“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৫

আয়স কাল ০৪

(C)Image:ছবি
(কিছুদিন আগে এই ব্লগে দক্ষিণ আফ্রিকীয় লেখক জে এম কোয়েটজি-র লেখা 'এজ অব আয়রন' -এর একটা ছোট সমালোচনাভিত্তিক সংক্ষিপ্তসার লিখেছিলাম । উপন্যাসটির কাব্যিক ভাষা, বর্ণনার চিত্রকল্পআঙ্গিক   এবং  বিষয় বস্তু আমাকে খুবই আকৃষ্ট করেছিল। কিছু কিছু বাক্য ও বাক্যবন্ধ মনের মধ্যে অনুরণন করতে থাকত, মনে হত এই কথাগুলো বাংলায় বললে কেমন হত তাই ধীরে ধীরে বইটাই অনুবাদ করে ফেলেছিলাম, 'আয়স কাল' নাম দিয়ে । অনুবাদটি ধারাবাহিক ভাবে এই ব্লগে বেরোতে থাকবেহয়তো যথাযথ সময়ানুবর্তীতা মেনে হবেনা, কারণ টাইপ করাতে  আমি নিতান্তই শম্বুকগতি ।  আজ তার চতুর্থ  ভাগ --- শিবানী দে )

যেহেতু এদেশের বর্তমান জীবন ঠিক একটা ডুবন্ত জাহাজের উপরের জীবনের মতন----- সেই পুরোনো দিনের জাহাজ, যার ক্যাপ্টেন বিষণ্ণ, মাতাল, যার নাবিকগুলো বদমেজাজি, যার লাইফবোটগুলো  ফুটো---- সেইহেতু আমি আমার বিছানার পাশে একটা শর্ট ওয়েভ রেডিও রাখি । তাতে অবশ্য বেশিরভাগ সময়  কথাই শোনা যায় । কিন্তু যদি কেউ ধৈর্য ধরে বোতাম ঘোরাতে থাকে, তবে রাতের দিকের কোন অভাবিত সময়ে কোনোও স্টেশন সদয় হয়, সঙ্গীত পরিবেশন করে । গত রাত্রে তেমনি আমি সঙ্গীত শুনছিলাম । কখনো স্পষ্ট, কখনোও অস্পষ্ট । কোন স্টেশন ? হেলসিংকি ? কুক দ্বীপপুঞ্জ ? ----জানি  না, কিন্তু তা সকল জাতিরই সঙ্গীত, স্বর্গীয় সঙ্গীতসঙ্গীত যা অনেক কাল আমাদের ছেড়ে গেছে, এবং এখন তারাদের জগতের মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত, পরিশীলিত, মৃদু হয়ে ফিরে আসছে , যেন আমাদের বোঝাতে, যে যদি কিছু কখনো দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে শেষ পর্যন্ত তা ফিরে আসে । এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সীমাবদ্ধ, ডিমের আকৃতি, আমাদের ঘিরে আছে ।

অন্ধকারে শুয়ে আমি তারাদের সঙ্গীত শুনছিলাম, তার সঙ্গে ঘড়ঘড় ও গুনগুন শব্দ ও-----তারাদের সঙ্গে উল্কাদের ধুলোও তো থাকবে-----সে সুদূরের সুসমাচার শুনতে শুনতে অধর মৃদুহাসিতে ও হৃদয় কৃতজ্ঞতায় ভরে আসছিল ।

আমি ভাবলাম, এই একটা বর্ডার ওরা বন্ধ করতে পারে না, সেটা হল উপরের সীমান্ত----দক্ষিণ আফ্রিকা ও  আকাশের সাম্রাজ্যের মধ্যেকার সীমান্ত । সেখানে আমার ভ্রমণের সময় হয়ে গেছে, যেখানে কোন পাসপোর্ট লাগে না ।

সঙ্গীতের জাদুর ঘোরে (বোধ হয় সুরস্রষ্টা  স্টকহাউসেন) আমি সেই বিকেলে বসে কিছু পুরোনো  রচনা থেকে বাজালাম, ওয়েল-টেম্পার্ড ক্লাভিয়ের ও শপিন-এর মুখড়া, ব্রাহ্‌ম্‌স-এর ওয়াল্‌জ -----সবই নভেল্লা এবং আউজেনার সংস্করণের, অনেকদিনের পুরোনো এবং যত্নের অভাবে পাতাগুলো জীর্ণ, পোকায় কাটা, এবং ধুলোর মত শুকনো । আমার বাজনা কিছু ভাল ছিল না,অর্ধ শতাব্দী আগে যেমন করে সুরসমষ্টিগুলোকে ভুল বাজাতাম, আঙ্গুলগুলো ঠিকঠাক চাবির উপর পড়ত না, সেইসব ভুলগুলো হাড়ে হাড়ে বসে গেছে, আর শোধরাবে না । (আমার স্মরণে আছে, পুরাতত্ববিদ্‌রা সেই হাড়গোড়কেই বেশি গুরুত্ব দেন যেগুলো রোগে ক্ষয়ে গেছে,বা তিরের আঘাতে ভেঙ্গে গেছে : ইতিহাসের আগের ইতিহাস জানতে হাড়ের এই সব চিহ্নই দরকারি )।

ব্রাহ্‌ম্‌স-এর মিষ্টতায়  ক্লান্ত হয়ে আমি চোখ বন্ধ করে সুর বাজাতে থাকলাম, আমার আঙ্গুল খুঁজতে থাকল সেই বিশেষ সুরটা আর যখন খুঁজে পেলাম তাকে, আমার সেই বিশেষ সুর বলে চিনতে পারলাম । পুরোনো দিনে আমরা এই হারানো সুরকে হৃদয়তন্ত্রী বলতাম । (আমি তোমার সময়ের আগেকার কথা বলছি, যখন কোনও এক গরম কালের শনিবার  বিকেলে রাস্তা দিয়ে যাবার সময় শোনা যেত ক্ষীণ ও ধৈর্যসহকারে বাজানো যন্ত্রসঙ্গীত----- কোন বাড়ির মেয়ে বসবার ঘরে বসে পিয়ানোর অনেক চাবির মধ্যে আঙ্গুল দিয়ে দিয়ে হারানো সুরটাকে খুঁজছে । সে সব দিন ছিল সৌন্দর্য, দুঃখ এবং রহস্যময়তার দিন । সারল্যের ও ।)

'জেরুসালেম,' আমি আমার ঠাকুমার কোলে বসে শেষ যে ভাবে শুনেছিলাম, সেই নরম সুরে বাজালাম 'জেরুসালেম' গানটা ।

শেষটাতে আবার বাখ-এ ফিরে গেলাম, অপরিচ্ছন্নভাবেই বারে বারে বাজালাম । সুর ঘোলাটে, দুটো সুরের সঙ্গম অস্পষ্ট, তবুও বারে বারে বাজানোর পর আসল সঙ্গীত বেরিয়ে এল, সেই শান্ত, দৃঢ়, অমর সঙ্গীত ।

আমি নিজের জন্যই বাজাচ্ছিলাম । কিন্তু একসময় মেঝের তক্তায় মচ্‌মচ শব্দ এবং পর্দার উপরে ছায়ার চলন দেখে বুঝতে পারলাম সেও বাইরে থেকে শুনছে , তাই আমি যতদূর ভাল করে বাজাতে পারি, বাজালাম । স্বরলিপির অন্তিম দাঁড়িটা পর্যন্ত বাজিয়ে সঙ্গীত শেষ করলাম, হাতদুটো কোলের উপর জড়ো করে রেখে স্বরলিপির মলাটের ডিম্বাকৃতি প্রতিকৃতি ---- যাতে দেখা যাচ্ছে ভারি মাংসল থুতনি, আলগা মৃদু হাসি, ফোলা ফোলা চোখ----তার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম । সঙ্গীতের বিশুদ্ধ আত্মা----এ কিধরণের মন্দিরের ভিতর প্রতিষ্ঠিত! এই বিশুদ্ধ আত্মা এখন কোথায় ? এই যে ইথার তরঙ্গে আমার অপটু বাজনা প্রতিধ্বনিত হল, তার মধ্যে আছে ? যে সঙ্গীত আমার হৃদয়ে এখনো নৃত্য করে তার মধ্যে আছে ? ন্যাকড়ার মত ট্রাউজার পরা যে লোকটা জানালার ওধার থেকে লুকিয়ে শুনছিল তার হৃদয়ে কি এই সঙ্গীত পৌঁছোতে পেরেছে ? আমাদের দুটো হৃদয়, দুটো প্রেমের প্রত্যঙ্গ কি এই মধুর ধ্বনির ডোরে এই সময়টুকুর জন্য বাঁধা পড়ল ?

টেলিফোন বাজল : রাস্তার ওধারের ফ্ল্যাট থেকে একজন মহিলা বললেন যে তিনি আমার জমির মধ্যে একজন ভবঘুরে লোককে ঢুকতে দেখেছেন । আমি জবাব দিলাম, ও ভবঘুরে নয়, আমার বাড়িতে কাজ করে ।

আমি ফোন ধরা ছেড়ে  দেব ভাবছি । তুমি এবং মলাটের মোটা লোকটা ছাড়া আর কেউ নেই যার সঙ্গে আমার কথা হতে পারে । তাও মোটা লোকটা স্বর্গে । আর মনে হয় তোমাদের মধ্যে ও কেউ কখনো আসবে না ।

স্বর্গ ! স্বর্গ বলতে আমার কল্পনায় আসে একটা হোটেলের উঁচু ছাদওলা লবি যেখানে গণসম্বোধন ব্যবস্থার মাধ্যমে সুমধুর সঙ্গীত ধীর লয়ে তান বিস্তার করে চলেছে যেখানে চামড়ায় মোড়া নরম আরামকেদারায় কেউ বসতে পারে ; এবং কোনোও ব্যথা অনুভব করে না । এমন হোটেলের লবি যেখানে আমার মত বয়স্ক লোকেরা গান শুনতে শুনতে ঝিমোচ্ছে, সকলের আত্মারা তাদের সামনে দিয়ে বাষ্পপুঞ্জের মত আসছে, যাচ্ছে । সেখানে বিদেহী আত্মার ভিড় । ওরা কি কাপড় পরা ? হাঁ, তাই মনে হয় আমার । কিন্তু হাত খালি । যেখানে তুমি কিছুই আনতে পারো না শুধুমাত্র অপার্থিব বস্ত্র আর স্মৃতি ছাড়া, কারণ স্মৃতিই তো তুমি আজ যা, তাকে গড়েছে সেই স্থানটা হল ঘটনারহিত, যেমন ট্রেনছাড়া রেলওয়ে স্টেশন । অনন্তসঙ্গীত কান পেতে শুনতে শুনতে, কোন কিছুর জন্য অপেক্ষা না করতে করতে, শুধুমাত্র অলসভাবে স্মৃতির ভাণ্ডারের পাতার পর পাতা উল্টাতে উল্টাতে বসে থাকা ।

এটা কি সম্ভব হবে যে সেই আরামকেদারায় বসে বসে স্বর্গীয় সঙ্গীত শুনতে শুনতে মনে চিন্তা হবে না যে বাড়িটা বন্ধ, অন্ধকার, বেড়ালগুলো ক্ষুধায় কাতর হয়ে বাগানে ঘোরাঘুরি করছে ? নিশ্চয়ই সম্ভব,না হলে স্বর্গ কিসের জন্য ? তবুও কোন উত্তরাধিকারী ছাড়া মৃত্যু----- এরকম বলছি বলে মনে কিছু করো না-----বড় অস্বাভাবিক । মনের শান্তির জন্য, আত্মার শান্তির জন্য আমরা জানতে চাই আমাদের মৃত্যুর পর কে আসছে, যেখানে আমার বাড়ি ছিল, সেই বাড়ির ঘরগুলো কার উপস্থিতিতে ভরাট হচ্ছে ।

'কারু'* পার হয়ে পশ্চিম উপকূলের দিকে গাড়ি চালিয়ে যেতে থাকলে চোখে পড়ত  বড় বড় পোড়ো বাগানবাড়ি, মালিকেরা সদর দরজা বন্ধ করে গেটে তালা দিয়ে অনেক বছর হল শহরে চলে গেছে ; সেইসব বাড়ির কথা মাঝে মাঝে ভাবি । আজকাল সেইসব বাড়িতে কাপড়মেলা তারে কাপড় বাতাসে নড়ে, চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বেরোয়, পেছনের দরজার বাইরে ছোট ছেলেমেয়েরা খেলা করতে করতে চলতি গাড়িগুলোকে টা টা করে । জমি পুনরায় দখল হচ্ছে , উত্তরাধিকারীরা নিরুচ্চারে জানান দিচ্ছে । একসময় জমি জোর করে দখল করে ব্যবহার করা হয়েছিল, তার সম্পদ লুট করে নষ্ট করা হয়েছিল, তার পরবর্তী বছরগুলোতে অব্যবহার্য অনুর্বর হওয়ায় পরিত্যক্ত হয়েছিল । লুণ্ঠনকারীরা হয়ত সেই জমিকে তার উৎপাদনশীলতার সময়ে ভালও বেসেছিল, সেজন্য ইতিহাসের বিচারে সেটা ছিল স্বার্থের ভালোবাসা, আসল ভালবাসা নয় ।

মৃত্যুর ঘটনা ঘটে গেলে মৃত ব্যক্তির হাতের আঙ্গুল অবধি খুলে দেওয়া হয়, যেন দেখার জন্য কিছু নিয়ে যাচ্ছে কি না , হয়তো একটা নুড়ি, একটা পালক, কিংবা নখের তলায় একটা সর্ষেদানা ।

এ যেন এক গোলকধাঁধা অঙ্ক কয়েক পাতা জুড়ে, বিয়োগের পর বিয়োগ, ভাগের পর ভাগ, যতক্ষণ পর্যন্ত না মাথা ঘুরে যায় । প্রত্যেকদিন আমি এটাকে নতুন করে কষবার চেষ্টা করি এই আশায়, যে এই ক্ষেত্রে, অন্তত: আমার ক্ষেত্রে, কোথাও হয়তো ভুল বেরোবে । আর প্রত্যেকদিনই আমি সেই একই খালি দেওয়ালের সামনে দাঁড়াই-----মৃত্যু, বিস্মৃতি । ডাঃ সাইফ্রেট ওঁর রুমে বসে বলেছিলেন, 'আমরা সত্যের মুখোমুখি হব' । সত্যি কথাটা হলসেই দেওয়ালের মুখোমুখি হব, কিন্তু উনি নয়, আমি ।

আমি সেই বন্দিদের কথা ভাবি, যারা পরিখার কিনারে দাঁড়িয়ে আছে,যে পরিখাতে ওদের মৃতদেহ আছড়ে পড়বে । তারা ফায়ারিং স্কোয়াডের কাছে মিনতি করে, তারা কাঁদে, কখনো বা মজাও করে, ঘুষ দেয় । ওদের কাছে যা আছে,সবই দেয়,আঙ্গুলের আংটি, গায়ের কাপড় । সৈন্যরা হাসে, কারণ তারা এমনিতেই সব পাবে, এমন কি ওদের দাঁত বাঁধানো সোনা ও

কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে একটা দৃশ্য কল্পনায় আমাকে অভিভূত করে, বাস্তব না হলেও প্রচণ্ড দুঃখে আমাকে নাড়া দেয় , সেটা হল, এই বাড়ি খালি, শূন্য বিছানায় জানালা দিয়ে রোদ্দুর পড়ছে ; অথবা নীল আকাশের নিচে ওই ফল্‌স বে, চিরনূতন, বিজন; আমি জীবনে যে জগতে বিচরণ করেছি, সেখানকার অংশ হয়ে আর থাকব না । আমার অস্তিত্ব যেন দিনের পর দিন সঙ্কুচিত হয়ে আমারই নজরের আড়ালে চলে যাবার মত হচ্ছে । মৃত্যুই একমাত্র সত্য যা বাকি আছে, অথচ আমি এখনো তার কথা ভাবতে পারি না । যে মুহূর্তে আমি অন্য কিছুর কথা ভাবছি, মৃত্যুর কথা ভাবছি না, আমি সত্য  ভাবছি  না ।

আমি ঘুমোনোর চেষ্টা করি, মন থেকে চিন্তা দূর করি, ধীরে ধীরে শান্তি আসতে থাকে । তখনি আমার মনে হয় আমি পড়ে যাচ্ছি :  মিষ্টি ঘুম, স্বাগত । বিস্মৃতির সীমায় পৌঁছোতেই আবার কিসে আমাকে জাগিয়ে দেয়, পেছনে টেনে নেয়, তার একমাত্র নাম হতে পারে 'মহাভীতি' । তার কবল থেকে জোর করে নিজেকে মুক্ত করি, বিছানাতে জাগি, জাগলেই ভাল । একটা মাছি  এসে গালে বসে। নিজেকে পরিষ্কার করে । এদিক ওদিক চলে । আমার খোলা চোখের উপর দিয়ে হাঁটে । আমি পলক ফেলতে চেষ্টা করি, নড়ে চড়ে ওকে তাড়াতে চেষ্টা করি, পারি না । যে চোখ আমার, অথচ আমারও নয়, তা দিয়ে তাকিয়ে থাকি । ও যেন নিজেকে চাটে, অবশ্য 'চাটা' কথাটা যদি সুপ্রযুক্ত হয় । ওর ফোলা ফোলা অঙ্গে মুখ বলে কিছু বুঝতে পারি না । কিন্তু ও আমার উপরে এখানেই আছে , আমার উপরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেন অন্য জগতের জীব ।

অথবা এই যেমন বিকেল দুটো বেজেছে । আমি সোফা অথবা বিছানায় শুয়ে আছি, চেষ্টা করছি আমার নিতম্ব, যেখানে ব্যথা সবচেয়ে বেশি, সেখানে যথাসম্ভব কম চাপ দিতে । আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে এস্‌থার উইলিয়াম্‌স** ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবতী অল্পবয়সি  মেয়েরা যারা ফুলছাপ সাঁতারের পোশাক পরে আকাশনীল, মৃদুহিল্লোলিত জলে অনায়াস ব্যাক্‌স্ট্রোকে সাঁতার কাটছে, হাসছে, গান করছে, কোথাও যেন এক অদৃশ্য গিটার বাজছে । মেয়েগুলোর মুখে টকটকে লাল লিপ্‌স্টিকের ধনুক, গানের কথা উচ্চারণের ভঙ্গিমায় নড়ছে । ওরা কি গাইছে ? 'সূর্যাস্ত'----'বিদায়'---'তাহিতি' ? সে সময় আমার সেই পুরোনো স্যাভয় বায়োস্কোপ দেখতে ইচ্ছে করছে যার টিকিট ছিল এক শিলিং চার পেন্স, সেই মুদ্রা ব্যবস্থা যা কবেই উঠে গেছে, মুদ্রাগুলোও গলানো হয়ে গেছে, শুধু দুচারটি ফার্দিং আমার ড্রয়ারে এখন ও পড়ে আছে, সেগুলোর একদিকে  'ভালরাজা তোতলা ষষ্ঠ জর্জের প্রতিকৃতি, অন্যদিকে জোড়া নাইটিঙ্গেল । নাইটিঙ্গেল ! আমি কখনো নাইটিঙ্গেলের গান শুনি নি, এবং কখনো শুনবও না । সেই বাসনা, সেই আক্ষেপকে বুকে  জড়িয়ে ধরি, রাজা, সাঁতারকাটা মেয়েরা, সবাইকে জড়িয়ে ধরি, যা আমাকে মৃত্যুভয় ভুলিয়ে অন্যদিকে ব্যস্ত
 রাখবে ।

অথবা আমি উঠি এবং টিভি খুলি । একটা চ্যানেলে ফুটবল চলছে । অন্য একটা চ্যানেলে একজন কালো মানুষ একটা হাতে বাইবেল ধরে আমার অবোধ্য কোন ভাষায় ধর্মকথা প্রচার করছে । এই সমস্ত দরজা খুলে দিয়ে আমি চাই বিশ্বজগৎ আমাকে প্লাবনে ডুবিয়ে দিক, আর আমার কাছে বিশ্ব এইটুকুই আসে । এ যেন একটা চোঙ্গার ভেতর দিয়ে বাইরে দেখা ।

(চলবে)


-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
*কারু : কেপ টাউনের উত্তর দিকে বিস্তৃত মরুপ্রায় পাথুরে অঞ্চল, যা আরোও উত্তরে কালাহারি মরুভূমির সঙ্গে মিশেছে 

**এস্থার উইলিয়াম্‌স :  (১৯২১---২০১৩) বিখ্যাত আমেরিকান সাঁতারু ও অভিনেত্রী।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------


কোন মন্তব্য নেই: