“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৫

সেই শেষ দিনে

(C)Image:ছবি




 









==========
© সুনীতি দেবনাথ




সারাটা শরীরে চাবুকের ডোরাকাটা
রক্ত ঝরছে পাগলা ঝর্ণার বেসামাল ধারার মত
টপকে খাঁজের সীমানা।
সেই সে দিন পৃথিবীর অন্য এক দিন
এমন আগুনঝরা পাগলা আকাশ
এমন খুন পিয়াসী নুড়ি পাথর
আর বিশাল সব আদিম প্রস্তরখণ্ড
আগুনে বিছের শুঁয়োর মত শুঁয়োওলা
আখের পাতা, কর্কশ পাতা 
আরও ভয়াল হাত বাড়িয়ে জাপটে ধরছে।
উন্মত্ত সূর্যটাও ক্ষিপ্ত ক্রোধের আক্রোশে
আকাশটাকে নিয়ে মত্ত আগুন খেলায়।
অদূরে সমুদ্র ভীষণ হিংস্র গর্জনে প্রমত্ত
বেলাভূমিতে আছড়ে পড়ছে ঢেউ,
এক মহানাটকের ভীষণতম দৃশ্যপট,
অভিনীত হবে ক্লাইমেক্সের বিমুর্ত দৃশ্য!

ঐ রাক্ষুসেবাহিনী সাদা চামড়ার পশুগুলি 
এসেছিল, আর ঠিক ফাঁকেই
আলকাতরা রঙের কৃষ্ণা জননী
এদিক ওদিক তাকিয়ে কাঠ কাঠ
টুকরো রুটি তুলে দিচ্ছিল কিশোর
ক্ষুধার্ত ছেলেটির হা করা লালচে মুখে।
মায়ের দুচোখ তখন শুকতারার মত
স্নিগ্ধ আলোয় কোমল মন্দাকিনী
দুঃখ যেন পটচিত্রে মূর্তিমতী জননী।
ওরা এলো দুর্ধর্ষ তাতার বাহিনীর মত,
এলো নরক থেকে আসা ভয়ঙ্কর সেই
মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে যমদূতের মত।
ভীত সন্ত্রস্ত কালো মা বুকে জাপটে ধরে
কোমলকান্ত শিশুর থরোথরো দেহ,
শৃঙ্খল বেজে ওঠে ঝনঝন আফ্রিকীয়
সেই সে কালো ক্রীতদাসীর আর
জন্মসূত্রে ক্রীতদাস অবুঝ শিশুটিরও।
ক্রীতদাসী অনুভবে জেনে গেলো
আজ আর নিস্তার নেই স্নেহের 
অপরাধ করেছে সে কাজ ফেলে ঘোরতর।

তারপর নির্দয় চাবুকের ওঠানামা
তারপর আর্ত শিশুর সে কী আর্তনাদ!
জননী তার দাঁতে চেপে দাঁত নিশ্চুপ
ঠোঁট কেটে ঝরলো খুন চোখ জলহীন
আকাশে আগুন জ্বলছে আগুন চোখে
অসহায় শিখা করছে দহন নিজেকে,
চাবকে চাবুক ক্লান্ত ওদের ঝরছে ঘাম
মা চোখ বুঝে চাটছে রক্ত ঠোঁটের
চিবুকের গালের কপাল থেকে নামা
ধারাস্রোতের, রক্তের স্বাদ নোনতা!
হঠাৎ ধুম্! ফট্টাস্!!
আকাশচেরা সমুদ্র কাঁপানো
মৃত্তিকার অনন্ত কাঁপানো
শিশুকণ্ঠের আর্তনাদ!
একবার শুধু একবার তারপর নিস্তব্ধ!
সমগ্র বিশ্ব থমকে শব্দশূন্য গতিশূন্য
সৃষ্টির বিপরীতে মনুষ্যত্বের পতনে
শিশু হত্যার কৃষ্ণতম পাপে কলঙ্কিত,
নির্লজ্জ মানুষের নিষ্ঠুর পাপের ছবি।

গলছে পাথর গলছে, জ্বলছে ঘৃণা জ্বলছে
মা জ্বলছে, পৃথিবী কাঁপছে!
কোথা থেকে আসা ডানা মেলা
শকুনের ঝাঁক খাচ্ছে পাঁক দেহটি ঘিরে
ঠুকরে নিচ্ছে কচি মাংসের টুকরো
মায়ের বুকের পাঁজর হচ্ছে গুঁড়ো গুঁড়ো
সারি বেঁধে ঢাউস কালো পিঁপড়েরা এলো
নিখুঁত কারুকাজে চোখ দুটি
কুরে কুরে শিশু ক্রীতদাসের স্বপ্ন নিয়ে গেলো চলে
খয়েরি সামুদ্রিক হিংস্র সেই 
মাংসাশী কাঁকড়ারা এলোদাঁড়া উঁচিয়ে
এতো স্বাদ মাংসে তোর?
ছুটে গেলো মা যে পাথরে ফুটবল হয়ে
সবুট পায়ে ঐ সাদা জানোয়ারের কিকে
রক্তাক্ত দেহটা পড়ে মাথা থেতলে যায়,
এখনো টাটকা রক্ত!
মা চাটতে লাগলো
সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে 
রক্তবীজ অসুরের রক্ত যেভাবে পান করেন
মহাশক্তি দানবনাশিনী কালিকা।
ইচ্ছে যেন আর কোন শিশু বংশসূত্রে
ক্রীতদাস না হয়, আর কোন ক্রীতদাসী
না হারায় মা হবার পবিত্র অধিকার!

যখন একফোঁটা রক্ত বাকি নেই
দুহাতে পরম মমতায় কঙ্কাল চেপে
জড়ায়ে বুকে পা পা হেঁটে
জলের কাছে নতজানু মা
বিদ্রূপে হেসে ভাসালো সমুদ্রের জলে,
দেখো মুক্ত ক্রীতদাস,
আমি মুক্ত হবো পারাবার, দেখি কোন
সে শক্তি আছে আমার মুক্তিকে রোধে?

সেদিন সমুদ্র দেখেছিল, আকাশ
দেখেছিল, মর্মরিত বাতাস অনুভবে
জেনেছিল,ভূমিও বুঝেছিল এক নারী
কৃষ্ণ আফ্রিকার মৃত্তিকায় জন্ম যার
আটলান্টিক পেরিয়ে ক্যারিবিয়ান দ্বীপে
সমগ্র মানব সভ্যতাকে ধিক্কার জানিয়ে
ইক্ষু ক্ষেতে রচেছিল ভিন্নতর ইতিহাস,
মুক্তির আকাঙ্ক্ষার ভয়ঙ্কর সুন্দর ইতিহাস
অদূরে গাছের ছায়ায় শায়িত কন্যাকে,
পাঁচ মাসের কন্যাটিকে বুকে জড়িয়ে
কপালে শেষ চুম্বন এঁকে নিষ্পলক দেখে
ইক্ষু কাটারির কোপ গলায় বসালো তার,
তুই আর কোনদিন হবি না ক্রীতদাসী মা!
তারপর নিষ্কম্প হাতে নিজকণ্ঠে
কাটারির ঘা একদম সহজ,
বর্তমান আর ভবিষ্যতের ক্রীতদাসীর রক্ত
সেই সেদিন মিলেমিশে সভ্যতাকে
ঘৃণা করেছিল, মুক্তি কিনেছিল!

কোন মন্তব্য নেই: