“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ২ জানুয়ারী, ২০১৬

আয়স কাল ১৪

(C)Image:ছবি

(দক্ষিণ আফ্রিকীয় লেখক জে এম কোয়েটজি-র লেখা 'এজ অব আয়রন'- উপন্যাসের  বাংলা অনুবাদের ৩য় অধ্যায়ের ৪র্থ   ভাগ: -- শিবানী দে)

টেলিফোনে যাচ্ছে ভালবাসা, কিন্তু সত্য নয় । অন্য কোনখান থেকে এই বিরাট লম্বা চিঠিটাতে আছে সত্য ও ভালোবাসা একসঙ্গে । প্রত্যেকটা ‘তুমি’ শব্দ যে আমি লিখছি, তারা দপদপ করছে, কাঁপছে, যেন সেন্ট এল্‌মোর* আগুন ; যে তুমি আমার সঙ্গে আছ, সেই তুমি আমেরিকাতে থাকা তুমি নও, যে তুমি এখান থেকে গিয়েছিলে, সেও নও , কিন্তু তুমি আরো গভীরতর ও অপরিবর্তনীয় এক সত্তাতে আছ : প্রিয়, প্রাণপ্রিয়, যার কখনো মৃত্যু হবে না । তোমার সেই আত্মাকেই আমি সম্বোধন করছি , কারণ এই পত্র যখন শেষ হবে, তখন আমার আত্মাই তোমার সঙ্গে থেকে যাবে । ঠিক যেন একটা মথ যখন গুটি থেকে বেরোনোর সময় ডানা ঝাপটায়, আমি আশা করছি এই চিঠি পড়েই তুমি মনশ্চক্ষে দেখবে: আমার আত্মা আরো দূরে উড়ে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে । মৃত্যুশয্যায় শায়িত শরীরের মুখ থেকে বেরোচ্ছে প্রেতাত্মা, একটা সাদা মথের মত । এই যে অসুস্থতার সঙ্গে লড়াই, বিষণ্ণতা ও আজকালকার আত্মঘৃণা, এই দোলাচল আর এই দ্বন্দ্ব, (হাউট বে-র গল্পটার আর সামান্যই বাকি----ভারকুয়েইল মদ খেয়ে বদমেজাজ নিয়ে ফিরে চাবিটা খুঁজে পেল, আমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরল---- এই তো এই ; সম্ভবত: সত্যটা হল তার কুকুরটাই তাকে ফিরিয়ে এনেছিল)---- সব কিছুই রূপান্তরণের অংশ, মৃতপ্রায় খোলস থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টার অংশ ।
এবং তারপর, মৃত্যুর পর ? ভয় করো না, আমি তোমার পিছু নেব না । সাদা মথ যদি রাত্রে উড়তে উড়তে তোমার বা তোমার কোনো সন্তানের ভুরুর উপর বসে পড়ে, সেই ভয়ে জানালা বন্ধ করার বা চিমনির ফুটো বুজিয়ে দেবার দরকার নেই । তুমি যখন চিঠির অন্তিম পাতাটা পড়া শেষ করে রাখতে যাবে, মথটা তার পরবর্তী উড়ানের জন্য বেরিয়ে পড়ার আগে আলতোভাবে তোমার গাল ছুঁয়ে যাবে । তোমার সঙ্গে থাকবে আমার আত্মা নয়, আমার আত্মার নির্যাস, শ্বাস, এই শব্দগুলোকে ঘিরে হাওয়ার চলন, তোমার আঙ্গুল দিয়ে ধরা কাগজের উপর আমার কলমের অশরীর গমনের ফলে হাওয়াতে ফুটে ওঠা মৃদুতম আলোড়ন ।
নিজেকে ছেড়ে যাওয়া, তোমাকে ছেড়ে যাওয়া, এখনো স্মৃতিতে জীবন্ত এই বাড়িটাকে ছেড়ে যাওয়া : এ বড় কঠিন কাজ, কিন্তু আমি অভ্যাস করছি । সঙ্গীত ও । কিন্তু সঙ্গীত আমি নিজের সঙ্গে নিয়ে যাব অন্তত:, কারণ এটা আমার অন্তরাত্মার সঙ্গে জড়ানো । ম্যাথু প্যাশনের* আকাশ পূর্ণ করা সঙ্গীত যেন জড়িয়ে এবং হাজার বার গিঁট মেরে বেঁধে আছে, যেটা আর কখনো খুলতে পারবে না ।
ভারকুয়েইল যদি এই লেখাগুলো না পাঠায়, তুমি কখনো পড়তে পারবে না । তুমি জানবেও না যে এগুলো কখনো ছিল । কিছু সত্য তাহলে কখনো আকার পাবে না : আমার সত্য : আমি কিভাবে এই সময়ে, এই জায়গায় বেঁচেছিলাম ।
তাহলে এই বাজিটা কেন, যে বাজিটা আমি ভারকুয়েইলের উপর, ভারকুয়েইলের সঙ্গে ধরছি ?
এই বাজিটা বিশ্বাসের উপর । কিছুই জিজ্ঞাসা করবার নেই, শুধু একটা পুলিন্দা পোস্ট আফিসে নিয়ে কাউন্টারের ওধারে জমা দেওয়া । এত ছোট কাজ, যে কিছু না বললেও চলে । প্যাকেটটা নিয়ে যাওয়া ও না যাওয়ার মধ্যে ফারাকটা একটা পালকের মত হাল্কা । আমি যখন চলে যাব, তখন যদি অতি সামান্যও বিশ্বাস, কর্তব্যজ্ঞান, এবং ধর্মের রেশ থাকে, তাহলে সে এটা নিশ্চয়ই নিয়ে যাবে ।
আর যদি না হয় ?
যদি না হয়, তাহলে বিশ্বাস থাকে না, এবং আমরা এর বেশি পাবার যোগ্য নই, আমাদের কেউই নয় , আমাদের গর্তে পড়ে নিশ্চিহ্ন হওয়াই উচিত ।
যেহেতু ভারকুয়েইলকে বিশ্বাস করতে পারিনা, সেজন্যই তাকে বিশ্বাস করা উচিত ।
যে সময়টা আত্মার প্রতি সদয় নয়, সেই সময়টায় আমি একটা আত্মাকে জাগ্রত রাখতে চাইছি ।
অনাথ, সর্বস্বান্ত, ক্ষুধার্তকে ভিক্ষা দেওয়া সহজ । যাদের হৃদয় তিক্ত হয়ে গেছে,(আমার ফ্লোরেন্সের কথা মনে পড়ল) তাদের ভিক্ষা দেওয়া কঠিন । কিন্তু ভারকুয়েইলকে ভিক্ষা দেওয়া আরো কঠিন । আমি তাকে কিছু দিলে সেই দেওয়ার জন্য সে আমাকে ক্ষমা করে না । ওর মধ্যে কোনো দানশীলতা নেই, কোনো ক্ষমা নেই । (ভারকুয়েইল বলে, দানশীলতা ? ক্ষমা ?) যেহেতু ওর ক্ষমা নেই, আমি দানশীলতা ছাড়াই দিই, প্রেম ছাড়াই সেবা করি, যেন বন্ধ্যা জমির উপর বৃষ্টি পড়ে ।
যখন আমার বয়স কম ছিল, আমি হয়তো আমার শরীর তাকে দিতে পারতাম । ভুল করে হলেও এরকম কাজ কেউ কেউ করে, করত । তার বদলে এখন আমার জীবনটা তার হাতে তুলে দিই । এই যে কথাগুলো, পৃষ্ঠার উপর কর্কটরোগগ্রস্ত অক্ষরগুলোর নড়াচড়াতে তৈরি হওয়া এই আঁকিবুঁকি, এই আমার জীবন । এই কথাগুলো, যখন তুমি পড়বে, যদি তুমি পড়, তোমার ভেতর যাবে, শ্বাস টেনে বাইরে আনবে । তুমি ভাবলেও ভাবতে পার, এগুলোই আমার মত করে বেঁচে থাকা, অনেকদিন আগে তুমি আমার ভেতরে বেঁচেছিলে, যেভাবে  আরো অনেকদিন আগে আমি আমার মায়ের ভেতর বেঁচেছিলাম । যেমন মা আমার মধ্যে আছেন, যেভাবে আমি তাঁর দিকেই বেড়ে যাচ্ছি, সেভাবেই আমি  তোমার মধ্যে বেঁচে থাকতে  পারি ।
আমি ভারকুয়েইলকে আমার জীবন নিয়ে যেতে দিয়েছি । আমি তাকে বিশ্বাস করি কারণ আমি তাকে বিশ্বাস করি না । আমি তাকে ভালবাসি কারণ আমি তাকে ভালবাসিনা । যেহেতু সে একটা উলুখাগড়ার মতো দুর্বল, আমি তার উপর নির্ভর করি ।
আমি যা বলি, তা বুঝি বলে মনে হয়, কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি বুঝি না । প্রথম থেকেই যখন আমি তাকে গ্যারেজের পেছনে তার কার্ডবোর্ডের বাক্সের ঘরে ঘুমোতে, অপেক্ষা করতে দেখেছিলাম, আমি কিছুই বুঝিনি । আমি আমার ক্রমশ: আঁধার হয়ে যাওয়া রাস্তা হাতড়ে যাচ্ছি । আমি তোমার দিকে যাবার রাস্তা হাতড়াচ্ছি, প্রত্যেকটি শব্দের সাথে আমি আমার রাস্তা অনুভব করছি ।


কয়েকদিন আগে আমার ঠাণ্ডা লেগেছিল, এখন আমার বুকে বসেছে, আর একটা শুকনো, হাতুড়ির ঘায়ের মত কাশি হয়েছে, যা কয়েক মিনিট একসঙ্গে চলে, এবং হাঁসফাঁস করতে কতে আমার শক্তি নিঃশেষ করে দেয় ।
যতক্ষণ পর্যন্ত এই বোঝাটা  শুধু একটা ব্যথার বোঝা, আমি তাকে দূরে রেখে সহ্য করি । আমি আমাকে বলি, এই ব্যথাতে আমি ভুগছি না : এই ব্যথা অন্য কারো, একটা শরীর যে আমার সঙ্গে এই বিছানায় শোয় । এই চালাকি দিয়ে আমি ব্যথাটাকে দূরে রাখি, অন্য কোথাও ঠেলে দিই । যখন এই চালাকি কাজ করে না, যখন ব্যথা আমাকে অধিকার করার জেদ করে, আমি তাকে কোনও রকমে সহ্য করি ।(ব্যথার ঢেউ যখন উঠবে, তখন আমি নিঃসন্দেহ যে আমার সব চালাকি জীল্যান্ডের* সমুদ্রবাঁধের মত ধুয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে ।)
কিন্তু এখন এই কাশির দমকের সময় আমি নিজের থেকে দূরত্ব রাখতে পারিনা । কোনো মন নেই, কোনো শরীর নেই, শুধুমাত্র আমি, পাগলের মত হাত পা ছোঁড়া, বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করব, ডুবন্ত একটা জীবের মত । ভয়, এবং ভয়ের লজ্জা । মৃত্যুর রাস্তায় যাবার জন্য এই উপত্যকা পেরোতে হবে । এটা কি ভাবে আমার ভাগ্যে ঘটতে পারে ? কাশির দমক চূড়ান্ত হলে আমি ভাবি, এ কি ঠিক বিচার হল ? হদ্দবোকামির লজ্জা । এমন কি একটা পিঠভাঙ্গা কুকুর, রাস্তার ধারে শেষ নিঃশ্বাস নিতে নিতে ভাববে না, আমার ভাগ্যে এটা কি ঠিক হল ?
মার্কাস অরিলাস* বলেছিলেন, “বেঁচে থাকার জন্য কুস্তিগিরের কায়দা দরকার, নর্তকের নয় । পায়ের উপর দাঁড়াতে পারাই আসল, সুন্দর পদক্ষেপের দরকার নেই ।
গতকাল রান্নাঘরের ভাঁড়ার শূন্য হওয়াতে আমাকে বাজারে যেতে হয়েছিল । ব্যাগগুলো বাড়ি বয়ে নিয়ে আসতে আমার বড় খারাপ সময় গেল । তিনটে স্কুলের ছাত্র আমার পাশ দিয়ে যাবার সময় একটু সময় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখছিল যে বুড়িটা বাতিস্তম্ভে হেলান দিয়ে বসে আছে, আর মুদিখানার থেকে কেনা জিনিষগুলো তার পায়ের কাছে ছড়িয়ে আছে । কাশির দমকের মধ্যে হাত নেড়ে তাদের চলে যেতে বলার চেষ্টা করলাম । আমাকে কিরকম লাগছিল তা কল্পনা করতে পারি না । একটি মহিলা গাড়ির গতি কমাল, তারপর আমাকে ডেকে জিগ্যেস করল, “আপনি কি ঠিক আছেন ?” আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, “আমি বাজার করছিলাম ।” “কি ?” সে ভুরু কুঁচকে কথাটা শোনার চেষ্টা করছিল । “কিছু না,” আমি খাবি খেতে খেতে কোনোরকমে বললাম । সে গাড়ি চালিয়ে চলে গেল ।
আমরা কি কুৎসিত হয়ে যাচ্ছি । নিজেদের সম্পর্কে ভাল কিছু চিন্তা করতেও অক্ষম । এমন কি সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় বিজয়িনীরাও বদমেজাজ দেখায় । এই সবই কুশ্রীতা । আত্মা স্থূল শরীরের মধ্য দিয়ে এই কুশ্রীতা ছাড়া আর কি দেখাচ্ছে ?
গতরাতে খুব খারাপ ব্যাপার হয়েছিল । আমার ঘুমের ওষুধ খেয়ে আসা অপ্রীতিকর তন্দ্রাচ্ছন্নতাকে কুকুরের ঘেউঘেউ বিদ্ধ করল । একটানা, বিরামহীন যান্ত্রিক ভাবে চলতেই থাকল । ভারকুয়েইল কেন কুকুরটাকে থামাচ্ছে না ?
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নিজের উপর ভরসা রাখতে পারছিলাম না । গাউন পরে ও পায়ে স্লিপার গলিয়ে আমি ব্যালকনিতে  গেলাম । ঠাণ্ডা ছিল, হাল্কা বৃষ্টিও পড়ছিল । আমি খ্যাসখ্যাস গলায় ডাকলাম , “মিঃ ভারকুয়েইল । কুকুরটা কেন চেঁচাচ্ছে, মিঃ ভারকুয়েইল ?”
কুকুরের ঘেউঘেউ একটু থেমে আবার শুরু হল । ভারকুয়েইলকে দেখা গেল না ।
আমি বিছানায় ফেরত গেলাম এবং শুয়ে থাকলাম, কিন্তু কিছুতেই ঘুমোতে পারছিলাম না, ঘেউঘেউ শব্দ যেন কানের ভেতর হাতুড়ি পিটছিল ।
এভাবেই বয়স্ক মহিলারা পড়ে গিয়ে কোমর ভাঙ্গে, আমি নিজেকে সাবধানবাণী শোনালাম । এইভাবেই ফাঁদ পাতা থাকে, আর এই ভাবেই ওরা ধরা পড়ে । সিঁড়ির রেলিং দুহাতে ধরে আমি গুটিগুটি করে নামলাম ।
রান্নাঘরে কেউ একজন ছিল, এবং সে ভারকুয়েইল নয় । যেই হোক, সে লুকোবার চেষ্টা করল না । হে ভগবান, আমি ভাবলাম, ভেকি ! একটা ঠাণ্ডা স্রোত আমার ভেতর বয়ে গেল ।
খোলা রিফ্রিজারেটারের রহস্যময় আলোতে সে আমার মুখোমুখি হল, তার কপালের বুলেটের ক্ষত সাদা ব্যান্ডেজ করা ।
আমি ফিসফিস করে বললাম, “তুমি কি চাও ? তোমার কি খাবার চাই ?”
সে বলল, “ভেকি কোথায় ?”
গলার স্বর নিচু, ভেকির থেকে মোটা, এ কে হতে পারে তাহলে ? মূঢ়ের মত আমি নামটা খুঁজতে থাকলাম ।
সে রিফ্রিজারেটারের দরজা বন্ধ করল । এখন আমরা সম্পূর্ণ অন্ধকারে । আমি খ্যাস্‌খ্যাসে গলায় আবার ডাকলাম, “মিঃ ভারকুয়েইল ।” কুকুরটা অনবরত ডাকছিল । “প্রতিবেশীরা এখন চলে আসবে ,” আমি ফিস্‌ফিসিয়ে বললাম ।
যেতে যেতে তার কাঁধটা আমার কাঁধে ঘষটে গেল । চমকে গিয়ে আমি তার গন্ধ পেলাম এবং বুঝলাম সে কে ।
সে দরজায় পৌঁছাল । কুকুরটা পাগলের মত ডাকছিল ।
“ফ্লোরেন্স তো এখানে আর থাকে না ।” আমি বললাম । আমি আলো জ্বালালাম ।
সে নিজের পরে ছিল না । অথবা হয়ত এটা একটা ফ্যাশন । তার জ্যাকেটটা একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষের, ট্রাউজার্স ও অনেক লম্বা । জ্যাকেটের একটা হাতা খালি ।
আমি জিগ্যেস করলাম, “তোমার হাত কেমন আছে ?”
“হাতটা নাড়তে বারণ,” সে বলল ।
“দরজা থেকে চলে এসো ।”
আমি দরজা খুললাম, ক্র্যাক ক্র্যাক শব্দে । কুকুরটা উত্তেজিত হয়ে লাফাল । আমি তার নাকে আস্তে আস্তে চাপড় দিলাম । বললাম, “এখন চুপ কর ।” কুকুরটা কুঁইকুঁই করল ।“তোমার মনিব কোথায় ?” ও তার কান নাড়াল । আমি দরজা বন্ধ করলাম ।
ছেলেটাকে জিগ্যেস করলাম, “এখানে কেন এলে ?”
“ভেকি কোথায় ?”
“ভেকি মারা গেছে । গত সপ্তাহে তুমি যখন হাসপাতালে ছিলে, তখন সে খুন হয়েছে। গুলি লেগেছিল, সঙ্গে সঙ্গেই মারা গেল । তোমাদের সেই সাইকেলের ব্যাপারটার পরদিনই ঘটনাটা ঘটল ।”
সে তার ঠোঁট চাটল । তার মুখের উপর একটা কোণঠাসা, অনিশ্চয়তার ছায়া ।
“তুমি কি কিছু খাবে ?”
সে মাথা নাড়ল । “টাকা । আমার কোনো টাকা নেই,” সে বলল । “বাসের খরচের জন্য ।”
“আমি তোমাকে টাকা দেব । কিন্তু তুমি কোথায় যেতে চাও ?”
“আমি বাড়ি যেতে চাই ।”
“এটা করো না, আমি তোমাকে অনুরোধ করছি । আমি জানি আমি কি ব্যাপারে কথা বলছি । ফ্ল্যাট অঞ্চলে কি চলছে আমি দেখে এসেছি । যতদিন না ওখানে সব কিছু স্বাভাবিক হচ্ছে, ওখান থেকে দূরে থাক ।”
“কিছুই স্বাভাবিক হবে না ।”
“প্লীজ, আমি তর্ক করতে জানি, কিন্তু আমার সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই নেই । যতদিন পর্যন্ত না আরেকটু শান্ত হয়, ততদিন এখানেই থাক । তুমি নিজেও আরেকটু সুস্থ হও । হাসপাতাল থেকে চলে এলে কেন ? তোমাকে কি ছেড়ে দিয়েছে ?”
“হ্যাঁ, আমাকে ছেড়ে দিয়েছে ।”
“তুমি কার পোশাক পরে আছ ?”
“এগুলো আমারই ।”
“এগুলো তোমার হতে পারে না । কোথায় পেলে এগুলো ?”
“এগুলো আমারই । একজন বন্ধু আমাকে এনে দিয়েছে ।”
সে মিথ্যেকথা বলছিল । একটা পনেরো বছরের ছেলে যতটুকু মিথ্যেকথা বলতে পারে ততটুকুই ।
“বসো, আমি তোমাকে কিছু খেতে দিই । তারপর তুমি একটু ঘুমোতে পার । সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করো, বরং তার পর কি করবে মনস্থির করো ।”
আমি চা বানালাম । সে বসল, আমার প্রতি কোনো মনোযোগ দিলনা । আমি যে তার কথা বিশ্বাস করিনি, তাতে সে বিন্দুমাত্র বিব্রত হল না । আমার বিশ্বাস অবিশ্বাসে তার কিছু যায় আসে না । সে আমাকে কি ভাবল ? সে কি আমার সম্পর্কে কিছু ভাবনা ভেবেছে ? সে কি ভাবনাশীল মানুষ ? না । ভেকির সঙ্গে তুলনা করলে সে হল চিন্তাশূন্য, অপরিশীলিত, কল্পনাহীন । কিন্তু সে বেঁচে আছে, আর ভেকি মৃত । প্রাণবন্ত যারা, তাদেরকেই আগে উঠিয়ে নেওয়া হয়, আর যারা জড়প্রায়, তারা বেঁচে থাকে । নিজের কিছু ভাল হওয়ার আগেই ভেকি চলে গেল । ভেকি সম্পর্কে আমি ভয় পেতাম না, এই ছেলেটার সম্পর্কে আমি অত নিশ্চিন্ত নই ।
আমি তার সামনে একটা স্যান্ডউইচ ও এককাপ চা রাখলাম । বললাম, “খাও ।” সে নড়ল না । হাতের উপর মাথা রাখা, চোখের পাতা বন্ধ, সে ভালোই ঘুমিয়ে পড়েছে । আমি তার গালে আলতো টোকা দিলাম । বললাম, “জাগো ।” সে চমকে উঠল , সোজা হয়ে বসল, এক কামড় নিয়ে তাড়াতাড়ি চিবুতে লাগল । তারপর চিবোনো মন্থর হয়ে গেল । মুখভরে খাবার নিয়ে সে দুর্বলতার তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল । আমি স্যাণ্ডউইচটা তার হাত থেকে নিয়ে রাখলাম, ভাবলাম, যখন তারা মুশকিলে পড়ে, নারীর কাছে যায় । ফ্লোরেন্সের কাছে যায়, এখন তো ফ্লোরেন্স নেই । ওর নিজের মা কি নেই ?
ফ্লোরেন্সের ঘরে গিয়ে ও একটু সুস্থ হল । বিড়বিড় করে বলল, “সাইকেলটা ?”
“সাইকেলটা সুরক্ষিত আছে, আমি ওটা রেখেছি । ওটাকে মেরামত করতে হবে, এই যা । আমি মিঃ ভারকুয়েইলকে দেখতে বলব ।”
তো দেখছ, এই যে বাড়িটা একদিন তোমার ও আমার বাড়ি ছিল, এটা এখন গৃহহীনের আশ্রয়, পথিকের বিশ্রামগৃহ হিয়ে দাঁড়িয়েছে ।
হে আমার প্রিয়তম সন্তান, আমি ভুলের কুয়াসায় আচ্ছন্ন । রাত শেষের দিকে, আর আমি জানিনা নিজেকে কিভাবে রক্ষা করব । যতদূর পর্যন্ত স্বীকারোক্তি আমি করতে পারি, তোমার কাছেই সেই স্বীকারোক্তি করব । কোথায় আমার ভুল, জিগ্যেস কর ? আমি যদি একটা বোতলে ভরতে পারতাম, যেভাবে মাকড়সাকে বোতলে পোরা যায়, তোমার কাছে পরীক্ষার জন্য পাঠাতে পারতাম, তাহলে তাই করতাম । কিন্তু এক তো কুয়াশার মত, সব জায়গাতেই আছে, আবার কোনো জায়গাতেই নেই । আমি তাকে ছুঁতে পারি না, ধরে বন্ধ করতে পারি না, কোন নাম দিতে পারি না । ধীরে ধীরে, যদিও অনিচ্ছা সত্ত্বে, আমাকে প্রথম কথাটা  বলতে দাও । আমি এই ছেলেটাকে, যে ফ্লোরেন্সের বিছানায় শুয়ে আছে, তাকে ভালবাসি না । আমি তোমাকে ভালবাসি, কিন্তু তাকে ভালবাসি না । তার প্রতি আমার কোনো বেদনা নেই, এককণাও নেই ।
হ্যাঁ, তুমি উত্তর দেবে, সে ভালোবাসার যোগ্য নয় । কিন্তু ভালোবাসার  অযোগ্য হবার জন্য তোমারও কি কোনো ভূমিকা নেই ?
আমি তা অস্বীকার করি না । কিন্তু একই সঙ্গে আমি বিশ্বাসও করিনা । আমার হৃদয় তাকে আমার বলে গ্রহণ করে না : কথাটা এতই সহজ । আমার অন্তর থেকে চাই যে ও চলে যাক, আমায় একা থাকতে দিক ।
এই হল আমার প্রথম কথা, প্রথম স্বীকারোক্তি । আমি এই যে অবস্থায় আছি, এই কুশ্রীতার অবস্থায়, এই ভাবে থেকে মরতে চাই না । আমি চাই যে কেউ আমাকে বাঁচাক । কিন্তু কিভাবে আমি বাঁচব ? সেই কাজটা করে, যা আমি করতে চাই না । এটা হল প্রথম ধাপ : যে কথাটা আমি জানি । যে ভালবাসার যোগ্য নয় তাকেই প্রথমে ভালোবাসা । উদাহরণস্বরূপ, এই ছেলেটাকে আমায় ভালোবাসতে হবে । প্রাণবন্ত ছোট ভেকিকে নয়, কিন্তু একে । ও এখানে আছে একটি কারণে । সে আমার মোক্ষলাভের অংশ । আমাকে তাকেই ভালোবাসতে হবে । কিন্তু আমি তাকে ভালোবাসি না । এবং আমার বিবেক সত্ত্বেও আমি তাকে যথেষ্ট ভালোবাসতে চাই না ।
পরিপূর্ণ হৃদয় নিয়ে আমি অন্য কিছু চাই না বলেই আমি কুয়াশায় ঘুরছি ।
আমার হৃদয়ে আমি ‘ভালোবাসতে পারা’ খুঁজে পাই না, ‘ভালোবাসতে চাওয়া’ খুঁজে পাই না । ‘ভালোবাসতে চাওয়াকে চাওয়া’ও খুঁজে পাই না ।
আমি মরছি কারণ আমার অন্তর থেকে আমি বাঁচতে চাইনা । আমি মরছি কারণ আমি মরতে চাই ।
সে কারণে আমার দ্বিতীয় সন্দেহজনক শব্দ উচ্চারণ করছি । ওকে যখন ভালোবাসতে চাই না, তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কতটুকু সত্য তা কি করে বলব ? কারণ ভালোবাসা তো ক্ষুধার মত নয় । ভালোবাসা কখনো তৃপ্ত হয় না, শান্ত হয় না , যখন কেউ ভালোবাসে, সে আরো ভালোবাসে । তোমাকে যত বেশি ভালোবাসতে থাকব, তাকেও তত বেশি ভালবাসা আমার উচিত হবে । যত কম তাকে ভালোবাসব, হয়তো ততটাই কম আমি তোমাকে ভালোবাসব ।
কাটাকুটির যুক্তি, যা আমাকে সেই সিদ্ধান্তে নিয়ে যায় যেখানে আমি যেতে চাই না । কিন্তু আমি যদি না চাইতাম, তা হলে নিজেকে এভাবে কোণঠাসা হতে দিতাম ?
যখন এই লম্বা চিঠিটা শুরু করেছিলাম, তখন ভেবেছিলাম যে এর আকর্ষণ হবে জোয়ারের মত, যেভাবে দুই কূলে আছাড় খাওয়া ঢেউয়ের নিচে এবং উপরে চাঁদের অবিরত আকর্ষণ থাকে, সেইভাবে আমাদের মধ্যে রক্তের আকর্ষণ, মায়ের প্রতি মেয়ের, নারীর প্রতি নারীর । কিন্তু প্রতিদিন যত আমি নতুন কথা যোগ করছি, চিঠিটা হয়ে উঠছে আরো ভাবময়, আরো ভাববাদিতায় পূর্ণ, যেন তারাদের দেশ থেকে, মহাশূন্য থেকে, লেখা, অবয়বহীন, স্ফটিকস্বচ্ছ, রক্তহীন । আমার ভালবাসার পরিণতি ও কি এইরকম ?
আমার মনে আছে, ছেলেটি যখন আহত হয়েছিল, কি প্রচুর রক্ত, কি রূঢ়ভাবে তার শরীর থেকে নির্গত হচ্ছিল । সেই তুলনায়, এই কাগজের উপর আমার রক্তক্ষরণ কত পাতলা । একটা গুটিয়ে যাওয়া হৃদয়ের ফসল ।
আমি জানি, রক্ত সম্পর্কে আমি আগেও লিখেছি । আমি সব কিছু সম্পর্কেই লিখে ফেলেছি , আমার লেখা নিঃশেষ । রক্ত শুকিয়ে গেছে, তবুও আমি চলছি । এই চিঠিটা যেন একটা গোলকধাঁধা, আর আমি এই গোলকধাঁধায় একটা কুকুর, যে সব শাখা এবং সুড়ঙ্গে ঢুকছে, আঁচড়াচ্ছে, এবং কুঁই কুঁই করছে, একই পুরোনো জায়গায়, বারবার ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হচ্ছে, শ্রান্ত হচ্ছে । আমি কেন সাহায্যের জন্য ঈশ্বরকে ডাকি না ? কারণ ঈশ্বরও আমাকে সহায়তা করতে পারেননা । ঈশ্বর আমাকে খুঁজছেন, কিন্তু আমাকে পাচ্ছেন না । ঈশ্বর এই গোলকধাঁধায় আরেকটা কুকুর । আমি ঈশ্বরের গন্ধ পাচ্ছি, ঈশ্বর আমার গন্ধ পাচ্ছেন । আমি গরমওঠা কুক্কুরী, ঈশ্বর পুরুষ কুকুর । ঈশ্বর আমার গন্ধ পাচ্ছেন, আমাকে কিভাবে খুঁজে বের করবেন এবং নিয়ে যাবেন, সেই কথাটাই শুধু ভাবছেন । গোলকধাঁধার শাখাগুলোতে উপরে নিচে তিনি ঘুরে মরছেন, গোলকধাঁধার গায়ে আঁচড়াচ্ছেন, কিন্তু আমি যেমন হারিয়ে গেছি, তিনিও তেমনি হারিয়ে গেছেন ।
আমি স্বপ্ন দেখি, কিন্তু সন্দেহ আছে ঈশ্বরকে স্বপ্ন দেখি কিনা । আমি যখন ঘুমিয়ে পড়ি, আমার চোখের পাতার পেছনে অবয়বহীন, গঠনহীন, ধূসর অথবা বাদামি কুয়াশায় ঢাকা গন্ধকের গন্ধজড়ানো আকৃতিরা অস্থিরভাবে চলতে শুরু করে । ঘুমের মধ্যে যে শব্দটা আমার মনে আসে তা হল ‘বোরোদিনো’*: রাশিয়ার সমভূমিতে একটা গরমের গ্রীষ্মকালের বিকাল, চারদিকে ধোঁয়া, ঘাসগুলো শুকনো, এবং জ্বলন্ত, দুটো সেনাবাহিনী যারা নিজেদের মধ্যে সব সংযোগ হারিয়েছে, পিপাসায় শুষ্ক তালু, অনির্দিষ্টভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে । হাজার হাজার মানুষ, মুখহীন, স্বরহীন, হাড়ের মত শুকনো, বধ্যভূমির ফাঁদে পড়া মানুষ, সেই পোড়ানো জমির গন্ধক এবং রক্তের গন্ধের মধ্যে একবার সামনের দিকে, একবার পেছনের দিকে মার্চ করছে । যখনি চোখ বুজি, এই নরকে আমি ডুবতে থাকি ।
আমি অনেকটাই বুঝে গেছি যে এই লাল পিল ‘ডিকনেল’ই আমার ভেতরে এই সেনাবাহিনী আনার জন্য দায়ী । কিন্তু পিলগুলো ছাড়া তো আমার ঘুম আসবে না ।
বোরোদিনো, ডিকোনেল : আমি শব্দগুলোর দিকে তাকাই । এগুলো কি অ্যানাগ্রাম* ? এদের দেখতে অ্যানাগ্রামের মত । কিন্তু কীজন্য ? এবং কোন ভাষাতে ?
যখন আমি এই বোরোদিনোর স্বপ্ন দেখা ঘুম থেকে জাগি, তখন আমি হয়তো কাউকে ডাকছি, কাঁদছি, অথবা বুকের নিচের গভীর থেকে শব্দ আসা কাশি কাশছি । তারপর আমি চুপ করি এবং শুয়ে শুয়ে আমার চারপাশে তাকাই । আমার ঘর, আমার বাড়ি আমার জীবন এতটাই আমার সঙ্গে সম্পৃক্ত যে তার আর অনুকৃতি হবে না । মোদ্দা কথা, আমি আবার ফিরে আসি । আমি বারেবারেই চলে আসি, যেন একটা  তিমিতে গিলে ফেলে ওর পেটের ভেতর থেকে আমাকে উগরে দিয়েছে । প্রতিবারেই জাদু ঘটে: কোনো বিজ্ঞপ্তি ছাড়া, কোনো  উদযাপন ছাড়া, অভিনন্দন ছাড়া । সকালের পর সকাল আমাকে উগরে সাগরতটে ফেলা হয়, আরেকবার সুযোগ দেওয়া হয় । আর আমি তা দিয়ে কি করি ? বালুর উপর নিশ্চল শুয়ে অপেক্ষা করে থাকি যাতে রাতের জোয়ার এসে আমাকে ঘিরে ফেলে, আমাকে আবার অন্ধকারের পেটে নিয়ে যায় । ঠিকঠাক জন্মই হয় নি : এক ত্রিশঙ্কু জীব, যে জলে শ্বাস নিতে পারেনা, আবার সাগর ছেড়ে ডাঙ্গায় বসবাস করার সাহসও নেই ।  
তোমার যাবার দিনে এয়ারপোর্টে তুমি আমায় শক্ত করে ধরেছিলে, আমার চোখে চোখ রেখে তাকিয়েছিলে । তুমি বলেছিলে, “আমাকে আর ফিরতে ডেকো না, মা । কারণ আমি আর ফিরব না ।”   তারপর তুমি তোমার পা থেকে এদেশের ধুলো ঝেড়ে ফেলেছিলে ।  তুমি ঠিকই করেছিলে । তা সত্ত্বেও, আমার একটা সত্ত্বা সবসময়ই সজাগ থাকে, সবসময়ই উত্তরপূর্বদিকে তাকিয়ে থাকে, বড় ইচ্ছা করে তোমাকে স্বাগত জানাতে, তোমাকে জড়িয়ে ধরতে, যদি তুমি একটু নমনীয় হও, যেমনভাবেই হোক না কেন, আমাকে দেখতে আস । তোমার সেই দৃঢ় পণের মধ্যে যেমন প্রশংসনীয়তা আছে, তেমনি আছে ভয়ঙ্করতা ; তুমি যেসব চিঠি আমাকে লেখ----আমি খোলাখুলিই বলছি----তাতে খুব বেশি ভালবাসা নেই, অথবা অন্তত: সেই পরিমাণ ভালোবাসার আত্মসমর্পণ নেই যা জীবনের প্রতি ভালোবাসা আনতে পারে । স্নেহপ্রবণ, দয়ালু, এমন কি অগোপন, আমার জন্য উদ্বিগ্ন, তবুও তারা একজন যেন অপরিচিত, দূরে সরে যাওয়া কারো লেখা চিঠি ।
এটা কি দোষারোপ ? না । কিন্তু এটা তিরস্কার, অন্তরের তিরস্কার । আর এই লম্বা চিঠিটা ----আমি এখন বলি----রাত্রে ফেরার আহ্বান, উত্তরপূর্ব দিক থেকে তোমাকে আমার কাছে ফেরার আহ্বান । এসো, এবং আমার কোলে তোমার মাথা গুঁজে দাও, যেভাবে একটা শিশু করে, যেভাবে তুমি আগে করতে, তোমার নাক, একটা গন্ধমূষিক যেমন করে গর্তের মধ্যে ঢোকে, তেমনি করে সেই স্থানটা খুঁজত যেখান থেকে তুমি এসেছিলে । চিঠিটা বলে, “এসো, আমার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করো না ।” আমার তৃতীয় কথা ।
তুমি যদি বলতে তুমি আমার পেট থেকে এসেছ, তাহলে আমাকে বলতে হত না আমি তিমির পেট থেকে এসেছি ।
আমি আমার সন্তান ছাড়া বাঁচতে পারি না । আমি সন্তান ছাড়া মরতে পারি না ।
তোমার অনুপস্থিতে আমি গর্ভে বেদনা ধারণ করি । আমি বেদনা প্রসব করি । তুমি আমার বেদনা ।
এটা কি দোষারোপ ? হ্যাঁ । আমি দোষারোপ করি । আমি তোমাকে দোষারোপ করি আমাকে ত্যাগ করার জন্য । আমি এই দোষারোপ উত্তরপূর্ব দিকে নিক্ষেপ করি বাতাসের দাঁতে করে । আমি আমার বেদনা তোমাকে নিক্ষেপ করি ।
বোরোদিনো : ‘ফিরে এসো’ কথাটার অ্যানাগ্রাম, তা যে ভাষাই হোক না কেন । ডিকোনেল : ‘আমি ডাকছি’-এর অ্যানাগ্রাম ।
তিমির পেট থেকে  কুৎসিত- অবয়ব, রহস্যময়, কথাগুলো বমির মত বেরিয়ে আসছে । হায় মেয়ে !


কোন মন্তব্য নেই: