“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ৯ জানুয়ারী, ২০১৬

সুরমা গাঙর পানি - ভাটি পর্ব ১৮

(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই  উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার অষ্টাদশ  অধ্যায় ---সুব্রতা মজুমদার।)   
 আঠারো
  বৈতল কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেয় তাড়া আবার । বলে,
--- চলো ।
--- কই চলো ।
--- আমারে ইন্ডিয়াত দিয়া আও ।
--- কই যাইতায় ইন্ডিয়াত ?
--- আছে, যাইমু । আমার মামা আছইন জালেঙ্গাত । আখড়া করছইন । আমারে আদর করিয়া ডাকইন, দুর্গা মাইকি জয় ।
--- হি তো বুঝলাম । অখন আর জয় দিবা নি ।
--- দিবা দিবা, তাইন এক আচানকি মানুষ । নিজর খানি না থাকলেও ভাগনিরে খাওয়াইবা ।
--- আর জামাইরে ?
--- বিয়া অইলে তো জামাই । বৈষ্ণবী সাজিয়া যাইমু । রসকলি আকমু ।
--- আর আমি । আমি কিতা পুলিশর হাতো ধরা খাইতাম নি আবার ।
--- কেনে । তুমিও অই যাইবায় গোসাই । নাম লই লাও একটা ।
--- আমার নাম নেওন লাগত নায় । যে নাম আছে হউ নামেউ অইব । আমি বৈতল, বৈতলের লগে গোসাই লাগাই দিও লাগব । দাশ লাগাইদিও লাগব, পাটনি লাগাই দিও লাগব, কৈবর্ত লাগাই দিও লাগব, মিয়া লাগাইদিও লাগব । তুমারর ই আচার্য উর্চায শর্মা উর্মা লাগত নায় ।
--- আমারে বিয়া করলে তো লাগানি লাগব ।
--- কেনে আমি কুনু বেটি নি । তুমি লেখবায় পাটনি । দুর্গা পাটনি লেখতে পারলে বিয়া করবায়, নাইলে না । আইচ্ছা নায় দাশ লেখিও । তুমার কিচ্চু করন লাগত নায় । আমারেও বিয়া করন লাগত নায় । তুমি তুমার বাব্‌নি অউ থাকিও গো মাই, অখন চলো দিয়া আই বৈষ্ণবীরে মামার বাড়িজয় দুর্গা মাইকি ।
   বৈতল হাত ধরে দুর্গাবতীর । কলাগাছের ভোরা বানিয়ে ভাসিয়ে দেয় সুরমার জলে । ভেসে যায় দুজনে । কুশিয়ারা পেরিয়ে মনে হয় নিশ্চিন্ত । বরাক বেয়ে বেয়ে তারাপুর, শিলচর । ওখানেও দুর্যোগ । দুর্যোগের পাইক পেয়াদা একা আসে না । একের পর এক দুর্ভোগ কাটিয়ে বৈতল বোষ্টুমীকে নিয়ে পৌঁছে যায় মেহেরপুর । পুনর্বাসন দপ্তরের বদান্যতায় ডামধাড়ার এক ঘরের মালিক হতে না হতেই দুর্গাবতী অসুস্থ । ধুমজ্বর আর পেটখারাপ, বারবার পায়খানা । বৈতল উতলা হয়, একে ওকে বলে, ডিসপেনসারির লবণজল আর শিবাজল বড়ি খেয়ে কমে না । কেউ বলে হোমিওপ্যাথি করতে, বীরেশ ভট্টাচার্য ধন্বন্তরির এক পুরিয়ায় ঠিক হয়ে যাবে । কেউ বলে, এলোপ্যাথি, বিভট । একজন এসে বলে,
--- আমি শৈলেন কবিরাজ । দেখি কই তুমার পরিবার ।
    কবিরাজের বড়িতে সুস্থ হয় দুর্গাবতী । কাচকলা দিয়ে চেঙ মাছের ঝোল খেয়ে চনমনে দুর্গাবতী মনে মনে প্রণাম করে কাকাবাবুকে । দুর্গাবতী কাকাবাবু ডাকলেও বৈতল ডাকতে পারেনি । বৈতল ডাকে কবিরাজ মশয় । দাম ছাড়া ঔষদের সুফলে প্রতিদান দিতে চায় বৈতল । ভিষগশাস্ত্রীর চাই ঔষধের উপকরণ, তাই বৈতল জঙ্গল থেকে পাতালতা যোগাড় করে দেয় কবিরাজকে । একবার এমনিতে দেয়, বারবার দেয় না, দাম চেয়ে রাখে । বৈতল এরকমই ।
     বৈতল জানে জালেঙ্গার গল্প ঢপ । মামা থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু দুর্গাবতী বোষ্টুমি হতে ওখানে যাবে না । ভেসেই যখন পড়েছে কলাগাছের ভোরায় আর ছাড়বে না সিতপুরুষ বৈতলকে । মেহেরপুর ক্যাম্প একাকী অসুস্থ যুবতিকে ছেড়ে যায়নি বৈতল । তারও আর খুনের আসামী হয়ে জেলে যাওয়া হয় না । থেকেই যায় বিদেশ ইন্ডিয়ার যুবতিমায়ায় মুগ্ধ হয়ে । তবু মাছের ঝোলে সুস্থ হওয়া রোগিণীর মতামতটাও তো জরুরি । গম্ভীর মুখে বিদায় নিতে যায় । বলে,
--- অখন যাই ।
--- কই যাইতায় ।
--- কেনে বইয়াখাউরি । অখন থাকোইখানো, তার পরে নায় যাইও মামার আখড়াত ।
--- অ, আখড়াত যাওয়ার লাগিনি ক্যাম্পো আইলাম । কিচ্ছু বুঝো নানি ? খালি গাট্টামি । যাও গিয়া, অখন পাকিস্তানর জেলো পচিয়া মরো ।
--- আমারে কে ধরত ? কেউ দেখছে নি ? বৈতলরে ধরা অতো সস্তা নায় ।
  দুর্গাবতী বৈতলের হঠাৎ গভীর হওয়া কালো চোখে তাকায় করুণ দৃষ্টিতে । বলে,
--- যাইতায় গিয়া । আমি অসতী এর লাগি । বইয়াখাউরির মাইনষে আমারে ভালা রাখছে না । একলা পুড়ি কেমনে ভালা থাকত ভাবছনি একবার ।
--- ছিছি, ইতা কিতা কও বৈতল ইলাখান নায় । তুমি কই আর আমি কই কও ? তুমি বাবনর পুড়ি আর আমি কৈবর্ত পাটনি । তুমি ধলা আমি কালা । কুনু মিল নাই ।
--- কিওর মিল নাই কও । আমি তসলার কালি মাখিয়া বই থাকমুনে । তে অইবনি ? আর বাবন ? তুমিও একটা বাবনাকি নাম নেও গি না, কিতা অইব ।
--- পারতাম নায়, একদিন কইছি নানি । আমি বৈতল বৈতল অউ থাকমু । বৈতল বৈতল তিন বৈতল ।
--- ইতা অইত নায় । বৈতল কুনু নাম নায় । ইতা গাইল ।
--- অউক গাইল । আমার নাম অউ গাইল ।
--- আমি সবরে কই দিছি আমরা বাবন । কাকাবাবুরেও কইছি আমি দুর্গাবতী শর্মা । তুমারে ও জামাই কইছি । অখন কিতা অইব ?
--- এ রাম, আমিতো ক্যাম্পো নাম লেখাইছি বৈতল দাস পাটনি ।
--- ইতায় কিচ্ছু অইত নায়, হরিদারে কইলেউ বদলাই দিব । তুমি আমার লাগি একটু করতায় পারো নানি ?
--- পারি । দেশ অউ ছাড়িয়া আইছি । তখন এক নামর লাগি নি আটকি যাইমু । কও কিতা নাম রাখতায় ?
--- আমি কেনে, তুমি কও ?
--- আমি তো এক নাম অউ জানি ।
--- বৈতল নানি । ই তুমার ডাক নাম থাকউক, ছাড়িও না । ভালা নাম বানাও ।
--- আরে নারে বাবা । আমি আমার গুরুর নামে ভালা নাম বানাইছি ।
--- কী নাম ?
--- সৃষ্টিধর উঝা ।
--- উঝা উঝা নায় । আমি নু কই লাইছি, আমার শর্মা ।
--- বুঝলাম তো, শর্মা বাবন হকল তো ছায়াত থাকইন, ভালা খাইন । আমার লাখান রইদে পানিয়ে ঘুরইন নি, হিদলপুড়া খাইন নি । তুমি তো ধলা, আমারে দেখলেউ ধরি লাইব । আমি ইতা পারতাম নায়, হাচা কথা কই দেও হক্কলরে ।
--- আমি তো লগ্‌গুনও আনাই রাখছি তুমার লাগি । অখন যদি উল্টা কথা কই কিতা ভাববা কাকাবাবুয়ে ? ভাববা ইতা ঠগ । অখন একতা তখন একতা মাতে ।
--- অয় বাঙালও ভাবতা পারইন । বউত বাঙালেও রিফুজি সাজিয়া হিন্দু নাম লেখাইছে । এগু হারিছ আলিয়ে হরিশ্চন্দ্র লেখাইছিল, ধরা পড়িয়া অলা মাইর খাইল । বাজারি কিল খাইয়া ভাগল বেরেঙ্গাত । ঠিক আছে তুমি অউ জিতলায়, আমি শর্মা অই গেলাম, যাও । কুল মান সব গেল এক বাবনি বেটির লাগি ।
   মেহেরপুর ক্যাম্পের যুবক কর্মচারি হরিদাস শুক্লবৈদ্যকে দিয়েই বৈতলের নামকরণ হয় নতুন করে । দুর্গাবতীর চোখের ভাষায় হরিদা সৃষ্টিধর শর্মা নামের নতুন রিফ্যুজি পরিবারকে নথিভুক্ত করে । বৈতলদাস পাটনির পরিবারের নামও থাকে যথারীতি । ডোল বরাদ্দ হয় দুই নামেই, দুই পরিবারে । হরিদাস কর্মচারী ও দুর্গাবতীর মধ্যে অর্থকরী সমঝোতা হয় । কয়েক মাসের মধ্যে শিলচর থেকে পরিদর্শক এসে নাম ডাকতেই ধরা পড়ার উপক্রম । কিন্তু কিছুই হয় না, হরিদাসের চোখের ইশারায় বৈতল দুনামেই থেকে যায় উদ্বাস্তু শিবিরে । এরকম আরো অনেক নামই তো নেই । রিফ্যুজি অফিসারদের সঙ্গে আসে জননেতা । খাদির পাঞ্জাবি আর ধুতি পরা বাবু । কংগ্রেস পার্টির । পুজোর সময় জানিগঞ্জের ব্যবসায়ীরা নতুন কাপড় নিয়ে আসে । শীতের কম্বল । তবে শিবিরের ভিতর হরিদার কথাই শেষ কথা । কাউকে ঢুকতে দেওয়া বের করে দেওয়ার একমাত্র কর্তা । অনেকের আত্মীয় স্বজনও আসে, থাকে । প্রথম প্রথম তো ডোলের পরিমাণ বেশিই ছিল । এক হপ্তায় পরিবার প্রতি নগদ কুড়ি টাকা কম কথা নয় । চাল ডাল তেল নুনও অনেক, অনেকেরই গরিব আত্মীয়স্বজন এসে ভাগ নিয়েছে । খাতায় লেখা অনেক পরিবারের নিজের বাড়ি আছে তারাপুর শিলকুড়ি শিববাড়ি রোডে, ওরাও আসে । সে এক মোচ্ছব । এর মধ্যেই বৈতলকে নিয়ে ক্যাম্পের ভিতর শুরু হয় আতান্তর । বৈতল কিছুতেই হরি শুক্লবৈদ্যর বশ্যতা মানবে না । আর বৈতলও নজরানা না দিয়ে দুই দুগুনে চার জনের রেশন ও ভাতা ওঠাবে । দুর্গাবতীর এসব লড়াই ঝগড়া ভাল লাগে না । বৈতলকে বলে,
--- দিলাও না বেটারে যেতা চায় । হে তুমার লাগি করছে ।
--- করছে, তো করছে । হে আমার মুখ দেখিয়া করছে নি, ভাবছে পাইব । পেট মুটা অইব । অখন বুঝ বেটা ধুড়া সাপর লাখান বেঙ গিলি লাইচছ তর থাকি গাট্টা । না পাররে বার করতে না পাররে গিলতে ।
--- যদি কই দেয়, জানাই দেয় ।
--- জানাইত নায়, চাইট দিলে হেউ মরব
--- মানুষ খারাপ নায় হরিদা । আমারে দিদি ডাকে ।
--- কেনে তুমারে দিদি ডাকত । হে কুনু তুমার ছুট নি । বুড়া বেটা । হুনো, ইতারে আমি চিনি লাইদিলেউ ঘাড়ো উঠব । আমি গাইল্লাই, এর লাগি আমারে ডরায় ।
--- খেদাই দিবনে দেখবায় কুনদিন ।
--- খেদাইত উ আমি চাই, ইনো কুনু হারা জীবন থাকমু নি ।
--- কই যাইবায় ।
--- অ, ইতা হুনছ নানি । রিফুজি হকল আবার যাইব গিয়া পাকিস্তানো ।
--- আর আমরা ।
--- আমরাও রিফুজি, যাওন লাগব ।
--- কই যাইতাম । কুন মুখে যাইতাম । কে আছে আমরার ।
--- আমি বেটা ফাসির আসামি । দুইমুখো করাতর মাঝখানো আছি । রামে মারলেও মারতা করিম চাচায় মারলেও মারতা । আমি কুনু আর যাইমু নি বইয়াখাউরি । তুমারে দিয়া আইমুনে বডার পার করি ।
--- অ, নিজর কথা ভাবলায় খালি । আমারে বাঘর মুখো দিয়া আইবায় আবার । বেটাইন্ত হকল নি অলা স্বার্থপর ।
--- ইতা কইও না । আমি স্বার্থপর নায়, আর হিপারোও সব বাঘ ভাল্লুক নায় । অখন ইতা অইল কির্তনর মাইর । না পাইয়া পাইছে ধন, বাপেপুতে কির্তন । পাকিস্তান পাইয়া ছলি গেছেইতা ঠাণ্ডা অই যাইব । করিমচাচা যদি বাচি থাকইন দেখবায়নে তুমার লাগি করবা । আমরার তো মন্ত্রী ও আছইন করাচিত একজন, যোগেন মণ্ডলরে একবার দেখছিলাম হবিগঞ্জো । বেটা খুব সাউকাড় ।
--- হে তো ছুনছি কৈবর্ত না মাইমল, কিতা কিজানি । হে বিয়া করব নি বাবনর পুড়িরে । করলে তো ভালা আছিল মন্ত্রীর বৌ হই গেলাম নে আর তুমারে বান্দিয়া নেওয়াইলাম নে পাকিস্তানো । বেটা ডরালুকর পাদ্রাপুক !
--- রিষ চড়াইও না কইলাম । বৈতলে কেউরে ডরায় না ।
চলবে

 < ভাটি পর্ব ১৭ পড়ুন                                                    ভাটি পর্ব ১৯ পড়ুন >

কোন মন্তব্য নেই: