“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৫

আমাদের কি স্বাধীন ইচ্ছে আছে?

।। রজতকান্তি দাস।।


(ইতিপূর্বে অন্যদেশ পত্রিকায় প্রকাশিত)

  মার ছোটবেলার একটি ঘটনা এখনো স্পষ্ট মনে আছে। আমি আমার জন্ম-শহর শিলঙের পুলিশ বাজার সাত সাত-মাথার মোড়ে দাঁড়িয়েছিলাম। বয়েস তখন সাত-আট হবে। দাঁড়িয়ে থেকে থেকে একটা কথা ভেবে অবাক হচ্ছিলাম যে বিপরীত মুখো গাড়িগুলো যখন পরস্পরকে পাশ কাটে তখন তাদের ধাক্কা লাগে না কেন। গাড়িচালকরা কি করে আগে থেকেই বুঝতে পারেন উল্টোদিকের গাড়িটা কোনদিকে পাশ কাটবে? আমার ছোটকাকা বয়েসে আমার চাইতে চার-পাঁচ বছরের বড়। তাই উনার জ্ঞানগম্যির উপর আমার যথেষ্ট আস্থা ছিল। কথাটা তাকে বলাতে তিনি আমাকে যা বুঝিয়ে বললেন তার সারমর্ম হল শহরের সমস্ত গাড়িচালকরা এক জায়গায় বসে মিটিং করে স্থির করেছেন যে পুলিশ বাজার পয়েন্টে ঠিক কোন গাড়িটা কোন গাড়ির সঙ্গে পাশ কাটবে আর পাশ কাটার সময় কে কোন দিকে থাকবে।
   আমার সামনে এর চাইতে ভাল যুক্তি না থাকায় কাকার কথাতেই বিশ্বাস করেছিলাম এবং এই ভেবে অবাক হয়েছিলাম যে কি করে গাড়িচালকরা তাদের সময়ের সঙ্গে গতি এতটা সঠিক রাখেন যাতে করে ঠিক ঠিক গাড়িগুলোর সঙ্গেই তাদের পুলিশ-পয়েন্টে সাক্ষাৎ হয়। পরে জানতে পেরেছিলাম যে গাড়িচালকদের এই ব্যক্তিগতভাবে বোঝাপড়ার কথাটা সত্যি নয়। আসলে চালকরা কিছু নিয়ম মেনে চলেন তাই তাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয় না।
   কিছু লোক আছেন যারা বিশ্বাস করেন যে ঈশ্বর আমাদের ভাগ্যকে এমনভাবে তৈরি করেছেন যে আমাদের জীবনের প্রতিটি ঘটনাই ঈশ্বর কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত। অতএব আমাদের স্বাধীন ইচ্ছে বলে কিছু নেই। এক্ষেত্রে সাধক রামপ্রসাদের গান অনুধাবন-যোগ্য। সকলই তোমারি ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি, তোমার কর্ম তুমি করো মা, লোকে বলে করি আমিঅন্যদিকে বিশ্বের প্রথম-সারির দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা আছেন যারা মনে করেন যে আমাদের জীবনের প্রতিটি ঘটনা সহ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি অণু-পরমাণু গতিবিধি পূর্বনির্ধারিত। সেই সঙ্গে আমাদের ইচ্ছেরও কোন স্বাধীনতা নেই। আমরা ইচ্ছে করে কোন কাজ করতে পারি ঠিকই কিন্তু ইচ্ছে করে ইচ্ছে করতে পারি না। অর্থাৎ আমাদের ইচ্ছেটা পূর্বনির্ধারিত, যার স্বাধীনতা হল এক ধরণের ভ্রম। এই চিন্তাবিদদের মধ্যে আছেন আইনস্টাইনসহ অধিকাংশ ধ্রুপদী পদার্থবিজ্ঞানীরা। তবে এই ব্যাপারে সবচাইতে সরব ছিলেন আইনস্টাইন। এছাড়া দার্শনিকদের মধ্যেও অনেকে এই পূর্বনির্ধারণ তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন। যেমন দেকার্তে, স্পিনোজা, লক, হিউম, কান্ট, হেগেল, মার্ক্স, মিল ও আলেকজান্ডার সহ অনেকেই। ঈশ্বর বিশ্বাসীদের বিশ্বাসের কারণ ছিল অনেকটা আমার কারার কথায় সেই গাড়িচালকদের চুক্তির মতো। অর্থাৎ আমাদের পূর্বজন্মের পাপপুণ্যের বিচারে ঈশ্বর প্রতিটি মানুষের সঙ্গে চুক্তি করে ফেলেছেন। আর বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের বিশ্বাস ছিল অনেকটা গাড়িচালকদের নিয়ম মেনে চলার মতো। বিজ্ঞানীদের ধারণা যে বিশ্বের প্রতিটি অণু-পরমাণু থেকে বিশাল বিশাল গ্রহ-নক্ষত্র, সমস্তই গণিতের নিয়ম মেনে চলে। তাই সবকিছুই পূর্বনির্ধারিত। তাঁদের মতে কোন এক মুহূর্তে যদি ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত বস্তু কণিকার অবস্থান ও ভরগতির (momentum) পরিমাণ জানা সম্ভব হতো তাহলে কতকগুলো গণিতের সমীকরণকে কাজে লাগিয়ে সমস্ত বস্তুরই ভবিষ্যৎ অবস্থান ও ভরগতিকে সঠিকভাবে বলে দেওয়া যেতো। বর্তমান অবস্থা উপরই যখন ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল তাই মানুষের ভাগ্য সহ সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে গতিবিধি হল পূর্বনির্ধারিত।
     ঈশ্বর বিশ্বাসীদের সঙ্গে বিজ্ঞানীদের তফাত হল এই যে প্রথমোক্তদের ধারণা হল ভাগ্য ঈশ্বরের দ্বারা নির্ধারিত হলেও প্রার্থনা, মানত ও তন্ত্রমন্ত্রের সাহায্যে ঈশ্বর-ভজনা করে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটানো যায়। তাবিজ, কবচ, মাদুলি ইত্যাদি তো আছেই। অন্যথায় বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি অণু-পরমাণু গণিতের নিয়মে এমন ভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা যে কোন একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তু কণিকারও সাধ্য নেই এই অমোঘ বন্ধন থেকে সামান্য সরে এসে নিজের নিয়মে চলে। মানুষও যেহেতু এক ধরণের বস্তুপিণ্ড ছাড়া আর কিছুই নয় এবং আমাদের মস্তিষ্কের প্রতিটি অণু-পরমাণু এই বস্তুজগতের নিয়মেই বাঁধা, তাই আমাদের জীবনের প্রতিটি গতিবিধি পূর্বনির্ধারিত। সম্পূর্ণ গণিতের নিয়ম মেনে চলার ক্ষেত্রে প্রকৃতি মানুষকে ছাড় দিয়েছে, এরকম কোন প্রমাণ যেহেতু বিজ্ঞানীদের হাতে নেই তাই মানুষের স্বাধীন ইচ্ছেকে ধ্রুপদী পদার্থবিজ্ঞানী ও অধিকাংশ দার্শনিকরা মেনে নিতে পারেন নি। তবে এই ধরণের নিয়তিবাদকে শুধু যে বস্তুবাদী দার্শনিকরাই মেনে নিয়েছিলেন তা নয়। অন্যান্যদের মধ্যেও অনেকেই তা মানতেন। যেমন দেকার্তে, স্পিনোজা, হিউম, কান্ট, হেগেল, মিল কিংবা আলেকজান্ডার বস্তুবাদী ছিলেন না। কিন্তু এই স্বাধীন ইচ্ছে না থাকার সপক্ষে যুক্তিটা এতই ধারালো ছিল যে এই ডিটারমিনিজম কিংবা নিয়তিবাদকে না মেনে তাদের উপায়ও ছিল না। এর মধ্যে কিছু কিছু দার্শনিক আমাদের স্বাধীন ইচ্ছে থাকাটাকে এতটাই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে তাঁরা মনে করতেন প্রকৃতির রহস্যের সবটাই উদ্ঘাটন হয় নি। আগামী দিনে প্রকৃতির নতুন নতুন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীন ইচ্ছে থাকার প্রমাণ পাওয়া যাবে।
    প্রকৃতিকে জানার জন্য মানুষের যে অনুসন্ধিৎসা তা বৃদ্ধি পায় যখন সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিকে বশ করারও তার ক্ষমতার বৃদ্ধি পায়। অধিকাংশ সময়ই সে তার ক্ষমতাকে কাজে লাগায় অত্যন্ত সচেতন ও ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের অভিজ্ঞতার নৈর্ব্যক্তিক অংশকে সম্বল করে এবং তা থেকে যে নির্যাস সে সংগ্রহ করে, তা-ই বিজ্ঞান ও দর্শনের ভিত। যেহেতু প্রকৃতির নিয়ম ও ব্যক্তিগত ধারণার মধ্যে তারতম্য-বর্জিত হওয়া উচিৎ, তাই বিজ্ঞানীরা ও বস্তুবাদী দার্শনিকরা নৈর্ব্যক্তিক সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কবিদের চরিত্রগত পার্থক্য থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে অনেক সময়ই দর্শন বিজ্ঞানের পথপ্রদর্শকের কাজও করে। আইনস্টাইন তাঁর রিলেটিভিটি থিওরির ধারণাটিও কার্ল মার্ক্সের লেখা জার্মান আইডিওলজিথেকে পেয়েছিলেন কি না এ নিয়ে কারো কারো মনে সন্দেহ আছে। আমাদের স্বাধীন ইচ্ছের ব্যাপারেও অনেক দার্শনিকরা বই-টই লিখেছেন। এক্ষেত্রে জ্যাঁ পল সাত্রে ‘Being and Nothingness’ বইটি স্মর্তব্য। সাত্রে বলেছিলেন ‘Man is condemned to be free; because once thrown into the world, he is responsible for everything he does’
            প্রকৃতির রহস্য এতটাই জটিল যে বিজ্ঞান যেসব রহস্যকে উদঘাটন করে মানুষের সামনে রাখে তা সে প্রায়শই তার সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না। তবে আধুনিক কালে বিজ্ঞানের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ছে। বহু শতাব্দী-ব্যাপী সংগ্রামের পর বিজ্ঞান আজ মানুষকে অন্তত এটুকু বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে প্রকৃতির অনেক রহস্যই আমাদের সাধারণ বুদ্ধির অগোচর। অর্থাৎ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যা দেখি, যা বুঝি তার অনেকটাই সত্য নাও হতে পারে। তাই আমাদের স্বাধীন ইচ্ছে নাও থাকতে পারে আবার থাকতেও পারে। তবে প্রকৃতির রহস্যকে উদঘাটন করার নিমিত্তে মানুষের যে এক অবিরত যাত্রা তা নিরন্তর চলতে থাকবে। সাধারণ উপলব্ধি থেকে বিশেষ উপলব্ধির পথে এই যাত্রায় মানুষ একদিন পাবে তার কাঙ্ক্ষিত আধ্যাত্মিক জগতকে যা অনেক দার্শনিকরাই কল্পনা করেছিলেন। ইতিমধ্যে সে তার স্বাধীন ইচ্ছেকেও খুঁজে পেয়েছে কি না তা আমরা দেখে নেবো।
            ধর্ম মানুষের মধ্যে যে বিশ্বাসের জন্ম দেয় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার অনেক ক্ষেত্রেই সেখানে আঘাত করে। ধর্ম বিশ্বাস মানুষের অহংকারকে উস্কে দিয়ে তার দুঃখ-দারিদ্রের গায়ে সান্ত্বনার মলম লাগায়। মানুষ এটাকে ভালোও বাসে। যেমন পৃথিবীকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রস্থল বলে বর্ণনা করায় মানুষ ভেবেছিল সে এমন একটি উৎকৃষ্ট প্রাণী যার চতুষ্পার্শ্বে সমগ্র নভোমণ্ডল প্রদক্ষিণ করে। বৈজ্ঞানিক সত্য এই অহংকারকে আঘাত করায় মানুষ এক তিক্ত অভিজ্ঞতার আস্বাদ পেয়েছিল। কিন্তু মানুষ ক্রমে সৌরকেন্দ্রিক ও পরে অ-সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বধারণাকেও মেনে নিয়েছে। এমন কি সে এও মেনে নিয়েছে যে ঈশ্বর তার নিজের শরীরের আদলে মানুষকে সৃষ্টি করেন নি। বরং সে প্রাণিজগতের বিবর্তনেরই ফসলতার ঘরে পোষা যে কুকুর-বিড়ালের সঙ্গেও আছে তার রক্তের সম্পর্ক। অস্বস্তিকর হলেও শেষ পর্যন্ত মানুষ এটাকেও মেনে নিয়েছে। মানুষ বোঝতে পেরেছে যে সত্য কখনও কারোর ক্ষতি করে না। এভাবে বিজ্ঞান ও দর্শন বহু শতাব্দী-ব্যাপী প্রগতির ধারায় মানব সমাজের কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের স্তূপীকৃত জঞ্জালকে অনেকটাই সাফ করতে পেরেছে। যদিও বিশুদ্ধ জ্ঞানের পথ এখনও সুদূর পরাহত। কিন্তু সুখের কথা যে মানুষ গোঁয়ারের মতো কোন বিশ্বাসকে আঁকড়ে না থেকে এই সুদূরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নিজের মনের দরজাকে খোলা রাখতেই বেশি উৎসাহী। কারণ বিশুদ্ধ জ্ঞানের পথ তখনই খোলে যখন মানুষ বর্তমান জ্ঞানকে সন্দেহ করে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন সন্দেহের বেদনা সেও যে ভাল প্রভু।
               মানুষ ভাবে সে তার নিজের ইচ্ছেয় যা সৃষ্টি করে তাই তার ইতিহাস। সে ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা ও কার্যক্রম নির্ধারণ করে তার স্বপ্নকে সাকার করার জন্য কর্মরত হয়। তার উদ্যোগে সে যখন সফল হয় তখন সে তার কৃতিত্বকে জাহির করে। কিন্তু তার উদ্যোগ যদি বিফল হয় তাহলে সে ঈশ্বরকে দায়ী করে। এভাবেই বহু শতাব্দী-ব্যাপী মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যে এক রহস্যময় ও চিত্তাকর্ষক সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এমন কি দার্শনিকরাও ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে একমত নন। এঁদের মধ্যেও আস্তিক ও নাস্তিক উভয় দলই আছেন। এখন প্রশ্ন হল যে মানুষ কি তার নিজের ইচ্ছেয় তার ভবিষ্যতকে সৃষ্টি করে। না কি সে প্রকৃতির অমোঘ ও অলঙ্ঘনীয় নিয়মের বেড়াজালে বাঁধা। আমাদের স্বাধীন ইচ্ছে কি এক ধরণের ভ্রম? যদি মনে করা যায় যে আমাদের স্বাধীন ইচ্ছে আছে এবং নিজেদের ইচ্ছে অনুযায়ী কাজ করতে পারি তাহলে ক্ষতিটা কি? বিশেষত আইনস্টাইনদের মতো ধ্রুপদী পদার্থবিজ্ঞানীরা আমাদের স্বাধীন ইচ্ছেকে নাকচ করে দেবার জন্য এমন শনি হয়ে পড়লেন কেন।
               আমাদের স্বাধীন ইচ্ছে আছে কি না এই প্রশ্নটি এতই সরল যে একটি বাচ্চা ছেলেও এর উত্তরে হ্যাঁ বলবে। কারণ এটাই আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতা। কিন্তু এই সহজ প্রশ্নটির উত্তর কিন্তু এতটা সহজ নয়। এ ব্যাপারে যে যত বিজ্ঞ তার কাছে উত্তরটা ততই কঠিন। গত কয়েক শতাব্দী ধরেই বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের মধ্যে এই বিতর্ক চলছে তো চলছেই। এখন অব্ধি তারা কোনধরনের ঐকমত্যে পৌছতে পারেন নি। এই প্রশ্নটি এতটা জটিল হয়ে পড়েছে কারণ আমাদের স্বাধীন ইচ্ছের অস্তিত্ব প্রকৃতির কার্যকারণ সম্পর্কের মধ্যে প্রবলভাবে আঘাত হানতে পারে যা হল কি না ধ্রুপদী পদার্থবিজ্ঞানের ভিত। বস্তুজগতের গতিবিধির মধ্যে কোন ধরণের অনিশ্চয়তা নেই, এই বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে সমগ্র ধ্রুপদী পদার্থবিজ্ঞান। এই বিশ্বাসকে সম্বল করে বিজ্ঞান এই বিশ্ব প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করে চলেছে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে। পঞ্চাশ বছর পর ঠিক কটার সময় সূর্যগ্রহণ হবে তাও বলে দিচ্ছে গণিতের সমীকরণকে কাজে লাগিয়ে। এর মধ্যে যদি দেখা যায় যে আমাদের স্বাধীন ইচ্ছে আছে তাহলে মেনে নিতে হবে যে প্রকৃতি অনেকটাই বিশৃঙ্খল। তাই আইনস্টাইন সহ অনেক বিজ্ঞানীরাই আমাদের স্বাধীন ইচ্ছেকে মেনে নিতে পারেন নি। তবে বিজ্ঞান-জগতে কেউই শেষ কথা বলেন না। এই নিয়ে নিত্য নতুন আবিষ্কার হয়েই চলেছে। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞান আরো কি ধরণের রহস্য আমাদের সামনে তুলে ধরে।
               চন্দ্র-সূর্য সহ আকাশের অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রগুলোর গতিবিধি দেখেই হয়ত মানুষ ভেবেছিল যে এই প্রকৃতির নিষ্প্রাণ বস্তুগুলিও নিয়ম মেনে চলে। এছাড়া সে বোঝতে পেরেছিল যে একই পরিবেশে ও পরিস্থিতিতে একই ধরণের ঘটনা ঘটেঅর্থাৎ একজন যে পরিবেশে ফসল পায়। অন্যজনও একই পরিবেশে তা পায়। তাই আপাত বিশৃঙ্খল এই প্রকৃতির মধ্যে সে শৃঙ্খলাকে খুঁজতে চেয়েছে অনাদিকাল ধরে। সেই সঙ্গে এই শৃঙ্খলা আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই তার বুদ্ধিবৃত্তিরও বিকাশ ঘটেছে। প্রকৃতি যদি সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল হতো তাহলে মানুষের বুদ্ধিরও বিকাশ ঘটত না। কারণ বুদ্ধির অর্থই হল শৃঙ্খলাকে বোঝতে পারা। এভাবে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ যেভাবে ঘটেছে তেমনি সে প্রকৃতির শৃঙ্খলাকেও আবিষ্কার করার কাজে মনোনিবেশ করেছে ততোধিক ভাবে। কারণ প্রকৃতিকে বশ করতে গেলে এর প্রয়োজন সর্বাধিক। এভাবেই প্রকৃতির শৃঙ্খলাকে আবিষ্কার করতে করতে সে একদিন দেখল যে প্রকৃতির সর্বত্র একশ শতাংশ শৃঙ্খলা। এমনকি সে নিজেই এই শৃঙ্খলায় এতটাই আবদ্ধ যে তার স্বাধীন ইচ্ছেই নেই। মানুষ তার স্বাধীন ইচ্ছের ভ্রম নিয়েই এই প্রকৃতির এই অমোঘ নিয়মের রাজত্বে বসবাস করে। ঠিক যেন এক তাসের দেশ।
                 বিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা যখন আমাদের স্বাধীন ইচ্ছেকে নাকচ করে দিয়েছেন তখনই বিজ্ঞান-জগতে এক অভাবনীয় আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের সমস্ত হিসেবকে ওলট-পালট করে দেয়। এই আবিষ্কারটি হল হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্ব। দেখা গেল যে অণু-পরমাণু কিংবা পরমাণুতর বস্তু কণিকাগুলোর গতিবিধিকে ধ্রুপদী পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মে ব্যাখ্যা করা যায় না। এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণু-পরমাণুর জগতে চলে আরেক ধরণের নিয়মের রাজত্ব। এমন কি এই কণিকাগুলো গণিতের অমোঘ নিয়মের মধ্যেও আবদ্ধ নয়। সেখানে নিশ্চয়তার বদলে আছে সম্ভাব্যতা। তা আমাদের মস্তিষ্কের চিন্তা-ভাবনাতো এই সব মাইক্রো কণিকাগুলোর দ্বারাই নির্দিষ্ট হয়। তাই নিশ্চয়ই আমাদের স্বাধীন ইচ্ছে আছে। এরকমই ভেবে নিয়েছিলেন একদল বিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা। তবে বিজ্ঞানী মহলে যে খুব সহজে এই ধরণের ঐকমত্য তৈরি হয়ে গিয়েছিল তাও নয়। একে তো আইনস্টাইন সহ ধ্রুপদী পদার্থবিজ্ঞানীরা এই অনিশ্চয়তা তত্ত্বকে মেনে নেন নি। আইনস্টাইন নিজে এই তত্ত্বকে খারিজ করে দেবার জন্য অন্য দুজন বিজ্ঞানীকে নিয়ে তৈরি করলেন EPR প্যারাডক্স নামে এক কাল্পনিক এক্সপেরিমেন্ট। কিন্তু তাও ধোপে টেকেনি। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে শেষ পর্যন্ত হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা-তত্ত্ব বিজ্ঞান-জগতে স্বীকৃতি পেয়ে গেল এবং সেই সঙ্গে ১৯৩২ সালে হাইজেনবার্গ কোয়ান্টামতত্ত্বের আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কারও পেয়ে যান। তবে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্বে বস্তুজগতের গতিবিধির মধ্যে সত্যি সত্যিই অনিশ্চয়তা আছে কিনা তা নিয়ে আলোচনা করার আগে অন্য একটি বিষয় এখানে উল্লেখ না করে পারছি না।
                  ১৯২৭ সালে অনিশ্চয়তা-তত্ত্ব আবিষ্কারের পর ওয়ার্নার হাইজেনবার্গের নাম যখন বিজ্ঞানী মহলে ছড়িয়ে পড়েছিল তখন তিনি জাপানে যাবার আমন্ত্রণ পান। ১৯২৯ সালে এই যাত্রাপথে তিনি দিন দুয়েকের জন্য কলকাতায় অবস্থান করেন। ঐ সময় একদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপককে সঙ্গে নিয়ে তিনি জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে আসেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে। ভাগ্য ভাল যে ঐ সময় কবি কলকাতাতেই ছিলেন। তাদের দুজনের মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে আলাপ আলোচনা হয়েছিল। সে সময় হাইজেনবার্গের বয়স ছিল মাত্র ২৮ বছর। তাই বয়সের ব্যবধানের জন্যই হয়ত রবীন্দ্রনাথই ছিলেন এই আলোচনার মূল বক্তা। তিনি এই বিজ্ঞানীকে ভারতীয় উপনিষদের অনেক কিছুই সেদিন বলেছিলেন। এই প্রসঙ্গে ফ্রিৎজফ কাপরা তাঁর Uncommon Wisdom বইটিতে লিখেছেন যে রবীন্দ্রনাথের মুখে ভারতীয় দর্শনের কথা শুনে হাইজেনবার্গ পুলকিত হয়েছিলেন কারণ তাঁর নিজের আবিষ্কারও ছিল অনেকটা বেদান্ত দর্শনের মতোই। তবে হাইজেনবার্গ কিন্তু তাঁর নিজের লেখায় এই সাক্ষাৎকার সম্পর্কে উল্লেখ করলেও তাদের আলোচনার বিষয়ে কিছু লিখে যান নি। তবে তাঁদের আলোচনার মধ্যে যে বস্তুজগতের অনিশ্চয়তার প্রসঙ্গটি আসে নি তা আমরা জানতে পারি রবীন্দ্রনাথ যখন ১৯৩০ সালের ১৪ জুলাই তারিখে বার্লিনের শহরতলি কাপুথে আইনস্টাইনের সঙ্গে এই স্বাধীন ইচ্ছে ও অনিশ্চয়তার তত্ত্বটি নিয়ে আলোচনা করেন। কবি তখন জানান যে এই ব্যাপারটি তিনি ড০ মেন্ডেলের কাছ থেকে শুনেছেন। এখানে রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের কথোপকথনের খানিকটা অংশ বাংলায় তর্জমা করে তুলে দিলাম।
রবীন্দ্রনাথ - আমি ড০ মেন্ডেলের সঙ্গে আজ গণিতের নতুন আবিষ্কার নিয়ে আলোচনা করছিলাম যা আমাদের বলছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরমাণুগুলোর গতিবিধিতে যে অনিশ্চয়তা আছে তাতে মনে হয় যে আমাদের অস্তিত্বের নাটকটি এতটা পূর্বনির্ধারিত নয়
আইনস্টাইন বিজ্ঞান এই দিকটাতে ঝুঁকছে ঠিকই তবে এতে করে কার্য-কারণ সম্পর্ককে বিদায় জানানো হয়নি। বৃহত্তর ক্ষেত্রে এই শৃঙ্খলাকে আমরা বুঝতে চেষ্টা করছি। শৃঙ্খলা তো আছেই, যেখানে বৃহৎ বস্তুগুলো মিলিত হয়ে অস্তিত্বকে পরিচালনা করে। তবে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তু-কণিকার মধ্যে এই শৃঙ্খলা ততটা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়।
রবীন্দ্রনাথ তবে অস্তিত্বের গভীরে এই দ্বৈত ভূমিকা আছে, স্বাধীন তাড়না ও নিয়ম এমনভাবে কাজ করে যাতে করে এক শৃঙ্খলার জন্ম দেয়, যে শৃঙ্খলায় প্রকৃতি চলে।
আইনস্টাইন আধুনিক জড়বিজ্ঞান এটাকে অবশ্য অসঙ্গত বলে না। মেঘকে দূর থেকে দেখলে একরকম দেখায়, কিন্তু কাছে গিয়ে দেখলে অবিন্যস্ত জল কণাই দেখা যায়।
রবীন্দ্রনাথ মানুষের মনস্তত্ত্বেও আমি অনুরূপ ব্যাপার স্যাপার লক্ষ্য করি। আমাদের আবেগ ও আকাঙ্ক্ষা হল অদম্য, কিন্তু আমাদের চরিত্র এগুলোকে দমন করে রাখে এবং এই প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি আমাদের সামগ্রিক স্বত্বাকে প্রকাশ করে। বস্তুজগতেও কি এরকমই কিছু আছে? বস্তু-কণিকাগুলি কি এরকমই নিয়মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নিজেদের তাড়নায় চলতে চায়, যেখানে প্রকৃতির মূল নিয়মাবলী এদের সংহত করে রেখে এক শৃঙ্খলাবদ্ধ জগতের মধ্যে চালিত করে।
আইনস্টাইন বস্তু-কণিকাগুলো পরিসংখ্যান-গত নিয়মের বাইরে নয়। রেডিয়াম কণিকাগুলো সবসময়ই একটি বিশেষ শৃঙ্খলা বজায় রাখে। একটি পরিসংখ্যান-গত শৃঙ্খলা সর্বত্রই আছে।
রবীন্দ্রনাথ অন্যথায় অস্তিত্বের এই নাটকটি খুবই অবাস্তব হয়ে যেতো। এই সম্ভাব্যতা ও নিয়তির সমলয়ের মধ্যেই নিহিত আছে নবীনত্ব ও শাশ্বত ভাবে বেঁচে থাকা।
আইনস্টাইন আমি মনে করি আমরা যা কিছু কি তার পেছনে আছে কার্যকারণ সম্পর্ক। তবে এটা ভাল যে আমরা এটাকে উপলব্ধি করতে পারি না।
                  এই আলোচনার মধ্যে আমরা দেখি যে একদিকে রবীন্দ্রনাথ স্বাধীন ইচ্ছের ব্যাপারে তার মত প্রকাশ করে চলেছেন। আবার আইনস্টাইন তার কার্য-কারণ সম্পর্ক থেকে একচুল সরে যেতে রাজি নন। বিশেষ করে ১৯২৭ সালে যখন ইতালির টমো শহরে কোপেনহেগেন ব্যাখ্যার জন্ম হল, যেখানে মুখ্য প্রবক্তা ছিলেন নাইলস বোর, সেখানে আইনস্টাইনের মাথা ঘোরে যায়। তিনি এটাকে ননসেন্সআখ্যা দিয়ে এর বিরুদ্ধে প্রচারে নামেন। আশ্চর্যের বিষয়টি হল, যে আইনস্টাইন এক সময় বৈপ্লবিক ধারণার জন্ম দিয়ে নিউটনীয় বলবিজ্ঞানের সমাপ্তি ঘটিয়েছিলেন, তিনি ভাবতেও পারেন নি যে এত শীঘ্রই তাঁর নিজের আবিষ্কারই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাবে। তাই বস্তু-কণিকার গতিবিধির মধ্যে অনিশ্চয়তার সম্ভাবনা তাঁকে এতটাই বিচলিত করে তুলেছিল যে তিনি তাঁর বন্ধু ম্যাক্স বর্নকে চিঠি লিখে জানিয়ে দেন তিনি বিশ্বাস করেন যে ঈশ্বর পাশা খেলেন না। তবে আধুনিককালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং লিখেছেন যে ঈশ্বর যে শুধু পাশাই খেলেন তা নয়, বরং তিনি সময়ে সময়ে পাশার দান এমন জায়গায় ছুড়ে দেন যে তাদের আর দেখাই যায় না। তবে স্টিফেন হকিং আমাদের স্বাধীন ইচ্ছে থাকার ব্যাপারে রায় দিলেও অন্য এক বিজ্ঞানী যার নাম গোটা বিশ্বের বিজ্ঞানী মহলে সুপরিচিত, তিনি লিখেছেন যে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্বের মধ্যে বস্তুজগতের গতিবিধির মধ্যে অনিশ্চয়তা বলে কিছু নেই। এটা হল এক ধরণের অনির্ণেয়তা। এ নিয়ে আলোচনা করার আগে আমরা দেখে নিই হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্বটি আসলে কি।
   এই অনিশ্চয়তা তত্ত্বে বলা হয়েছে যে অণু-পরমাণুর অবস্থান ও ভরগতিকে (momentum) আমরা এক সঙ্গে জানতে পারি না। অর্থাৎ কোন এক মুহূর্তে যদি আমরা একটি পরমাণুর অবস্থানকে নিরূপণ করতে পারি তাহলে এর ভরগতিতে নিরূপণ করতে পারবো না। আবার যদি ভরগতিকে নিরূপণ করতে পারি তাহলে এর অবস্থানকে নিরূপণ করতে পারব না। পরমাণুটির ভরগতিকে যতটা জানতে পারব, তার অবস্থান ঠিক ততটাই ঝাপসা হয়ে যাবে আমাদের কাছে। আবার অবস্থানকে যতটা জানতে পারব, ঠিক ততটাই এর ভরগতির বিষয়টি আমাদের কাছে ঝাপসা হয়ে যাবে। এদিকে কোন একটি পরমাণুর অবস্থান ও ভরগতিকে এক সঙ্গে জানতে না পারলে তার ভবিষ্যৎ অবস্থানকে জানতে পারব না। তাই সূর্য গ্রহণের সঠিক সময় যদিও আগে থেকে বলে দেওয়া সম্ভব, কিন্তু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তু কণিকার ক্ষেত্রে সেটি হচ্ছে না। তবে যে প্রশ্নটি অচিরেই আমাদের মনে আসে তা হল যে আমরা না হয় জানতে পারব না, কিন্তু তাই বলে কি পরমাণুটির গতিবিধি অনিশ্চিত। আমাদের জানতে না পারাটা আমাদের সমস্যা। পরমাণুর তাতে কি? সে নিজে হয়ত একটি সুনির্দিষ্ট পথ ধরেই চলেতাই হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে কি নিয়তিবাদ বা ডিটারমিনিজমকে খারিজ করে দেওয়া যায়। দেখা যাক বিশ্বের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে কি বলেন।
    আমরা এখন যা ভাবলাম, রজার পেনরোজ তাঁর Emperor’s New Mind বইটিতেও ঠিক এই কথাটাই লিখেছেন। হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, “... there seems to be no room for free will since the future behavior of a system seems to be determined by physical laws.”এরপর তিনি লিখছেন, “This would imply that the future would not be computable from the present even though it might be determined by it.”অর্থাৎ অণু-পরমাণুর গতিবিধি অনির্ণেয়হলেও তাদের গতিবিধি সুনিশ্চিত। আমরা জানতে পারব না এটা আমাদের ব্যাপার, তাই বলে বস্তু জগতের গতিবিধি অনিশ্চিত নয়। এখন প্রশ্ন হল যে রজার পেনরোজের কথাই কি শেষ কথা। না, তা মোটেই নয় কারণ এ ব্যাপারে অন্যান্য অনেক বিজ্ঞানীই ভিন্ন মত পোষণ করেন। যেমন স্টিফেন হকিং তাঁর A brief History of Time বইটিতে লিখেছেন যে অনিশ্চয়তা তত্ত্বের ভিত্তিতেই অনেক বিজ্ঞানীরা আমাদের স্বাধীন ইচ্ছে থাকার ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। তবে হকিং নিজে এ ব্যাপারে কোন ব্যাখ্যা না দিলেও ঈশ্বর যে পাশা খেলেন না তা লিখেছেন। হকিঙের জীবনীকার মাইকেল হোয়াইট ও জন গ্রিবিন তাঁদের ‘Stephen Hawking – A life in Science’ বইটিতে লিখেছেন, “By introducing uncertainty and probability into the equations, quantum physics does away once and for all with the predictive clockwork of Newtonian determinism. If the Universe operates, at the deepest level, in a genuinely unpredictable and indeterministic way, then we are given back our free will, and we can after all make our own decisions and our own mistakes.”
   এছাড়াও স্বাধীন ইচ্ছের সমর্থনকারী বিজ্ঞানীদের মধ্যে আরেকজন হলেন গোটিনজেন বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধ্যাপক হেনরি স্টাপ। তিনি তাঁর Mind, Matter and Quantum Mechanics গ্রন্থে লিখেছেন যে আমাদের স্বাধীন ইচ্ছে অবশ্যই আছে। তাই হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্বকে খারিজ করতে গিয়ে আইনস্টাইনকেও তাঁর EPR প্যারাডক্সে দূরকে সরাসরি প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে স্ববিরোধিতার আশ্রয় নিতে হয়েছে। এদিকে আবার স্বাধীন ইচ্ছের কট্টর সমালোচক হিসেবে আইনস্টাইনের সুখ্যাতি আছে। ১৯৩১ সালে যখন রবীন্দ্রনাথের সত্তরতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ‘The Golden Book of Tagore’ নামে একটি স্মরণিকা প্রকাশিত হয়। সেখানে আইনস্টাইনকে একটি লেখা পাঠানোর অনুরোধ করায় তিনি আমাদের স্বাধীন ইচ্ছে থাকার বিরুদ্ধে একটি লেখা পাঠান। তিনি লিখছেন, “If the moon, in the act of completing its eternal way around the Earth, were gifted with self-consciousness, it would feel thoroughly convinced that it was traveling its way of its own accord…. So would a Being, endowed with higher insight and more perfect intelligence, watching man and his doings, smile about man’s illusion that he was acting according to his own free will.”অর্থাৎ চাঁদের যদি চেতনা থাকত তাহলেও সে দেখতে পেতো যে সচেতন মন থাকা স্বত্বেও তাকে পৃথিবীর চার দিকেই ঘুরতে হয়। আর আমাদের স্বাধীন ইচ্ছে থাকার ভ্রম দেখে তো ঈশ্বরের হাসি পায়।

    এবারে পাঠকদের কৌতূহলকে আরো একটু উস্কে দিয়ে জানাই যে হেনরি স্টাপ সহ কয়েকজন বিজ্ঞানী দাবি করছেন যে বস্তুই দুরকম। যেমন Classical Matter Quantum Matter. প্রথমোক্ত বস্তু ধ্রুপদী পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়ম মেনে চলে। কিন্তু শেষোক্ত বস্তু কণিকা তা মানে না। এই শেষোক্ত বস্তু কণিকাগুলোই আমাদের মনের কারক। যে মন স্বাধীন ও সচেতন। ২০০১ সালের ২১ মে তারিখে প্যারিস শহরে ভাষণ দিতে গিয়ে হেনরি স্টাপ বলেন, “Properties of this stuff (Quantum Matter) are radically different from the properties of matter postulated by Isaac Newton and his successors. The properties of quantum matter lie ‘mid-way’ between those of classical matter and mind.”অর্থাৎ কোয়ান্টাম ম্যাটার হল এমন কিছু যার অবস্থান হল মন ও বস্তুর মাঝামাঝি। তাই এই বস্তু কণিকাগুলো মন ও বস্তুর মধ্যে সমন্বয় রক্ষা করে চলে। যার একটি স্বাধীন, অন্যটি গণিতের নিয়মে বাঁধা। তবে বিজ্ঞানী মহলে এই কোয়ান্টাম ম্যাটারের অস্তিত্ব এখনও  স্বীকৃতি পায় নি। ভবিষ্যতে পেলে পেতেও পারে।
   পরিশেষে এটুকুই বলতে চাই যে কয়েকজন স্নায়ু বিজ্ঞানীও আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে আত্ম-সচেতন মনের অস্তিত্বের সন্ধান পেয়েছেন। এদের মধ্যে আছেন দুজন নোবেল পুরষ্কার বিজেতা স্নায়ু বিজ্ঞানী, জন কারেউ একলেস ও রজার স্পেরি। এই বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে সব সময় বস্তুজগতের নিয়ম মেনে চলে না। একটি স্বাধীন স্বত্বা কাজ করে ঠিকই কিন্তু কি ভাবে করে তা জানতে পারা যায় না। আমার বিশ্বাস যে মস্তিষ্কও বস্তুর নিয়ম মেনেই চলে। কিন্তু আমরা এখনো বস্তুকেই ভাল করে জানতে পারি নি।
   যাই হোক, এ ধরণের অনেক অনেক উদাহরণ দেওয়া যায় যা থেকে অন্তত এটুকু অনুমান করা যায় যে কোয়ান্টাম তত্ত্বের আবির্ভাবে ও স্নায়ু বিজ্ঞানের উন্নততর গবেষণায় আমাদের স্বাধীন ইচ্ছে সম্পর্কে বিজ্ঞানী-মহল আজ দ্বিধা বিভক্ত। এ নিয়ে এখনও কোন ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয় নি। আমি শুধু এটুকু বলব যে বিষয়টি বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের মহলে যে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে তাতে অন্য আরো অনেক বিষয় নিয়েই আমাদের নতুন করে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে। এমন কি সমগ্র ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রেও নতুন ভাবনার সৃষ্টি হতে পারে। কার্ল মার্ক্স থেকে বারট্র্যান্ড রাসেল পর্যন্ত বিভিন্ন মনিষীদের চিন্তাধারায় এ পর্যন্ত 'ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা' নিয়ে যে সব বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দেওয়া আছে, তাও নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচ্য হতে পারে।




                                         



 




কোন মন্তব্য নেই: