“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৫

কৈবর্ত মেয়েদের সামাজিক অবস্থান


।।শৈলেন দাস।।

(C)Image:ছবি

ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েরা পরিবারের সম্মান বা মর্যাদার প্রতীক। রামায়ণ , মহাভারতের যুগ থেকেই মেয়েরা পরম্পরাগতভাবে দেবীর স্বীকৃতি পেয়ে আসছে সামাজিক জীবনে। মেয়েদেরকে এই সম্মান বা শ্রদ্ধা জানানোর রীতি কৈবর্ত সমাজেরও ঐতিহ্য। কালের বিবর্তনে কৈবর্ত সমাজ কখনো এতটুকু ব্যতিক্রম করেনি এই ঐতিহ্য পালনে। বরং ভারতের অন্যান্য সমাজ ব্যবস্থার মতই এই সমাজের মেয়েরা পরিবারের পুরুষদের কাছে খুবই আদরের, অনেক বেশি সম্মানীয় বা শ্রদ্ধার পাত্রী। কিন্তু দু:খের বিষয়, সামাজিক রক্ষণশীলতা ও বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতের ভয়ে এই সমাজের মেয়েরা বাইরের জগত থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সময়ের সাথে সাথে। এর মূল কারণ অবশ্যই শিক্ষাক্ষেত্রে কৈবর্ত সমাজের সামগ্রিকভাবে পিছিয়ে পড়া। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ভারতীয় সমাজ জীবনে যেভাবে শিক্ষার প্রসার হয়েছে সে তুলনায় কৈবর্ত সমাজের অভিভাবকরা মেয়েদের পড়ানোর ব্যাপারে তেমন একটা আগ্রহ দেখায়নি। কৈবর্ত পরিবারে মেয়েদের পড়াশুনা না করে ঘরের কাজে মনোযোগ দেওয়ার জন্য বরং উৎসাহ দেওয়া হয়ে থাকে ছোটবেলা থেকে। দুয়েকটি পরিবারের কথা বাদ দিলে কৈবর্ত সমাজের অধিকাংশ অভিভাবকেরই কল্পনারও অতীত যে তাদের মেয়ে উচ্চশিক্ষিত হয়ে বৃহত্তর কর্মজীবনে যোগদান করে অর্থ উপার্জন সহ সমাজ বা পরিবারের মর্যাদা বৃদ্ধি করে সফলভাবে প্রত্যাবর্তন করবে সমাজে। দু একটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে তবে তা হাতে গোনা।
           বর্ত্তমান সময়ে সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞেও কৈবর্ত মেয়েদের যোগদান অন্তর্মুখী। শুধু মাত্র মেয়েদের কিছু ব্রত বা পূজার্চনা বাদ দিলে কোন মেয়ে মানুষের তত্ত্বাবধানে বৃহত্তর কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা পূজা পার্বণ পরিচালিত হওয়ার নজির কৈবর্ত সমাজে বিরল। নাচ, গান বা সাহিত্য চর্চা যে কৈবর্ত সমাজের মেয়েরা করেনা এমন নয় তবে নিজস্ব প্রতিভা প্রদর্শন হেতু জনসমক্ষে আসতে এক অদৃশ্য পর্দা যেন তাদের আগলে রাখে -বেরিয়ে আসতে দ্বিধা বোধ করে তারা নিজের থেকেই। ফলস্বরূপ বাইরের জগতের কাছে পরিচিতি পাচ্ছেনা তারা। এমনকি সামাজিক রক্ষণশীলতার কারণে নিজ সমাজেও তাদের পরিচয় অমুকের মা বা তমুকের বোন হিসাবে। আক্ষেপের বিষয় হল কৈবর্ত সমাজের যেসব মেয়েরা কিছুটা হলেও শিক্ষার আলো স্পর্শ করতে পেরেছে তাদের মধ্যেও জনাকয়েককে বাদ দিলে বাকীদের মধ্যে নিজের নামে পরিচিতি লাভ করার মানসিকতা বা জেদ পরিলক্ষিত হয়না খুব একটা।
              বরাক উপত্যকায় কৈবর্ত মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটছে ঠিকই তবে তা খুবই ধীর লয়ে। এখানে বলে রাখা দরকার যে নিম্নবিত্ত কৈবর্ত পরিবারের অভিভাবকরা মূলত মেয়েদের স্কুলে পাঠায় যাতে অল্পস্বল্প লেখাপড়া থাকলে ভাল পাত্রের সাথে মেয়েকে বিয়ে দিতে গিয়ে যৌতুক দিতে না হয়। মধ্যবিত্ত বা সচল পরিবারগুলির মানসিকতাও তদ্রূপই, কিছুটা রকমফের আছে বৈকি তবে তা উল্লেখ করার মত নয়।
          পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থায় থেকেও ভারতবর্ষের রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিচালনয় যেখানে মেয়েদের প্রভাব দিন দিন বেড়ে চলেছে সেখানে কৈবর্ত সমাজের মেয়েরা সংরক্ষণ ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারছেনা। নিজের প্রাপ্য অধিকার বা ক্ষমতা প্রয়োগ করছে তারা পরিবারের পুরুষ সদস্যদের দ্বারা। তাই যখনই তারা নিজেদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয় বা লাঞ্ছনা সইতে হয় তাদের নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে তখন তারা কোনো জোরালো প্রতিবাদ করতে পারে না, গড়ে তুলতে পারেনা কোন আন্দোলন। তাদের বঞ্চনার ইতিহাস ইট কাঠ পাথরের পাঁজরে চাপা পড়ে যায় এবং এরই সাথে একটি সমাজ ব্যবস্থা অর্ধপঙ্গু হয় -খোঁড়া পায়ে কাহাতক এগিয়ে যাওয়া যায়?

কোন মন্তব্য নেই: