।। শিবানী দে।।
মরিয়ম মির্জাখানি চলে গেলেন। মাত্র চল্লিশ বৎসর বয়সে, গত ১৫ জুলাই । গণিতের রানি চার বছর ধরে ব্রেস্ট ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াইয়ে হেরে গেলেন, কিন্তু গণিতের মত তথাকথিত পুরুষের বিষয়েও যে মেয়েরা সর্বোচ্চ শৃঙ্গে পৌছাতে পারে, তার জাজ্বল্যমান
নজির রেখে গেলেন এই মাত্র চল্লিশ বৎসরের মধ্যেই ।
তিনিই বিশ্বের প্রথম এবং একমাত্র মহিলা গণিতজ্ঞ যিনি গণিতের নোবেল বলে কথিত
ফিল্ড মেডেল লাভ করেছিলেন ২০১৪ সালে ।
আজ বড়ো আফসোস হচ্ছে, কেন এই মহিলার সম্বন্ধে এতদিন পর্যন্ত নাম ও গণিতের ফিল্ড
মেডেল প্রাপ্তির বেশি আর কিছু জানিনি বা তাঁর বিষয়ে কোনো লেখা চোখে পড়ে নি ।
জন্ম ৩ মে, ১৯৭৭, ইরানের তেহরানে । পিতা আহমেদ মির্জাখানি । তেহরানের
বিখ্যাত ফারজানেগান স্কুলে পড়াশুনো । জীবনের প্রথম দিকে মরিয়ম লেখক হবার স্বপ্ন
দেখতেন । হাইস্কুলে পড়বার সময় গণিতের সমস্যাগুলোর সমাধান করতে
করতে গণিতে, বিশেষ করে জ্যামিতিতে আগ্রহ জন্মায় । সেই সঙ্গে বড় দাদার অনুপ্রেরণাও ছিল
। পরপর দুবার আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড-এ সোনা জিতেন, ১৯৯৪
এবং ১৯৯৫ সালে । স্কুলের শিক্ষা শেষ করে তেহরানের শরিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে
গণিত নিয়ে স্নাতক হন । তারপর আমেরিকা যান হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার
জন্য । সেখান থেকে পি এইচ ডি করে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন অধ্যাপনার কাজে
। তার ক’বছর পর যোগ দেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে । একই সঙ্গে জটিল জ্যামিতি
নিয়ে গবেষণার কাজও চলতে থাকে । বিয়ে করেন চেক নাগরিক সহ-অধ্যাপক কম্প্যুটার-বৈজ্ঞানিক জান ভোন্দ্রাক-কে । তাঁদের একটি কন্যা আছে, অনহিতা ।
ফিল্ড মেডেল প্রাপ্তির আগে তাঁর গবেষণাকর্মের জন্য
তিনি আরো দুটো বিখ্যাত পুরস্কার পেয়েছিলেন, ব্লুমেন্থাল অ্যাওয়ার্ড ফর দি অ্যাডভান্সমেণ্ট
অব পিওর ম্যাথামেটিক্স(২০০৯), এবং স্যাটার প্রাইজ(২০১৩),
যা আমেরিকান ম্যাথামেটিক্যাল সোসাইটি দিয়ে থাকে ।
২০১৪ সালে ফিল্ড মেডেল লাভ করার পর গণিতে তাঁর আগ্রহ সম্পর্কে
প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘এটা(গণিতের সমস্যা) তো খুব মজাদার, ঠিক
যেন কোনো ধাঁধার সমাধান, অথবা ডিটেকটিভ গল্পের ডট সংযোগ করা
। আমার মনে হয়েছিল আমি এ বিষয়ে কিছু করতে পারি । তাই এই পথ বেছেছিলাম ।’ তিনি বলতেন, বিশুদ্ধ গণিত তিনি উপভোগ করেন, কারণ তার নিজস্ব
সৌন্দর্য এবং দীর্ঘস্থায়িত্ব আছে । বলেছিলেন, ‘এ যেন জঙ্গলের
মধ্যে হারিয়ে যাওয়া এবং তার থেকে বেরোনোর চেষ্টায় নিজের সমস্ত বিদ্যা প্রয়োগ করে
নতুন উপায় বানিয়ে এবং অল্প ভাগ্যের সহায়ে নতুন পথ খুঁজে পাওয়া ।’
তাঁর মৃত্যু ইরানের মহিলাদের হিজাবের ট্যাবু ও যেন শিথিল করে দিয়েছে । ইরানে
মহিলাদের মাথা সবসময়ই হিজাব ঢাকা দিয়ে রাখতে হয়, হিজাব না পরা কোনো ইরানি মহিলার ছবি
ছাপা হয় না । মরিয়মের মৃত্যুর খবর সব পত্রপত্রিকাই
ছেপেছে, দুএকটি অতি রক্ষণশীল পত্রিকা বাদে সকলেই তাঁর যে ফোটো ছেপেছে তা তাঁর
হিজাবছাড়া ছবি । তাঁর ফিল্ড মেডেল পাবার পর
প্রেসিডেণ্ট রৌহানি ও নিজের ট্যুইটার-এ মরিয়মের দু’ধরনের ছবি
দিয়েছিলেন, একটি পুরোনো হিজাব পরা এবং অন্যটি পরের দিকের
খোলা মাথা । আসলে মরিয়ম এমন উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিলেন যে তাঁকে কোনো সঙ্কীর্ণতায়
ধরে রাখতে রক্ষণশীলতাও হার মেনেছে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন