“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৫

আয়স কাল ০৬

(C)Image:ছবি
(দক্ষিণ আফ্রিকীয় লেখক জে এম কোয়েটজি-র লেখা 'এজ অব আয়রন'- উপন্যাসের  বাংলা অনুবাদের ষষ্ঠ  ভাগঃ -- শিবানী দে )



   
ফ্লোরেন্স ফিরে এসেছে । সঙ্গে তার বাচ্চা মেয়ে দুটো আছেই, পনেরো বছরের ছেলে ভেকিকেও নিয়ে এসেছে।
আমি শুধোলাম, 'ভেকি কি এখানে অনেক দিন থাকবে ? ঘরে ওর জন্য কি  জায়গা হবে ?'
ফ্লোরেন্স বলল, 'আমার সঙ্গে না থাকলে ও ঝামেলাতে জড়িয়ে পড়বে । আমার দিদি ওকে আর দেখাশোনা করতে পারছে না । গুগুলেতুর অবস্থা খুব, খুবই খারাপ ।'
তো আমার বাড়ির পেছনের অংশে এখন পাঁচ পাঁচটা লোক । পাঁচজন মানুষ, একটা কুকুর ,আর দুটো বেড়াল । সেই যে ছড়া আছে না----
'একটা বুড়ি ছিল, সে যে থাকত জুতোর ভেতরে,
ভাবত বসে সারাটা দিন কি করে সে কি  করে ।'

মাসের শুরুতে যখন ফ্লোরেন্স চলে যাচ্ছিল, তখন আমি তাকে বুঝিয়েছিলাম যে বাড়ির কাজগুলো আমিই করে নিতে পারব । কিন্তু সবকিছুই পড়ে রইল, আর শিগগিরই উপরতলার ঘরটা কোল্ড ক্রিম, ময়লা চাদর, ট্যালকাম পাউডারের মেশানো একটা টকটক সোঁদা গন্ধে ভরে গেছে । সে ফিরবার পর যখন ঘরের হাল ধরছিল, আমি লজ্জিতমুখে তার দৃষ্টি অনুসরণ করতে থাকলাম । ওর পেছনে দুটো হাত জড়ো, নাকের পাটা ফুলছিল, চোখের চশমা ঝকঝক করছিল, সে আমার অকর্মণ্যতা জরিপ করছিল । তারপর সে কাজে লেগে গেল । সন্ধের আগেই রান্নাঘর এবং বাথরুম তকতকে হয়ে গেল, বেডরুম হল কড়কড়ে পরিচ্ছন্ন,  ঘরের হাওয়ায় আসবাবপত্র পালিশের গন্ধ । আমি আগের মতই ফ্লোরেন্সকে বললাম, 'চমৎকার, ফ্লোরেন্স । তুমি না থাকলে যে আমি কি করতাম !' কি করতাম তা অবশ্যই জানি, আমি বুড়োবয়সের উদাসীন অপরিচ্ছন্নতায় ডুবে যেতাম ।

আমার কাজ শেষ করে ফ্লোরেন্স নিজের কাজ ধরল । উনুনে রাতের রান্না চড়াল, ছোট মেয়েদুটোকে বাথরুমে নিয়ে গেল । বাচ্চাদুটোর কান রগড়ে, হাতপায়ের ভাঁজ শক্ত হাতে ডলে ডলে পরিষ্কার করে স্নান করিয়ে দিচ্ছিল, বাচ্চাদুটো ঘ্যান ঘ্যান করলেও  পাত্তা দিচ্ছিল না । ওর কাজ দেখে মনে হল, অত্যন্ত প্রশংসনীয় মহিলা, তবে আমার ভাগ্য ভাল যে সে আমার মা নয় !

ফ্লোরেন্সের ছেলেটাকে দেখলাম উঠোনে পায়চারি করছে । আগে তার নাম ছিল 'ডিগবি', এখন 'ভেকি' । বয়সের তুলনায় লম্বা, ফ্লোরেন্সের মত গম্ভীর চেহারা । বললাম, 'ভাবা যায় না তুমি কত লম্বা হয়ে গেছ ।' সে কোন জবাব দিল না । আগে সে কেমন খোলামেলা স্বভাবের ছিল, যখনই আসত, ছুটে যেত খরগোসের খাঁচার কাছে, বড় মোটা মাদী খরগোসটাকে টেনে বের করে বুকে চেপে ধরত । এখন সে বন্ধুবান্ধবদের থেকে দূর, তাই নিশ্চয়ই অসন্তুষ্ট, কারো বাড়ির পেছনের ঘরে ছোটছোট বোনেদের সঙ্গে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে ।

 ফ্লোরেন্সকে জিগ্যেস করলাম, 'স্কুল কবে থেকে ছুটি হল ?'
'গত সপ্তাহ থেকে । গুগুলেতু, লাঙ্গা, ন্যাঙ্গার সব স্কুল বন্ধ । বাচ্চাদের কিছু করবার নেই । তাই ওরা রাস্তায় ছোটাছুটি করছে, আর ঝামেলায় পড়ছে । তাই মনে হল এখানেই ভাল । অন্তত: আমি তাকে চোখে চোখে রাখতে পারব ।'

'বন্ধুবান্ধব না থাকলেও তার অশান্তি বেড়ে যাবে ।'
সে কাঁধ ঝাঁকাল; তার মুখেও কোন হাসির আভাস নেই । আমি অবশ্য স্মরণ করতে পারি না তাকে কখনো মৃদু হাসতেও দেখেছি কি না । যখন বাচ্চাদের সঙ্গে একান্তে থাকে তখন হয়তো হাসে ।
ফ্লোরেন্স জিগ্যেস করল, 'লোকটা কে ?'
আমি বললাম, 'ওর নাম মি: ভারকুয়েইল । ভারকুয়েইল, ভারকুইল, ভারস্‌কুইল----সবই ও বলে । আমি অবশ্য কখনো এরকম নাম শুনিনি । আমি কিছুদিনের জন্য ওকে এখানে থাকতে দিচ্ছি। ওর একটা কুকুর আছে । বাচ্চাদের বলবে, যদি কুকুরটার সঙ্গে ওরা খেলে, তাহলে ও যেন বেশি না খ্যাপায় । কুকুরটা বাচ্চা, ওদের আক্রমণ করতে পারে ।'

ফ্লোরেন্স মাথা নাড়ল ।
'লোকটা যদি ঝামেলা করে, তাহলে আমি ওকে চলে যেতেই বলব ,' আমি বললাম , 'কিন্তু অকারণে তো তাকে আমি চলে যেতে বলতে পারিনা ।'
ঠাণ্ডা দিন, বাতাস বইছে । আমি ড্রেসিং গাউন পরে ব্যালকনিতে বসেছিলাম । নিচে লনে  ভারকুয়েইল পুরোনো ঘাস কাটার যন্ত্রটিকে খুলে সরিয়ে রাখছিল, ছোট মেয়েদুটো তাকে দেখছিল । ওদের মধ্যে বড়টা, ফ্লোরেন্স যার নাম 'হোপ' বলেছে, (ফ্লোরেন্স আমাকে আসল নাম বলতে বিশ্বাস করে না ।) লোকটার দৃষ্টির বাইরে হাঁটুর নিচে হাত রেখে উবু হয়ে বসেছিল । তার পায়ে নতুন লাল চটি । বাচ্চাটা, যার নাম 'বিউটি', সেও লাল চটি পায়ে, টলমল করে লনের ঘাসে হাঁটছিল । মাঝে মাঝে লাথি মারছিল, আবার হঠাৎ হঠাৎ বসে পড়ছিল ।
আমি দেখছিলাম, বাচ্চাটা আঙ্গুলগুলো মুঠো করে হাতদুটো ছড়িয়ে ভারকুয়েইল-এর দিকে এগোচ্ছিল । ঘাসকাটা যন্ত্রটার উপর পড়বার উপক্রম হতেই ভারকুয়েইল তাকে ধরে ফেলল, তার মোটা মোটা নরম হাত ধরে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে গেল ।টলমল পায়ে এগোতে বাচ্চাটা আবার পরে যাচ্ছিল, সে আবার তাকে ধরে নিল । এটা যেন একটা খেলার মত হয়ে যাচ্ছিল । কিন্তু গোমড়া ভারকুয়েইল কি খেলবে ?
আবার বিউটি লোকটার দিকে এগিয়ে পড়ে যাচ্ছিল, আবার সে তাকে বাঁচাল । তারপর, কি আশ্চর্য, কি আশ্চর্য, সে আধখোলা মেশিনটা একপাশে সরিয়ে রাখল, তারপর একহাতে বাচ্চাটাকে, একহাতে হোপকে ধরে ঘুরতে লাগল, প্রথমটা আস্তে আস্তে, তারপর দ্রুত । হোপ লাল চটি পরে দৌড়ে দৌড়ে ঘুরছিল, আর বাচ্চাটার পা তো মাটিতে নেই, খুশিতে চিৎকার করে শূন্যে ঘুরছিল । কুকুরটা গেটের পেছনে দাঁড়িয়ে লাফাচ্ছিল  ও ডাকছিল । এত হল্লা, এত উত্তেজনা !
এই সমইয়েই ফ্লোরেন্স নিশ্চয়ই দেখা দিয়েছিল, কারণ ঘোরা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল । দু একটা নরম কথাবার্তা, তারপর হোপ ভারকুয়েইলের হাত ছেড়ে দিল, বোনকেও বুঝিয়ে সুজিয়ে ছাড়াল । তারপর দুবোনে আমার নজরের বাইরে চলে গেল । দরজা বন্ধ করার শব্দ পেলাম । কুকুরটাও যেন হতাশ হয়ে কুঁইকুঁই করতে লাগল । ভারকুয়েইল ও লন চাঁছার কাজে লেগে গেল। আধঘণ্টা পর বৃষ্টি নামল ।
ভেকি ছেলেটা ফ্লোরেন্সের বিছানায় বসে পুরোনো পত্রিকার পাতা উলটে সময় কাটায়, আর ঘরের কোণ থেকে হোপ সম্ভ্রমপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকে দেখতে থাকে । মাঝে মাঝে যখন আর পড়তে ইচ্ছে করে না, একটা টেনিস বল নিয়ে ড্রাইভওয়েতে  চলে যায় আর গ্যারেজের দরজায় বল মেরে মেরে খেলতে থাকে, শব্দটা আমার অসহ্য লাগে । আমি মাথায় একটা বালিশ চেপে বসে থাকি, তবুও বল মারার খট খট শব্দ আমার কানে আঘাত করতে থাকে । আমি বিরক্ত হয়ে ফ্লোরেন্সকে বলি, 'স্কুল কখন খুলবে ?' ফ্লোরেন্স বলে, 'আমি ওকে বলব ।' একটু পরে শব্দ থামে ।
            গত বৎসর যখন স্কুলগুলোতে গণ্ডগোল শুরু হয়েছিল, আমি ফ্লোরেন্সকে  কিছু কথা শুনিয়েছিলাম । আমি বলেছিলাম, 'আমাদের সময়ে শিক্ষাকে একটা সুযোগ ভাবা হত । মা বাবা অনেক কষ্ট সহ্য করে টাকা বাঁচাত যাতে ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারে । স্কুলবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়াকে আমরা পাগলামি বলে গণ্য করতাম ।'
ফ্লোরেন্স বলল, 'আজকাল ব্যাপারটা অন্যরকম ।'
এই  যে ছেলেরা স্কুল জ্বালিয়ে দিচ্ছে, তুমি এসব সমর্থন কর ?'
ফ্লোরেন্স বলল, 'আমরা ছেলেদের কি করবে কি না করবে তা বলে দিতে পারি না । আজকাল সব বদলে গেছে । আজকাল মা বাবাই নেই ।'
'বাজে কথা', আমি বললাম , 'মা বাবা সব সময়েই আছে ।' এই সুরেই কথা শেষ হল আমাদের ।
স্কুলগুলোতে গণ্ডগোলের ব্যাপারে রেডিওতে কিছুই বলে না । টেলিভিশনে কিছুই দেখায় না । খবরের কাগজে কিছু লিখে না । সারা পৃথিবীর সামনে দেখানো হয় যে এখানকার ছেলেমেয়েরা ডেস্কে বসে সমকোণী ত্রিভুজের অতিভুজের উপর বর্গক্ষেত্রের সম্বন্ধে এবং আমাজনের জঙ্গলের টিয়েপাখির বিষয়ে সুখে পড়াশোনা করছে । গুগুলেতুর ব্যাপারে আমি যা জানি, তার সবটাই ফ্লোরেন্স আমাকে যতটুকু বলে, ততটুকু, আর ব্যাল্‌কনি থেকে উত্তরপূর্ব দিকে তাকিয়ে আমি যতটুকু দেখতে পাই : মানে, গুগুলেতু আজ জ্বলছে না, বা যদিও জ্বলছে , আজকে আগুনের শিখা কম ।
দেশটা দেহেমনে জ্বলছে । তথাপি আমি আমার সমুদয় শুভেচ্ছা নিয়ে তার প্রতি পুরোপুরি মনোযোগ দিতে পারি না । আমার আসল মনো্যোগ সবটাই অন্তর্মুখী, সেটা হল শব্দ, যে কোন বস্তুর নাম । এটা একটা লজ্জাকর অধ্যবসায়, কোন কোন সময় হাস্যকরও, যেমন, একজন ব্যাঙ্ক-মালিকের কাপড়ে আগুন লাগলে সেটা মজাদার ব্যাপার, কিন্তু ভিখারির গায়ে আগুন লাগলে তা আর মজাদার নয় । তবু আমি পারি না নিজেকে সংবরণ করতে, আমি ফ্লোরেন্সকে কেঁদে বলতে চাই--- দেখো, আমিও জ্বলছি ।

           বেশির ভাগ সময়ই আমি একটা শব্দের বর্ণগুলোকে ফাঁদের মুখকে হাঁ করিয়ে দেখার মত করে দেখি; যখনই আমি কিছু একটা পড়ি, সতর্ক হয়ে পড়ি, চোখের কোণ দিয়েও হয়ত  নজরে পড়ে যায় ওত পেতে থাকা কোন এক বিশিষ্ট শব্দের আভাস, আর সেজন্য মাঝে মাঝে কিছু পঙক্তি বা অনুচ্ছেদ ও বাদ দিয়ে যাই, পাছে সেই শব্দে মনোযোগ দিয়ে ফেলি ।

           কিন্তু অন্ধকার বিছানায় গিয়ে সেই শব্দকে ফিরে দেখার লোভ দুর্নিবার হয়ে ওঠে । আমার মনে হয় কেউ যেন আমাকে তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে । আমার তখন নিজেকে এক বালিকা মনে হয়, যে সাদা জামা ও খড়ের টুপি পরে নির্জন সৈকতে হাঁটছে । আমার চারদিকে বালি ওড়ে : আমি টুপিটা শক্ত করে ধরি, কিন্তু কিছুক্ষণ পর এই নির্জন স্থান  যেখানে দেখবার কেউ নেই, এই প্রয়াস বড় ভারি হয়ে ওঠে । আমি ঢিলে দিই । পিঠের উপর কেউ হাত দেওয়ার মত বাতাস আমাকে ধাক্কা দেয় । প্রতিরোধ না করাই যেন স্বস্তিদায়ক প্রথম হাঁটলাম, তারপর দৌড়ালাম, এখন আর নয় । বাতাসই তার গতিতে আমাকে নিয়ে যাক ।

           রাতের পর রাত আমি 'মার্চেণ্ট অব ভেনিস'-এর কথা ভাবি । ইহুদি শাইলক যখন বলে, 'আমি কি তোমাদের মত খাই না, ঘুমোই না, শ্বাস নিই না ? আমার কি তোমাদের মত রক্তপাত হয় না ? ' বলে একটা ছোরা তুলে দেখায় যার ডগায় এক পাউন্ড রক্তমাখা মাংস গাঁথা আছে । লম্বা দাড়ি, মাথায় টুপি, চোখে রাগ ও হতাশা নিয়ে স্টেজের উপর ইহুদিটা বলে, 'আমার কি তোমাদের মত রক্ত ঝরে না ?'

          তুমি যদি এখানে থাকতে, আমি তোমার কাছে কাঁদতে পারতাম । কিন্তু তুমি ত এখানে নেই । তাই ফ্লোরেন্স ছাড়া আর কার কাছে যাব ? ভয়ের বিস্ফোরণে যখন আমার মনের কুঞ্জের সব সবুজ পাতা দগ্ধ হয়ে যায়, তখন ফ্লোরেন্সই তার আঁচ পাবে । 'সব ঠিক হয়ে যাবে,' এই আশ্বাসটুকু আমি শুনতে চাই আমি কারো বুকে মাথা রাখতে চাই , সেটা হোক ফ্লোরেন্সের, হোক তোমার বা আর কারো, শুধু শুনতে চাই, 'সব ঠিক হয়ে যাবে'

         গতরাতে বিছানায় নিতম্বের নিচে একটা বালিশ গুঁজে হাতদুটো বুকের উপর জড়ো করে শুয়েছি যাতে ব্যথাটা যেন বেশি চাগিয়ে উঠতে না পারে, ঘড়িতে ৩-৪৫ বাজল । আমি ঈর্ষা ও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে ভাবছিলাম ফ্লোরেন্স তার তিনটে বাচ্চার সঙ্গে ঘুমিয়ে আছে, তাদের চারজনের নানা মাপের শ্বাস প্রশ্বাস পড়ছে, প্রত্যেকটা শ্বাস সবল ও স্পষ্ট ।

          আমারও  একদিন  সব ছিল, আমি ভাবছিলাম, এখন তোমার সব আছে, আমার কিছুই নেই ।

           চারটে শ্বাস অবাধ গতিতে ঘড়ির নরম ক্লিক ক্লিক শব্দের মত চলতে থাকল ।

          একটা কাগজের টুকরো দুভাঁজ করে আমি ফ্লোরেন্সকে নোট লিখলাম, 'রাতটা খুব খারাপ কেটেছে । তাই চেষ্টা করব একটু বেলা অবধি ঘুমোতে । বাচ্চাদের চুপচাপ থাকতে বলো । ধন্যবাদ, ,সি। নিচে গিয়ে রান্নাঘরের টেবিলের মাঝখানে কাগজটা গুঁজে এলাম । কাঁপতে কাঁপতে বিছানায় এসে চারটে বাজার পিল গিললাম, চোখ বন্ধ করে হাত ভাঁজ করে রেখে ঘুমোনোর চেষ্টা করতে লাগলাম, কিন্তু ঘুম আর এলো না ।

          ফ্লোরেন্সের কাছ থেকে যা চাই তা আমি পেতে পারি না । যা চাই তার কিছুই পেতে পারি না ।

           গতবছর ছোটটা যখন একেবারে কোলের শিশু ছিল, আমি ফ্লোরেন্সকে আমার গাড়িতে করে তার স্বামীর কাছে ব্রাকেনফেল-এ নিয়ে গিয়েছিলাম ।

        নিঃসন্দেহে সে ভেবেছিল আমি আমি তাকে পৌছে দিয়ে ফিরে যাব । কিন্তু কৌতূহলবশতঃ ওর স্বামীকে দেখবার জন্য, এবং ওরা সবাই একসঙ্গে হলে কেমন দেখায় তা দেখতেই আমি তার সঙ্গে গেলাম ।

           সেদিন ছিল শনিবার, সময়টা পড়ন্ত বিকেল। গাড়িটা পার্ক করে আমরা একটা ধুলোভরা রাস্তা দিয়ে দুটো লম্বা শেড ছাড়িয়ে তৃতীয় শেডে পৌছুলাম, যেখানে নীল ওভার-অল পরা একটি লোক তারের জালিঘেরা একটা জায়গায় বড়বড় মুরগির বাচ্চাগুলোকে পা দিয়ে চেপে ধরছিল । হোপ মেয়েটা মায়ের হাত ছাড়িয়ে ছুটে গিয়ে তারের জাল ধরে দাঁড়াল । লোকটা ও ফ্লোরেন্সের মধ্যে কিছু যেন আদানপ্রদান হল---- একটা চাউনি, একটা প্রশ্ন, একটা স্বীকৃতি ।

            কিন্তু তখন তো ভালমন্দ বলার সময় ছিল না  । ফ্লোরেন্সের বর উইলিয়ামের একটা চাকরি আছে, এবং তাই তাকে কাজে বাধা দেওয়া যায় না । তার কাজ হল  মুরগিগুলোকে এক এক করে ধরা, তারপর সেটাকে উলটে দু হাঁটুর মধ্যে চেপে ধরা, মুরগির দু ঠ্যাংকে এক করে একটা তার দিয়ে বাঁধা, তারপর সেটাকে দ্বিতীয় একজন কম বয়সী লোকের কাছে দিয়ে দেওয়া, সেই লোকটা আবার ঝটপটানো ও কোঁক কোঁক শব্দ করা পাখিটাকে  উপরের একটা কনভেয়ার বেল্টের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেয়, কনভেয়ারটা চলে যায় তৃতীয় আরেকজনের কাছে, । অয়েলস্কিন পরা সারা গায়ে রক্তমাখা তৃতীয় লোকটা মুরগির ঘাড় শক্ত করে ধরে একটা ছোট ছুরি ( যেটা এত ছোট যে তার হাতের অংশ বলেই মনে হয় ) দিয়ে মাথা কেটে সঙ্গে সঙ্গেই  ওইরকম মরা মাথা ভর্তি একটা  পাত্রে ফেলে দেয় ।

এই ছিল উইলিয়ামের চাকরি । এবং এই কাজটা আমি দেখতে চাই কি চাই না বুঝে উঠবার আগেই দেখে ফেললাম । সপ্তাহের ছ'দিনই সে  এই কাজ করত । সে মুরগির ঠ্যাং বাঁধত । কিংবা হয়তো কাজের পালা বদলে মুরগিগুলোকে ঝুলিয়ে দিত, বা মাথা কাটত । এই কাজের জন্য তার মাসিক বেতন ছিল তিনশত র‍্যাণ্ড্‌, এবং র‍্যাশন । গত পনেরো বছর ধরেই সে এই কাজটা করে আসছিল । কাজেই এটা বোঝা কঠিন নয় যে এই 'বছরে যেসব মুরগির দেহে আমি পাউরুটির গুঁড়ো, ডিমের কুসুম,'সেজ' মশলার মিশ্রণের পুর ভরে তেল রসুন মাখিয়ে রান্না করেছি, সেই সব মুরগির কয়েকটি অন্তত, তাদের প্রাণ থাকা অবস্থার শেষ সময়ে এই লোকটার, ফ্লোরেন্সের বাচ্চাদের জন্মদাতার  দুপায়ের মধ্যে আটকে রাখা ছিল । ভোর পাঁচটার সময়ে আমি যখন বিছানা ছেড়ে উঠিনি, এই লোকটা তখন ঘুম থেকে উঠে মুরগির খাঁচার পাত্রগুলো জল ছেড়ে পরিষ্কার করত, খাবার ট্রে-গুলো নতুন খাবারে ভরে দিত, শেডগুলো ঝাঁটাত, তারপর প্রাতরাশ সেরে মুরগি কাটার কাজ শুরু করত , তারপর সেগুলোর পালক ছাড়িয়ে পরিষ্কার করে হাজার হাজার মুরগি শরীর ফ্রিজে রাখত, মাথা, পা,অনেক মাইল লম্বা নাড়িভুঁড়ি, পাহাড়-প্রমাণ পালক সব প্যাক করত ।

যখন আমি দেখলাম কি কাজ হচ্ছে, আমার তক্ষুনি চলে যাওয়া উচিত ছিল । আমি গাড়ি চালিয়ে চলে যেতাম, আর এই সব ভুলে যাবার চেষ্টা করতাম, সেই ছিল ভাল । তার পরিবর্তে আমি  তারের জাল ঘেরা জায়গাটার কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম মোহগ্রস্তের মত, তিনটি লোক উড়ন-অক্ষম পাখিগুলোকে মৃত্যুর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিতে থাকল । আমার পাশে শিশুটি, তার হাতের আঙ্গুল তারের জালে শক্ত করে ধরে রাখা, সেও যেন এই মৃত্যুদৃশ্য গিলছিল ।

কত কঠিন, অথচ কত সহজ এই হত্যা, এই মৃত্যু ।

পাঁচটা বাজল, আমি বিদায় নিলাম । আমি যখন গাড়ি চালিয়ে এই শূন্যগৃহে ফিরছিলাম, উইলিয়াম, ফ্লোরেন্স ও বাচ্চাদের নিয়ে ওর  থাকার জায়গায় গেল। সে স্নান করল, তার বউ প্যারাফিন স্টোভে চাল ও মুরগির মাংস চড়াল রাতের খাবারের জন্য, তারপর সে শিশুটিকে স্তন্যপান করাল । সেদিনটা শনিবার থাকাতে কিছু শ্রমিক আত্মীয় বন্ধুদের সাথে দেখা করতে চলে গিয়েছিল, কিছু লোক অন্য আমোদপ্রমোদের জন্য বাইরে গিয়েছিল । তাই ফ্লোরেন্স ও উইলিয়াম  বাচ্চাদুটোকে একটি খালি বাঙ্কে শুইয়ে দিয়ে নিজেরা, শুধু দুজনে সেই উষ্ণ সন্ধ্যায়  হাঁটতে বেরোল ।

ওরা রাস্তার কিনারা ধরে হাঁটল, আগের সপ্তাহের বিষয়ে, কিভাবে ওদের সময় কেটেছে, তার ব্যাপারে, নিজেদের জীবনযাত্রার  বিষয়ে কথা বলছিল ।

যখন তারা ফিরে এল, তখন বাচ্চারা পুরোপুরি ঘুমে, নিজেদের আড়ালের জন্য ওরা ব্যাংক থেকে একটা কম্বল ঝুলিয়ে দিল । তারপর সারা রাত তারা নিজেদের মধ্যে কাটাল শুধু মাঝে আধঘণ্টা বাদে, যখন ফ্লোরেন্স অন্ধকারে উঠে বাচ্চাটিকে খাওয়াতে গেল ।

রবিবার সকালে উইলিয়াম----এটা কিন্তু তার আসল নাম নয়----- যদিও সে এই নামেই সকলের কাছে পরিচিত---- স্যুট, হ্যাট ও ভাল জুতো পরল । সে ও ফ্লোরেন্স বাসস্টপ পর্যন্ত হেঁটে গেল । বাচ্চাটা ফ্লোরেন্সের পিঠে বাঁধা, হোপকে উইলিয়াম হাতে ধরল । ওরা কুইলস্রিভিয়ার-এর বাস ধরল, তারপর একটা ট্যাক্সি ধরে গুগুলেতু গেল।সেখানে ফ্লোরেন্সের দিদির বাড়ি, আর তাদের ছেলেও সেখানেই  থাকত।

দশটা পেরিয়ে গিয়েছিল, এবং গরম লাগছিল । চার্চ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাড়ির বসবার ঘর অভ্যাগততে ভর্তি, কথাবার্তা চলছিল । কিছুক্ষণ পর পুরুষেরা বেরিয়ে গেল । ফ্লোরেন্স রান্নাঘরে গেল ওর দিদিকে সাহায্য করতে । হোপ মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়ল । একটা কুকুর এসে ওর মুখ চাটতে শুরু করল, সেটাকে তাড়িয়ে দিল কেউ । ঘুমন্ত বাচ্চাটাকে তুলে সোফায় রাখা হল ।একসময় লোকজন কমলে ফ্লোরেন্স ভেকির ঘরভাড়া, খাবার, পোশাক, জুতো, স্কুলের বই ইত্যাদির খরচা হিসেবে দিদিকে কিছু টাকা দিল দিদি সেটা নিজের অন্তর্বাসের ভেতর ঢুকিয়ে রাখল । তারপর ভেকি এসে মাকে অভিবাদন করল । অন্য পুরুষেরাও যে যেখানে ছিল ফিরে এসে দুপুরের খাবার খেতে বসল । খাবার হল খামার বা কারখানা বা বাড়ি কেজানে কোত্থেকে আনা  মুরগির মাংস, ভাত, বাঁধাকপি আর ঝোল । বাইরে থেকে ভেকির বন্ধুরা তাকে ডাকতে থাকলে সে তাড়াতাড়ি নিজের খাবার শেষ করে টেবিল ছেড়ে চলে গেল ।

এইসবই ঘটেছিল, নিশ্চয় এই সবই ঘটে থাকবে । কারণ এটা আফ্রিকার একটা সাধারণ বিকাল, অলস আবহাওয়া, অলস দিন । এই রকম বলা প্রায় সম্ভব----জীবন এইরকমই হওয়া উচিত ।

ওদের বিদায় নেবার সময় এসে গেল । ওরা বাসস্টপে চলে এল, এবার হোপ তার বাবার কাঁধে বাস এসে গেল, ওরা পরস্পরকে বিদায় জানাল । বাস ফ্লোরেন্স ও তার মেয়েদের নিয়ে চলল । ওরা মো-ব্রে-তে নামল, সেখান থেকে আরেকটা বাস ধরে জর্জ স্ট্রিট, তারপর তৃতীয় বাসে ক্লফ স্ট্রিট । ক্লফ স্ট্রিট থেকে ওরা হেঁটে চলল । যখন ওরা স্কুনার স্ট্রিটে পৌঁছল,তখন ছায়া দীর্ঘ হয়ে এসেছে । এখন হোপ ক্লান্ত, মেজাজ খারাপ, তার রাতের খাবার  সময় । বাচ্চাটাকেও চান করাতে হবে । তারপর গতকালের পরা কাপড় ইস্ত্রি করে রাখতে হবে ।

অন্তত: লোকটা গরু ছাগল কাটছে না, আমি নিজেকে বোঝালাম । সে যা করছে, তা হল মুরগিজবাই, মুরগি ছোট জীবতার বোবা বোবা চোখ, আর এইটুকু মাথায়  ঝুঁটির মহিমার ভড়ং । কিন্তু আমার মন কিছুতেই ভুলতে পারে না সেই খামার, মাংসের কারখানা, সেই ব্যবসায়, যেখানে আমার সংগে  নিত্যদিন বাস করা মহিলার স্বামী  দিনের পরদিন তারে ঘেরা খাঁচায় দুপা ফাঁক করে দাঁড়িয়েতার সামনে, পেছনে, ডাইনে, বাঁয়ে, চারিদিকে রক্তের গন্ধ ও পালক, ভীত ক্রুদ্ধ কোঁক  কোঁক ডাক, সে নিচু হয়ে পাখিগুলোকে  তোলে, মুঠি শক্ত করে পাখিগুলোকে ধরে, বাঁধে, ঝোলায় । আমি জানালা দিয়ে দেখতে দেখতে দক্ষিণ আফ্রিকার  বিস্তৃত আয়তনে সেইসমস্ত পুরুষের কথা ভাবছিলাম যারা মুরগি জবাই করে, মাটি কেটে ঠেলাগাড়ির পর ঠেলাগাড়ি করে নিয়ে যায়, মহিলারা যারা কমলা বাছাই করে, জামায় বোতামের ঘর সেলাই করে । কোদাল ভর্তি মাটি, কমলা, নোতামের ঘর, মুরগি----- কে গুণে হিসেব করবে, কত কাজ হল? শ্রমের জগত, গণনার জগত---- যেমন সারা দিন ঘড়ির সামনে বসে থাকা, এক এক সেকেন্ডে যেই আসে, মরে  যায় । এই ভাবেই একদিন জীবনই চলে যায় ।
(চলবে)









কোন মন্তব্য নেই: