“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বুধবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৫

পিপুফিশু


 ।। সুদীপ নাথ।।
(C)Image:ছবি
শেফালি আর অন্তরা। দুই বোন। প্রান্তিক এক শহরের এক প্রান্তে বাড়ি। শেফালি আর অন্তরা জীবনে কোন দিন এক গ্লাস জল নিয়েও খায়নি। মা-বাবার আদরের ধন। কোন কাজ করতে দেয় না তাদের মা আর বাবা। ধীরে ধীরে আলস্য গ্রাস করতে থাকে তাদের। দেশ তখন পরাধীন। একটা বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বসুদ্ধ মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু দুই বোন এসব কিছুই দেখেনি। মায়ের মুখে গল্প শুনেছে। যুদ্ধের সময়ে অনেক ঘুম পাড়ানিয়া গান, গল্প, ছড়া ইত্যাদিও মায়েরা মুখে মুখে তৈরি করেছিল। এসব সবার মুখে মুখে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। এইসব গীত ও ছড়া শুনে শুনেও, যুদ্ধের একটা ধারণা তাদের মনে তৈরি হয়েই ছিল।

দেখতে দেখতে ওরা শৈশব ছেড়ে বাল্যে এসে পৌঁছেছে। এদিকে, দিনে দিনে সীমাহীন আলস্য দুজনকে গ্রাস করতে থাকে। এমন সময়ে তাদের মা তিন দিনের জ্বরেই মারা যান। তখন চিকিৎসা বলতে কোয়াক ডাক্তার। কেউ জানে না মায়ের কী রোগ হয়েছিল। মেনিনজাইটিস না ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া না অন্য কিছু, তা জানা যাবে না কোন দিনও।

বাবা মেয়ে দুটির দিকে তাকান, আর বুক ফাটা কান্না চেপে রাখেন। চোখের জল যেন মেয়েরা দেখতে না পারে, তাই মুখ সরিয়ে নেন। সকাল সকাল ওদের জন্যে রান্না সেরে নেন। ওদের চান করিয়ে, খাইয়ে দাইয়ে, কাজের সন্ধানে বেড়িয়ে যান। তাই বোন দুটির আলসেমি আরো বেড়ে চলে। ওরা আলস্যের ঢেঁকি। এতদিনে মায়ের কথাও আর বিশেষ মনে পড়ে না। সারাদিন শুয়ে শুয়েই কাটিয়ে দেয় দুজনে। যেন আলসেমির প্রতিযোগিতা চলছে ওদের মধ্যে। দিনে দিনে ওরা বড় হতে থাকে।

ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। পয়লা সেপ্টেম্বর ১৯৩৯এ পোল্যান্ড আক্রমণের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সূচনা করে হিটলারের জার্মানি। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে হেরে যাওয়ার প্রতিশোধ নিতে, সেইদিন জার্মানি কোন আগাম ঘোষণা না দিয়েই যুদ্ধ শুরু করে দেয়। জার্মানির সাথে যোগ দেয় জাপান ও ইটালি। অন্যদিকে থাকে রাশিয়া, ফ্রান্স, ব্রিটেন ও আমেরিকা। আঠার মে ১৯৪৫ তারিখে জার্মানির আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ।

ততদিনে শেফালি আর অন্তরা আর বালিকা নয়, এখন ওরা কিশোরী। কিন্তু এই দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের বীভৎসতা এখন আর গল্পে শোনা কল্পকথা কথা নয়। অল্প-স্বল্প হলেও, চাক্ষুষ করেছে সমস্ত ধরণের পরিস্থিতি। দিনের পর দিন, নিষ্প্রদীপ চলতো। যা আমরা যারা এখন পৌঢ়, প্রত্যক্ষ করেছি চীন ভারতের যুদ্ধের সময়। হ্যারিক্যানে সবুজ চিমনী ব্যবহার করতে হতো। তখন এলাকার পর এলাকা সন্ধ্যা থেকেই অন্ধকারে ডুবে হয়ে থাকত। দুই বোন ভয়ে গুটিয়ে থাকত। বাবা চলে গেলে, দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকতো। তাদের চলাফেরাও বলতে গেলে স্তব্ধ হয়ে যায়। 

আলসেমিতে শেফালি আর অন্তরা, একে অপরের সাথে কথা বলাতেও লাগাম টেনে দেয়। তারা সংক্ষেপে কথা বলতে শুরু করে। ভাতকে বলে ভা, জলকে বলে জা, মাছকে বলে মা, পিঠ কে বলে পি, রাতকে রাইত্যাদি। আর তাদের বাবা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলে, এই আলসেমি আরো বেশি করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। বাবার অনুপস্থিতিতে, আলসতার তাগিদে, গোপন প্র্যাকটিস চলতে থাকে, এক অক্ষরের শব্দমালা রচনায়। এখন বাবার বাড়িতে ঢোকার সময় পায়ের শব্দে একজন অন্যজনকে জানিয়ে দিতে, শুধু বলে- বা। এভাবেই দিন গড়ায়।

একদিন সন্ধ্যায়, বাবা তখনো বাড়ি আসেনি। কাঠের টুলের উপর, বইয়ের গাদায়, মোম জ্বালিয়ে চুপটি করে শুয়ে আছে দুই বোন, শেফালি আর অন্তরা। অন্তরা ছোট। সে শুয়ে আছে বাবার বিছানায়। শেফালি নিজেদের বিছানায়। মোম জ্বলে জ্বলে বইয়ে আগুন ধরে যায় । টুলটি বিছানার গা ঘেঁষা ছিল বলে, অন্তরার পেছনের অংশে আগুন লেগে যায়। ধীরে ধীরে সেই আগুন, বিছানায় ছড়িয়ে যেতে থাকে। অন্তরার পিঠ অব্দি আগুন পৌঁছে যায়। অন্তরা আলসেমি ভরা গলার স্বরে দিদিকে সাহায্যের কাতর আহবান জানাতে চায়, কিন্তু নড়েও না, চড়েও না। ঘাপটি মেরে সেই শুয়ে শুয়েই দিদি শেফালিকে ডাকে শুধু দিবলে। শেফালি বলে , মানে বল শুনছি। অন্তরা তার দিদিকে জানায় তার পিঠ পুড়ছে। সংক্ষেপে শুধু বলে পি পু। দিদি শেফালি তখন বোন অন্তরাকে পাশ ফিরে শুয়ে পিঠ বাঁচাতে উপদেশ দেয়। আর সংক্ষেপে বলে, ‘ফি শু

এটা একটা বহুল প্রচারিত গল্প মাত্র। আমি ছোটবেলায় আমার দাদা দিদিদের থেকে শুনেছি। হয়ত দাদা দিদিরা কোনও বড় সাহিত্যিকের কোন বইয়ে পড়েছেন। কিন্তু এটাও আমি মহা অলসদের পিপুফিশুবলে ব্যঙ্গ করতে অনেককেই দেখেছি। কেউ কাজকর্ম না করে, অলস জীবন যাপন করলেই, তাকে এই বিশেষণে ভূষিত করা হতে দেখেছি। অলসতা যাদের জীবনকে গ্রাস করে নেয় তারা পিপুফিশুনামেই ধিক্কৃত হয়। ধিক্কারের আগে আমরা একটুও তার কারণ খুঁজে দেখি না। এবার সেদিকেই একটু নজর দেয়া যাক।

আলস্য অনেক কারণেই আমাদের গ্রাস করে। প্রধান তিনটে দিক হচ্ছে সামাজিক,  মনস্তাত্ত্বিক আর শারীরিক। শারীরিক দিকগুলোর মধ্যে থাকছে, কিছু ভিটামিনের অভাব, স্পন্ডেলাইসিস সহ নানা ধরণের রোগ বা উপসর্গ। মনস্তাত্ত্বিক দিকের মধ্যে রয়েছে কিছু মানসিক রোগ, যেমন বাই পোলার রোগের ডিপ্রেশন আর স্কিজোফ্রেনিক ডিপ্রেশন ইত্যাদির মত গুরুতর রোগ। এই অবস্থায় মানুষ তখন চরম উদ্যোগহীনতায় আক্রান্ত হয়। এমনকি, চান-খাওয়াও না করতে পারে। আপাত দৃষ্টিতে এদের অলস মনে হলেও, এরা মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত। তাই এদের চিকিৎসা করতে কাউকে এগিয়ে আসতে হয়। এরা নিজের ভালমন্দ বিচার করতে অক্ষম। এক্ষেত্রেও এরা অলস বলেই প্রথমে ধিক্কৃত হয়। এদেরও তখন নাম হয় পিপুফিশু

এটা আজ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত সত্যি যে, মানুষের জীবনের সৃষ্টির সময় থেকে প্রকৃতির সাথে যে মেলবন্ধন তৈরি হয়েছে, তা যদি নড়ে যায়, তাহলে মানব মনেও তার মারাত্মক প্রভাব পড়ে। অন্ধকার আর আলোর সাথে চিরায়ত যে সম্পর্ক শরীরের তৈরি হয়েছে, তার যদি ছন্দপতন ঘটে, তাহলে শরীরের বায়োলজিক্যাল কাজ এলোমেলো হয়ে যায়। মস্তিষ্কের ভিতরের কার্যকলাপ বাইরের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। দেখা দেয় ক্লান্তি, অবসাদ, রক্ত চাপের ও পরিপাকের এবং ঘুমের সমস্যা সহ অনেক সমস্যা এবং সর্বোপরি অলসতা। আমাদের চোখের রেটিনায় আলো এসে নার্ভের মাধ্যমে হাইপোথ্যালামাস গ্রন্থিতে ঘনীভূত মেলাটোনিন হরমোনকে নিয়ন্ত্রণ করে। আলোর অনুপস্থিতিতে মেলাটোনিন নিঃসরণ বেড়ে যায়। অতিরিক্ত মেলাটোনিনের নিঃসরণে আমাদের মস্তিষ্কে অবসাদ তথা ডিপ্রেশন তথা নিস্তেজনা সৃষ্ট হয়। বিপরীতে অতিরিক্ত আলো আমাদের ঘুম ব্যাহত করে। দিন-রাতের দৈর্ঘ্যের তারতম্যের ফলে শীত ও গ্রীষ্মে অবসাদ ও উত্তেজনার রকমফের আজ ক্রনোবায়োলিজির বিজ্ঞানীদের দ্বারা পরিক্ষিত সত্য। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের প্রভাব, শেফালি আর অন্তরার উপর সাংঘাতিক প্রভাব বিস্তার করেছিল।

এদিকে, সামাজিক দিকটিই আলস্যের সর্বজন গ্রাহ্য কারণ হিসেবে বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত। যখন কোন শ্রম, কারও কাছে তার দৃষ্টিভঙ্গিতে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়, তখন সেই কাজ করতে সে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে উদ্যোগহীন হয়ে পড়ে। এই মানসিকতা সাধারণত গড়ে উঠে ছোট বেলায়। চিত্তাকর্ষক নয়, এমন শ্রমের প্রতি কাউকে আকৃষ্ট করতে হলে, সেই শ্রমের অফুরন্ত সৌন্দর্য তাকে দেখানো উচিৎ, তা তাকে কতটুকু আনন্দ দিতে পারে তা বোঝানো উচিৎ। বকাঝকা করে কাউকে শ্রমের প্রতি আকৃষ্ট করানো যায় না। শিশুকে সঙ্গে নিয়ে যদি সমস্ত পারিবারিক শ্রমে এমনকি পড়াশোনার মত কাজেও পারস্পরিক সম্পর্কে ব্যাপ্ত থাকা যায়, তাহলেই শ্রমের প্রতি তাদের অনীহা দূর হয়ে যায়। আমি এমনটা বলছিনা যে, তাদের শ্রম, ঘরের দৈনন্দিন কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুক। তাদের শ্রমশীল করতে হলে, তাদেরকে এমন কিছু আকর্ষণীয় কাজের সাথে যুক্ত করতে হবে, যাতে শারীরিক পরিশ্রম ঘটে। এক কথায়, পরিশ্রম করাটাও প্র্যাকটিস করেই আয়ত্তে আনতে হয়। পরিশ্রমী ছেলে-মেয়ে সব মা বাবার কাছেই গর্বের বিষয়। মা বাবার মন আনন্দে ভরে যায়।

কিন্তু শেফালি আর অন্তরা। এই দুই বোনের ক্ষেত্রে তাদের বাবার করার কিছুই থাকেনা। মাতৃ হারা দুই শিশুকে তিনি কোন কাজ করতে দেননি, আবেগের বশে। তারই পরিণতি এখানে দৃশ্যমান। আগে থেকে পারিবারিক অর্থাৎ সামাজিক কারণের সাথে বাড়তি মাত্রা যোগ করে যুদ্ধের মানসিক চাপ ও নিষ্প্রদীপ, যা তাদের জীবনকে আরো দুর্বিষহ করে বিপদের দিকে ঠেলে দেয়।

শিক্ষাবিদেরা শ্রম-শিক্ষাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবেই গণ্য করে। তারা শ্রম শিক্ষাকে তিনটি জিনিসের সঙ্গতি হিসেবেই বর্ণনা করে থাকেন। এই তিনটে জিনিস হলো- উচিৎ, কঠিন এবং চমৎকার। কথাটির অর্থ খুবই গভীর এবং তাৎপর্য পূর্ণ। শ্রমের প্রতি ভালবাসা ছাড়া, মানুষ মনুষ্যত্বের অধিকারী হতে পারে না। ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে না।

বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছানোর মত, আর কোন কিছুই মানুষকে এত গভীর নৈতিক তৃপ্তি দানে সক্ষম নয়। যে শ্রম ভালবাসে, সেই ব্যক্তিই এই আনন্দ পুরোপুরিভাবে উপভোগ করতে পারে।


কোন মন্তব্য নেই: