(দক্ষিণ আফ্রিকীয় লেখক জে এম কোয়েটজি-র লেখা 'এজ অব আয়রন'- উপন্যাসের বাংলা অনুবাদের ৪র্থ অধ্যায়ের ১ম ভাগ: -- শিবানী দে)
(C)Imageঃছবি |
আমি ফ্লোরেন্সকে
স্বপ্নে দেখলাম, স্বপ্ন অথবা মানসিক দর্শন । স্বপ্নে
দেখলাম সে গভর্নমেন্ট এভিন্যু দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, হোপকে হাতে ধরে
এবং বিউটিকে পিঠে বেঁধে । তিনজনই মুখোশ পরা । আমিও ওখানে আছি । নানাধরনের ও নানা
অবস্থার লোকের ভিড় আমার চার পাশে । আবহাওয়া যেন উৎসবের, আমিও কিছু একটা
শো করব ।
কিন্তু ফ্লোরেন্স
দেখবার জন্য দাঁড়ায় না । সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে চলে যেন সে একদল প্রেতের মধ্য
দিয়ে যাচ্ছে ।
তার মুখোশের
চোখদুটো পুরোনো ভূমধ্যসাগরীয় ছবির চোখের মত : বড়, ডিম্বাকৃতি, চোখের মণিদুটো
ঠিক মাঝখানে : অ্যামন্ডের আকারের দেবীচক্ষু ।
আমি পার্লামেন্ট
ভবনের সামনে এভিন্যু স্ট্রিটের মাঝখানে দাঁড়াই, আমার চারদিকে
লোকজন, আমি আগুনের খেলা খেলছি । আমার উপরে
বিশাল বিশাল ওকগাছ ঝুঁকে আছে । কিন্তু মন খেলা দেখানোতে নেই । আমার মন ফ্লোরেন্সের
দিকে । তার ঘোর রঙের কোট, হালকা অনুজ্জ্বল রঙের পোশাক খসে পড়ে
গেছে । গায়ে শুধু একটা সাদা স্লিপ হাওয়াতে বিপর্যস্ত, তার খালি পা, মাথাও খালি, তার ডান স্তন
অনাবৃত, সে হেঁটে যাচ্ছে, একটা বাচ্চা
মুখোশ পরা, উলঙ্গ, তার পাশে
তাড়াতাড়ি হাঁটছে, অন্য বাচ্চাটি তার কাঁধের উপর দিয়ে এক
হাত বাড়িয়ে কিছু একটা দেখাচ্ছে ।
এই দেবী, যিনি অনাবৃত
স্তনে বাতাস কেটে দর্শন দেন, তিনি কে ? ইনি আফ্রোদিতি*, কিন্তু ইনি
হাস্যপ্রিয়, প্রমোদের অধিষ্ঠাত্রী নন । ইনি আরো
বয়স্ক, যিনি দরকারের, অন্ধকারে ছোট অথচ
তীব্র চীৎকারের, রক্ত ও ভূমির মূর্তিমতী শরীর, যাবার পথে
মুহূর্তের জন্য আবির্ভূত হয়েছেন ।
দেবীর থেকে কোনো
ডাক, কোনো ইঙ্গিত এল না । তাঁর চোখ খোলা এবং
দৃষ্টি শূন্য । তিনি দেখেন এবং দেখেন না ।
আমার খেলা দেখাতে
দেখাতে আমি স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে জ্বলছি । আমার থেকে যে শিখা বেরোচ্ছে, তা বরফের মত নীল
। আমার কোনো ব্যথা হচ্ছে না ।
এই দর্শনটা
গতরাতের স্বপ্নের সময়ের, কিন্তু তার বাইরের সময়েরও । সব সময়েই
দেবী যাচ্ছেন, সব সময়েই ভঙ্গিটি আশ্চর্যান্বিতের, এবং পশ্চাত্তাপের, আমি ঠিক বুঝতে
পারিনা । আমি উঁকি মেরে দেখতে থাকি, দেখতে থাকি সেই
ঘূর্ণির মধ্যখানে যেখান থেকে দর্শন আসে, দেবী ও তাঁর
দেবশিশুদের বোধনস্থল শূন্যই থাকে, কারণ যে নারী
তাদের পেছনে যাবে সে সেখানে নেই । সেই নারীর চুলে অগ্নিশিখার সাপ জড়ানো, সে তার বাহুতে
হাত দিয়ে আঘাত করে, চীৎকার করে এবং নাচে ।
আমি ভারকুয়েইলকে
স্বপ্নটা বলি ।
“এটা কি সত্যি ?”
সে জিগ্যেস করল।
“সত্যি ? অবশ্যই না । এটা
মোটেই আসল নয় । ফ্লোরেন্সের সঙ্গে গ্রিসের কোনো সম্পর্ক নেই । স্বপ্নের অবয়বদের
অন্য অর্থ আছে । তারা অন্য কিছুর প্রতীক ।”
“ওরা কি সত্যি ছিল
? সে কি সত্যি ছিল ?” সে আবার বলল, প্রসঙ্গান্তরে
যেতে চাইল না । “আর কি দেখেছ ?”
“আর কি ? আরো কিছু আছে ? তুমি কি জান ?”
আমি তার পেছন পেছন আমার রাস্তা অনুভব করে বললাম ।
সে হতবুদ্ধির মত
ঘাড় নাড়ল ।
“এই এতদিনে যে
তুমি আমাকে জেনেছ,” আমি বললাম । “আমি আমার পালার
জন্য নদীতীরে অপেক্ষা করছিলাম । আমি অপেক্ষা করছিলাম কেউ আমায় ওপারে যাবার রাস্তা
দেখাবে । প্রতিটি দিনের প্রতিটি মিনিট আমি এখানে অপেক্ষা করছি । এই দর্শনটাও আমার
মনে আসে । তুমিও কি এটা দেখ ?”
সে কিছু বলল না ।
“যে কারণে আমি
হাসপাতালে ফিরে যাবার বিরুদ্ধে ছিলাম, তা হল যে তারা
আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখবে। এই কাজটা ওরা জানোয়ারের ক্ষেত্রেও দয়ার নিদর্শন হিসেবে
ব্যবহার করে, কিন্তু এটা মানুষের ক্ষেত্রেও ব্যবহার
করা যেতে পারে । ওরা আমাকে যে ঘুম পাড়াবে, তাতে স্বপ্ন
থাকবে না ।
তারা আমাকে ম্যান্ড্রাগোরা* খাওয়াবে যতক্ষণ না আমি নদীতে পড়ে যাই, ডুবে যাই, এবং জলবাহিত হয়ে
চলে যাই । তাহলে তো আমি ওপারে যেতে পারব না । এটা আমি হতে দিতে পারি না । এখন অনেক
দূর এসে গেছি, আমি আমার চোখ বন্ধ করতে পারি না ।”
“তুমি কি দেখতে
চাও ?” ভারকুয়েইল জিগ্যেস করল ।
“আমি তোমার আসল
রূপ দেখতে চাই ।”
সে দুর্বলভাবে
কাঁধ ঝাঁকিয়ে জিগ্যেস করল, “আমি কে ?”
“একজন মানুষ ।
একজন মানুষ যে নিমন্ত্রণ ছাড়াই এসেছিল । এর বেশি কিছু এখন বলতে পারব না । তুমি
পারবে ?”
সে মাথা নাড়ল । “না ।”
“তুমি যদি আমার
জন্য কিছু করতে চাও,” আমি বললাম,
“তাহলে রেডিওর এরিয়েলটা লাগিয়ে দাও ।”
“তার বদলে
টেলিভিশনটাই উপরের ঘরে নিয়ে যেতে বলতে পার ।”
“আমার টেলিভিশন
দেখবার ও দৃশ্যাবলী হজম করবার ক্ষমতা নেই । ওটা আমাকে উলটে আরো অসুস্থ করে দেবে ।”
“টেলিভিশন তোমাকে
অসুস্থ করতে পারে না । ও তো শুধু ছবি ।”
“শুধু ছবি বলে
কিছু হয় না । ছবির পেছনে মানুষের হাত আছে । তারা নিজেদের যে সব ছবি পাঠায় তাতে লোক
অসুস্থ হয়ে যায় । তুমি জান আমি কি বিষয়ে কথা বলছি ।”
“ছবি তোমাকে
অসুস্থ করতে পারে না ।”
মাঝে মাঝে সে
এইরকম করে : আমার কথার বিরোধিতা করে, আমাকে উস্কে দেয়, বিদ্রূপ করে, আমার বিরক্তির
চিহ্ন ফুটে উঠেছে কিনা দেখে । এটা হল তার খ্যাপানোর তরিকা, এত বোকাবোকা, এত অনাকর্ষণীয় যে
আমার হৃদয় তার দিকেই যায় ।
“এরিয়েলটা লাগিয়ে
দাও, এটাই শুধু আমি চাই ।”
সে নিচের ঘরে গেল
। কয়েক মিনিট পরে টেলিভিশনের সেটটাকে দুহাতে ধরে সে থপথপ করে চলে এল । বিছানার
মুখোমুখি করে সে সেটাকে রাখল, প্লাগ লাগাল, এরিয়েল নিয়ে এদিক
ওদিক করল, পাশে দাঁড়াল । সময়টা ছিল মাঝবিকেল । নীল
আকাশে পতাকা উড়ছিল । কাঁসার বাদ্যযন্ত্র বাজানো শিল্পীদল জাতীয়সঙ্গীত গাইছিল ।
“বন্ধ কর ।” আমি বললাম ।
সে সাউন্ড আরো
বাড়িয়ে দিল ।
আমি চিৎকার করে
বললাম, “বন্ধ কর ওটা ।”
সে আমার ক্রুদ্ধ
দৃষ্টির সামনে ঘুরতে থাকল । তারপর কি আশ্চর্য, শাফ্ল* নাচতে
আরম্ভ করল । পাছা দুলিয়ে, হাত বাড়িয়ে, আঙ্গুলগুলো দিয়ে
তুড়ি মেরে, নির্ভুল নাচতে থাকল সেই গানের সঙ্গে যার
সঙ্গে কখনো নাচা যেতে পারে বলে আমি ভাবিনি । সে কিছু গানের শব্দ ও বলছিল । কি
সেগুলো ? আমার নিশ্চিত করে জানা নেই ।
“বন্ধ কর,”
আমি আবার চেঁচিয়ে বললাম ।
একটা বুড়ি, দাঁত নেই, রাগে জ্বলছে ।
আমাকে নিশ্চয়ই দর্শনীয় লাগছিল । সে শব্দটা কমাল ।
“বন্ধ কর একদম ।”
সে সুইচ টিপে
বন্ধ করল । “এত উত্তেজিত হয়োনা ,” সে মৃদুস্বরে বলল
।
“তাহলে বোকাবোকা
কাজ করো না ভারকুয়েইল । আর আমাকে নিয়ে মজা কোরো না ।”
“তবুও, এত রাগবার কারণ
কি ?”
“কারণ আমার ভয়
লাগছে যে আমি নরকে যাব এবং শাশ্বত কাল ধরে এই ‘দি স্টেম’ জাতীয়সঙ্গীতটি
শুনতে থাকব ।”
সে মাথা নাড়ল । “চিন্তা করো না,”
সে বলল, “এটা শেষ হতে চলেছে । ধৈর্য ধরো ।”
“আমার ধৈর্য ধরার
সময় নেই । তোমার হয়তো আছে, কিন্তু আমার সময় নেই ।”
সে আবার মাথা
নাড়ল ।“হয়তো তোমারও সময় আছে,” সে ফিসফিস করে
বলল, আর দাঁত দেখিয়ে বদমায়েশি হাসি হাসল ।
এক মুহূর্তে যেন
স্বর্গ খুলে গেল এবং আলোর ধারা নিচে পড়ল ।সারাটা জীবন ধরে খারাপ খারাপ খবরের পর
ভাল সংবাদের জন্য বুভুক্ষু আমি না হেসে পারলাম না । “সত্যি ?”
আমি বললাম । সে মাথা নাড়াল । দুটো বোকার মত আমরা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে দেঁতো
হাসি হাসতে থাকলাম । সে অর্থপূর্ণভাবে তার আঙ্গুল দিয়ে তুড়ি মারল; পালক ও
হাড়সর্বস্ব গ্যানেট পাখির মত সে তার নাচের তাল আবার ঠুকতে লাগল । তারপর সে বেরিয়ে
গেল, সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে ছেড়া তার জুড়ে দিল, আমার রেডিও চালু
হল ।
কিন্তু রেডিওতেই
বা কি শোনার ছিল ? আজকাল বেতার তরঙ্গ প্রতিটি জাতির
ব্যবসায়িক বিজ্ঞাপনে এত ভরে গেছে যে গানের জায়গাটা সঙ্কুচিত হয়ে গেছে । আমি ‘অ্যান আমেরিকান
ইন প্যারিস’ নাটকটা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম, জাগলাম মোর্স
কোডের একটানা টকাটক শব্দে । কোত্থেকে আসছে শব্দটা ? সাগরে কোনো
জাহাজ থেকে ? কোনো পুরোনো ধরণের বাষ্পীয় জাহাজ, ওয়ালভিস বে এবং
অ্যাসেন্শন দ্বীপের মাঝখানের ঢেঊয়ে চলছে ? কোনো তাড়াহুড়ো
ছাড়া, কোনো বিচ্যুতি ছাড়া, ডট্ এবং ড্যাশ
যেন এক ধারার মত চলছে, যেন প্রতিজ্ঞা করেছে যেন গরুর ঘরে ফেরা
সময় অবধি চলতেই থাকবে । ওদের কি কোনো খবর দেবার আছে ? কোনো প্রয়োজন আছে
? ওদের প্যাটার্ন বৃষ্টির মতন, তাৎপর্যের
বৃষ্টির মতন আমাকে সান্ত্বনা দিল, আমার রাত্রি
সহনীয় করে তুলল, আর আমি পরবর্তী পিল খাবার আগের
ঘণ্টাগুলো গড়িয়ে যাবার অপেক্ষা করে শুয়ে রইলাম ।
আমি বলি যে আমি
ঘুমিয়ে পড়তে চাই না । বাস্তবে, ঘুম ছাড়া আমি
সহ্য করতে পারিনা ।
আর যাই আসুক না কেন, ডিকোনেল অন্তত: ঘুম বা ঘুমের মত কিছু
একটা নিয়ে আসে । ব্যথা যত কমতে থাকে, সময় তাড়াতাড়ি
পালায়, দিগন্ত যেন উঠে আসে, আমার মনোযোগ যা
শুধুমাত্র ব্যথার উপরে একটা পোড়া কাচের মত নিবদ্ধ ছিল, তাতে একটু ঢিলে
দেয় ; আমি শ্বাস নিরে পারি, আমার মুষ্টিবদ্ধ
হাত খুলি, পাগুলোকে সোজা করি । এই করুণার জন্য
কৃতজ্ঞতা বোধ করি, নিজেকে বলি, এই ধন্য বাদ এই
পীড়িত শরীরকে সোজা করার জন্য, তন্দ্রাচ্ছন্ন
আত্মার জন্য, যে আত্মা তার খোলস আদ্ধেক ছাড়িয়েছে, ভাসতে আরম্ভ করেছে
।
কিন্তু এই মুক্তি
বেশিক্ষণের জন্য নয় । মেঘ জমে যায় । চিন্তা জট পাকিয়ে যায়, ঠিক যেন ঘন হয়ে
উড়তে থাকা একদল রাগী মাছি । আমি মাথা নাড়াই, তাদের তাড়িয়ে
দিতে চাই, চোখ বড়বড় করে খুলে হাতের পেছন দিকে
শিরার দিকে তাকিয়ে বলি, এটা আমার হাত; এটা বিছানার চাদর
। তারপরই বিদ্যুতের মত কিছু একটা আঘাত করে । একমুহূর্তে আমি চলে যাই এবং অন্যএক
মুহূর্তে ফিরে আসি, হাতের দিকে তখনো তাকিয়েই আছি । এই দুই মুহূর্তের মধ্যে
হয়তো একঘণ্টাও পেরিয়ে যেতে পারে, অথবা চোখের পলকের
মত সামান্য সময়ও, যে সময়টায় আমি অনুপস্থিত, গত, সে সময়ে আমি
যুঝতে থাকি কিছু একটা রবারের মত মোটা জিনিষের সাথে যা আমার মুখকে আক্রমণ করে এবং জিহ্বার
মূল আঁকড়ে ধরে, যা সাগরের অতল থেকে উঠে আসে । আমি কোনোরকমে
সাঁতারুর মত মাথা নাড়াতে নাড়াতে ভেসে উঠি । আমার গলায় পিত্তের মত, গন্ধকের মত স্বাদ
আটকে থাকে । পাগলামি ! আমি নিজেকে বলি, এটাই হল পাগলামির
স্বাদ ।
একদিন আমি জ্ঞান
ফিরে আসার পর দেওয়ালের মুখোমুখি ছিলাম । আমার হাতে একটা ভাঙ্গা পেন্সিল ছিল।
দেওয়ালের সর্বত্র ছড়ানো বাঁকানো আঁকিবুঁকি, অর্থহীন, আমার অন্তর থেকে, অথবা আমার ভেতরের
অন্য কারো থেকে ।
আমি ডাঃ
সাইফ্রেটকে ফোন করলাম । ডিকোনেলের প্রতিক্রিয়াতে বোধ হয় দিনদিন খারাপ হচ্ছে । আমি
কথাটা ব্যাখ্যা করে বোঝানোর চেষ্টা করলাম । “আমি ভাবছি, আর কোনো বিকল্প
ওষুধ দেওয়া যাবে না ?”
“আমি জানতাম না
আপনি এখনো নিজেকে আমার চিকিৎসাধীন ভাবেন,” ডাঃ সাইফ্রেট
বললেন, “আপনার তো ঠিকঠাক দেখাশোনার জন্য হাসপাতালে
থাকা উচিত । টেলিফোনে তো আমি সার্জারি করতে পারি না ।”
“আমি খুবই কম
চাইছি,” আমি বললাম ।“ডিকোনেল খেয়ে
আমার হ্যালুসিনেশন* হচ্ছে ।”
“আর আমি বলছি, আমি আপনাকে না
দেখে চিকিৎসা করতে পারি না । আমি এভাবে কাজ করি না , আমার সহকর্মীরাও
এভাবে কাজ করে না ।”
আমি ততক্ষণই চুপ
ছিলাম যতক্ষণ পর্যন্ত না উনি ভেবে বসেছেন আমার লাইন কেটে গেছে । সত্যিটা হল, আমি বলতে
চাইছিলাম: আমি দ্বিধায় ছিলাম, তুমি বুঝতে পার
না ? আমি ক্লান্ত, মরবার আগে অবধি
ক্লান্ত । আমাকে তোমার হাতে নাও, আমাকে একটু দেখ, যদি তা না পার, তাহলে তার পরের
যা সবচেয়ে ভাল হবে, তা-ই করো ।
“আমি আরেকটা শেষ
প্রশ্ন জিগ্যেস করছি,” আমি বললাম,
“আমার যা ওষুধের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, অন্য লোকেরও কি
সেরকম হয় ?”
“রোগীদের ভিন্ন
ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া হয় । হ্যাঁ, এটা হতে পারে যে
আপনার প্রতিক্রিয়া ডিকোনেল থেকে হয়েছে ।”
“তাহলে যদি আপনি কোনোভাবে
মন পরিবর্তন করেন,” আমি বললাম,
“মিল স্ট্রিটের অ্যাভালন ফার্মাসিতে একটা নতুন প্রেসক্রিপশন দেবার জন্য একটা
টেলিফোন করতে পারেন ? আমার অবস্থা সম্পর্কে আমার কোনো মোহ নেই, ডাক্তারবাবু ।
আমি যত্ন চাই না, শুধু ব্যথা কমার ব্যাপারে একটু সহায়তা
চাই ।”
“আর আপনি যদি
আপনার মন পরিবর্তন করে থাকেন, আমার সঙ্গে দেখা
করতে চান, দিনে অথবা রাতে, আপনি শুধু ফোন
করলেই পারেন, মিসেস কারেন ।”
একঘণ্টা পর দরজার
বেল বাজল । ফার্মাসির ডেলিভারির লোকটা চোদ্দদিনের ওষুধের নতুন প্রেসক্রিপশন নিয়ে
হাজির হল ।
আমি
ফার্মাসিস্টকে ফোন করলাম, “টাইলক্স, এটাই কি সবচেয়ে
শক্তিশালী ওষুধ ?”
“আপনি কি বলতে চান
?”
“বলতে চাইছি, এই ওষুধটাই কি
শেষ বারের জন্য বলে দেওয়া হয়েছে ?”
“মিসেস কারেন, এরকম করে তো ওষুধ
কাজ করে না । এর কোনো প্রথম বা শেষ নেই ।”
আমি নতুন পিলদুটো
খেলাম । আবার ম্যাজিকের মত ব্যথা কমে গেল, আনন্দ, জীবনে ফেরার
অনুভূতি । চান করলাম, আবার বিছানাতে গেলাম, পড়বার চেষ্টা
করলাম, আচ্ছন্নের মত ঘুম এল । একঘণ্টার পর আবার
জেগে গেলাম । ব্যথাটা আবার উঠছে, বমি বমি ভাব
সঙ্গে আছে, আর মন খারাপের ছায়া ।
ব্যথার ওষুধ:
একটা আলোর রশ্মি, কিন্তু তার পরেই দ্বিগুণ অন্ধকার ।
ভারকুয়েইল ভেতরে
এল ।
“নতুন পিল খেলাম,”
আমি বললাম, “কোনো উন্নতি নেই । ওষুধটা বোধ হয় অল্প বেশি শক্তিশালী, এইটুকুই যা ।”
“আরো খাও,”
ভারকুয়েইল বলল, “তাহলে তোমাকে আর চারঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে না ।”
মাতালের উপদেশ ।
“আমি নিশ্চিত যে
আমি তা-ই করব,” আমি বললাম,
“কিন্তু যদি আমাকে সেগুলো যখন ইচ্ছে তখনই খেতে হয়, তাহলে সবগুলো
একেবারে নয় কেন ?”
দুজনের মধ্যে
নিস্তব্ধতা ।
আমি জিগ্যেস
করলাম, “তুমি আমাকেই বাছলে কেন ?”
“আমি তোমাকে
বাছিনি ।”
“এখানে কেন এলে, এই বাড়িতে ?”
“তোমার কোনো কুকুর
নেই ।”
“আর কি কারণে ?”
“আমি ভেবেছিলাম তুমি
ঝামেলা করবে না ।”
“আর আমি কি ঝামেলা
করেছি ?”
সে আমার দিকে এল
। তার মুখ ফোলাফোলা, আমি তার শ্বাসে মদের গন্ধ পাচ্ছিলাম । “তুমি যদি চাও, আমি তোমাকে
সাহায্য করব, আমি করতে পারি,”
সে বলল । সে আমার উপর ঝুঁকে আমার গলা ধরল, তার বুড়ো আঙ্গুল আমার
স্বরযন্ত্রের উপর, তিনটে খারাপ আঙ্গুল আমার কানের নিচে । “করো না”,
আমি ফিস্ফিসিয়ে বললাম । তার হাতটা ঠেলে দিলাম । আমার চোখ জলে ভরে গেল । আমি
তার হাত আমার হাতে নিয়ে আমার বুকে আঘাত করতে থাকলাম বিলাপ করার ভঙ্গিতে, যা আমার নিজের
কাছেও অভাবিত ।
কিছুক্ষণ পর আমি
শান্ত হলাম । সে আমার উপর ঝুঁকে থাকল, তার হাত আমাকে
ব্যবহার করতে দিল । কুকুরটা তার নাক বিছানার কিনারায় রেখে আমাদের শুঁকতে লাগল ।
“তুমি কি
কুকুরটাকে আমার সঙ্গে শুতে দেবে ?” আমি বললাম ।
“কেন ?”
“উষ্ণতা পাবার
জন্য ।”
“ও থাকবে না । ও
আমি যেখানে শুই, সেখানেই শোয় ।”
“তাহলে তুমিও
এখানে শোও ।”
সে নিচের ঘরে গেল, আমি অনেকক্ষণ
অপেক্ষা করতে থাকলাম । আমি আরেকটা পিল খেলাম । সিঁড়ির নিচে আলো নিবল । আমি তার
জুতো খোলার শব্দ পেলাম । “টুপিটাও খুলে ফেল, একটু পরিবর্তন
হবে ,” আমি বললাম ।
সে আমার পেছনে
শুল, বিছানাঢাকা চাদর না সরিয়েই । তার নোংরা পায়ের
গন্ধ নাকে লাগল । সে ধীরে ধীরে শিস দিতে থাকল । কুকুরটা লাফিয়ে উপরে উঠল, ঘুরে ঘুরে নাচল, তারপর তারও আমার
পায়ের মাঝখানে শুয়ে পড়ল । ট্রিস্টানের* তলোয়ারের মত, আমাদের সৎ রাখতে
।
পিল আশ্চর্য কাজ
করছিল । আধঘণ্টা ধরে সে ও কুকুরটা যখন ঘুমোচ্ছল, আমি ব্যথামুক্ত, মনটা সতর্ক, স্পষ্ট, চুপচাপ শুয়ে
থাকলাম । একটা দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল----বাচ্চা মেয়ে বিউটি তার মায়ের
পিঠে চড়ে মাথাটা দোলাতে দোলাতে, সামনের দিকে বড়
বড় চোখে তাকিয়ে আমার দিকে আসছে । তারপর দৃশ্যটা মিলিয়ে গেল । ধুলোর মেঘ, বোরোদিনোর ধুলো, মৃত্যুর শকটের
চাকার মত ঘুরে ঘুরে আমার দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে ফেলল ।
আমি আলো
জ্বালালাম । তখন মধ্যরাত্রি ।
শিগ্গিরই আমি
নিজের উপর ঘোমটা টানব । এটা কোনো শরীরের গল্প হবে না, কিন্তু তার মধ্যে
যে আত্মা থাকে তার । আমি তোমাকে সেই দৃশ্য দেখাব না যা তুমি সহ্য করতে পারবে
না-----আগুন লাগা বাড়িতে এক নারী জানালা থেকে জানালায়, গরাদের মধ্য দিয়ে
সহায়তার জন্য ডাকছে ।
ভারকুয়েইল ও তার
কুকুর এই দুঃখের স্রোতের পাশে শান্তভাবে ঘুমোচ্ছে । তাদের দায়িত্ব
পরিপূরণ করে, আত্মার উড়ানের জন্য অপেক্ষা করে । আত্মা, আরম্ভকারী, আর্দ্র, অন্ধ, অজ্ঞান ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন