“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০১৬

সুরমা গাঙর পানি - ভাটি পর্ব ২০

কুড়ি 
(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা
এই  উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার  বিংশ অধ্যায় ---সুব্রতা মজুমদার।)    
যে যেখানে যায় যাক বৈতল তার মায়ের জন্মদেশেই থাকবে, বাঁচবে, মরবে । বইয়াখাউরি ছেড়ে কোথাও যাবে না । মা নেই বাপ নেই তো কী হয়েছে, কাকা চাচা মই ভাই বন্ধু গিরিবাবার মতো সাধু মানুষ আছে । একা লুলার জন্য সে সর্বস্ব ছেড়ে দিতে পারে । গুরু সৃষ্টিধর তাকে জৈন্তিয়ার পাহাড় থেকে এক ক্ষীণ জলরেখা দেখিয়ে বলেছেন,
--- তেড়া ভেড়া এইন সৎ মা । আপন মা নায়, যাইও না সুরমা মারে ছাড়িয়া । বৈতল তাই নিজেকে দিনরাতের অবিশ্বাস ভরা হিন্দুমুসলমান সম্পর্কের বাইরে রাখতে চায়লুলাকে বলে,
--- দোস্ত ইতা তকরারো আমরা থাকতাম কেনে চাইন । অউ তরে ছাড়িয়া, পানি ছাড়িয়া, টিল্লা ছাড়িয়া, জঙ্গল ছাড়িয়া কই যাইতাম । আর অখন যেখানো যাইমু, নুতন জাগা চিনতে চিনতে বুড়া ওই যাইমু ।
লুলাও বন্ধুর সঙ্গে সহমত পোষণ করে । কিন্তু বন্ধু সদুপদেশ দেয় । বলে,
--- দোস্ত, যা গিয়া হিন্দুস্থানো । জান বাচাই লা, পরে দেখা অইবনে ।
রাগে দুঃখে, চোখের কোণের শুকনো জল আটকে বন্ধুর মুখে মারে এক আঠারো সিক্কার ঘুষি । বৈতল বলে,
--- গেলে তুই যা বান্দির বাইচ্চা, হালার হালা !
মা বাপ তুলে গালাগালি তাদের সমাজে রাগের কারণ হয় না কখনও । বরং দুঃখিত হওয়ার অভিপ্রকাশ । বন্ধুর সৎবুদ্ধি গ্রহণ করতে পারে না বলে রাগে লুলা । বলে,
--- ভালা কথা তো কানো যার না । পুটকি দিয়া যখন বরুয়া বাঁশ ঢুকাইয়া মারব তখন দেখছি ।
--- ইতা তোর খিত্তার বাঙাল হকলে পারে । বইয়াখাউরিত বাঙাল কম ।
--- অয়, কম । অখন দেখ গি তোর মতো মরার উফরা দুই এক বাড়ি আছে খালি । বাকি সব ভাগছে । আমারেউ কইছে তোরে ভুলাই ভালাই ভিটা দখল করি লিতাম ।
--- , অউ বন্ধু তুই । সব ভুলি গেচছ । দিন নাই রাইত নাই হাকালুকিত পড়ি থাকছি তোর লগে । তুই কইচছ, মজিদো গিয়া নামাজ পড়ছি । গোস্ত খাইছি ।
--- অই বেটা, আমি গেছি নানি । ঢাকাদক্ষিণ গেছি, বাসুদেব বাড়ি গেছি, পনা মন্দিরো গেছি । বাপরগুতে ইতা নিরামিশা খাইছি না । বিষর লাখান কচু শাক । তেও খাইছি, তোর মহাপ্রভুয়ে নু ভালা পাইন ।
--- খাইচছ খাইচছ, অখন বিষ ঝাড়বে । ঝাড়, আমার লাগে না কুন্তা । তুই থাক বাড়ি লইয়া ।
--- তোর তো বেটিও লাগে । ইন্ডিয়াত গিয়া পাইবে খুমখুমা পুড়ি ।
--- ইন্ডিয়াত কেনে যাইতাম । হিন্দু না পাইলে বাঙাল বিয়া করি বাঙাল অই যাইমু । তেও তুই বাঙাল অইছ না ।
--- কেনে ।
--- বাঙাল অইলে তুইন গরু খাওয়ার যম অইবে ।
  নতুন দেশের দুই নবীন নাগরিক ধর্মের বিভাজন ঝেড়ে একসঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নেয় । দুই অনাথ যুবকের একজন দেশি অন্যজন খিত্তা গাওএর পরদেশি । তবু, দুই সহচরের সিদ্ধান্তের জেরে তো আর দেশ চলে না, সহাবস্থান হয় না । আজব সময় কোনও নিয়ম মেনে চলে না । হিসেব নেই, আইন নেই, মূল্যবোধ নেই, মান্যমানতা নেই । দেশভাগের ফলে কেউ হারল, গণভোটে ঘরবাড়ির শান্তির প্রতীক হেরে গেল মনে করে একপক্ষ, অন্য পক্ষ মনে করে কুড়াল তো কুড়ালের কাজই করবে । হারল যারা, তাদের এবার তাড়াতে হবে । কিন্তু বাঙালির এক পক্ষ অতিথিকে দেবতা ভাবে, অন্যপক্ষও মেহমানের সেবা করে । প্রতিবেশীকে নিয়ে সুখে থাকতে চায় ধর্মভীরু দুপক্ষের ধর্মই বলে প্রতিবেশীর সঙ্গে বন্ধুত্ব কথা । কিন্তু লোভের কাছে ধর্মকর্ম কিছু নয়, লুঠতরাজে কোন ধর্মমানুষ থাকে না, অমানুষ হয়ে ওঠে । এখন তাই দখলের রাজনীতি । এখন শুধু বিদ্বেষ । হিন্দুর পূজা পার্বণে মুসলমানরা দূরে থাকে, কিন্তু জড়িয়ে থাকে । এখন উদ্ধত ছোঁয়াছুঁয়ি মানে না । মজা করে ছড়া কাটার কথা কেউ ভাবে না এখন । এমন সুন্দর কবির কথা হয়তো হারিয়ে যাবে ধীরে ধীরে । বৈতলকে যা শিখিয়েছেন গুরু সৃষ্টিধর । বলেছেন,
--- শিখিলে দেখবায় নে কী মজা কথার মাঝে,
ও বাজান দুগ্‌গি দেখলায় নানি ?
হিন্দু হকলর দুর্গাপূজা
বেলপাতা বোঝা বোঝা
চন্নামিত্তি খাইয়া দেখলাম,
সুরমা গাঙর পানি ।
শুনে শুনে লুলা বলেছে,
--- ইতা হিন্দু হকলে বানাইছে, আমরার নাম দিছে ।
 শরৎ-এর উৎসব নিয়ে বৈতলের মনেও দ্বিধা । পূজা শব্দ দিয়ে কেন যে প্রকৃতিকে বেঁধে রাখা । ঢাকের বাদ্যি কেন শুধু হিন্দুদেরই হয় । কাশফুল তো পুজোয় লাগে না, তবে কেন শরৎ -এর একটা উৎসব হয় না ধর্মছাড়া । লৌকিক উৎসব শুধু, কাশ উৎসব, সবাই শুধু আনন্দ করবে । ধর্ম হবে না, ধূপ হবে না ধুনো হবে না এমন কী যদি কখনও শরতেই ইদ উৎসব ঘুরে ফিরে আসে, আসুক । বাঙালির শরৎ উৎসব চলতেই থাকুক । বৈতল বোঝে শরৎ এলেই বৈতল কেমন একলা আলাদা হয়ে যায় । বৈতলের সঙ্গে মেলাতে পারে না । শরৎ এলে সে ঢাকের বাদ্যির জন্য অপেক্ষা করে । শব্দের উৎস কোথায় জানে না বৈতলধ্বনি দিয়ে যে শব্দ তৈরি হয় সে কি কোনো ভাষার, কোন ধর্মের । অতশত না জানলেও তো চলে । বৈতল জানে তিন শব্দে শরৎ আসে বইয়াখাউরিতে, শিউলি ফোটে । বিলে শালুক ফোটে, পদ্ম চোখ মেলে । উৎসবের অগ্রদূত হয়ে আসে বাদ্যি, ঢ্যাম কুড়াকুড় । সবাই পছন্দ করে । পবিত্রভূমি পাকিস্থান হওয়ার পর প্রথম পুজোয় কোন জৌলুষ নেই এবার । ঢাকের বাদ্যিও কেমন শহুরে বাবুর মতো ভদ্রলোকহুড়মুড়িয়ে সবাইকে ডাকে না উৎসবে যোগ দিতে । বৈতল জানত না উৎসবের এই তিন শব্দও মানুষ অপচ্ছন্দ করে । এরশাদ, মকবুলরা এসে বলে যায়,
--- ইতা বাজনা উজনা একটু আস্তে বাজাইছ বা ।
লুলা প্রতিবাদ করে । বলে,
--- কেনে, আস্তে কেনে আক্‌তা । বাঙাল হকল জিনি গেছইন, নানি ।
 লুলা দ্বিধান্বিত হলেও জানে কাশের বনে দোল জাগিয়ে আসে ঋতুর রাজা শরৎ । আর ঢ্যাম কুড়াকুড় ধবনিও প্রকৃতির সাজ বদলের অঙ্গ । কিছু ধর্মব্যবসায়ী আর নেতৃত্বলোভী মানুষকীটের দংশন ক্ষতে ছারে খারে যেতে বসেছে তার নকশিকাঁথা । তার ঐতিহ্যের স্বদেশ । ভোরের আজানের শব্দ তো বৈতলের কানে তালা লাগায় না । যেখানে ঢাকের কাঠি অসহায় নয়, অসহায় নয় সেখানে মোয়জ্জিনের কণ্ঠস্বরও । সময় মানুষকে বদলে দেয় প্রতিনিয়ত । কত রকম যে সময়ের খেলা, ছোট বড় মাঝারি । বৈতলের কাছে সময়ও দেখার হাওর, বড় হাওরের মাছের মতো । জগৎবেড় পড়ার পর মাছের লাফালাফি শুরু হয় হাওর জুড়ে । নৌকোর খোলে কেউ নিস্তেজ । ব্যাপারির হাতে আবার লাফালাফি । ভাগার মধ্যেও লাফায়, এই ভাগা থেকে ওই ভাগায় । কড়াই থেকে পাতে গিয়েও কি শেষ হয় । সময় শেষ হয় না । সময়ের স্মৃতি, সময়ে ক্ষত থাকেই । বৈতলের বাপ খলুই- এ আলদের বাচ্চা ঢুকিয়ে দেয় । বৈতল তুলে ফেলে দেয় । লুলা পারে নি, নতুন সময়ে এসে বৈতলও পারে নি । অভিমানী মানুষ কখন যে কী করে কেউ জানে না । অভিমান মানুষকে দুর্বল করে, সহনশীল করে, সব মেনে নিতে শেখায় । আবার অভিমান দুর্বিনীত করে, হিতাহিতজ্ঞান শূন্য করে । সময় নতুন সমাজের জন্ম দিচ্ছে দেখে লুলা দুঃখিত হয় বলে বাঙাল হকল জিনি গেছইনএকার প্রতিবাদী কণ্ঠ কি তবে লুলার একা লাগে সঙ্গীহীন । সেই লুলাও শেষ পর্যন্ত পরিবর্তন পন্থায় নাম লেখায় । সেই লুলাকেই সময় শেখায় ঝাঁকে থাকার তত্ত্ব । নতুন সমাজ সংস্কারের পন্থা । মানুষ একা থাকতে পারে না, প্রতিবাদী হয়ে সুখী হওয়া যায় না জেনে যায় লুলা । যে লুলাকে বৈতল চরিত্রবান জেনে এসেছে কৈশোর কাল থেকে, সভয় নারীসঙ্গ পরিহার করতে দেখেছে, সেই লুলাও পাল্টে ফেলে নিজেকে । সেই লুলা যে বৈতলের মনোব্যথা শুনে ব্যথিত হয়, কোন আদিকালের এক দুঃখ বয়ে বেড়ানোর জন্য । দাড়িয়াপাড়ার গৌরাঙ্গী কন্যার কান ছিঁড়ে পলায়নের জন্য দায়ী করে । বলে,
--- তুই গুনাগার অই গেলে দোস্ত !
বলে,
--- পুড়ির গাত হাত দিলে কেনে । তোর ধর্মতও তো বেটা ইতা পাপ !
লুলার রায় শুনে গর্বিত বন্ধু বৈতলও বলে,
--- মুসলমান না অইলে তো বেটা তুই বরমচারী অই গেলে নে । হনুমানর লাখান ধুপধাপ করলে নে । সব লাগে বেটা দুনিয়াত । খালি বেটা দিয়া কিচ্ছু হয় না, বেটিও লাগে ।

চলবে

 < ভাটি পর্ব ১৯ পড়ুন                                                    ভাটি পর্ব ২১ পড়ুন >

কোন মন্তব্য নেই: