“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ২ জানুয়ারী, ২০১৬

আয়স কাল ১৩



(দক্ষিণ আফ্রিকীয় লেখক জে এম কোয়েটজি-র লেখা 'এজ অব আয়রন'- উপন্যাসের  বাংলা অনুবাদের ৩য় অধ্যায়ের ৩য়   ভাগ: -- শিবানী দে)
(C)Image:ছবি

কটা সুন্দর দিন। শীতকালের সেই রকম দিন যখন মনে হয় আলোর ধারা আকাশের সব দিক থেকেই বইছে । ভারকুয়েইল আমাকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে ব্রেডা স্ট্রিট দিয়ে অরেঞ্জ স্ট্রিটে ঢুকল, গভর্নমেন্ট এভিন্যুতে রাস্তা পেরিয়ে আমি তাকে পার্ক করতে বললাম । 

আমি ভেবেছিলাম এভিন্যুর পুরো ঢালু রাস্তা ধরে গাড়ি চালাব,” আমি বললাম । একবার শেকল পেরিয়ে গেলে, দেখছি কেউ আমাকে থামাতে পারবে না । কেউ আমাকে কাটিয়ে যেতে পারবে বলে  ভাব ?” 

(তোমার হয়তো মনে পড়বে, এভিন্যু-এর মাথায় দুটো লোহার খুঁটি আছে, তাদের মধ্যে একটা শিকল টাঙ্গানো ।)

হ্যাঁ কেউ পাশ কাটিয়ে যেতে পারে ।তারপর গাড়িটাকে শুধু সোজা চালালেই হবে ।

তুমি কি সত্যিই এই কাজটা করতে যাচ্ছ ?” সে শুধোল । তার মুরগির মত চোখদুটো নিষ্ঠুরভাবে ঝিলিক দিয়ে উঠল ।

যদি সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারি

কিন্তু কেন ? কিসের জন্য ?”

সেই ধারালো, কঠিন দৃষ্টির জবাব দিতে পারলাম না । আমি চোখ বুজলাম, এবং মনে মনে চিন্তা করার চেষ্টা করতে থাকলাম, অতি দ্রুতগতিতে ধাবমান গাড়ি গতির বাতাসে ভেতরের আগুনের শিখাকে পেছনে ঠেলে দিচ্ছে, বাঁধানো রাস্তার ঢাল বেয়ে, পেভমেণ্টে টুরিস্ট, রাস্তার ছেলে, প্রেমিকযুগলদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে, মিউজিয়ম, আর্ট গ্যালারি, বোটানিক্যাল গার্ডেন ছাড়িয়ে যতক্ষণ না বাড়ির সামনে লজ্জায় জ্বলন্ত, গলে যাবার মত হয়ে থামল ।

আমরা আবার ফিরে যেতে পারি,” আমি বললাম, “আমি শুধু নিশ্চিত হতে চাইছিলাম যে এটা করা যেতে পারে ।
সে ভেতরে এল এবং আমি তাকে চা দিলাম । কুকুরটা তার পায়ের কাছে বসল, আমরা যখন কথা বলছিলাম, ও তার কান আমাদের দিকে পরপর ঘোরাচ্ছিল । ভাল কুকুরটা : উজ্জ্বল উপস্থিতি, শুভযোগে জন্মানো কিছু মানুষ যেমন হয়ে থাকে ।

তোমার প্রশ্ন ছিল , ‘কিসের জন্য ?’ তার জবাব হল, এটা আমার জীবন নিয়ে । এমন জীবন নিয়ে যার কোনো মূল্য এখন আর নেই । আমি এবার দেখতে চাইছি এর বদলে আমি কি পেতে পারি ।

তার হাত কুকুরটার লোমের  উপর সামনে পেছনে আস্তে আস্তে  চলতে থাকল । কুকুরটা চোখ মিটমিট করল, তারপর বুজল । ভালোবাসা, আমি ভাবলাম: যতই অভাবিত হোক, এটা ভালবাসাই, যা আমি দেখছি ।

আমি আবার চেষ্টা করলাম ।একটা উপন্যাস* আছে যাতে একজন নারীকে অবৈধ যৌনসম্পর্কের জন্য শাস্তি দেওয়া হয়----আগেকার সময়ে অবৈধ যৌন সম্পর্ক শাস্তিযোগ্য অপরাধ ছিল-----শাস্তিটা ছিল তাকে জনসমক্ষে সব সময় ‘A’ অক্ষর সেলাই করা পোশাক পরে যেতে হবে । সে ‘A’ সেলাই করা পোশাক এত বছর থেকে পরতে থাকে যে শেষপর্যন্ত লোকে তার অর্থই ভুলে যায় । তারা ভুলে যায় যে এর কোনো তাৎপর্য আছে । সে যেন একটা আংটি কিংবা ব্রোচের মত ‘A’ অক্ষরটা পরে আছে । এমনও হতে পারে সে-ই হয়তো পোশাকের গায়ে কিছু লেখার ফ্যাশান শুরু করেছিল । তবে বইতে তা নেই

এইসব লোকদেখানো ব্যাপার, এই যে প্রদর্শন----এই গল্পটার মূল কথাই এটা----এসব কিসের জন্য সেই সম্পর্কে কি কেউ নিশ্চিত হতে পারে ? উদাহরণস্বরূপে, এক বুড়ি ভদ্রমহিলা নিজের গায়ে আগুন লাগায় । কেন ? কারণ সে পাগল হয়ে গেছে ? কারণ সে হতাশাগ্রস্ত ? আমি ভেবেছিলাম, কথাটা ব্যাখ্যা করার জন্য একটা অক্ষর গাড়িটার উপর লিখে দেব । কিন্তু কি? A ? B? C ? আমার ক্ষেত্রে অর্থপূর্ণ অক্ষর কোনটি ? আর ব্যাখ্যা করেই বা কি হবে ? এটা তো আমারই ব্যাপার, আর কারো তো নয় ?”

আমি হয়তো আর বলতে থাকতাম, কিন্তু সেই মুহূর্তে গেটের হুড়কো খোলার শব্দ হল, আর কুকুরটা গোঁ গোঁ করতে লাগল । দুজন মহিলা, যাদের একজনকে আমি ফ্লোরেন্সের বোন বলে চিনতে পারলাম, দুটো স্যুটকেস নিয়ে আসছিল ।

বোন বলল, “শুভ অপরাহ্ণ ।সে একটা চাবি দেখাল । আমরা আমার বোন ফ্লোরেন্সের জিনিষপত্র নিয়ে যেতে এসেছি ।

হ্যাঁ”, আমি বললাম ।

ওরা নিজেরাই ফ্লোরেন্সের ঘরে ঢুকল । কিছুক্ষণ পর আমি সেখানে গেলাম । জিগ্যেস করলাম, “ফ্লোরেন্স ভাল আছে তো ?”
বোন একটা ড্রয়ার খুলে জিনিষপত্র বের করছিল । কথাটা শুনে সোজা দাঁড়াল, ভারি শ্বাস ফেলল । স্পষ্টত: সে এই বোকা বোকা প্রশ্ন শুনে মনে মনে হাসছিল ।

না, আমি বলতে পারিনা যে সে ভাল আছে,” সে বলল, “মোটেই ভাল নয় । সে কিভাবে ভাল থাকতে পারে ?” (‘ভালকথাটার উপর জোর দিয়ে সে আমাকে উপহাস করছিল ।)

অন্য মহিলাটি ভান করছিল যেন কিছু শোনে নি, বাচ্চার কাপড়গুলো ভাঁজ করছিল । দুটো স্যুটকেসে যা ধরে তার চাইতে অনেক বেশি মালপত্র ঘরে ছিল । 

আমি বললাম, “আমি ঠিক তা বোঝাই নি । কিছু মনে করোনা । ফ্লোরেন্সের জন্য কিছু দিতে চাই, তোমাদের কি তা নিয়ে যেতে অনুরোধ করতে পারি ?”

হ্যাঁ, যদি সেটা বেশি বড় না হয়, তাহলে নিয়ে যেতে পারি ।

আমি একটা চেক লিখে দিলাম ।

ফ্লোরেন্সকে বলো যে আমি দুঃখিত ওকে বলো যে আমি যতটুকু বলতে পারছি, তার চাইতে অনেক বেশি দুঃখিত । আমার ভেকির কথা সব সময়ই মনে পড়ে ।

তুমি দুঃখিত ?”

হ্যাঁ ।


আরেকটা পরিষ্কার আকাশের দিন । ভারকুয়েইল অদ্ভুতভাবে উত্তেজিত । সে জিগ্যেস করল, “তাহলে আজকেই সেই দিন ?”  তার অভদ্র ঔৎসুক্যের কারণে মুখ শক্ত রেখে আমি জবাব দিলাম,“হ্যাঁ”, আর প্রায় বলতেই যাচ্ছিলাম, “তাতে তোমার কি ?”

হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম, আজকেই সেই দিন । তবুও আজকে কেটে গেল এবং আমি যে কথা দিয়েছিলাম, তা রাখতে গেলাম না । যতক্ষণ পর্যন্ত শব্দের পিঠে শব্দ চলতে থাকবে, তুমি নিশ্চিত ভাবে জানবে যে আমি ওই ব্যাপারটার মধ্য দিয়ে যাইনি : একটা নিয়ম, একটা অন্যতম নিয়ম । লেখার সর্বশেষ প্রধান শত্রু মৃত্যু হতে পারে, কিন্তু লেখাও মৃত্যুর শত্রু । অতএব, লিখতে গিয়ে, মৃত্যুকে অন্তত: হাতের দূরত্বে রেখে, আমি তোমাকে বলছি যে আমি আরম্ভ ও করেছিলাম, কিন্তু তার মধ্য দিয়ে যাই নি । আমি তোমাকে আরো কিছু বলছি । আমি বলছি যে আমি স্নান করলাম । আমি তোমাকে বলছি যে আমি পোশাক পরলাম। আমি তোমাকে বলছি যে আমার শরীরকে যখন প্রস্তুত করলাম, একটা সামান্য গর্বের আভাও যেন ফিরে এলো । বিছানায় শ্বাস বন্ধ হওয়া এবং নিজেই নিজের অন্তকে নিয়ে আসার জন্য যাওয়া----- দুটোর মধ্যে কত ফারাক ।

এটা কি সত্য যে আমি সেই প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে যেতে চাইছিলাম ? হ্যাঁ । না । হ্যাঁ-না : প্রত্যেক নারী জানে এর মানে, কারণ এটা প্রত্যেক পুরুষকে পরাজিত করে । ভারকুয়েইল জিগ্যেস করেছিল, “তুমি এটা করতে যাচ্ছ ?” তার পুরুষ-চোখ জ্বলজ্বল করছিল, আমার জবাব হওয়া উচিত ছিল : হ্যাঁ-না ।

আমি নীল ও সাদা পোশাক পরলাম । একটা হালকা নীল স্যুট, একটা সাদা ব্লাউজ, গলায় একটা বো । আমার মুখে সাবধানে একটু প্রসাধন করলাম, চুল ঠিক করলাম । যতক্ষণ পর্যন্ত আয়নার সামনে ছিলাম, আমি অল্প অল্প কাঁপছিলাম । কোনো ব্যথা অনুভব করছিলাম না । কাঁকড়াটা ও চাঁচতে থাকা বন্ধ করেছিল । 

কৌতূহলে ঝলমল করে ভারকুয়েইল আমাকে রান্নাঘর অবধি অনুসরণ করল এবং যখন আমি প্রাতরাশ সারছিলাম, তখনও ওত পেতে বসে রইল । শেষ পর্যন্ত বিরক্তিতে অস্থির হয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, “তুমি কি আমাকে একা থাকতে দেবে না ?” তাতে সে একটা ধমক খাওয়া বাচ্চার মত মুখ করে চলে যেতে চাইছিল, আমি তার জামার হাতা ধরে থামালাম । বললাম, “আমি ওভাবে বলতে চাই নি । দয়া করে বস । যখন আমার শান্তি চাই, তখন তুমি আমাকে ঘাবড়ে দাও । আমি সামনে পেছনে দোদুল্যমান হয়ে যাই। এক সময় আমি ভাবি, এই অসার জীবন তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলি । পর মুহূর্তে ভাবি, আমি নিজেকে কেন দুষছি ? আমাকে কেন আমার সময়ের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে ? আমার সমকাল যে এত লজ্জাজনক হয়েছে, এতে কি আমার কোনো হাত আছে ? আমি বয়স্ক, অসুস্থ, ব্যথাগ্রস্ত, এই দুর্দশার গর্ত থেকে কোনো সহায়তা ছাড়াই নিজেকে উঠানোর দায় কেন আমারই উপর বর্তাবে ?

যারা এই দুঃসময়ের সৃষ্টি করেছে, আমি তাদের বিরুদ্ধে জ্বলে উঠতে চাই । ইঁদুর কিংবা আরশোলা একটুও না খেয়েই যেমন করে খাবার নষ্ট করে ফেলে-----খাবারের উপর দিয়ে চলে গিয়ে, শুঁকে, তার উপর শারীরিক কর্ম করে, তেমনি ভাবে যারা আমার জীবনটাকে নষ্ট করে ফেলেছে, তাদের দিকে আমার অভিযোগের অঙ্গুলি তুলতে চাই । অবশ্যই এটা শিশুসুলভ, আমি জানি, এই অন্যদের দিকে আঙ্গুল তোলা ও দোষারোপ করা । কিন্তু এই দেশে যেই ক্ষমতায়  থাকুক না কেন, আমার জীবন তাদের জন্য অসার হয়ে যাবে----এটা আমি কেন মেনে নেব ? ক্ষমতা সর্বোপরি ক্ষমতাই । তা আক্রমণ করে । এটাই তার ধর্ম । তা মানুষের জীবনকে আক্রমণ করে ।

তুমি জানতে চাও আমার ব্যাপার কি, এবং আমি তোমাকে বলতে চেষ্টা করছিআমি আমাকে বিক্রয় করে নিজেকে উদ্ধার করতে চাই, কিন্তু কি করে তা করব তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত বুঝতে পারছ কিনা জানিনা, এই পাগলামোই আমাকে পেয়ে বসেছে । তোমার আশ্চর্য হবার দরকার নেইতুমি এই দেশকে জান । এখানকার বাতাসেই পাগলামো আছে
আমার পুরো বক্তৃতার মধ্যে ভারকুয়েইল  একই ভাবে কঠিন, লুকোনো, সরু দৃষ্টিতে দেখছিল । এখন সে একটা অদ্ভুত কথা বলল, “তুমি কি গাড়িতে করে বেড়াতে যেতে চাও ?”

আমরা গাড়ি নিয়ে বেড়াতে যেতে পারি না, মিঃ ভারকুয়েইল, কেন যাওয়া যাবে না তার হাজারটা কারণ আছে

আমরা একটু দৃশ্য দেখতে দেখতে যেতে পারি, বারোটার মধ্যে ফিরে আসব ।

আমরা উইন্ডস্ক্রিনে গর্ত থাকা একটা গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারি নাএটা হাস্যকর ব্যাপার ।

আমি উইণ্ডস্ক্রিনটাই খুলে দেব এটা তো শুধু কাচই, না হলেও চলে ।

আমি কেন রাজি হলাম ? হয়তো এই যে নতুন মনোযোগ সে আমাকে দিচ্ছিল, তাতেই সে আমার মন জিতে নিয়েছিল । সে ছিল একটা বালকের মত, যার উত্তেজনা, যৌন উত্তেজনা হয়েছে, আর আমিই তার লক্ষ্যবস্তু । আত্মতুষ্টি বোধ করলাম, সব কিছুর পরও একটু দূরগতভাবে মজা ও লাগছিল । একটা কুকুর মাটিতে অগভীর ভাবে পোঁতা পচা মাংস খুঁড়তে গিয়ে উত্তেজিত হবার মধ্যে যে অরুচিকর ব্যাপার থাকে, এরকম একটা অস্পষ্ট অরুচিকর ভাবও আমি অনুভব করছিলাম । কিন্তু আমার কোনো গণ্ডি টানার ইচ্ছে ছিল না । আসলে আমি কি চেয়েছিলাম ? আমি চেয়েছিলাম নিরালম্ব হতে, চিন্তাহীন, ব্যথাহীন, সন্দেহহীন, আশঙ্কাহীন নিরালম্ব, যতক্ষণ না দুপুর আসে । যতক্ষণ না সিগন্যাল পাহাড়ের উপর ঠিক দুপুরে কামান গর্জন করে ওঠে, এবং সিটের পাশে এক বোতল পেট্রল নিয়ে আমি এভিন্যু রোডের টাঙ্গানো শেকল পেরিয়ে ঢালের রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে যাই বা না যাই । কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত আমি চিন্তাশূন্য থাকতে চাই, পাখির গান শুতে চাই, ত্বকের উপর বাতাসের স্পর্শ পেতে চাই, আকাশ দেখতে চাই, বাঁচতে চাই ।

তাই আমি রাজি হলাম । ভারকুয়েইল হাতে একটা তোয়ালে জড়িয়ে ভাঙ্গা কাচগুলো তুলে ফেলতে থাকল । আর গর্তটা একটা বাচ্চা ঢোকার মত বড় হয়ে গেল । আমি তাকে চাবিটা দিলাম । একটা ধাক্কা, আর আমরা বেরিয়ে পড়লাম
যেভাবে প্রেমিকযুগল তাদের প্রথম স্বীকারোক্তির দৃশ্যপট আবার ফিরে দেখতে যায়, আমরাও ম্যুইজেনবার্গের উপরের পাহাড়তলির রাস্তা নিলাম । (প্রেমিকযুগল! আমি ও ভারকুয়েইল কি কখনো কিছু স্বীকারোক্তি করেছিলাম ? যে সে মদখাওয়া ছাড়বে ? সে কি কিছু স্বীকারোক্তি করেছে আমার কাছে ? কিছুই না, বোধ হয় তার আসল নামটিও নয় ।) আমরা সেই আগের জায়গাটাতে গাড়ি থামালাম । এখন এইসব দৃশ্য শেষ বারের মত উপভোগ কর, আমি নিজেকে বললাম, হাতের তেলোর মধ্যে নখ ডুবিয়ে ফল্‌স বে-দিকে, ফল্‌স বে, যার মানে মিথ্যে আশার উপসাগর, এবং দক্ষিণ দিকে সব চেয়ে অবহেলিত মহাসাগরের শূন্য শীতল জলের দিকে তাকিয়ে ।

আমি আস্তে আস্তে বললাম, “আমাদের যদি একটা নৌকো থাকত, তাহলে তুমি আমাকে নিয়ে সমুদ্রে যেতে পারতে ।
দক্ষিণমুখো : ভারকুয়েইল এবং আমি একা, পাল তুলে সেই অক্ষাংশ পর্যন্ত যাচ্ছি যেখানে অ্যাল্‌বাট্রস পাখি ওড়ে, সেখানে সে আমাকে একটা ব্যারেল কিংবা তক্তার উপর চড়িয়ে সেই বড় বড় সাদা পাখার নিচে ঢেউয়ের উপর টলমল করতে ছেড়ে দিতে পারে ।

ভারকুয়েইল রাস্তায় একেবারে বদলে গেছে আমার কি ভ্রম, অথবা ইঞ্জিনটা আমার চাইতে তার হাতে বেশি মিষ্টিভাবে কাঁপছিল ? আমি বললাম, “আমি দুঃখিত যদি আমার কথার মানে বুঝতে না পার । আমি যথাসাধ্য আমার লক্ষ্য না হারানোর চেষ্টা করছি । আমি তৎপরতার বোধ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছি । তৎপরতার বোধ আমাকে আস্তে আস্তে ছেড়ে যাচ্ছে । এখানে এই সুন্দর নিসর্গের মধ্যে বসে, অথবা আমার ঘরে ও আমার নিজের জিনিষপত্রের মধ্যে বসে এটা বিশ্বাস করাও সম্ভব হয় না যে আমার চারপাশে হত্যা ও অবনমনের বিস্তৃত ক্ষেত্র । এ যেন একটা দুঃস্বপ্নকিছু একটা আমার ভেতরে চাপ দেয়, খোঁচা দিতে থাকে । আমি খেয়াল না করার চেষ্টা করি, কিন্তু সেটা চলতেই থাকে । আমি এক ইঞ্চি ছাড়ি; সেটা আমাকে আরো জোরে চেপে ধরে । আমি পুরোপুরি ছাড়ি, জীবন হঠাৎই আবার সাধারণ হয়ে যায় । আমি সাধারণত্বের পাঁকে গড়াই । আমার লজ্জাবোধ হারিয়ে যায়, একটা শিশুর মত নির্লজ্জ হয়ে যাই । এই নির্লজ্জতার লজ্জা : এই জিনিষটাই আমি ভুলতে পারি না, এটাই আমি পরে সহ্য করতে পারি না । এই জন্য আমি নিজের রাশ ধরতে চাই, ঢালের পথ দিয়ে গড়িয়ে যেতে চাই । বুঝেছ ?”

ভারকুয়েইল স্টিয়ারিঙয়ের উপর চোখে কম দেখা লোকের মত ঝুঁকে বসেছিল । তার সেই শিকারি পাখির মত চোখ । সে বুঝল কি না, তাতে কি আসে যায় ?

এটা অ্যালকোহল ছাড়ার মত,” আমি নাছোড় বলে চললাম, “চেষ্টা করতে থাকা আর করতে থাকা, সব সময়ই করতে থাকা, কিন্তু তুমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছ যে তুমি আবার আগের জায়গার দিকেই গড়াচ্ছ । এই গোপন বোধে একটা লজ্জা আছে, সেটা এত উষ্ণ, অন্তরঙ্গ, এত সান্ত্বনাদায়ক যে আরো বেশি লজ্জা বন্যার মত তার সাথে চলে আসে । মানুষ কত লজ্জা বোধ করতে পারে তার মনে হয় কোনো সীমা নেই ।

কিন্তু নিজেকে হত্যা করা কত কঠিন! মানুষ জীবনকে কি ভাবেই না আটকে থাকে ! আমার মনে হয় ইচ্ছাশক্তি ছাড়াও অন্য একটা কিছু সেই শেষ সময়টায় কাজ করবেই, অচেনা, অভাবনীয় কিছু যা তোমাকে কিনারার ওধারে ঠেলে দেবে । তোমাকে তুমি ছাড়া আরো কিছু হতে হবে । কিন্তু কে ? কে সে যে তারা ছায়ায় আমার যাবার জন্য অপেক্ষা করে ? তাকে কোথায় পাই ?”

আমার ঘড়িতে দশটা কুড়ি বাজল । আমাদের ফিরে যেতে হবে ,” আমি বললাম ।

ভারকুয়েইল গতি কমাল । বলল, তুমি যদি তা-ই চাও, আমি তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি । অথবা তুমি যদি চাও, আমরা চলতে থাকতেই পারি । আমরা পুরো উপদ্বীপটাই ঘুরে আসতে পারি । আজকে দিনটা ও সুন্দর ।

আমার বলা উচিত ছিল, না, আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো । কিন্তু আমি দ্বিধান্বিত হলাম, আর দ্বিধার মুহূর্তে আমার মুখে কোনো কথা যোগাল না । 

আমি বললাম, “এখানে থামাও ।

ভারকুয়েইল রাস্তা ছেড়ে পার্ক করল ।

আমাকে একটা অনুগ্রহ করতে হবে,” আমি বললাম, “দয়া করে আমাকে উপহাস করোনা ।

এটাই অনুগ্রহ ?”

হ্যাঁ, এখন, ভবিষ্যতেও ।

সে কাঁধ ঝাঁকাল ।

রাস্তার অন্যপাশে একটা ছেঁড়া কাপড় পরা লোক বিক্রি করার জ্বালানি কাঠের স্তূপের পাশে বসেছিল । সে আমাদের দিকে একবার তাকাল, তারপর চোখ ফেরাল ।

সময় পেরোচ্ছিল ।

শেষটায় আমি বললাম, গলায় যথাসম্ভব কোমলতা এনে, “আমি তোমাকে একবার আমার মায়ের গল্প বলেছিলাম । মা যখন ছোট্ট মেয়ে ছিলেন, তখন তিনি বুঝতে পারছিলেন না তাঁর উপর দিয়ে কি গড়িয়ে যাচ্ছে, গাড়ির চাকা না আকাশের তারা ।

আমি সারা জীবন গল্পটা মনে রেখেছি । আমাদের প্রত্যেকেরই যদি নিজেদের বলার মতো একটা গল্প থাকে এই বিষয়ে যে আমরা কে এবং কোত্থেকে এসেছি, তাহলে এটাই আমার গল্প । এই গল্পটাই আমি পছন্দ করেছি, অথবা গল্পটাই আমাকে পছন্দ করে নিয়েছে । আমি সেখান থেকেই এসেছি, ওখানেই আমার শুরু ।

তুমি জিগ্যেস করেছ আমি গাড়িতে চলতে থাকতে চাই কি না । এটা যদি বাস্তবিক সম্ভব হত, তাহলে আমি চাইতাম আমরা গাড়ি নিয়ে পূর্ব অন্তরীপের দিকে গিয়ে প্রিন্স অ্যালফ্রেড গিরিপথের উপরের সবচেয়ে উঁচু অংশ আউটেনিকুয়া পাহাড়ের উপর সেই থামবার জায়গাতে গিয়ে থামি । আমি এমন কি বলতাম, ম্যাপ ছেড়ে দাও, উত্তর এবং পূর্ব দিকে সূর্যের দিক ধরে চল, যখনি সেইখানে পৌঁছাব, আমি ঠিক চিনতে পারব: সেই থামার জায়গা , আরম্ভের স্থান, নাভিবিন্দু, সেই স্থান যেখানে আমি জগতের সহিত যুক্ত হয়েছিলাম । আমাকে সেখানে নামিয়ে দাও, গিরিবর্ত্মের সর্বোচ্চ স্থানে, তারপর চলে যাও, আমি রাত্রির জন্য, তারা এবং ভৌতিক বলদের গাড়িটা আমার উপর দিয়ে গড়িয়ে চলে যাবার জন্য অপেক্ষা করি ।

কিন্তু বাস্তব হল, ম্যাপএর সাহায্য নিয়ে অথবা সাহায্য ছাড়া, আমি জায়গাটা কখনো খুঁজে পাব না । কেন? কারণ একটা বিশেষ ইচ্ছে আমার থেকে চলে গেছে একবছর অথবা একমাস আগেও ব্যাপারটা অন্যরকম হতএকটা ইচ্ছা, সম্ভবত: আমার সর্বশক্তি দিয়ে সবচেয়ে গূঢ় ইচ্ছা আমার ভেতর থেকে প্রবাহিত হয়ে পথ দেখিয়ে পৃথিবীর সেই বিন্দুতে নিয়ে যেত । আমি সেখানে নতজানু হয়ে বসে বলতাম, ‘এই-ই আমার মা । এই-ই আমাকে জীবন দেয় ।পবিত্র ভূমি, কবরের পবিত্রতা নয়, পুনরুত্থানের স্থান হিসেবে পবিত্র । পৃথিবী থেকে শাশ্বত পুনরুত্থান । 

এখন সেই ইচ্ছা, যাকে ভালবাসাও বলা যেতে পারে, আমার থেকে চলে গেছে । আমি এই ভূমিকে আর ভালোবাসি না । এটা এতই সাধারণ কথা । আমি হলাম সেই লোকটির মত যার মুষ্ক ছিন্ন করা হয়েছে, বয়স্ক হবার পর ক্লীবে পরিণত করা হয়েছে যে লোকটাকে এরকম করা হয়েছে, তার কথা আমি ভাববার চেষ্টা করি । আমি কল্পনা করি সে দেখছে আগে কি কি জিনিষ সে ভালবাসত, স্মৃতি থেকে জানতে পারছে কি কি তার ভালবাসা উচিত, কিন্তু ভালোবাসাটাকেই সে আর জাগরিত করতে পারছে না । ভালবাসা : সেটা কি ছিল ? সে হয়তো মনে মনে বলছে, পুরোনো অনুভূতিকে মনে ভাববার চেষ্টা করছে । কিন্তু সব কিছুতেই এখন তার অনুভূতিহীন, শান্ত, নিরুত্তাপ ভাব । সে হয়তো ভাববে, একটা কিছু যা আমার থেকে বিশ্বাসঘাতকতা করে কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তারপর সে গভীর মনঃসংযোগ করার চেষ্টা করবে সেই বিশ্বাসঘাতকতার গভীরতা অনুভব করার জন্য; কিন্তু কোনো গভীর বোধ আসবে না । সব কিছু থেকেই গভীরতা চলে যাবে । তার বদলে সে একটা হাল্‌কা অথচ নিরবচ্ছিন্ন আকর্ষণ অনুভব করবে তন্দ্রাচ্ছন্নতার, নিরাসক্তির প্রতি । নিরাসক্তকথাটা সে মনে মনে বলবে, তীক্ষ্ণ শব্দটি উচ্চারণ করবে, এবং চাইবে তীক্ষ্ণতা অনুভব করতে । কিন্তু এখানেও  সেই অস্পষ্টতা, একটা ধারহীনতা চলে আসবে । সব কিছুতেই ভাঁটার টান, সে ভাববে, হয়তো এক সপ্তাহ, এক মাস লাগবে আমি সব ভুলে যাব । আমি লোটসভোজীদের* দলে পড়ব, বিচ্ছিন্ন, ভাসমান । শেষ বারের জন্য সে সেই বিচ্ছিন্নতার ব্যথা অনুভব করবার চেষ্টা করবে, কিন্তু সব চেষ্টাই তার কাছে একটা চলমান বিষণ্ণতার মত আসবে ।
আমি জানিনা আমি ঠিক বোঝাতে পারছি কি না, মিঃ ভারকুয়েইল । আমি সংকল্পের কথা বলছি, আমার সংকল্প আমি ধরে রাখতে চেষ্টা করছি, এবং অকৃতকার্য হচ্ছি , আমি স্বীকার করছি, আমি ডুবছি । আমি এই তোমার পাশে বসেছি এবং ডুবছি ।

তখন সে তার জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা দেশলাই বাক্স বের করে আমার সামনে ধরল ।এখনই ওটা কর ,” সে বলল ।

কি করব ?”

ওটা ।

তুমি কি তাই চাও ?”

ওটা এখনই কর । আমি গাড়ি থেকে নেমে যাব । এখনই, এখানেই, ওটা কর ।

তার মুখের কোণে থুতুর দলা উপর নিচে নাচছিল । আমি ভাবলাম, ও পাগল হয়ে যাক । ওর সম্পর্কে এই রকম করে বলা সম্ভব হোক : ও যে একটা নিষ্ঠুর পাগল, পাগলা কুকুর ।

সে দেশলাইটা আমার সামনে নাড়াল । তুমি ঐ লোকটার জন্য চিন্তা করছ ?” সে জ্বালানি কাঠ নিয়ে বসা লোকটার দিকে নির্দেশ করল, “ও নাক গলাবে না ।

আমি বললাম, “এখানে নয় ।

আমরা চ্যাপম্যানস পিক-এ যেতে পারি । তুমি তার কিনারা দিয়ে গাড়ি নিয়ে গড়িয়ে যেতে পার, যদি তাই তুমি চাও ।

এ যেন গাড়ির মধ্যে ফাঁদে পড়া , যেখানে কোনো লোক তোমাকে ধর্ষণ করতে চাইছে, আর তুমি আত্মসমর্পণ না করাতে বিরক্ত হচ্ছে । মেয়েবেলার সবচেয়ে খারাপ দিনগুলোর মধ্যে যেন ফিরে আসছি ।

আমরা কি বাড়ি যেতে পারি ?” আমি বললাম । 

আমি ভাবলাম তুমি ওটা করতে চাও

তুমি বুঝতে পারছ না ।

আমি ভেবেছিলাম তুমি রাস্তার ঢালে একটা ধাক্কা চাইছ । আমি সেই ধাক্কাটাই  তোমাকে  দিচ্ছি ।

হাউট বে-তে একটা হোটেলের বাইরে সে গাড়িটা আবার থামাল । বলল, “আমার জন্য কি কিছু টাকা আছে ?”

আমি তাকে একটা দশ র‍্যান্ড নোট দিলাম ।

সে লাইসেন্সহীন মদের দোকানে গেল, ব্রাউন পেপারে মোড়া একটা বোতল হাতে ফিরল । একটু পান কর,” সে বোতলের ছিপি মোচড়ে খুলল ।

না, ধন্যবাদ । আমি ব্র্যান্ডি খাই না ।

এটা ব্র্যান্ডি নয়, এটা ওষুধ

আমি এক চুমুক নিলাম, গিলতে চেষ্টা করলাম, গলায় বেধে গেল, তাই কাশলাম ; আমার দাঁতের পাটি ঢিলে হয়ে গেল ।

তোমার মুখের ভেতর রাখ ।সে বলল ।

আমি আরেক চুমুক নিলাম এবং মুখের মধ্যে রাখলাম । আমার মাড়ি ও তালু যেন জ্বলে গেল, তারপর অসাড় হয়ে গেল । আমি তরলটা গিলে চোখ বুজলাম আমার ভেতরে কিছু একটা উঠতে লাগল : একটা পর্দা, একটা মেঘ । এটাই তাহলে সেটা ? আমি ভাবলাম । এইভাবেই ভারকুয়েইল পথ দেখায় ?

সে গাড়িটাকে ঘোরাল, আবার পাহাড়ের উপর চড়ল, উপসাগরের অনেক উঁচুতে একটা পিকনিক স্পটে গাড়িটা রাখল । সে কিছুটা মদ খেল, তারপর বোতলটা আমাকে দিলআমি সাবধানে খেলাম । যে ধূসরতার আচ্ছাদন সবকিছু ঢেকে দিয়েছিল, তা কমে এল । সন্দেহজনক, অথচ বিস্ময়কর, আমি ভাবলাম : এটা কি এতই সরল, জীবনমৃত্যুর ব্যাপার মোটেই নয় ?

আমি বললাম, “তোমাকে শেষপর্যন্ত বলি, যে ব্যাপারটা আমাকে প্রেরিত করেছিল, তা আমার নিজের অবস্থা, আমার অসুস্থতা ছিল না, বরং সম্পূর্ণ আলাদা কিছু ছিল ।

কুকুরটা মৃদুভাবে অনুযোগ করতে থাকল । ভারকুয়েইল তার মদালস হাতটা বাড়িয়ে দিল । কুকুরটা তার আঙ্গুলগুলো চেটে দিল । 

ফ্লোরেন্সের ছেলেটা মঙ্গলবারে গুলি খেয়ে মরেছে ।

সে মাথা নাড়ল ।

আমি বডি দেখেছি ।আমি আরেক চুমুক খেয়ে ভাবলাম, আমি যদি এখন বকবক করতে থাকি, ভারকুয়েইলও কি কথা বলবে ? সে ও আমি, মদের প্রভাবে ছোট গাড়িটার ভেতর দুজনে বকবক করতে থাকব ?

আমি অত্যন্ত আঘাত পেয়েছিলাম,” আমি বললাম । আমি বলব না দুঃখ পেয়েছিলাম, কারণ আমার ওই শব্দে অধিকার নেই, দুঃখ শব্দটিতে ওর নিজের লোকেদের অধিকার । কিন্তু তবুও, আমি কি বলব ? বিচলিত ? আমার বিচলন সরাসরি তার মৃত ভাবের সঙ্গে, তার মৃত্যুর ভারের সঙ্গে সম্বন্ধিত । এটা যেন এইরকম---- মৃত্যুতে সে সীসকের মত, বাঁধের নিচে বায়ুহীন কাদার মত ভারি হয়ে গেছে । যেন মৃত্যুর সময়ে সে যে শেষ শ্বাস ফেলেছিল, তাতে তার শরীর থেকে সমস্ত লঘু ভাব বেরিয়ে গেছে । এখন সে আমার উপর তার সমস্ত ভার নিয়ে শুয়ে আছে । চাপ দিচ্ছে না, শুধু শুয়ে আছে ।

যখন তার বন্ধুটির রাস্তায় রক্তপাত হচ্ছিল, তখনও এইরকম ছিল । তখনো এইরকম ভার ছিল । ভারি রক্ত । আমি রক্ত নালায় গড়িয়ে পড়াকে বন্ধ করতে চাইছিলামএত রক্ত ! আমি যদি সবটা ধরতে পারতাম, বালতিটাকে তুলতে পারতাম না । সীসার বালতি যেরকম ভারি, তোলা যাবে না ।

আমি এর আগে কালো মানুষের মৃত্যু দেখি নি, মিঃ ভারকুয়েইল । আমি জানি তারা সবসময়েই মরছে, কিন্তু সব সময়েই অন্য জায়গায় সেটা ঘটছে । আমি যাদের মরতে দেখেছি, তারা সবাই শ্বেতাঙ্গ, তারা কাগজের মত শুকিয়ে গিয়ে, হাওয়ার মত হাল্কা হয়ে বিছানাতে মরেছে । আমি নিশ্চিত যে তাদের শরীর ভালোভাবে পুড়েছে, খুব কম ছাই অবশিষ্ট রেখে । তুমি কি জানতে চাও কেন আমি মনে করছি আমার শবদেহ পোড়ানো হোক ? কারণ আমি জানি আমি ভাল পুড়ব ।অন্যদিকে,এই মানুষগুলো, এই ভেকি ও অন্য মৃত মানুষগুলো পুড়বে না । ওদের পোড়ানোর চেষ্টা করা যেন কাঁচা লোহার তাল বা সিসা পোড়ানোর মত । তাদের শরীরের কাঠামোর ধার নষ্ট হতে পারে, কিন্তু আগুন নিভলেও তারা ওখানেই থাকবে, সব সময়েই ভারি ওদের ওখানেই রেখে দিলে ওরা মিলিমিটার মিলিমিটার করে মাটির ভেতরে ঢুকতে থাকবে যতক্ষণ না মাটি তাদের সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলে । তারপর তারা আর ডুববে না । তারা ওখানেই শুধু  উপরের মাটির স্তরের নিচেই থাকবে । হয়তো তোমার জুতোর আঘাতে মাটি সরিয়ে তুমি তাদের দেখতে পার : মুখগুলো মৃত, চোখ খোলা, বালিমাখা ।

ভারকুয়েইল আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “পান কর ।তার মুখের চেহারা পাল্টাচ্ছিল, ঠোঁট বাইরের দিকে ভরে আসছিল, দুই ঠোঁটের মাঝে ফাঁক, ভেজা, চোখ দুটোর দৃষ্টি অনিশ্চিত । ঠিক যেন সেই স্ত্রীলোকটির মত যাকে সে আমার বাড়িতে নিয়ে  এসেছিলআমি বোতলটি নিয়ে জামার হাতাতে মুছলাম ।

তোমাকে বুঝতে হবে যে এই ব্যাপারটা নিজস্ব নয়, এই যে দোলাচল, যার বিষয়ে বলছি ।আমি আবার বলতে থাকলাম । আসলে এটা মোটেই নিজস্ব ব্যাপার নয় । ভেকি যখন বাচ্চা ছিল, নিশ্চিতই আমি তাকে ভালবাসতাম, কিন্তু সে যা তৈরি হচ্ছিল, তাতে আমি সুখী ছিলাম না । আমি অন্যকিছুর আশা করছিলাম । সে ও তার সঙ্গীরা বলত যে তারা তাদের শৈশব পেছনে ছেড়ে এসেছে । ভাল, তারা শৈশবকে ছুটি দিয়েছে, কিন্তু তারা কি হয়েছে ? ছোট ছোট গম্ভীর শুচিবাদী, হাসিকে ঘৃণা করে, খেলাকে ঘৃণা করে ।

তাই আমি কেন তার জন্য দুঃখ করব ? উত্তর হল, আমি তার মুখটা দেখেছি । সে যখন মারা গেল সে আবার শিশুতে পরিণত হয়েছিল । শৈশবের নগ্ন বিস্ময়ে তার মুখোশ খসে পড়েছিল তখন, যখন সেই শেষ মুহূর্তে  তার কাছে  এই কথাটা ভেঙ্গে গেল যে পাথর ছোঁড়া ও গুলি করা কোন ছেলেখেলা নয়; যে দৈত্য থপ্‌থপ পায়ে এসে তার মুখে এক থাবা বালি গুঁজে দিল, তাকে মন্ত্র আউড়ে বা স্লোগান দিয়ে তাড়ানো যায় না; দীর্ঘ গলিপথের শেষে যেখানে তার মুখে দলা আটকে গলা মুখ বুজে গিয়েছিল, এবং সে শ্বাস নিতে পারছিল না, সেখানে কোনো আলো নেই ।

এখন সেই শিশুটি কবরে, আমরা তার উপর দিয়ে হেঁটে যাই । আমি তোমাকে বলছি, যখন আমি এই মাটি, এই দক্ষিণ আফ্রিকার মাটির উপর দিয়ে হাঁটি, আমার মনে একটা অনুভূতি আসে যেন আমি কালোদের মুখের উপর দিয়ে হাঁটছি তারা মৃত ঠিকই, কিন্তু তাদের আত্মা তাদের ছেড়ে যায়নি । তারা এখানে শুয়ে আছে, ভারি এবং কঠিন, অপেক্ষা করছে আমার পা ওই স্থান অতিক্রম করার জন্য, আমার যাবার জন্য, অপেক্ষা করছে উঠবার জন্য । লক্ষলক্ষ কাঁচা লোহার মূর্তি পৃথিবীর চর্মস্তরের নিচে ভাসছে । আয়স কাল ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করছে । 

তুমি ভাবছ আমি উদ্বিগ্ন, কিন্তু এই ভাবটা কেটে যাবে । ভাবছ যে এই সস্তা চোখের জল, আবেগের কান্না এখানে এখন হচ্ছে, কালকে চলে যাবে । এটা সত্য যে আমি আগেও উদ্বিগ্ন হয়েছি, ভেবেছি যে এর চাইতে খারাপ কিছু হতে পারে না, এবং তারপর আরো বেশি খারাপ চলে এসেছে, যেমন তা আসে অবধারিতভাবে, এবং আমি তা পেরিয়ে গিয়েছি, অথবা এইরকমই মনে হয় । কিন্তু সেখানেই তো মুস্কিল । লজ্জায় অবশ হবার থেকে বাঁচতে আমাকে অধিকতর খারাপ পেরিয়ে যাবার জীবন বাঁচতে হবে । আমি যদি এবারো পেরিয়ে যাই, তাহলে আর পেরিয়ে না যাবার জীবনটা বাঁচবার আর সুযোগ পাবনা । আমার নিজের পুনরুত্থানের জন্য আমি এবারে আর পেরিয়ে যেতে পারি না

ভারকুয়েইল বোতলটা বাড়াল । পুরো চার ইঞ্চি শেষ হয়ে গিয়েছিল । আমি তার হাত সরিয়ে দিলাম । বললাম, “আমি আর ড্রিঙ্ক করতে চাই না

সে বলল, “চলো, একটু অন্যরকম হবার জন্য  মাতাল হও ।

আমি জোরের সঙ্গে বললাম, “নাতার নিষ্ঠুরতা, তার উদাসীনতায় আমার মাথায় একটা মাতাল ক্রোধ চাড়া দিয়ে উঠল । আমি কি করছি এখানে ? এই নিঃশেষ হওয়া গাড়িতে আমাদের দুজনকে নিশ্চয়ই বড় মন্দার* সময়কার প্লেটল্যান্ড থেকে আসা শরণার্থীদের আধুনিক সংস্করণ মনে হচ্ছে । আমাদের নেই শুধু গাড়ির ছাদে বাঁধা ছোবড়ার গদি আর মুরগির একটা খাঁচা । আমি তার হাত থেকে বোতলটা কেড়ে নিলাম, কিন্তু যখন আমি সেটা ফেলে দেবার জন্য গাড়ির জানালা খুলছিলাম, সে  আবার কেড়ে নিল ।

আমি রেগে বললাম, “আমার গাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও ।গাড়ির ইগ্নিশন লক থেকে চাবিটা খুলে নিয়ে সে বেরিয়ে গেল । কুকুরটাও তার পেছন পেছন লাফিয়ে গেল । আমার চোখের সামনেই সে চাবিটা ঝোপের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলল, ফিরল, তারপর বোতল হাতে নিয়ে পাহাড় থেকে নেমে হাউট বে-র দিকে টলমল পায়ে চলে গেল ।

রাগে জ্বলে গিয়ে আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম, কিন্তু সে ফিরল না ।

বেশ কয়েক মিনিট চলে গেল । একটা গাড়ি রাস্তা ছেড়ে আমার পাশে এসে দাঁড়াল । গাড়ির মধ্য থেকে উচ্চগ্রামে ধাতব সঙ্গীত বাজছিল । সেই বেসুরো তালবাদ্যের মাঝখানে এক দম্পতি সাগরের দিকে তাকিয়ে বসেছিল । এ হল দক্ষিণ আফ্রিকাসুলভ বিনোদন । আমি বেরিয়ে গিয়ে ওদের জানালায় টোকা দিলাম । পুরুষটি কিছু একটা চিবোতে চিবোতে অনিশ্চিত দৃষ্টিতে আমার দিকে দেখল । তোমরা কি মিউজিকের শব্দটা কম করতে পার ?” আমি বললাম । সে কিছু একটা নাড়াচাড়া অথবা নাড়াচাড়ার ভান করল, শব্দ কমল না । আমি আবার টোকা দিলাম । কাচের মধ্য দিয়ে সে আমার উদ্দেশ্যে কিছু বলল, তারপর প্রচণ্ড ধুলো উড়িয়ে গাড়িটা জায়গাটার অন্যপাশে সরিয়ে নিল । ভারকুয়েইল যেদিকে চাবি ছুঁড়েছিল, আমি সেখানটার ঝোপে খুঁজলাম, কিন্তু চাবিটা পেলাম না ।

অন্য গাড়িটা শেষপর্যন্ত যখন চলে যাচ্ছিল, গাড়ির মহিলাটি আমার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল । তার মুখটা অনাকর্ষণীয় নয়, অথচ কুৎসিত : চোখ নাক মুখ সব কিছু কাছাকাছি, একত্র বাঁধা,যেন আলো, হাওয়া, এমন কি জীবনও তাকে একসঙ্গে আঘাত করতে যাচ্ছে । ঠিক মুখ নয়, কিন্তু একটা অভিব্যক্তি, অথচ এমন একটা অভিব্যক্তি যেটা যতদিন পর্যন্ত আছে, সেটা তারই, একমাত্র তার । বিশ্বসংসারে এবং নিজের মধ্যে পাতলা আবরণ ক্রমশ ভারি হতে থাকে, ভারি হতে হতে ক্রমশ ভারে পরিণত হয় । তুমি নিশ্চয়ই জান যে প্রাচীন গভীরতায় মাছেদের শরীরের চামড়ায় আলোকরশ্মির প্রতি সংবেদনশীল কিছু ছোট ছোট অংশ তৈরি হয়েছিল, সেইসব চামড়ার অংশই পরবর্তীকালে চোখে পরিণত হয়েছে । এখন, দক্ষিণ আফ্রিকায়, আমি দেখি, চোখগুলো ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে, চোখের উপর যেন আঁশ গজাচ্ছে, কারণ এখানে শ্বেতাঙ্গ জমি-আবিষ্কারক ঔপনিবেশিকেরা আবার গভীরে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে ।

তুমি যখন আমাকে তোমার ওখানে যাবার জন্য আমন্ত্রণ করেছিলে, তখন কি আমার যাওয়া উচিত  ছিল ? আমার দুর্বলতর মুহূর্তে অনেক সময় আমি নিজেকে তোমার করুণার উপর ছাড়তে চেয়েছি । আমাদের দুজনেরই সৌভাগ্য যে আমি নিজেকে শেষপর্যন্ত নিজেকে আটকে দিয়েছি । পুরোনো দুনিয়ার কোনো অ্যাল্‌বাট্রসকে* গলায় বাঁধার তোমার কোনো প্রয়োজন নেই আর আমার ক্ষেত্রে, আমি বাস্তবে কেন দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে তোমার কাছে যাব ? আমি কি করে জানব যে আমার চোখের উপরও আঁশ ঘন হচ্ছে না ? গাড়ির সেই মহিলাটি, ওরা যখন চলে যাচ্ছিল, তখন হয়তো তার সঙ্গীকে বলছিল : কি খিটখিটে বুড়ি ! কি রকম বাঁধাছাদা মুখ !

এবং তখন, যখন এই পোকা থিকথিকে জাহাজটা ডুবতে বসেছে, কিছু টেনিস খেলোয়াড়, কুটিল দালাল, এবং পকেটভর্তি হিরে থাকা জেনারেলদের সঙ্গে পৃথিবীর অন্যধারের শান্ত সমুদ্রসৈকতের দেশে আশ্রয় নেবার জন্য চুপি চুপি পালিয়ে যাওয়াতে কি সম্মান আছে ? জেনারেল গ, মিনিস্টার ম, পারাগুয়েতে ওদের ভূসম্পত্তিতে বসে দক্ষিণ আকাশের নিচে কয়লার আগুনের উপর গোমাংস স্টেক ঝলসাচ্ছে, ওদের ইয়ার বন্ধুদের সঙ্গে বসে বিয়ার পান করছে,পুরোনো দেশের গান গাইছে, আশা করছে যে বৃদ্ধবয়সে ঘুমের মধ্যেই প্রাণত্যাগ করবে, আর তখন নাতি নাতনিরা সঙ্গে থাকবে, এবং পিয়নরা হাতে টুপি নিয়ে বিছানার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকবে : পারাগুয়ের আফ্রিকানাররা পাটাগোনিয়ার আফ্রিকানারদের সাথে, নিজেদের বিমর্ষ জাতভাইদের সাথে মিলবে : লালচে, মোটা ভুঁড়িওলা পুরুষগুলো ও তাদের মোটা মোটা স্ত্রীরা, তাদের বসবার ঘরের দেওয়ালে রাখা বন্দুকের সংগ্রহ, রোজারিও* শহরে ওদের ব্যাঙ্কের ভল্টে জমানো নিরাপদ টাকা, রবিবার বিকেলে তারা বেড়াতে যায় বার্বি* ও আইখম্যানের *ছেলেমেয়েদের বাড়িতে : গুণ্ডা, জোচ্চোর, অত্যাচারী, খুনি-----কি সব সঙ্গী !

তা ছাড়া আমি অত্যন্ত ক্লান্ত । আমার ক্লান্তি কারণের ঊর্ধ্বে, সময়ের বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে ব্যবহার হয়ে হয়ে ক্লান্ত ; আমি চোখ বুজতে চাই, ঘুমোতে চাই । সর্বোপরি, মৃত্যু, ক্লান্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে আরোহণ করা ছাড়া আর কি ?
তোমার করা শেষ টেলিফোনের কথা মনে পড়ছে । তুমি জিগ্যেস করেছিলে, “তুমি কেমন আছ ?” আমি জবাব দিয়েছিলাম, “ক্লান্ত, কিন্তু ওইটা ছাড়া ভাল । আমি ধীরে ধীরে ঠিক হচ্ছি । ফ্লোরেন্স বরাবরের মতই একেবারে শক্তির স্তম্ভ । আমার বাগানের কাজে সহায়ক হিসেবে একটি নতুন লোক নিয়েছি ।তুমি তোমার চটপটে আমেরিকান টানে বলেছিলে, “তোমাকে অনেক বিশ্রাম করতে হবে, এবং যাতে শক্তি ফিরে পাও সেই দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে

মা ও মেয়ের টেলিফোনে কথোপকথন । ওখানে যখন দুপুর, এখানে তখন সন্ধে । ওখানে যখন গ্রীষ্ম, এখানে তখন শীত । তবুও লাইন এত পরিষ্কার যে মনে হচ্ছিল তুমি পাশের বাড়িতে আছ । আমাদের কথাগুলো একটা একটা করে আকাশে ছুঁড়ে দেওয়া হল, তারপর আবার একসঙ্গে নির্ভুল ভাবে সাজিয়ে দেওয়া হল । তোমাকে আমার সঙ্গে যুক্ত করার জন্য পুরোনো দিনের মত সাগরের তলা দিয়ে যাওয়া তারের দরকার নেই, তার কারণ, এই দক্ষ, বস্তুহীন আকাশবাহী সংযোগ : কথা নয়, আমাদের দুজনের মধ্যে শ্বাসপ্রশ্বাস বহমান নয়, কিন্তু কথার ভাবকে, শ্বাসের ভাবকে সাঙ্কেতিক শব্দে পরিবর্তন, বেতারতরঙ্গে প্রেরণ, তারপর আবার সাঙ্কেতিক শব্দগুলোকে সাধারণ শব্দে পরিবর্তন । শেষটাতে তুমি বললে, “শুভরাত্রি, মা,” আর আমি বললাম, “শুভরাত্রি, আমার সোনা, ফোন করার জন্য ধন্যবাদ ।” ‘সোনাশব্দটার উপর আমার স্বর একটু থামল, (কি আত্মপ্রশ্রয়!) সমস্ত ভালবাসার ভার নিয়ে, এই প্রার্থনা করে, যে আমার ভালবাসার আত্মা মহাকাশের শীতল পথ অতিক্রম করে তোমার কাছে তার ঠিক জায়গায় পৌঁছবে ।

কোন মন্তব্য নেই: