(দেশভাগ
এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস
ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার
প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে
ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই
উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই
উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার উনবিংশ অধ্যায় ---সুব্রতা মজুমদার।)
বিপদ মানুষকে একত্রিত করে, ভেদ ভাবনায় শত্রুতায় সামতিক বিরতি দেয় । বন্যার কবল থেকে বেরিয়ে গেলে সিলেট আবার উতপ্ত হয় । শ্রীমঙ্গল স্টেশনে এতবড় একটা ঘটনা ঘটে যায় । অনেক মানুষের মৃত্যু । তবে ভাটির দেশে বন্যার জল গেলেও জল থাকে । বৈতলও লুলাকে পেয়ে অন্য ভাবনায় মাতে । লুলাকে নিয়ে যাবে এবার বাড়ি, কোনও কথা শুনবে না । শুনলে মার কিরা দেবে
। বইয়াখাউরি ছাড়া বৈতলের আছেই বা কী । মানুষ নিয়ে বড় আতান্তর । নানা জনে নানা কথা কয় । সদর সিলেট থেকেই সব গুজব ছড়ায় । শুনা যাচ্ছে বন্দরবাজার থেকে সব মাড়োয়ারি ভাগছে । শ্রীমঙ্গল থেকে প্রতিরোধ আসছে জোর, চাবাগানের সব শ্রমিক মদেশিয়া হিন্দু, সাহেব মালিক রাও প্রথমে মাড়োয়ারির কোম্পানির কাছে বিক্রি করার কথা ঠিক করেও আদমজীকে দেবে এখন । মৌলভী বাজার কুলাউড়া নিয়েও সংশয় । জল্লার পার সিলেটের অনন্ত সাধু খুব ছুটছেন এদিক থেকে ওদিক, জোরালো বক্তৃতা দিচ্ছেন সিলেটভাগের বিপক্ষে । বলেছেন, দেশভাগ মেনে নিয়েছে মানুষ । সিলেট কেন । সিলেট তো আর বাংলায় নয় । লুলাও ইদানীং রাজনীতি করছে খুব । বলে, --- সিলেটও অইছে বাংলার মতো । বান্দরর রুটি । আসামো থাকলে প্রধানমন্ত্রী অইব বাঙালি । আসামি হকলেউ চাইরা না, গোপিনাথ বরদলইর ডর লাগি গেছে, এর লাগি গণভোট করি দিলাইলা পাকিস্তানো । হিন্দু হকলে ইতা চাল বুঝছইন না । বৈতল জানে রাজনীতি করে সে পারবে না । বোঝেও না । লুলার রাজনীতি আর ধর্মনীতির কথা শুনে তাই রাগে । সেন বাড়ির ডাকাতির পর আবার দোস্তি ফিরে এসেছে । আবার খুনসুটি শুরু করেছে, লাথি কিল চড় সব চালিয়ে যাচ্ছে যেমন করেছে মিরতিঙ্গার পাহাড়ে । বৈতলের মার খেয়ে কোনোদিন পাল্টা মারে নি লুলা । লুলার কাছে বন্ধুর অধিকার একএকজনের কাছে একএক রকম । বৈতল ওকে খুব মারে, যখন তখন মারে, বৈতল জানে লুলাকে মারতে মারতেই ওর কাছে নিয়ে যাবে । না হলে ঐ কুতুব-এর মতো সাথীরা দখল করে নেবে । এখন লুলা ছাড়া দুনিয়ার শাসন করার মানুষ নেই বৈতলের । ভালোমন্দ বিচার করার কেউ নেই । চাঁপার বরণ মেয়েটির গায়ে হাত দিয়ে যে অপরাধ করেছিল বৈতল, লুলার কাছে স্বীকার করে । লুলা বলে,
--- তুইন গুনাগার ওই গেলে দোস্ত ।
চায়নার কথা বলায়ও একই কথা বলেছে । বলেছে,
--- তুইন কিতা চাছ ক চাইন । পেয়ার মোহাব্বত ইতাও তো লাগে । তে কেনে তাইর লগে গপ করতে । ইতা উতা কেনে কিনি দিতে বিয়ানিবাজার থাকি ।
কী জবাব দেবে বৈতল । বোকার মতো বলে,
--- দিতাম আরি ।
লুলাই প্রথম আসল জায়গায় মোচড় দেয় । বলে,
--- ছুক্রি ইগু কালা নি বে ।
--- একদম তসলার তলর রং ।
--- অউ বুঝছি, হউ পুড়ি ইগু তোর মনো পড়ি রইছে । সিলেটি ইগুরে ভুলতে পাররে না । খুব সুন্দর নানি, বাবুর বাড়ির পুড়ি । তুইন কিতা দেখচছ নি নিজরে, কালা তো কালা বেটা ধ্বজভঙ্গ । তর তো মুছও নাই ।
--- হিতো তরও নাই । খালি এক গাছা ছাগলা থুতার তলে ।
--- আমি পুড়িন্তর লগে এর লাগি একেবারেউ মিশি না । আমার ভালা লাগে না ।
--- আমি অখন কিতা করতাম ক । যাইতাম গিনি আবার পঞ্চখণ্ডত ।
--- একবার গুনা করচছ, করি লাইচছ, অখন দেখবেনে তরে চিনত নায় ।
--- তোর ইতা গুনা উনা ভাল লাগে না । সব কিচ্চুত তুই গুনা দেখছ । এক কথাউ হিকচছ ।
--- আল্লার দুনিয়াত নেকি করণ লাগে ।
--- ফালাই থ তোর নেকি । চুরর মুখো রামনাম ।
সময় আস্থির হলেও বৈতল তার মতো থাকে । বৈতলের কর্মকাণ্ড বেড়ে যায় । ওর এখন দুই সংসার । সে আর তার বন্ধু লুলা । দুই বন্ধুতে বড় হাওরে জাল ফেলে মাছ ধরে । চুরি ডাকাতি দিন গুজরান হয় । লুলা কবির শোনায় বৈতলকে । বৈতল বলে তার ফিঙে পাখি নিয়ে কবি গান লিখতে । লুলা বলে,
--- কে হুনব । আমার কবি শুনে খালি মুসলমানে ।
--- তে এক কাম কর, আমারেও বাঙাল বানাইলা । হাসিনা তো আছেউ ।
--- আসল ইগু তো হাসিনা নায় । নাম জানি কিতা কইছলে ।
--- বুড়ি । ইতো ডাকনাম, ভালা নাম কিচ্ছু আছে একটা, খুব ভালা ।
--- অইব, লেখমু । তার নামেউ লেখমু । বুড়ি চলত নায়, কাননবালা দিলাইমু, আর তুই বৈতল অউ ।
--- ধুর বেটা কবিত কুনু নাম বৈতল হয় নি । বৈতলতো গাইল । হালার হালা বাপে রাখছিল, গাইল্লাইবার লাগি । মায় ডাকছে না কুনুদিন । এক কাম করিছ, দাড়িয়াপাড়ার পুড়ির নাম রাখি দিছ চামেলি ।
মালীর ভিটার গিরিবাবাও এখন বৈতলকে চোখে হারায় । কালীমন্দিরে এখন এক নতুন হাওয়া এসে গেছে । এখন আর জাতধর্ম নিয়ে খুব কড়াকড়ি নেই । বৈতল যায় সঙ্গে লুলাও যায় । রুল আমিন বেজও স্বনামে মন্দিরের প্রসাদ পায় । বাবাজিও রাজনীতির আঁচ নিতে দুই যুবকের সঙ্গে মন বিনিময় করেন । গণভোট শেষ, সিলেট- চলো আন্দোলনও শেষ । কুঁড়েঘর প্রতীক হেরে যায়, পাকিস্তান পন্থী কুড়াল এর জয় হয় । শ্রীমঙ্গল কমলগঞ্জ বড়লেখা কুলাউড়া আসামে থাকবে না, না পাকিস্তান যাবে স্থির হয়নি । কংগ্রেসি মন্ত্রী বসন্ত দাস কিংবা অনন্ত সাধুর মতো নেতাদের বক্তব্যের তেজ কমে যায় ফল বেরোনোর আগেই । পাকিস্তানপন্থী মতিন চৌধুরী মনোয়ার আলি মৌলানা ভাসানী ও ময়নূল হক চৌধুরীদের দাপট বাড়ে । অনন্ত সাধু আর প্রকাশ্যে বক্তৃতা করার সাহস পান না । গিরিবাবার মনেও সংশয় । আশার আলো কোথাও নেই । বলেন,
--- গণভোট অইছে, তে কিতা অইছে । এক মাসের ভিতরে সব ঠিক করা যাইব নি কুনু । পনর আগস্ট ভাগাভাগি অইব, এর মাঝে ঠিক করা যাইব নি । দিল্লীত প্যাটেলে কইছইন রাস্তা তো দেওন লাগব, কিছু থানার অদলবদল অইব । রেডক্লিফ সাহেবে অখন যেতা কইবা অইব । নেহেরুয়েও কইছইন এক কথা । মন্ত্রীসভা বইলে সব অইব । ইতা কিলাখান থম মারি বই রইছে ।
হিন্দুস্থান পাকিস্তানের গরমাগরম চলছেই । অসন্তোষ বাড়ছে মানুষের মনে । নিজে যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানে হিন্দু পাটনিদের গলার আওয়াজ বাড়ে । নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে,
--- কোন বেটায় খেদাইত । অউক না দেখি একবার ‘কুড়াল’ আলা, রামদা ঘষিয়া রাখছি, কল্লা উড়াই দিমু ।
কিন্তু মনের ভিতর সে-বল কোথাও নেই । জাদুকরের ভেল্কিবাজির মতো রাতারাতি পাল্টে যাচ্ছে মতটা । সে লোকটা আগের দিন বলেছে ভিটে ছাড়বে না । পরদিন সকালেই দেখা যাচ্ছে সে হাওয়া । বইয়াখাউরির ভীম পাটনির উপর ভরসা করে অনেক মানুষ । ভীম চলে যেতে সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে । বৈতল রাগে মাটিতে থু থু ছেটায় বলে,
--- হালার হালা নেতা অইয়া ভাগল !
তখন গুজব ছড়ায় আগুনের থেকেও দ্রুত । আর সাহসে ভরসা করা মানুষের মনের আগুন জুড়িয়ে ঠাণ্ডা হয় । অসহায় হয় ।
সিলেটের লিডার অনন্ত সাধু চলে যায় শিলচর ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন