“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৫

এক ফুট সমান কত সেকেন্ড?


।। রজতকান্তি দাস।।
ক ফুট সমান কত সেকেন্ড? এই প্রশ্নটি শুনে অনেকেই হয়ত হকচকিয়ে যাবেন। ভাববেন এ তো দেখছি পাগলের প্রলাপ। কেউ কেউ হয়ত বলবেন, দাদা, আপনার বাড়ি থেকে পাগলা গারদ যেতে যত সেকেন্ড লাগে তত সেকেন্ড। তা মনে করুন উলুবাড়ি থেকে পল্টন বাজারের দূরত্ব এক কিলোমিটার। আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম উলুবাড়ি থেকে পল্টন বাজার কত দূর? তিনি হয়ত জবাবে আমাকে বললেন, এই হাটা পথে কুড়ি মিনিট। দেখুন, আমি দূরত্ব জানতে চাইলাম আর জবাব পেলাম সময়। এই সময়ের কথা বলে তিনি কিন্তু আমাকে দূরত্বই বুঝিয়েছেন। তাই সময় দূরত্বের একটি পরিমাপক হতে পারে। কিন্তু সমস্যাটা হলো আমি যদি আস্তে হাটি তা হলে কুড়ি মিনিটের জায়গায় তিরিশ মিনিটও হয়ে যেতে পারে। আবার দ্রুত পায়ে হাঁটলে পনেরো মিনিটও হতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো আমি ঠিক কতটা জোরে হাঁটব তা না জানা পর্যন্ত ঠিক কত মিনিট লাগবে তা বলা যাবে না। এছাড়াও আমি হয়ত পায়ে হেটে না গিয়ে রিক্সা নিয়ে নিলাম। অথবা অটো কিংবা বাসে চড়ে বসলাম। তাই উলুবাড়ি থেকে পল্টন বাজারের দূরত্ব কুড়ি মিনিট, এটা বলা যাবে না।
           এই গতির ব্যাপারে আরেকটি আরেকটি সমস্যাও আছে। কোন জিনিসের গতি নির্ভর করে কোন জায়গা থেকে তাকে নিরীক্ষণ করা হচ্ছে তার উপর। আমি হয়ত একটি চেয়ারে বসে আছি আর ভাবছি যে আমি তো স্থির। কিন্তু যদি আমাকে কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে দেখা যায় তাহলে দেখা যাবে যে চলমান এই পৃথিবীর আহ্নিক গতির ফলে আমিও বিপুল গতিতে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে এগিয়ে চলেছি। কেউ কেউ হয়ত ভাবছেন সূর্যতো পূর্ব দিকে ওঠে পশ্চিম দিকে অস্ত যায়। তাই পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে কথাটা কি ঠিক। আসলে ট্রেনে বসে আমরা যেমন দেখি সব কিছু উল্টো দিকে যেতে। সূর্যের বেলাতেও তাই। আমরা যেদিকে চলি, সূর্যকে দেখি তার উল্টো দিকে যেতে। তা আমি স্থির কি না তা নির্ভর করছে আমাকে কোন জায়গা থেকে নিরীক্ষণ করা হচ্ছে তার উপর। অর্থাৎ আমার গতি দর্শক নির্ভর। এখন প্রশ্ন হলো দর্শককে বাদ দিয়ে আমার গতি কিভাবে জানা যাবে। অর্থাৎ আমার দর্শক নিরপেক্ষ পরম গতি তাহলে কি হবে । আদৌ কি আমার কোন পরম গতি আছে যা কোন নিরীক্ষণ স্থলের উপর নির্ভরশীল নয়। এই বিষয়টি নিয়ে ইউরোপের বিজ্ঞানীরা অনেক চিন্তা ভাবনা করেছেন। শেষ পর্যন্ত নিউটন আমাদের জানিয়ে দেন যে প্রতিটি গতিই হলো আপেক্ষিক। এই আপেক্ষিকতাকে বলা হয় নিউটনীয়।
             এই পরম গতির ব্যাপারে আরেকটি সমস্যাও আছে, তা হলো গতির ধরণ। মনে করুন আমি একটি ট্রেনে বসে তীব্র গতিতে এগিয়ে চলেছি। এই চলমান অবস্থায় আমি একটি বলকে উপরের দিকে ছুঁড়ে দিলাম। এই বলটি নেমে এসে আমার হাতেই পড়বে। প্রাচীন যুগে টলেমী পৃথিবী যে স্থির তা প্রমাণ করেছিলেন এভাবেই। তবে টলেমীর যুগ শেষ, এখন আমরা জানি যে চলমান অবস্থাতেও বলটি আবার হাতেই এসে পড়ে। তা আমি দেখলাম যে বলটি সোজা উপরের দিকে উঠে আবার নিচের দিকে নেমে এলো। যাকে বলে to-and-fro motion.কিন্তু ট্রেনের বাইরে থেকে কেউ যদি এই বলের গতিকে নিরীক্ষণ করত তাহলে সে দেখতে পেতো যে এর গতি হলো ধনুকাকৃতি। অর্থাৎ projectile কারণ যে জায়গা থেকে আমি বলটিকে ছুঁড়ে দিয়েছিলাম আর যে জায়গায় বলটি এসে আমার হাতে পড়ল তার মধ্যে খানিকটা দূরত্ব আছে। এখন প্রশ্ন হলো যে এই বলটির গতির ধরণ আসলে কি। এক্ষেত্রে নিউটনীয় উত্তর হবে এর কোন আসল গতির ধরণ নেই। এর গতির ধরণ নিরীক্ষণ স্থল সাপেক্ষ এবং আপেক্ষিক। তাই কে স্থির, কে গতিশীল তা একেকটি নিরীক্ষণ স্থল থেকে একেক রকম দেখায়। আমি একটি ট্রেনের ডাইনিং কারে বসে আহার করলাম। পরিচারককে জিজ্ঞেস করলে বলবে, বাবু তো সতেরো নম্বর টেবিলে বসেই আহারটা সারলেন। অন্য একজন বলতে পারেন যে আমি প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার দূরত্ব জুড়ে আহারটা সেরেছি।
           আমাদের পরম সৌভাগ্য যে এদেশে এমন এক কবি জন্মেছিলেন যিনি বিশ্বের বিজ্ঞানের সমস্ত অগ্রগতি নিয়ে নিয়মিত চিন্তা-চর্চা করতেন। বিদেশ থেকে বিজ্ঞানের বই আনিয়ে পড়তেন। এমন কি তিনি ছিলেন সায়েন্টিফিক আমেরিকানপত্রিকার নিয়মিত গ্রাহক ও পাঠক। তিনি লিখেছেন যে অনেক কিছু তিনি বুঝতে পারেন না, তাও পড়তে থাকেন। এমন কবি এই পোড়া বাংলায় একজনই আছেন আর তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ । রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন সাড়ে বারো বছর তখন তত্ত্ববোধিনীনামের পত্রিকায় তাঁর যে বিজ্ঞান বিষয়ক লেখাটি বেরিয়েছিল সেটাই কবির প্রথম প্রকাশিত গদ্য। কবি তাঁর শেষ জীবনে তিনি বিশ্ব পরিচয়নামে একটি জনপ্রিয় বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থও লিখে গেছেন। ইদানীং কালে এই বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ হয়ে আমেরিকায় বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তা ধান বানতে রবির গীত শুরু করার একটাই কারণ যে এই গতির আপেক্ষিকতার বিষয়টি আমি প্রথম জানতে পারি রবীন্দ্রনাথেরই আমার জগৎনামে একটি প্রবন্ধ পড়ে।
          ‘আমার জগৎপ্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধগুলো মধ্যে অন্যতম বলে আমি মনে করি। এখানে নিউটনীয় গতি বিজ্ঞানের আপেক্ষিকতাকে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে তাঁর কবি-সুলভ ভাষায় কাব্যিক ঢঙে ব্যাখ্যা করেছেন তার নজির বিশ্বের আর কোথাও আছে কি না তা জানি না। এই নিউটনীয় গতি বিজ্ঞানের আপেক্ষিকতা কবিকে আকৃষ্ট করেছিল কারণ তিনি এর মধ্যে উপনিষদয় ভাবধারার বৈজ্ঞানিক সমর্থন পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের এই প্রবন্ধ থেকে খানিকটা অংশ এখানে তুলে দিলাম।
            “এখনকার কালের পণ্ডিতেরা বলতে চান, চলা ছাড়া আর কিছুই নেই, ধ্রুবত্বটা আমাদের বিদ্যার সৃষ্টি মায়া। অর্থাৎ জগতটা চলছে কিন্তু আমাদের জ্ঞানেতে আমরা তাকে একটা স্থিরত্বের কাঠামোর মধ্যে দাঁড় করিয়ে দেখছি নইলে দেখা বলে জানা বলে পদার্থটা থাকতই নাঅতএব চলাটাই সত্য এবং স্থিরত্বটা বিদ্যার মায়া। আবার আরেক কালের পণ্ডিত বলেছিলেন, ধ্রুব ছাড়া কিছুই নেই, চঞ্চলতাটা অবিদ্যার সৃষ্টি। পণ্ডিতেরা যতক্ষণ এক পক্ষের ওকালতি করবেন ততক্ষণ তাঁদের মধ্যে লড়াইয়ের অন্ত থাকবে না। কিন্তু সরল বুদ্ধি জানে, চলাও সত্য, থামাও সত্য। অংশ, যেটা নিকটবর্তী, সেটা চলছে; সমগ্র, যেটা দূরবর্তী, সেটা স্থির রয়েছে।
          “ সম্বন্ধে একটা উপমা আমি পূর্বেই ব্যবহার করেছি, এখনও ব্যবহার করব। গাইয়ে যখন গান করে তখন তার গাওয়াটা প্রতি মুহূর্তে চলতে থাকে। কিন্তু সমগ্র গানটা সকল মুহূর্তকে ছাড়িয়ে স্থির হয়ে আছে। যেটা কোনো গাওয়ার মধ্যেই চলে না সেটা গানই নয়, যেটা কোনো গানের মধ্যে স্থিরপ্রতিষ্ঠ হতে না পারে তাকে গাওয়াই বলা যেতে পারে না। গানে ও গাওয়ায় মিলে যে সত্য সেই তো— ‘তদেজতি তন্নৈজতি তদ্দূরে তদ্বন্তিকে। সে চলেও বটে চলে নাও বটে, সে দূরেও বটে নিকটেও বটে।
         এই যে ভারতীয় দর্শন তা অনেকটা ইউরোপীয় ভাববাদী দর্শনের মতোই। অর্থাৎ এই জগতকে আমরা যেভাবে দেখতে চাই জগত সে রকম। এই subjective দর্শন এক সময় বস্তুবাদের সব চাইতে বড় শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কার্ল মার্ক্স সহ অন্যান্য বস্তুবাদী দার্শনিকদের কাছে এই subjectivity এমন এক চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছিল যে বৌদ্ধিক জগতে মার্ক্সবাদের প্রতিষ্ঠা পাওয়াটাই সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল কারণ এই ভাববাদী দর্শনের সামনে ঢাল নিয়ে দাঁড়িয়েছিল নিউটনীয় গতি বিজ্ঞান যা কোন বস্তুর পরম গতিকেই নির্দেশ করতে পারে নি। এমন কি এই গতি বিজ্ঞান কাল বা সময়কেই সঠিক ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে নি। এই সুযোগে ভাববাদীরা বলতে শুরু করলেন যে গতি যেমন আপেক্ষিক তেমনি সময়ও শুধুমাত্র একটি concept যা দুটো ঘটনার মধ্যে আমাদের মনে এক ধারণার জন্ম দেয় ঠিকই তবে বাস্তবে এর কোন অস্তিত্ব নেই। এই ভাবধারার ফলে চার্লস ডারউইনের প্রাণিজগতের বিবর্তন কিংবা মার্ক্সবাদে বর্ণিত মানব সমাজের বিবর্তনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।
        ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন আমার জগৎলিখছেন তখন তিনি জানতেন না যে গতি বিজ্ঞানের এই নিউটনীয় আপেক্ষিকতার এইসে কি তেইসেকরে দিয়েছেন ২৬ বছরের এক ইহুদী যুবক যার নাম এলবার্ট আইনস্টাইন। ১৯০৫ সালে তাঁর গবেষণা পত্র প্রকাশিত হলেও ১৯২১ সাল পর্যন্ত তা বিজ্ঞান সমাজে স্বীকৃতি পায় নি। ইউরোপের অধিকাংশ বিজ্ঞানীরাও জানতেন না যে নিউটনীয় ভাবধারার সমাপ্তি ঘটে গেছে। তাই ১৯১৫ সালে লেখা রবীন্দ্রনাথের এই ভাববাদী প্রবন্ধে তৎকালের বৈজ্ঞানিক চিন্তা ধারার প্রতিফলন ঘটেছে। তবে আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব একদিকে যেমন ইউরোপের ভাববাদী দর্শন থেকে দার্শনিকদের সরিয়ে এনেছিল, তেমনি মার্ক্সবাদের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল।
          ‘কালকিংবা সময়নিয়ে নিউটনীয় গতি বিজ্ঞান কোন সদর্থক ভূমিকা পালন করতে পারেনি। নিউটনের মতে সময় হলো এমন কিছু যার নিজস্ব একটি গতি আছে, এই গতির পরিবর্তন হয় না এবং যা অন্য সবকিছু থেকে প্রভাবমুক্ত। আসলে ঐ সময়ে বিজ্ঞান এতটা উন্নতি করতে পারেনি যার উপর ভিত্তি করে সময়ের মতো একটি জটিল বিষয় নিয়ে কোন ধরণের সিদ্ধান্তে আসা যায়। তবে নিউটন সময়নিয়ে যে মত দিয়েছিলেন তা তার নিজেরই হজম হয় নি। বন্ধু হাইজেনকে লেখা একটি চিঠিতে এ ব্যাপারে তিনি তাঁর ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন। পরবর্তী কালে দেখা গেছে যে নিউটন তাঁর সমস্ত ভুল ভ্রান্তি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। কিন্তু তাঁর উপায় ছিল না কারণ বিজ্ঞান একটি ধারাবাহিকতা মেনেই চলে। বিজ্ঞানের ইতিহাসও এক ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস। বিজ্ঞানে কোন কিছু তখনই আবিষ্কার হয় যখন এর জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি তত্ত্ব আবিষ্কারের জন্যও ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েই ছিল। তাই নিউটন, গালিলিও, কেপলার কিংবা আইনস্টাইন তাদের নিজের সময়ে যা কিছু আবিষ্কার করে গেছেন সেই সময়ের ভিত্তিতে বিবেচনা করে নিউটনকেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জিনিয়াসহিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
         বিজ্ঞান যখন প্রমাণের ভিত্তিতে কোন কিছুর ব্যাখ্যা করতে পারে না তখন দার্শনিকরা যুক্তির ভিত্তিতে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। অনেক ক্ষেত্রে তা বিজ্ঞানের পথ প্রদর্শকের কাজও করে। আইনস্টাইনের এক কাকা ছিলেন যার নাম ছিলতালমুদ। আইনস্টাইন তাঁর কিশোর বয়স থেকেই এই তালমুদ কাকার সঙ্গে দর্শন নিয়ে আলোচনা করতে ভালবাসতেন। পরবর্তীকালে দর্শন নিয়ে বিস্তর পড়াশুনাও করেছেন। কিছু কিছু কম্যুনিস্টদের মতে আইনস্টাইন কার্ল মার্ক্সের লেখা জার্মান আইডিওলজিবইটি থেকেই তাঁর রিলেটিভিটি তত্ত্বের ধারণাটি পেয়েছিলেন। তবে আমার ব্যক্তিগত মতামত হল যে এঙ্গেলসের লেখা ‘Anti Duhring’ বইটিতে তিনি Space and Time নামে একটি চ্যাপ্টারে যা কিছু লিখেছেন তার সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানের মিল খুব বেশি নেই। বরং তিনি কিছু কিছু ব্যাপারে উল্টো কথাই বলেছেন। তবে সময়কে আদি অন্তহীন হিসেবে বর্ণনা করেও মার্ক্সবাদে একটি কথা বলা হয়েছে যে সময় হল একটি মাত্রা (Dimension) যা কোন 'ধারণা' নয়। তাই সময়কে একটি মাত্রা ধরেই কার্ল মার্ক্স তাঁর ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এযাবৎ এর চাইতে ভাল ব্যাখ্যা আর কেউ দিতে পারেন নি।
          মার্ক্সবাদ অনেক পরম সত্যকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছে ঠিকই কিন্তু বিজ্ঞানই যেখানে চরম সত্যকে তুলে ধরতে পারছে না সেখানে কোন মতবাদই চরম সত্য হতে পারে না। তাই চরম সত্যের কথা ভুলে গিয়ে পরম সত্যকে নিয়েই মানব সভ্যতা কিছুটা পথ এগিয়ে চলে চরম সত্যের লক্ষ্যে পৌঁছানোর আশা নিয়ে, এটাই সভ্যতার রীতি। কোনকিছুকে চরম সত্য বলে ধরে নেওয়া হলে সভ্যতার গতিও সেখানেই থমকে দাঁড়াবে। উপনিষদের ঋষিরা একটা কথা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে পরিবর্তনই হলো একমাত্র সত্য যা অপরিবর্তনীয়। চলতে থাকাই একমাত্র নিয়ম। অতএবচরৈবেতি। উপনিষদের এই কথাটি মেনে নিয়ে রবীন্দ্রনাথও চলেছেন এক পরম সত্যের খোঁজে। শেষ পর্যন্ত বস্তুবাদকেও মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু যখন তাঁর মন উপনিষদীয় ভাববাদী ধারায় আচ্ছন্ন হয়েছিল তখন তিনি কি লিখছেন তা জানার জন্য কবির আমার জগৎপ্রবন্ধ থেকে কিছুটা অংশ তুলে ধরছি। এখানে 'সময়' সম্পর্কে কবি লিখছেন, “এই তো গেল দেশ। তার পরে কাল। যদি এমন হতে পারত যে আমি যে কালটাতে আছি সেটা যেমন আছে তেমনই থাকত অথচ গাছের ঐ পাতাটার সম্বন্ধে এক মাসকে এক মিনিটে ঠেসে দিতে পারতুম তবে পাতা হওয়ার পূর্ববর্তী অবস্থা থেকে পাতা হওয়ার পরবর্তী অবস্থা পর্যন্ত এমনি হুস করে দৌড় দিত যে আমি ওকে প্রায় দেখতে পেতুম না। জগতের যে সব পদার্থ আমাদের কাল থেকে অত্যন্ত ভিন্ন কালে চলছে তারা আমাদের চারদিকে থাকলেও তাদের দেখতেই পাচ্ছিনে এমন হওয়া অসম্ভব নয়। .
..
              “আমার মনে আছে, একদিন দিনের বেলা আমি অল্পক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমি সেই সময়ের মধ্যে দীর্ঘকালের স্বপ্ন দেখেছিলেম। আমার ভ্রম হল আমি অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছি। আমার পাশের লোককে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল আমি পাঁচ মিনিটের বেশি ঘুমোইনি। আমার স্বপ্নের ভিতরকার সময়ের সঙ্গে আমার স্বপ্নের বাহিরের সময়ের পার্থক্য ছিল। আমি যদি একই সময়ে এই দুই কাল সম্বন্ধে সচেতন থাকতাম তাহলে হয় স্বপ্ন এত দ্রুতবেগে মনের মধ্যে চলে যেত যে, তাকে চেনা শক্ত হয় নয় তো সেই স্বপ্নবর্তীকালের রেলগাড়িতে করে চলে যাওয়ার দরুন স্বপ্নের বাইরের জগতটা রেলগাড়ির বাইরের দৃশ্যের মতো বেগে পিছিয়ে যেতে থাকত; তার কোনো একটা জিনিসের উপর চোখ রাখা যেত না। অর্থাৎ স্বভাবত যার গতি নেই সেও গতি প্রাপ্ত হত।
             “যে-ঘোড়া দৌড়োচ্ছে তার সম্বন্ধে এক মিনিটকে যদি দশঘণ্টা করতে পারি তাহলে দেখব তার পা উঠছেই না। ঘাস প্রতিমুহূর্তে বাড়ছে অথচ আমরা তা দেখতেই পাচ্ছিনে। ব্যাপক কালের মধ্যে ঘাসের হিসাব নিয়ে তবে আমরা জানতে পারি ঘাস বাড়ছে। সেই ব্যাপক কাল যদি আমাদের আয়ত্তের চেয়ে বেশি হত তাহলে ঘাস আমাদের পক্ষে পাহাড় পর্বতের মতোই অচল হত।
অতএব আমাদের মন যে কালের তালে চলছে তারই বেগ অনুসারে আমরা দেখছি বটগাছটা দাঁড়িয়ে আছে এবং নদীটা চলছে। কালের পরিবর্তন হলে হয়তো দেখতুম বটগাছটা চলছে কিংবা নদীটা নিস্তব্ধ।
           “তাহলেই দেখা যাচ্ছে, আমরা যাকে জগৎ বলছি সেটা আমাদের জ্ঞানের যোগে ছাড়া হতেই পারে না। যখন আমরা পাহাড় পর্বত সূর্য চন্দ্র দেখি তখন আমাদের সহজেই মনে হয় বাইরে যা আছে আমরা তাই দেখছি। যেন আমার মন আয়নামাত্র। কিন্তু আমার মন আয়না নয়, তা সৃষ্টির প্রধান উপকরণ। আমি যে মুহূর্তে দেখছি সেই মুহূর্তে সেই দেখার যোগে সৃষ্টি হচ্ছে। যতগুলি মন ততগুলি সৃষ্টি। অন্য কোনো অবস্থায় মনের প্রকৃতি যদি অন্য রকম হয় তবে সৃষ্টিও অন্য রকম হবে।
              “আমার মন ইন্দ্রিয়যোগে ঘন দেশের জিনিসকে একরকম দেখে, ব্যাপক দেশের জিনিসকে অন্য রকম দেখে, দ্রুতকালের গতিতে এক রকম দেখে, মন্দকালের গতিতে অন্য রকম দেখেএই প্রভেদ অনুসারে সৃষ্টির বিচিত্রতা। আকাশে লক্ষকোটি ক্রোশ পরিমাণ দেশকে যখন সে এক হাত আধ হাতের মধ্যে দেখে তখন দেখে তারাগুলি কাছাকাছি এবং স্থির। আমার মন কেবল যে আকাশের তারাগুলিকে দেখছে তা নয়, লোহার পরমাণুকে নিবিড় এবং স্থির দেখছেযদি লোহাকে সে ব্যাপ্ত আকাশে দেখত তাহলে দেখত তার পরমাণুগুলি স্বতন্ত্র হয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। এই বিচিত্র দেশকালের ভিতর দিয়ে দেখাই হচ্ছে সৃষ্টির লীলা দেখা। সেই জন্যেই লোহা হচ্ছে লোহা, জল হচ্ছে জল,মেঘ হচ্ছে মেঘ।
             রবীন্দ্রনাথের এই ব্যাখ্যা সম্পর্কে আধুনিক বিজ্ঞানও একমত। তফাৎ শুধু একটাই যে রবীন্দ্রনাথ এই কালের বিষয়টিকে শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রবন্ধে ব্যক্তি মানসের কাল সম্পর্কে একটি ধারণা হিসেবে বর্ণনা করেছেন যা ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন হতে পারে। অর্থাৎ সাবজেক্টিভিটাই তাঁর মনে বেশি প্রভাব ফেলেছে। এখানেই আইনস্টাইনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের তফাৎ । আইনস্টাইনের কাছে সময় হল একটি মাত্রা যার সঙ্কোচন কিংবা প্রসারণ নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনে চলে যা গণিতের সমীকরণ দিয়ে পরিমাপ করা যায়। ভিন্ন ভিন্ন লোকের কাছে সময় ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে কিন্তু তা ব্যক্তি মানসের ভ্রম নয়। আইনস্টাইন 'টাইম ডায়েলেশন' নিয়ে কতকগুলো গাণিতিক সমীকরণও দিয়েছেন এবং গণিতের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন যে সময় হলো দৈর্ঘ্য, প্রস্ত কিংবা উচ্চতার মতই একটি মাত্রা যার গতি নির্ভর করে মাধ্যাকর্ষণ ও কোন বস্তুর গতির উপর। পরবর্তীকালে আইনস্টাইনের তত্ত্ব নানা ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষার দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে।
           এবারে আমরা আমাদের মূল প্রশ্নে ফিরে যাই যা ছিল এক ফুট সমান কত সেকেন্ড। আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম যে পল্টন বাজার কত দূর। জবাবে তিনি বললেন কুড়ি মিনিট। কিন্তু এই জবাবের মধ্যে সমস্যাটা হল দুটো। প্রথমত এখানে আমার একটি নির্দিষ্ট গতিকে ধরে নিতে হবে। দ্বিতীয়ত আমার গতি একেক জায়গা থেকে একেক রকম দেখায়। কেউ যদি একই গতিতে আমার পেছনে পেছনে আসে তাহলে তার জন্য আমি স্থির। কাজেই আমার গতির একে তো কোন ঠিক নেই তার উপরে সেটা আপেক্ষিক, তাই সময় দিয়ে দূরত্ব বলাটা হবে মহা বেকুফি। কিন্তু যদি এমন কিছু আবিষ্কার হয়ে যায় যার গতি মোটেই আপেক্ষিক নয় অর্থাৎ যে কোন নিরিক্ষণস্থল থেকে একই দেখায় এবং এই গতি সব সময় একই থাকে তাহলে কিন্তু সময় দিয়ে দূরত্বকে বলা যেতে পারে। এখন দেখা যাক এরকম কোন কিছু আছে কি না। যদি থেকে তাহলে কিন্তু এক ফুট সমান কত সেকেন্ডের উত্তরও বেরিয়ে যাবে।
           ১৮৮৭ সালে অ্যালবার্ট অ্যাব্রাহাম মাইকেলসন ও এডওয়ার্ড মোর্লে নামে দুজন বিজ্ঞানী বার্লিনের শহরতলি পটসডাম নামের এক জায়গা থেকে একটি পরীক্ষা চালান। এই পরীক্ষাটি যদিও মূলত মাইকেলসনেরই কল্পনাপ্রসূত, তা সত্ত্বেও এই পরীক্ষাটি মাইকেলসন-মোর্লে এক্সপেরিমেন্ট নামে সারা বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করে নিয়েছে। ঐ সময়ে একটি ধারণা ছিল যে সারা ব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে আছে এমন এক পদার্থ যার নাম ইথার। এই ইথারের ধারণাটি এসেছিল কিছুটা অজ্ঞতা থেকেই। তাই মাইকেলসন ও মোর্লের মনে এই ধারণাটি এসেছিল পৃথিবী যে সূর্যের চারদিকে প্রদক্ষিণরত অবস্থায় তীব্র গতিতে চলছে তার প্রভাব ইথারের উপর কিভাবে পড়ে তা জানা দরকার। তা ইথার বলে যেখানে কোন কিছু নেই সেখানে কেঁচো খুড়তে গেলে কেঁচো কি করে বেরুবে। তাই কেঁচো যে বেরোয়নি তা বলার অপেক্ষা রাখে না ঠিকই, তবে এই পরীক্ষাটি খ্যাতি অর্জন করেছিল কারণ এই পরীক্ষাতে কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়েছিল। শুধুমাত্র এই পরীক্ষাটি ডিজাইন করার জন্যই ১৯০৭ সালে মাইকেলসন নোবেল পুরষ্কার পেয়ে যান। এটাই হলো পৃথিবীর একমাত্র ফেইল্ড এক্সপেরিমেন্টযা এই পুরষ্কার পেল।
            মাইকেলসন-মোর্লে পরীক্ষায় যে অদ্ভুত জিনিস দেখা গেল তা হলো পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিম দু দিকেই আলোর গতি সমান। এতে কি আশ্চর্য হবার মতো কিছু আছে? হ্যাঁ, অবশ্যই আছে। মনে করলাম যে আমি পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে তীব্র গতিতে এগিয়ে চলেছি। এখন যদি কোন কিছুকে একই গতিতে পূর্ব-পশ্চিম দুদিকে ছুঁড়ে দিই তাহলে আমি কিন্তু পূর্ব দিকের জিনিসটির গতি দেখব কম আর পশ্চিম দিকেরটার গতি দেখব বেশি। কারণ আমি তো স্থির নই। দুদিকের জিনিসটির একই গতি দেখতে পারি তখনই যদি আমি স্থির থাকি। কিন্তু মাইকেলসন কিংবা মোর্লে তাঁদের স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন নি যে পৃথিবী স্থির। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো যে এর একশ বছরেরও পর এমন কিছু লোক আছেন যারা নিজেদের বিজ্ঞানী নাম দিয়ে এই বিখ্যাত পরীক্ষাটিকে সম্বল করে পৃথিবী স্থির প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে একজন হলেন বাংলাদেশের ধর্মীয় মৌলবাদী বিজ্ঞানী নুরল ইসলাম যিনি পৃথিবী নয়, সূর্য ঘোরেনামে একটি বই লিখে অখ্যাতি ও প্রচুর অনর্থ কামিয়েছেন।
             মাইকেলসন ও মোর্লে প্রথমে ভেবেছিলেন তাদের পরীক্ষায় ভুল হচ্ছে। তাই তারা আরো দক্ষতার সঙ্গে বার বার এই পরীক্ষা চালান। কিন্তু রেজাল্ট একই বেরোয়। শেষ পর্যন্ত যখন তারা তাদের পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করলেন তখন সারা পৃথিবী বিজ্ঞানী মহল এক চরম আতান্তরে পড়ে গিয়েছিল। কারণ নিউটনীয় গতি বিজ্ঞানকে মূলধনকে এই ফলাফলকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব ছিল না। আসলে নিউটনীয় গতি বিজ্ঞান তখন থেকেই আকাশে সিঁদুরে মেঘ দেখতে শুরু করে দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ১৯০৫ সালে প্রকাশিত হলো আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। এই তত্ত্বে অন্য আরো অনেক কিছুর সঙ্গে এটাও প্রমাণ করা হয়েছে যে আলোকের গতি হলো এক ধরণের মহাজাগতিক ধ্রুবকযার কোন পরিবর্তন হয় না। এমন কি যে কোন নিরিক্ষণস্থল থেকে দেখলেও আলোর গতির তারতম্য হয় না। এই গতি প্রতি সেকেন্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার। এই গতি হলো ব্রহ্মাণ্ডের সর্বোচ্চ সম্ভবপর গতিবেগ। তাই আলোর গতিকে একটি ধ্রুবক হিসেবে ব্যবহার করে আইনস্টাইন একদিকে যেমন বস্তু ও শক্তির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করেন তেমনি টাইম ও স্পেসের মধ্যেও সম্পর্ক স্থাপন করে বিজ্ঞানকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেন।
            এখন আমরা আবার সেই পুরনো প্রশ্নেই ফিরে যাচ্ছি। এক ফুট সমান কত সেকেন্ড? আমাদের আরেকটি প্রশ্ন ছিল যে এমন কি কিছু আছে যার গতি সব সময় সমান তো থাকেই, এমন কি যে কোন নিরীক্ষণ স্থল থেকে দেখলেও তার পরিবর্তন হয় না। অর্থাৎ যে গতি হলো অনাপেক্ষিক ও অপরিবর্তনীয়। দেখা যাচ্ছে যে আলোর গতি হলো তাই। তাহলে এক ফুট যেতে আলোর যত সেকেন্ড লাগবে, এক ফুট সমান তত সেকেন্ড। ব্যাপারটা পরিষ্কার। তা এক ফুট যেতে আলোর লাগে ০.০০০০০০০০১০ সেকেন্ড। তাই এক ফুট সমান ০.০০০০০০০০১০ সেকেন্ড। তাই আমরা যদি একটি এক ফুট চতুর্মাত্রিক কিউবের কথা ভাবি তা হবে ১ ফুট লম্বা, ১ ফুট চাওড়া, ১ ফুট উঁচু ও ততটুকু সময় যতটুকু সমান এক ফুট। কতটুকু সময় সমান এক ফুট এটা এখন আমাদের জানা।

কোন মন্তব্য নেই: