঁজ রয়েছে, নলের মত, আকর্ষের মত প্রত্যঙ্গটা, যা ছেলেকে আলাদাভাবে চেনায়, তা বাস্তবিক কোনো বড় জিনিষ নয় খুব অল্প ব্যাপারের জন্য জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে ফারাক আসে । তবুও, অন্য সব কিছু, যা কিছু অনির্দিষ্ট, যা কিছু চাপের মুখে আত্মসমর্পণ করে, তাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়, তাদের পক্ষের যুক্তির কথা না শুনেই । আমি সেই না-শোনাদের পক্ষে বলছি ।
তুমি বুড়োদের কথা শুনে শুনে ক্লান্ত মনে হচ্ছে । তুমি পুরুষ হয়ে পুরুষোচিত কাজ করবার জন্য আকুল হচ্ছ । তুমি ভাবছ এই হল জীবন । তুমি বিরাট ভুল করছ । জীবন কোনো লাঠি, খুঁটি, পতাকাদন্ড, বা বন্দুককে অনুসরণ করা নয় , এবং তা অনুসরণ করে কোথায় যাচ্ছ তা দেখতে থাকাও নয় । জীবন সামনের কোনো কোণায় নেই । তুমি জীবনের মধ্যেই এসে গেছ ।
 টেলিফোন বাজল ।
ও ঠিক আছে, আমি ফোন ধরব না । আমি বললাম । চুপচাপ ফোনের রিং বন্ধ হবার অপেক্ষা করতে লাগলাম ।
বললাম, “তোমার নাম কি ? ”
জন ।
জন’ : যদ্দুর জানি, একটা সাধারণ  নাম
তোমার কর্মসূচি কি ?”
সে না বোঝার মত ভান করে তাকাল ।
তুমি কি করতে চাও ? তুমি এখানে থাকতে চাও ?”
আমি বাড়ি যাব।
বাড়ি কোথায় ?”
সে আমার দিকে হতাশভাবে তাকাল, মিথ্যে বলতে বলতে বোধ হয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল বেচারা ছেলেটা,” আমি ফিস্‌ফিসিয়ে বললাম ।

আমি গোয়েন্দাগিরি করতে চাইছিলাম না । কিন্তু আমার পায়ে ছিল স্লিপার, আর ফ্লোরেন্সের ঘরের দরজা ছিল খোলা । তার পিঠ আমার দিকে । সে বিছানায় বসেছিল, হাতে কিছু একটা জিনিষ নিয়ে মনোযোগ সহকারে দেখছিল । আমার উপস্থিতি টের পেয়ে সে চমকে উঠে জিনিষটা বিছানার চাদরের নিচে চালান করল ।
আমি শুধোলাম, “ওখানে কি আছে ?”
ও কিছু না,” সে জোর করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল ।
আমি হয়তো জোর করতাম না, যদি না দেখতাম যে দেওয়ালের ধার থেকে মেঝের তক্তা খানিকটা তুলে ফেলা হয়েছে, এবং সেটা মেঝের উপরই পড়ে আছে, দেওয়ালের পলেস্তারা- ছাড়া ইটের কাজ দেখা যাচ্ছে ।
তুমি কি করছ ? তুমি ঘরটা টুকরো টুকরো করে ফেলবে নাকি ?”
সে নিরুত্তর ।
কি লুকোচ্ছ ? আমাকে দেখাও ।
সে মাথা নাড়ল ।
আমি দেওয়ালের দিকে উঁকি দিলাম । ইটের কাজের গায়ে বেশ বড় একটা ভেন্টিলেটর বসানো হয়েছে । ফাঁকটা দিয়ে যে কেউ মেঝের কাঠের নিচে গলে যেতে পারে ।
তুমি কি মেঝের নিচে কিছু রাখছ ?”
আমি কিছু করছি না ।
আমি ফ্লোরেন্স যে নম্বরটা দিয়েছিল, সেই নম্বরটাতে ডায়েল করলাম । একটা বাচ্চা ফোন তুলল । আমি জিগ্যেস করলাম, আমি কি মিসেস ম্‌কুবুকেলির সাথে কথা বলতে পারি ? ওদিক থেকে চুপচাপ আমি বললাম, “মিসেস ম্‌কুবুকেলি, ফ্লোরেন্স ।
অল্প গুনগুন শব্দ, তারপর মেয়েলি গলা, “আপনি কার সঙ্গে কথা বলতে চান ?”
মিসেস ম্‌কুবুকেলি, ফ্লোরেন্স
সে এখানে নেই ।
আমি বললাম, “আমি মিসেস কারেন । মিসেস ম্‌কুবুকেলি আমার কাজ করত । আমি তার ছেলের বন্ধু, যে তার নাম বলেছে জন, তার ব্যাপারে কথা বলবআমি তার আসল নাম জানি না । ব্যাপারটা জরুরি । ফ্লোরেন্স যদি ওখানে না থাকে, তবে কি আমি মিঃ থাবেনের সঙ্গে কথা বলতে পারি ?”
অনেকক্ষণ চুপচাপ । তারপরে একটা পুরুষ কণ্ঠ :  হ্যাঁ, থাবেন বলছি ।
আমি মিসেস কারেন । তোমার হয়তো মনে থাকতে পারে, আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল আমি ভেকির স্কুলের বন্ধুর ব্যাপারে ফোন করছি । হয়তো তুমি জাননা, সে হাসপাতালে ছিল ।
আমি জানি ।
এখন সে হাসপাতাল থেকে চলে এসেছে অথবা পালিয়েছে , এবং এখানে এসেছে । আমার বিশ্বাস করার কারণ আছে যে সে কোনও প্রকারের অস্ত্র রেখেছে, ঠিক কি জানিনা, যেটা সে ও ভেকি ফ্লোরেন্সের ঘরে রেখেছিল । আমার মনে হয় সেজন্যই সে এখন ফিরে এসেছে ।
হ্যাঁ,” সে সোজাসুজি বলল ।
মিঃ থাবেন, আমি তোমাকে বলছি না যে ছেলেটার উপর তুমি কোনো কর্তৃত্ব দেখাও । কিন্তু ছেলেটা সুস্থ নয় । তার খুব খারাপভাবে আঘাত লেগেছিল । আর আমার মনে হয় মানসিকভাবেও সে খুব বিচলিত অবস্থায় আছে । আমি জানিনা কিভাবে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করব । আমি এটাও জানিনা যে তার পরিবার কেপটাউনে আছে কি না । সে আমাকে বলে না । আমি শুধু এটাই বলছি যে কেউ একজন, যাকে সে বিশ্বাস করে, এসে ওর সঙ্গে কথা বলুক, আর কোনো কিছু ঘটবার আগে তাকে এখান থেকে নিয়ে যাক ।” 
সে মানসিকভাবে বিচলিত : তুমি কি বলছ ?”
আমি এটাই বোঝাতে চাইছি যে সে সহায়তা চায় । আমি বোঝাতে চাইছি যে তার কাজের জন্য সে নিজে দায়ী হতে নাও পারে । আমি বোঝাতে চাইছি যে তার মাথায় জখম হয়েছিল । আমি তার যত্ন নিতে অক্ষম, সে আমার কথা শুনবে না । তাই কারো আসা দরকার ।
আমি দেখছি ।
না, এরকম বললে হবে না, আমাকে কথা দিতে হবে ।
আমি তাকে নিয়ে যাবার জন্য কাউকে বলব । কিন্তু কখন সেটা বলতে পারব না ।
আজকে ?”
আমি বলতে পারব না । হয়তো আজকে, হয়তো কাল, আমি দেখব ।
মিঃ থাবেন, আমি একটা কথা পরিষ্কার বলে দিতে চাই । আমি এই ছেলেটা কিংবা আর কাউকে সে তার জীবন নিয়ে কি করবে তা নিয়ে উপদেশ দেবার চেষ্টা করছি না । সে বড় হয়েছে, এবং তার ইচ্ছাশক্তি ও আছে, সে কি করবে তা সে জানে । কিন্তু এই আদর্শবাদ-বন্ধুত্বের(comradeship) নামে এই যে হত্যা, রক্তপাত, এসবকে আমি মনেপ্রাণে ঘৃণা করি । আমার মনে হয় এসব বর্বরোচিত কাজ । এই কথাটাই আমি বলতে চাই ।
মিসেস কারেন, এই টেলিফোন লাইনটা খুব একটা ভাল নয় । তোমার স্বর ক্ষীণ, অত্যন্ত ক্ষীণ এবং অত্যন্ত দূর মনে হচ্ছে । আশা করি আমার কথা শুনছ ।
আমি তোমার কথা শুনতে পাচ্ছি ।
ভাল, তাহলে আমার কথা শোন, মিসেস কারেন । আমার মনে হয় তুমি আদর্শবাদ-বন্ধুত্ব ব্যাপারটা ভালোকরে বোঝ নি ।
আমি যথেষ্ট বুঝি ।
না, তুমি বুঝতে পারছ না ।সে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল । এই অল্পবিশ্বাসী ছেলেরা যেভাবে লড়ছে, তেমনি কোনো লড়াইতে তুমি যদি মনপ্রাণ দিয়ে লড়, যখন তোমরা একজন আরেকজনের জন্য জীবন পর্যন্ত প্রশ্নাতীতভাবে দিতে প্রস্তুত, তখন যে বন্ধন গড়ে উঠে, তা তোমাদের জানা সব রকম বন্ধন থেকে শক্তিশালী । এ্টাই হল আদর্শবাদ-বন্ধুত্বআমি নিজের চোখে এটা প্রতিদিন দেখি । আমার প্রজন্মে এর সঙ্গে তুলনা করবার মত কিছু নেই । এইজন্যই এদের, এই ছেলেদের পেছনে দাঁড়াব । সেইজন্যই তুমি বুঝতে পার না, কারণ তুমি অনেক দূরে আছ ।
আমি বললাম, “নিশ্চয়ই আমি দূরে আছি, অনেক দূর, এবং ক্ষীণ । এতৎসত্বেও আমার ভয় করছে যে এই আদর্শবাদ-বন্ধুত্ব আমি ভালই জানি । জার্মানদের এই প্রকারের বন্ধুত্ব ছিল, জাপানিদের ছিল, স্পার্টানদের ও ছিল । আমি নিশ্চিত যে শাকা*র ইম্পিস-এ ও ছিল । আদর্শবাদ-বন্ধুত্ব হল আর কিছু নয়, যাকে তোমরা বন্ধন (কিসের বন্ধন ? প্রেম ? আমার সন্দেহ আছে ।) বলছ, তার মুখোশ পরে মৃত্যুর, হত্যার মন্ত্রগুপ্তি । আমার এই বন্ধুত্বের প্রতি কোনো সহানুভূতি নেই । তোমরা ভুল করছ, তুমি, ফ্লোরেন্স, ও আর সবাই, তোমরা নিজেরা এই ব্যাপারটাতে বুঁদ হয়েছ, আরোও খারাপ ব্যাপার, বাচ্চা ছেলেদের উৎসাহিত করছ । এটা হল আরও একটা বরফশীতল, বিযুক্তকারী, মৃত্যুচালিত, পুরুষ-সৃষ্ট ব্যাপার । এই হল আমার মত
আরো অনেক কথা আমাদের মধ্যে হয়েছিল, তার আর পুনরুক্তি করছি না । আমরা মত বিনিময় করলাম । আমাদের মতপার্থক্য আছে, বোঝা গেল ।
বিকেল কেটে গেল, আমি ওষুধে আচ্ছন্ন হয়ে পিঠের তলায় বালিশ গুঁজে বিছানায় পড়ে রইলাম, ব্যথা কমানোর জন্য এপাশ থেকে ওপাশে কিছু কিছু গোঁজ দিতে থাকলাম, ঘুমের জন্য চেষ্টা করতে থাকলাম, কিন্তু আবার বোরোদিনোর স্বপ্ন যদি আসে সেই ভয়ে ঘুমও আসছিল না ।
আবহাওয়া ভারি হয়ে এল, বৃষ্টি নামল । বুজে যাওয়া জল বেরোনোর পাইপগুলো থেকে টপ টপ করে জল পড়তে থাকল । একতলার সিঁড়ির নিচের কার্পেট থেকে বেড়ালের পেচ্ছাপের গন্ধ আসতে লাগল । একটা কবর যেন, ধনী মানুষের একটা বড় কবর । আমার মাথা  এপাশ ওপাশ করতে থাকল । পাকা, আধোয়া উস্কো খুস্কো চুল বালিশের উপর । ফ্লোরেন্সের ঘরে ক্রমশ: হতে থাকা অন্ধকারে বুকের উপর বোমা অথবা অন্য কিছু হাতে নিয়ে সোজা হয়ে ছেলেটা শুয়ে আছে, তার চোখ খোলা, এখন আর ঝাপসা নয়, পরিষ্কার: চিন্তা করছে, চিন্তা নয়, তার চেয়েও বেশি, মনে মনে ভবিষ্যতের ছবি দেখছে । ছবি দেখছে যে শেষ মুহূর্তে সে হবে মাথা সোজা, শক্তিতে ভরপুর,পরিবর্তিত, গৌরবোজ্জ্ব্ল । যখন আগুনের ফুল ফুটবে, ধোঁয়ার স্তম্ভ উঠবে। তার বুকে রাখা বোমাই তার কবচ: যেভাবে ক্রিস্টোফার কলম্বাস নিজের কেবিনে অন্ধকারে শুতেন বুকের উপরে কম্পাস রেখে, সেই জাদুযন্ত্র, যা তাঁকে আশিসপ্রাপ্তদের দ্বীপপুঞ্জ ইন্ডিজ-এর রাস্তা দেখাবে । বুকখোলা যুবতীদের দল তাঁকে ঘিরে বাহু বাড়িয়ে গান করবে, যখন তাঁর সেই যন্ত্র, যার কাঁটা কখনো ভ্রান্ত হয় না, সব সময় একই দিকে, ভবিষ্যতের দিকে দেখায়, সেই যন্ত্র নিয়ে তিনি জলের মধ্য দিয়ে হেঁটে তাদের দিকে যাবেন ।
বেচারা ছেলেটা! বেচারা ছেলেটা! কোনখান থেকে অশ্রুর প্রস্রবণ উথলে আমার দৃষ্টি ঝাপসা করে দিল । বেচারা জন, পুরোনো দিনে যে হয়তো একটা বাগানের মালি হত, পেছনের দরজায় বসে রুটি ও জ্যাম খেত, টিন থেকে জল পান করত, এখন দক্ষিণ আফ্রিকার সমস্ত মালি ছেলেদের জন্য লড়াই করছে ।



কোন মন্তব্য নেই: