মাহমদপুর-জয়কৃষ্ণপুর জিপিতে ফোরাম ফর সোশ্যাল হারমনি’র সমীক্ষক দলের
বৈঠক
একটি অসম্পূর্ণ প্রতিবেদন
একটি অসম্পূর্ণ প্রতিবেদন
“ এর আগে করিমগঞ্জ জেলাতে উমর পুরে ভ্রমণ করে ছিল ফোরামের টীম। সেখানকার প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বদরপুর আগরতলা নির্মীয়নাম বিজি রেল লাইনে ছটি "রাব' (RUB) তৈরির দাবি জানিয়ে একটি আবেদনে গণ স্বাক্ষর সংগ্রহ করছে ফোরাম। এখানে ক্লিক করে সেই আবেদনে সই করুন। বহু গ্রামের মানুষের বেদনা আর সংগ্রামের শরিক হোন ''
৯ জানুয়ারি, ২০১৬ বেলা ৩ টায় ফোরাম ফর সোশ্যাল হারমনি’র সমীক্ষক দল হাইলাকান্দি জেলার লালা শহর থেকে ৫/৬ কিঃমিঃ দূরে মাহমদপুর-জয়কৃষ্ণপুর জিপি’তে পৌঁছয়, লালা ও কাটলিছড়ার মধ্যবর্তী অঞ্চলে এই জিপি অবস্থিত। দুর্ভাগ্যক্রমে
আবহাওয়া ছিল প্রতিকূল। এই শীতের মরসুমেও মতবিনিময় সভার আগে ও
পরে অঝোরে বৃষ্টি
হয়, এমনকি সেখান থেকে
শিলচরে ফেরার প্রায় ৫০ কিঃমিঃ পথ পাড়ি দিতে শিলাবৃষ্টির তোপে খানিকক্ষণ
নিরাপদ আশ্রয়ে টিমের গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখতে হয়। দু-পাশে চা-বাগান ও
গ্রামগুলিকে রেখে নব্য সেজে ওঠা কুচকুচে কালো পি-ডবলিউ-ডি
রাস্তাকে বৃষ্টির জল ধুয়েমুছে সাফ করে আমাদের মত যাত্রীদেরকে যখন
আবাহন করছিল, আমাদের নাগরিক মনকে যখন করে তুলছিল রোমান্টিক,
ঠিক তখনই হয়ত
রাস্তার পাশে খড়কুটোর ঘরে কোন এক চা-শ্রমিক মা তার কালো শিশুটিকে
ছাদের ফোটা দিয়ে আসা বৃষ্টির জলের ও কিনকিনে ঠাণ্ডার মারণ ছোবল থেকে
বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। সে যাই হোক, ভূমিকা বাদ দিয়ে এবার মোদ্দা কথায়
আসা যাক।
মতবিনিময় সভার স্থান যদিও ছিল মাহমদপুর-জয়কৃষ্ণপুর জিপি, কিন্তু সভায় আসলে উপস্থিত হোন আশপাশের অনেকগুলি জিপি ও দূরবর্তী স্থানের কিছু প্রতিনিধিরা। এরকম সভায় কোন একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য বিশদ তথ্য সংগ্রহ করা কঠিন, বিশেষকরে প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য
ফোরামের টিম যখন গ্রামের অভ্যন্তরে ঘুরে বেড়াতে অক্ষম হয়। স্বাভাবিকভাবেই এই
জিপি’র তথ্য ছাড়াও
আশপাশের অনেক ঘটনার কথা উঠে আসে এই আলাপচারিতায়। এই আলোচনা থেকে সমীক্ষক
দলের মনে হয় যে হাইলাকান্দি জেলার কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যা গোটা জেলার
জনমানসেই শুধু প্রভাব ফেলেনি আর্থিক-সামাজিক বিন্যাসেও প্রভাব ফেলেছে
এরকম ঘটনা, সামগ্রিক জনবিন্যাস, অভ্যন্তরীণ আর্থিক-সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে এক বিশদ প্রতিবেদন
তৈরির উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। তাই এই আলোচনা থেকে যেসব আর্থিক, সামাজিক ও
রাজনৈতিক তথ্য উঠে এসেছে সেগুলি আরও গভীরে যাচাই না করে তাৎক্ষণিক একটি
পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি করা থেকে আপাতত: বিরত থাকাই শ্রেয় বিবেচিত হয়। এই দিক
থেকে এদিনের আলোচনার এক বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে, কারণ এই আলোচনা ফোরাম টিমকে হাইলাকান্দি জেলার সামাজিক-রাজনীতিকে আরও গভীরে যাচাই করতে আগ্রহান্বিত করে তুলেছে।
তবে সেদিনের আলোচনার বিশদ তথ্য এখানে
তুলে না ধরলেও, কিছু সাধারণ তথ্য এখানে তুলে ধরছি। ১৯৭৯-৮০ সালে কাটলিছড়া
এলাকায় এক ভয়াবহ দাঙ্গার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। আব্দুল মালিক লস্কর এই
প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে কাটলিছড়া এলাকার অধীর নাথ জানান, সে সময় লবণ-কেরোসিনের খুব সংকট দেখা দেয়।
সেই লবণ-কেরোসিনের বণ্টনকে কেন্দ্র করে সমবায় সমিতির তৎকালীন
চেয়ারম্যান প্রয়াত ইউনিস খান চৌধুরীকে অপমানিত করার মত কোন এক ঘটনা ঘটে।
প্রয়াত চৌধুরী ছিলেন সে এলাকার সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রভাবশালী ব্যক্তি। এই ঘটনার
প্রতিবাদে ১৯৭৯ সালের সম্ভবত জুন-জুলাই মাসে তাঁর সমর্থনে হিন্দু-মুসলিম
নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের এক ঐক্যবদ্ধ মিছিল বেরোয়। এই সময় জনৈক বিভূতি দেবের
বাড়িতে কেউ বা কারা কিছু ইট-পাটকেল ছোড়ে, ইউনুস খান এই ঘটনার প্রতিবাদও করেন।
কিন্তু মিছিল যখন কাটলিছড়া বাগান-থানা হয়ে ফিরে গিয়ে কাটাখাল নদী
পার হয় তখনই সাম্প্রদায়িক রূপ পরিগ্রহ করে, কেন-কীভাবে তা আরও বিশদভাবে জানা
প্রয়োজন। আব্দুল মালিক লস্কর ও অধীর নাথ জানান যে এই দাঙ্গায় ময়না
মোক্তারের দুই ছেলে সপু ও তপুকে হত্যা করা হয়। ইউনুস খানের মত ময়না
মোক্তারও ছিলেন এই এলাকার মুসলিম জমিদার (আনুমানিক ৭০০/৮০০ বিঘা জমির মালিক) ও
প্রভাব প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি এবং সেই সুবাদে তার ছেলেদেরও ছিল
এলাকায় দাপট। সপু-তপু দুই ভাইয়ের হত্যা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে, কারুর মতে তাদেরকে
পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, আবার পুলিশের গুলিতে তারা নিহত হোন বলে ভিন্ন মতও রয়েছে। তবে সেই ঘটনায় দীননাথপুর চা-বাগানের ৩ জন মুসলিম শ্রমিক পুলিশের গুলিতেই নিহত হয়েছেন বলে জানান অধীর নাথ। এই দাঙ্গার নির্ভরযোগ্য বিশদ তথ্য সংগ্রহ করা এবং দাঙ্গার পেছনে অন্তর্নিহিত আর্থ-সামাজিক
কারণসমূহ বিশ্লেষণ করা জরুরি। তবে এই দাঙ্গার পর কাটলিছড়া
বাজারে মুসলিম ব্যবসায়ী যারা ব্যবসা করতেন তাদের প্রায় সবাই ধীরে ধীরে সরে
আসেন এবং সাহাবাদ ও লালা এলাকায় চলে আসেন। সাহাবাদ বাজার সেই সময়েই গড়ে ওঠে। আব্দুল
মালিক লস্কর বলেন যে কাটলিছড়া বাজার মসজিদে আজান দিতে দেওয়া হয় না, হিফজুর রহমান এই
তথ্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন, আবার সালা উদ্দিনের মতে সেখানে মুসলাম না থাকায় সম্ভবত আজান দেওয়া হয় না। যে জিপিতে সভা বসেছিল সেই জিপিতে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোক বাস করলেও সেই দাঙ্গার কোন প্রভাব এই এলাকায় পড়েনি। তার কারণ জানতে চাইলে আব্দুল মালিক লস্কর জানান যে এই এলাকায় সবাই স্থানীয় এবং মুসলিম, এসসি, অবিসি সম্প্রদায়ের লোক। সালা উদ্দিন, রেকিব উদ্দিন, সাজ্জাদ আলি লস্কর বলেন যে এই এলাকায়
হিন্দু-মুসলমানে সামাজিক মেলামেশার পরিবেশ ও সম্প্রীতি রয়েছে
এবং কোনধরনের সাম্প্রদায়িক ঘটনার নজির নেই, তবে অতীতে টান্টুর মোকামকে
কেন্দ্র করেই হোক বা সাধারণভাবে এ অঞ্চলে যৌথ সামাজিক আনন্দ উৎসবের যেসব
অনুষ্ঠান ছিল তা এখন আর অবশিষ্ট নেই, দৈনন্দিন মেলামেশা মূলত বাজার ও পারিবারিক
অনুষ্ঠানকেন্দ্রীক।
বিভিন্ন কথোপকথন থেকে সমীক্ষক দলের ধারণা জন্মে যে এই দাঙ্গার পেছনে রয়েছে ধর্ম-বর্ণ-জমিকে কেন্দ্র করে উৎপাদন সম্পর্ক এবং সর্বোপরি তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান থেকে আসা উচ্চবর্ণ হিন্দু পরিবারদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের সাথে স্থানীয় প্রতিষ্ঠিত মুসলিম পরিবারদের সংঘাতের এক জটিল আর্থিক-সামাজিক-রাজনৈতিক সংমিশ্রণের পরিণতি। এটা ফোরাম টিমের শুধু ধারণাই, এনিয়ে আরও গভীরে পর্যালোচনা করা জরুরি। পর্যালোচনা
করা জরুরি ১৯৯০ সালের হাইলাকান্দি দাঙ্গার ঘটনা নিয়েও। সত্তরোর্ধ সাজ্জাদ
আলি লস্কর বলেন একষট্টির ভাষা আন্দোলনের সময় অসমীয়া ভাষার দাবিতে
তাঁরা মিছিল করেছেন, কিন্তু পরবর্তীতে বুঝতে পারেন যে তিনি তো অসমীয়া ভাষা এক
লাইনও বলতে পারেন না। সুতরাং সে সময়কার ঘটনাবলীও নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে
বিচার করে দেখা জরুরি। এই কাজগুলি করা অত্যন্ত জরুরি এই কারণেই যে মুসলিম
সংখ্যাগরিষ্ঠ এই জেলা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ভ্রান্ত ধারণা মধ্যবিত্ত শিক্ষিত
মননে বিরাজ করছে এবং হাইলাকান্দি জেলায় হিন্দু-মুসলিম বিভাজনকে সুদৃঢ়
করতে উগ্র-সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী অতি-সক্রিয় রয়েছে।
এই জিপি সম্পর্কে
কিছু তথ্য সংগ্রহ করা গেছে উপস্থিতিদের বয়ান থেকে। তবে ভাল করে যাচাই না করে
সবগুলি তথ্য এখানে উপস্থাপন করা থেকে বিরত থাকা গেল। শুধুমাত্র গুটিকয়
তথ্য এখানে তুলে ধরা হচ্ছে। জবরুল ইসলাম জানান যে এই জিপি-তে আনুমানিক
৬/৭ হাজার ভোটারের মধ্যে পাঁচশত থেকে এক হাজার হিন্দু ভোটার রয়েছে। জমির
মালিকানা রয়েছে ৭০% মানুষের। গড়ে ১ থেকে ২ বিঘার জমি মালিকানা। ৩%-এর ৫
বিঘার উপর জমি রয়েছে, আনুমানিক ১০ টি পরিবারের রয়েছে ১০ বিঘার উপর জমি। সবাই পাওয়ার টিলার দিয়ে
জমি চাষ করেন। এই ৭০%-এর মধ্যে ১৫%-এর ক্ষুদ্র ব্যবসায় আছে ও দুইজন
জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া ৫% লোক ৩য়-৪র্থ শ্রেণি ও
শিক্ষকতার (অধিকাংশ প্রাইমারী স্কুলের) চাকরীর সাথে যুক্ত। বাকী ৩০% লোক বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরোপুরি দিনমজুর। চাষের জমি দুই ফসলি, অসংখ্য ফিসারি রয়েছে এ অঞ্চলে। জমি না থাকায় এ অঞ্চলের মৎস্যজীবী মাইমাল সম্প্রদায়ের মানুষ মৎস্য চাষের সাথে যুক্ত থাকলেও ফিসারির মালিকানা প্রায় নেই। এলাকায় একটি ক্যানেল ইরিগেশনের ব্যবস্থা থাকলেও তা অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। অথচ কাটাখাল নদী থেকে বা টিউবওয়েলের মাধ্যমে ইরিগেশনের ব্যবস্থা করলে চাষবাস ও ফিসারির প্রভূত উন্নতি হতে পারত। পাশের নিজবার্ণারপুর-সর্বানন্দপুর জিপিতে তারা-পাম্পগুলি অকেজো হয়ে পরে থাকায় ভীষণ পানীয় জলের সংকট এবং এই জিপি’র বহু এলাকা বিদ্যুৎ সংযোগহীন।
উপরোক্ত
তথ্যগুলিকে আরও গভীরে যাচাই করার মাধ্যমে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন
প্রস্তুত করার ইচ্ছা নিয়ে ফোরামের সমীক্ষক দল শিলচর ফিরে আসে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন