(দেশভাগ
এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস
ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার
প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে
ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই
উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই
উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার সপ্তদশ অধ্যায় ---সুব্রতা মজুমদার।)
সতেরো
মা গেল বেঘোরে,
বাপও গেল । অনাথ বৈতলের পিছুটান আর কিছুই রইল না বইয়াখাউরি গ্রামে । অস্থির সময়
বৈতলকেও আরো দুরন্ত করে তোলে । বন্ধু লুলাকে প্রাণপণে কাছে পেতে চায় ।
গ্রাসাচ্ছাদন আর জীবিকা পরিবর্তনের লড়াইএ লুলাকেও খুঁজে পায় না বৈতল । বেজগিরিতে
অবিশ্বাস ছাড়া কিছু নেই বলেছে বৈতলকে । এর থেকে এই কবিগানে সম্মান বেশি । গ্রাম
সিলেটের মানুষের কাছে এখন আর সে লুলা বেজ নয় । জড়িবুটি রং করে বুজরুকির কারবার সে
আর করে না । তার কবিগান শুনে গ্রামের মানুষ, হাটুরে মানুষ থমকে দাঁড়ায় হাসে কাঁদে
এক আনা দিয়ে কিনে নিয়ে যায় চার পাতার বই । তার নামও পাল্টে নিয়েছে, এখন সে
দিলবাহার বাঙাল । অবাক বৈতল বলে,
--- ইতা কিতা বে । তুই তো রুল আমিন শেখ । আক্তা ই দিলবাহার
বাঙাল অই গেলে কেমনে ।
--- অই গেলাম আরি । জানছ নানি গপ, সবর অউ চিৎ অইয়া ঘুমানির
শখ হয় । আমিও জাতো উঠছি । গত বছর আমি বেজ আছলাম, ইবার আমি শেখ, আগামী বছর আমি সৈয়দ
অইমু । আমি বাঙাল অই গেছি । ইতা কুতুবর কাম । কইল কবির নাম সুন্দর সান্দর না অইলে
মা’নে পড়তা নায়, কান্দতা নায় ।
--- তর কুতুবরে কইছ, আমার লাগিও একটা সুন্দর নাম দিত ।
--- এ, কুতুবে কিতা করত, আমিউ দিলাইমু নাম, নে তোর নাম অখন
সুখবাহার । কিন্তু বাঙাল লাগানি লাগব ।
--- লাগাইমু । তুই আইও , তোর লাগি বাড়ির ছানি দিলাম, বেড়া
লেপলাম । তর কিতা মতলব ক চাইন , আমার লগে থাকতে নায় নি ।
--- না বে কুতুবরে লইয়া কিতা করতাম । ইগুওনু আছে আমার লগে ।
--- তে কিতা অইছে ইগুরেও লইয়া আইও ।
--- না না । এর থাকি এক কাম কর । তুইও আইও পিয়াইনর পারো ।
আমি থাকমু কয়বরো, তুইন থাকবে শ্মশানো । ইলাখান লাগালাগি কয়বর শ্মশান সারা সিলেটো
নাই । আইও থাকমুনে দুইজনে ।
--- কেমনে থাকমু । তরে শ্মশানো ঢুকতে দিব নি ।
--- তে তুই আইঅইছ কয়বরো আমরার ইতা মানামানি নাই ।
--- কইরে নি । আইতাম । না বে শ্মশান কয়বর ইতা আমার ভালা
লাগে না । ডর লাগে মরার আগে মরতাম কেনে । একেবারে আইমু । তুই থাক তর কয়বর আর কবি
লইয়া । মাঝে মাঝে আইছ ।
নদীর গায়ে
পাশাপাশি হলেও একটা প্রাকৃতিক বিভাজিকা আছে শ্মশান আর কবরের । সুরমার গায়ে শ্মশান
আর পিয়াইনের গায়ে কবর । বইয়াখাউরি থেকে অনেক দূরে । কথার কথা বলেছে বৈতল, সে ভয়
করে না কিছুর । শ্মশান কবরে কী ভয় । বরং এরকম জায়গা নিয়ে বৈতল অন্যকে ভয় দেখাতে
পারে । আসলে বাড়িটার প্রতি একটা টান আছে বৈতলের । মাতৃস্মৃতি ছেড়ে আর নড়তে চায় না
।
জেলা সিলেটের
একমাত্র দুঃখ তার বন্যা । আর বন্যার সময় সুখের জায়গা হলো তার টিলাভুমি । বেশির ভাগ টিলাভূমিতেই এখন চা
বাগান । সুনামগঞ্জ মহকুমায় চা বাগান নেই । সুনামগঞ্জের সুনাম তার জলের জন্য । তিন
ভাগ জল একভাগ কিংবা তারও কম স্থল । জয়ন্তীয়া পাহাড় থেকে নদী এসে মিশেছে সুরমায় ।
পিয়াইন নদীর যখন তখন জলবমি হয় । উপত্যকা ভরিয়ে দেয় । সুরমার যেখানে পিয়াইন এসে
মিশেছে, সেখানে প্রকৃতি আর ধর্মের এক অবাক সমন্বয় । পাশাপাশি দূরত্বের কবর আর
শ্মশানঘাটের জমি অনেক উঁচু, টিলা না হলেও উচ্চভূমি । এই দুই অন্তিম গন্তব্যের
মুখোমুখি এক সুউচ্চ পাহাড় । পাহাড়ের নাম মালীর ভিটা । কেউ কেউ বলে মোল্লার ভিটা ।
কত কথা এই পাহাড় নিয়ে । রাজা গোবিন্দর আমলে এখানে মন্দির
ছিল মা কালীর, সংক্ষিপ্ত হতে হতে মা কালী হয়েছেন মালী । পীরসাহেবের আগমনে ইসলাম
ধর্মের প্রচারে মন্দির বন্ধ হয়ে যায় । মুসলমান অধীনে যায় অসাধারণ সৌন্দর্যময় এই উচ্চভূমি
। মন্দির মসজিদ হয় বলে কথিত । আবার ফিরে পায় হিন্দুরা সম্প্রীতির হাত ধরে । মালী
আর মোল্লা নিয়ে যতই মতভেদ থাকুক কেউ অধিকার যাচাই করে না । অধিষ্ঠাত্রী দেবী
কালীকে জাগ্রত বলেই জানে অধিবাসীরা ।
বৈতল
বন্ধুত্বের টানে, জলের ঠেলায় আবার লুলার কাছাকাছি হয় । বইয়াখাউরি ফেরার তিনমাসের
মধ্যে দ্বিতীয় বন্যায় ঘরছাড়াদের সঙ্গী হতে মন চায়নি বৈতলের । দেখার হাওরের পারে
উত্তর টিলার মনসামন্দিরের দুর্গতরা আশ্রয় নেয় । কিন্তু বৈতলের এক গোঁ, মনসার সঙ্গে
আড়ি । তাই কালীমাতার সঙ্গে মিত্রতা । মালীর ভিটার সঙ্গে এমনিতেও যাতায়াত আছে
বৈতলের । অমাবস্যার রাতে ওখানেই থাকে । বিভোর হয়ে কাটিয়ে দেয় রাত । মন্দিরের সেবাইত গিরিবাবাকে
গানের সুরে বিভোর করে গায়,
‘ বড় ধুম লেগেছে হৃদি কমলে
মজা দেখিছে আমার মন- পাগলে ।’
বাবাজিও
শুদ্ধচিত্তে বৈতলের এনে দেওয়া জবা ফুলের অর্চনা দেয় মাতৃচরণে । আর মধুর স্বরে গায়
গান,
দ্যাখনা চেয়ে ন্যাংটা মেয়ে করতেছে কী কারখানা
হাস্য করে, আস্যে পোরে
মত্ত মাতঙ্গ সেনা ।
আসব পানে মত্ত
মন রোষে আরক্ত নয়ন
রাত বাড়ালে যুবক শিষ্য বৈতলের দিকে ন্যাকড়াজড়ানো ছিলিমটিও
বাড়িয়ে দেয় । বৈতলকে বলে,
--- গাও, গাইলে দিমু নাইলে দিতাম নায় ।
বৈতলও মিষ্টি হাসিতে ভরিয়ে দেয় মায়ের মুখ । গায়,
গাইঞ্জা চিরল চিরল পাত
গাইঞ্জা খাইয়া মত্ত হইয়া নাচে ভোলানাথ ।
গিরিবাবার
শালগাছের মতো বিশাল দেহের উপর জটার পাহাড় দীর্ঘ দাড়ি আর কপালের রক্ততিলক দেখে বৈতল
বোল দেয় ‘ হর হর মহাদেব’। বৈতল জানে এই মানুষটির সঙ্গে থাকলে সব দুর্যোগ কেটে যাবে
। বিশালদেহী মানুষটার মিষ্টিভাষণেও আপ্লুত হয় বৈতল । ভাবে অভিভাবক এমনই হওয়া উচিত
।
একদিকে
প্লাবনের জল, অন্যদিকে গুজবের বন্যা । কত মানুষের কত কথা । শুনে শুনে বিরক্ত হয়
বৈতল । এক পক্ষ ভীত , অন্য পক্ষ উল্লসিত । এছাড়াও একদল আছে যারা শান্তিসুখে থাকতে
চায় মিলেমিশে । বৈতল খোঁজে মানুষ । মানুষের মতো মানুষ, যে নেতৃত্ব দিতে পারবে,
দুর্বল মানুষকে বল দিতে পারবে । একজন শক্ত মানুষের আশ্রয় চাই । গিরিবাবা পারেন,
একমাত্র নির্ভয় মানুষ এ তল্লাটে । নেশার ঘোর যখন জমে ওঠে বৈতলের তখন অমাবস্যা
রাত্রির মধ্যযাম । তখন বৈতলের শুরু হয় কথোপকথন ! বাবাজির পায়ে হাত দিয়ে বলে,
--- আইচ্ছা বাবাজি ইতা ঠিক নি কথা ।
--- কী কথা বা ।
--- অউযে খেদাই দিব । ঘরবাড়ি নিব গি ।
--- শুনা কথাত বিশ্বাস করিও না । অইলে তো অইবউ, কিতা করবায়,
গুলার পানি আটকাইতায় পারবায় নি ।
--- সিলেটও পাকিস্তানো যাইব গি । আমরার সুনামগঞ্জও ।
--- অ বা বৈতল । হিন্দুস্থান পাকিস্তান দিয়া আমরার কিতা কও
। গরিবর হক্কল খানোউ কাম করি খাওন লাগব । তুমি তো ইলাখান মানুষ নায় ।
--- আমি চুকি না কুনুগুরে । কিন্তু একলগে যদি আইন তখন তো
বেবস্তা রাখন লাগব ।
--- কিতা বেবস্তা ।
--- কয়েকটারে মারিয়া তো মরতাম ।
--- মারামারির কথা ভাবিও না । আমরা যেলাখান আছি মিলিমিশিয়া
থাকমু ।
মার উপরে
ভরসা রাখিও ।
--- আমার মা নাই ।
--- তে এইন কে ।
বৈতল ঢুলু ঢুলু
চোখে তাকিয়ে দেখে করালবদনির চোখে মিটিমিটি হাসি । হাসির অর্থ বোঝে বৈতল । কালো
পাথরের মূর্তি থেকে উপহাসের জট খুলে ছুটে আসছে তার দিকে । বিদ্ধ করেছে । বলছে
কাপুরুষ । বলছে অসমসাহসের বলিহারি । বইয়াখাউরির জলকে ভয় পেয়ে পালিয়ে এসেছে করালবদনীর
কাছে । বাপের আর্ত চিৎকার, বড় হাওরের জলে হুড়মুড়িয়ে টঙ ভেঙে পড়া, রইদপুয়ানি
গ্রামের ঘাটা খুলে বেরিয়ে আসা, সিলেটের সাদা মেয়ের কান ছিঁড়ে পালিয়ে যাওয়া, এসব
কোন বাহাদুরি । বৈতল মিথ্যে অভিযোগ থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া চিৎকার করে ওঠে । বলে,
--- মিছা কথা, সব মিছা কথা । তাই আমারে চাকর কইছে, বাপে পুত
মানে না, আলদ দিয়া মারত চায়, আর কালা পুড়ি এগুরে বিয়া করিয়া আমি কিতা করতাম । পানি
কম অউক আমি যাইমু গি আমার বাড়িত । বাড়ি ছাড়িয়া আমি লড়তাম নায় । পাকিস্তান উকিস্তান
আমি চুকি না ।
রাত বাড়ে জলও
বাড়ে । মাতৃমূর্তিকে মনের কথা বলে নিরুদ্বেগ শুয়ে থাকে মন্দির গৃহের এক কোণে । ঘুম
ভাঙে লুলার গালাগালিতে । অকথ্য চিৎকারে লুলা বৈতলের গায়ে লাথি মারে । বৈতল ওঠে ।
এত বড় সাহস তার । ভাল করে তাকায় ঘাতকের দিকে । চিনতে পারে না লুলাকে । এই কই তার
প্রাণের বন্ধু রুল আমিন শেখ । দেখে লুলার থুতনিতে পেয়াজের জড়ের মতো কালো এক
মুঠো দাড়ি । বৈতল ভাবে লুলা ঠাট্টা করেছে, আবার কোনো দুষ্ট পরিকল্পনা আছে, আবার
বেরোবে কোথাও । বৈতলকে বলবে ‘চল’ । বৈতলও বেরিয়ে পড়বে । বৈতল তাই হাসি মুখে লুলার
দাড়ি নেড়ে দেয় । বলে,
--- ইতা কিতাবে ,
‘এক বেটা যায় শ্বশুরবাড়ি
মাথা নাই তার পুন্দো দাড়ি ।’
--- তুই আক্তা দাড়ি রাখলে কিতা ।
--- দাড়ি রাখন লাগে । ইমানদার মুসলমান অইলে রাখন লাগে ।
তুইও রাখবে ।
--- আমার দাড়ি উঠে না ।
--- ইখানো থাকলে উঠানি লাগব ।
--- অই হালার হালা, তুই মন্দিরো ঢুকলে কেমনে ।
--- অখন মন্দির উন্দির কিচ্ছু নাই ।
--- কেনে ।
--- ইনো আমরার মজিদ আছিল, কাফির হকলে মন্দির বানাইছিল
মোল্লার ভিটাত । আমরা আবার আজান দিমু ইনথনি ।
--- তুই নি দিবে আজান । বেজর বেটা অইতে মুয়াজ্জিন । কইতে
পারবে নি আল্লা হো আকবর কথার অর্থ কিতা ।
লুলার কণ্ঠ নয়
অন্য এক গমগমে গলার আওয়াজ শোনে বৈতল মন্দির চত্বরে ঘুমঘোরে,
--- ঈশ্বর করুণাময় । অখন উঠো রেবা, দেখ চউখ মেলিয়া চাইর
দিকে । সব বাড়িঘর ডুবি গেছে । কবর আর শ্মশানও ডুবি যাইব মনোলয় বিকালর আগেউ ।
কিচ্ছু করণ লাগব রেবা ।
কী করে বৈতল ।
সকালের স্বপ্ন যদি সত্যি হয় । তার বন্ধু যদি পাল্টে যায় । পাল্টাবে কেন,
লুলার মন একেবারে সাদা , চেরাপুঞ্জি চুনের মতো । বৈতলের মতো কুকড়ি নয় । প্যাঁচ
পয়জার নেই, একটু অভিমানী । বৈতলের কিল চড় লাথি না খেলে ঠিক হয় না । আসলে পাঁচ বছরের
ব্যবধানে, অদর্শনের দূরত্বে লুলার যে নতুন পৃথিবী গড়ে উঠেছে তা মানতে পারছে না
বৈতল । তাই সবসময় উল্টো পাল্টা ভাবছে, স্বপ্ন দেখছে । গিরিবাবার কথার সূত্র ধরে
তাই লাফিয়ে ওঠে বৈতল । বলে,
--- লুলা অগুরে
লইয়া আই আগে ।
--- কই আনতায় ।
--- কেনে, মন্দিরো । মন্দির টিল্লা ছাড়া মাটি নাই কুনুখানো
।
--- আনতায় । মাইনষে যদি কিচ্ছু কইন । দেখো তুমি যেতা বুঝো ।
শ্মশানো একলা পুড়ি এগু থাকে । আইত কও, সব আউকা, যেতা অইব দেখা যাইব নে । বিপদ থাকি
রক্ষা অউক আগে ।
লুলা একা
জলভূমিতে যেতে চায় না, বৈতল কুতুব সহ সব আবাসিককে আমন্ত্রণ জানিয়েছে । লুলা বলে,
--- তোর বাবাজি এইন বড় ভালা নানি বে । দেখলে কিন্তু ডর লাগে ।
--- আইবে নি ক ।
--- আইমু আইমু, পানি কয়বরর উপরে উঠলেউ যাইমু । হিন্দুর ধর্ম
নষ্ট করণ লাগব নানি ।
প্রলয় কাকে বলে
জানে না বৈতল, তবে সে বুঝতে পেরেছে প্রকৃতি এবার ক্রুদ্ধ হয়েছে । সৃষ্টিনাশ হওয়ার
কথা বলেন বয়স্কজনেরা, জল যে – হারে বাড়ছে তাতে আর পায়ের তলার মাটি থাকবে না ।
সন্ধ্যার আঁধার ঘন হয়ে এসেছে দুপুরেই । চোখের দেখায় বেশিদূর দেখা যায় না । বড়জোর
কয়েক পাড়া। কয়েক পায়ের দূরত্ব দৃশ্যমান । অনেক দূরের একটা আভাস শুধু চোখের সামনে ।
বন্যার জলের ধূসর, আর মাঝে মাঝে গাছগাছালির সবুজথোকা । আকাশে কালো মেঘের লড়াই থামছেই
না, ঝমঝমানি বেশি করে শুরু হতেই বৈতল মন্দিরের ভিতরেও দেখে বন্যার প্রকোপ । পীড়িত
মানুষ উঠে আসছে একজন দুজন করে । অসহায় জলবন্দী মানুষ এখনও ধর্মে জড়িয়ে আছে । সবাই
মা কালীর ভক্ত । কুপি লন্ঠনের আলোয় মা কালীর সামনে বসে জল্পনা করে সম্ভাব্যের । টিলার নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে অস্থির
সময়ের ভাবনায় কাতর হয় । কেউ বলে ওরা যদি দল বেঁধে ওঠে আসে । একা কতজন অসহায়
মানুষকে আক্রমণ করলে কী হবে । কেউ বলে, জবাব হবে । কেউ বলে নিচে কবরের ভিতর লাল
ফকিরের মাজারে ওরা জড়ো হয়েছে । আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে ঐ নিচে । কেউ একজন দেখে এসে সত্যতা নির্ধারণ
করে । ভীত মানুষকে বরাভয় দিয়ে গিরিবাবা বসেন পূজায় । বাবাজির মুখে এক উজ্জ্বল আলো,
কালো মায়ের মুখে তাকিয়ে যেন কাতরে কিছু বলতে চান । পাশে বসা বৈতলকে ডেকে বলেন,
--- চিলিম সাজাইছ নিবা । চিলিম সাজাইয়া গাও, ‘সমরে নাচেরে
শ্যামা শিব সীমন্তিনী’ ।
নৈবেদ্যের
ভক্তিতে চিলিম সাজিয়ে ন্যাতায় জড়িয়ে জোড় করে বৈতল বাবাজির হাতে দেয় । অচিরেই ফেরত
পায় বৈতল । এক চিলিমে যেমন তেমন হতেই বৈতল বোল দিয়ে ওঠে ‘বোম বোম বম্বালে’ । কুড়ি
কণ্ঠের প্রতিধ্বনিও ওঠে ।
আল্লা হো আকবরের
জিগিরও ওঠে কোথাও । এবার তাহলে সম্ভাবনা সত্যি হয়ে ওঠে । ‘হায় হায়, গেল গেল’ করে
ওঠে সমবেত শরণার্থী । গিরিবাবার মুখেও
এবার আতঙ্কের ছাপ । এ কই সত্যি জিকির নাকি সুরমা পিয়াইনের সম্মিলিত আক্রোশধ্বনি ।
বাবাজি বৈতলকে ডেকে বলেন,
--- তেউ । কিতা অইব বা বৈতল বাবাজি ।
--- কিতা আর অইব । এমনে ছাড়ি দিমু নি ।
--- ইতা কিতা কও, কত মানুষ তারার । সব গাউউতো তারার । এক
কাম করণ লাগব, মন্দিরর পিছে দি গিয়া সুরমাত ঝাপ দেওন লাগব ।
বৈতল মন্দিরের
পিছনে যায় । জলের শব্দ শুনতে পায় । বলে,
--- ডরানির কিচ্ছু নাই । এমনে মরতাম নায়, মারিয়া মরমু । এক
একটারে মারমু আর পিয়াইনো ফালাইমু সুরমাত ফালাইমু, সোজা স্বর্গত যাইব, বেহেস্ত
উয়েস্ত পাইত নায় । আপনার রামদা বার করইন বাবাজি ।
চলবে
< ভাটি পর্ব ১৬পড়ুন ভাটি পর্ব ১৮ পড়ুন >
চলবে
< ভাটি পর্ব ১৬পড়ুন ভাটি পর্ব ১৮ পড়ুন >
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন