“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ১ জানুয়ারী, ২০১৮

যাযাবর


।। সুপ্রদীপ দত্তরায় ।।








মি যাযাবর,
হাজার ক্রোশ পথ পেরিয়ে
বহমান কলংমার কুলে দাঁড়িয়ে
স্থায়ী আস্তানার আশায়।
আমার চলার পথ লক্ষ্মীন্দরের ভেলা
বিষধর সর্পের বিষে মৃতপ্রায় দেহ
আমিতো দোষী নই, ভাগ্যের পরিহাস
একচোখ মনসার কুটিল প্রয়াস।
পথে পথে যত আছে ভৈরবী সেতু
শত শত রাজাকার হায়নার দল--
অবলারে দলে যায় পাষণ্ড প্রবল,
তবু পথ চলি, বড় অসহায় আমি,
হীন, দুর্বল । রাত্রি গভীর হয় আমার সম্মুখে
লক্ষ ললনার হাহাকার আর তীব্র আর্তনাদে ।
ঘর বাড়ি উঠোন আর তুলসিতলা,
যত গোয়ালের গাভী,ধান ভরা গোলা
সব ছেড়ে এক রাত্রে করেছি প্রস্থান
মহাপ্রস্থানের পথে । স্ত্রী, কন্যা, ভগিনী জননী
একে একে লুণ্ঠিত ধর্ষিত হয় বিবস্ত্র বাজারে ।
দেশ থেকে হয়েছি দেশান্তর, আশ্রয়ের খোঁজে ।
বাংলা ভাগ, রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা মৌলবাদের জয়।
একাত্তরের বলি । কেউ বলছেন শরণার্থী
কেউ বলছেন আপদ, উপদ্রব । আমি যাযাবর
মাথা পেতে নিয়েছি মেনে, অপমান, অনাদর ।
আমাদের কেউ জমিদার, ডাক্তার খেলোয়াড়,
কেউ শিক্ষক, কেরানী, কেউ কোষাগার রক্ষক
সর্বস্ব খুইয়ে সেদিন সব একাকার
নতুন জাতির সৃষ্টি, শরণার্থী পরিচয়
স্থানে স্থানে শিবিরেতে নিয়েছি আশ্রয় ।
কেউ বিবেকের বলে, কেউ অর্থের বিনিময়ে, কেউ মানবতা দিয়ে নিয়েছে টেনে,
ছিল কেরানী হয়েছে কামলা
নিয়তির নিষ্ঠুর ক্রুর ছলে ।
তবু যাযাবর, চলেছি পথ, ভুলেছি সকল ব্যথা
যা কিছু পেয়েছি আঁকড়ে ধরেছি জেনেছি ভাগ্যে গাঁথা
ফেলে আসা যত সিমের লতা, পুকুর ভরাট মাছ
ফিরে ফিরে ডাকে মনের গভীরে পেতে চায় নিবিড় আঁচ।
প্রাণপণে ঠেলি চিৎকার করি বলি, ও দেশ আমার নয়,
ওখানেই হারিয়েছি যত প্রিয়জন, আত্মীয়,
যত স্বপ্ন, ভালবাসা, আমার আত্মপরিচয়।
বুঝিয়েছি মন, মানিয়ে নিয়েছি এখানে, এদেশে
যা পেয়েছি, অধিক দিয়েছি নিজেকে নিঃশেষে ।
জপ করি রোজ, এদেশ আমার, আমার আশ্রয়দাতা
এখানে যত নরনারী আছে, মাইবাপ মোর, দেবতা, বিধাতা ।
আমার যা আছে আমি সর্বস্ব সঁপিব
হাতে হাত সঁপে দিয়ে স্বদেশ গড়িব ।
হে মোর ভাগ্য বিধাতা তুমি উজানেতে বাও
অতীত ভুলিতে পারি সেই শক্তি দাও । কালে কালে বহে যায় বহু জলধারা
কলংমার কুলে জাগে নতুন সাহারা ।
আশার কুঁড়ি ফোটে, স্বপ্ন মুকুল
ভাগ্যদেবী এইবার দেন বুঝি কোল
গড়ে ঘর, পরিবার, লাউ কুমড়ো লতা
ধানে আসে শীষ, লক্ষ্মীর আশিস
সমুদ্রে শয্যা পাতা ।
আঁকড়ে ধরে মাটি, বৃক্ষ গজায় ।
হাসি ফুটে শিশু মুখে দিগন্তে ছড়ায় । আজ আবার সেই একত্রিশ ডিসেম্বর মধ্যরাত
সাতচল্লিশের উচ্ছ্বাস আতঙ্ক আর আর্তনাদ
একাত্তরের নির্যাতন, আশীর উৎকণ্ঠা
ডি ভোটার, ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে নো ম্যান্স ল্যান্ড
সেই পুনরাবৃত্তি, পথচলায় , শিকড় নির্মূল।
কে আছো পথিকবন্ধু, হাত বাড়াও
একবার সাথ দাও, রুখে দাঁড়াতে চাই,
ক্লান্ত, শ্রান্ত, আমি কাণ্ডারি হীন পথভ্রান্ত
এ পথের অন্ত দেখতে চাই ।



কোন মন্তব্য নেই: