“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

স্বাধীনোত্তর ভারতের শিল্পনীতিতে ফেবিয়ানিজম


ভারত যখন স্বাধীন হলো তখন সারা বিশ্ব জুড়েই চলছিল এক বিতর্ক, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা ভালো নাকি  সমাজতান্ত্রিক।দুটো সমাজব্যবস্থার ভালোমন্দ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের মতাবলম্বীদের উদ্ভব হলো সারা বিশ্ব জুড়েই।এমন কি সমাজতান্ত্রিকদের মধ্যেও অনেকেই রুশ বিপ্লবে সর্বহারার একনায়কত্বকে মেনে নিতে পারেননি।তাঁদের চিন্তায় একদিকে ছিল পুঁজিবাদী অর্থনীতির মন্দা ও বেকারত্বের আতঙ্ক, আবার অন্যদিকে ছিল সর্বহারার একনায়কত্বের আগ্রাসী রূপ, যা মানুষের স্বাভাবিক বিকাশকে রুদ্ধ করে চিন্তা জগতে আনতে পারে এমন এক ধরনের নিয়ন্ত্রণাধীকরণ, যেখানে কঠোর রাজনৈতিক শৃঙ্খলার মধ্যে বিরুদ্ধ চিন্তার কোনও স্থান থাকবে না। এই ধরণের একনায়কত্বের প্রতি রবীন্দ্রনাথের মতো জহরলাল নেহরুও তাঁর নিরাশা ব্যক্ত করেছেন 'Glimpses of the World History' বইটিতে। তাই মার্ক্সীয় সমাজ ব্যবস্থার প্রতি অনেক মনীষীদেরই আস্থা ছিল না। অথচ তৎকালীন মনীষীরা পৃথিবীর অর্থনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে এই দুটো ব্যবস্থার মধ্যেই দেখতে পেয়েছিলেন প্রগতির বীজ। উক্ত সমাজতন্ত্রীরা দুটো ব্যবস্থার কোনটাকেই পুরোপুরি মেনে নিতে পারেননি। শেষমেশ তাঁরা এক মধ্যপন্থার জন্ম দেন এবং নিজেদের ফেবিয়ানসবলে পরিচয় দিতে থাকেন।
  ফেবিয়ানকথাটি এসেছে ফেবিয়াস নামে এক রোমান সেনাপতির নাম থেকে, যিনি অত্যন্ত কৌশলে বিনা যুদ্ধে শক্রকে বিনাশ করতেন। ফেবিয়ানসদের মতে ক্রমবিকাশ ও বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। তাই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার্থে রক্তক্ষয়ী বিপ্লব এবং সর্বহারার একনায়কত্ব বর্জিত নতুন পথের সন্ধান করতে লাগলেন ফেবিয়ানরা। সেই সঙ্গে নিজেদের সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রী বলে পরিচয় দিতে থাকেন।
   এই ফেবিয়ান মতাদর্শ যে সব চিন্তাবিদদের দ্বারা পুষ্টি লাভ করেছিল, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন চারজন। তারা হলেন জর্জ বার্নার্ড শ, সিডনি ওয়েব ও বিত্তত্রিস ওয়েব (এঁরা স্বামী-স্ত্রী)এবং প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ জন এম কিনস। এছাড়াও এইচ জি ওয়েলসের মত জনপ্রিয় লেখক ও ইতিহাসবিদও ছিলেন ফেবিয়ান। এই মতাদর্শের ভিত্তিতে কিনসের অর্থনৈতিক চিন্তাধারা সমাজতন্ত্রীদের মনে প্রভাব ফেলেছিল, পরবর্তীকালে তা কিনসীয় বিপ্লব নামেও আখ্যায়িত হয়। এমনকি ফেবিয়ান মতাদর্শের অনুগামী ব্রিটিশ লেবার পার্টি যুদ্ধোত্তর কালে সরকার গঠন করতেও সমর্থ হয়।
   স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু ছিলেন লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের অনুগামী, যা ছিল ফেবিয়ান প্রভাবিত। যার ফলে স্বাধীনোত্তর ভারতে অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে বিশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয় তা হলো কিনসের অর্থনৈতিক চিন্তাধারার ফল।
   মার্ক্সীয় অর্থনীতিতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সর্বনাশা যে দিকটি দেখানো হয়েছে তা হলো অতি উৎপাদনের সংকট। অর্থাৎ বিভিন্ন পুঁজিপতিরা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে উৎপাদন বাড়াতে থাকে। পরে এমন একটা সময় আসে যখন উৎপাদিত পণ্য বাজারে বিক্রি করার ক্ষমতা তাদের থাকে না। কারণ উপভোক্তার হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্রয় ক্ষমতা নেই, যা দিয়ে ঐ সমস্ত ভোগ্যপণ্য কেনা যেতে পারে। পুঁজিবাদী সমাজের এই অব্যবস্থাকে লেনিন 'অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জঙ্গলের আইন' হিসাবে বর্ণনা করেছেন।এই মন্দা যখন আসে তখন তড়িঘড়ি উৎপাদন কমিয়ে দিতে গিয়ে অসংখ্য বেকারের সৃষ্টি হয়। এই মন্দা-দশা কিছুকালের মধ্যে দূর হয়। উৎপাদিত পণ্য বাজারে বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর আবার নতুন করে চাহিদা বাড়ে। বন্ধ হয়ে যাওয়া অথবা উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া কলকারখানায় নতুন প্রাণের সঞ্চার হতে থাকে। বেকাররা আবার কর্মরত হন। আবার উৎপাদন বাড়তে বাড়তে আবার সেই 'অতি উৎপাদনের সংকটঅর্থাৎ আবার মন্দা-দশা ও বেকারত্ব। পুঁজিবাদী অর্থনীতিকরা এই চক্রের নাম দিয়েছেন 'ব্যবসা চক্র' বা 'ট্রেড সাইকল'যদিও এই ব্যবসা চক্রের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে তারা প্রায় কেউই মার্ক্সের বর্ণিত যুক্তিকে মেনে নেননি।কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে থেকে এই ভয়াবহ চক্রের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার ক্ষেত্রে কিনস যে সকল পন্থা দেখিয়েছিলেন, তা থেকে স্পষ্টতই অনুমান করা যে এই সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ যে অতি উৎপাদন তা আসলে তিনি মেনে নিয়েছিলেন।তাই কিনসের মতে সংকট এড়ানোর উপায় হলো শিল্প ও বাণিজ্যের উপর 'আরও আরও বেশি পরিমাণে সরকারি নিয়ন্ত্রণ' অর্থাৎ সরকার হিসাব করে দেখবেন যে কি পরিমাণ পণ্য বাজারে বিক্রি হতে পারে এবং নতুন কলকারখানা স্থাপন অথবা কোনও কারখানায় উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে লাইসেন্স, কোটা অথবা পারমিট ইত্যাদির মাধ্যমে উৎপাদনকে সীমিত রাখতে হবে যাতে অতি উৎপাদনের সংকট এড়ানো যায়। সেই সঙ্গে পুঁজিকে নিয়ন্ত্রণ করে জনকল্যাণমূলক কাজে লাগাতে হবে। বর্তমানে অমর্ত্য সেনের অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনাও অনেকটা এরকমই।
   ফেবিয়ান মতাদর্শে বিশ্বাসী নেহরু তাই স্বাধীনোত্তর ভারতে প্রথমেই নিয়ে আসেন উদ্যোগ ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ।এই উপলক্ষে দিল্লিতে স্থাপিত হলো 'উদ্যোগ ভবন', যেখানকার কর্মকর্তারা লাইসেন্স প্রথার মধ্য দিয়ে ভারতের শিল্পোদ্যোগ নিয়ন্ত্রণ করতে লাগলেন।নামে 'উদ্যোগ ভবন' হলেও এ সংস্থার লালা ফিতের বন্ধন ছিল এমনই যা শিল্পোদ্যোগকে ও ব্যবসা বাণিজ্যকে যতটা না নিরুৎসাহিত করেছে, ততটা সুযোগ করে দেয় নি।
   শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে এই কিনসীয় অর্থনীতির আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল এই যে, এর ফলে পুঁজিবাদের বিকাশ হবে কম এবং শিল্প ও বাণিজ্য থেকে অতিরিক্ত হারে আয়কর, বিক্রয়কর, উৎপাদন শুল্ক ইত্যাদি আদায় করে সরকারের হাতে আসবে বিপুল পরিমাণ অর্থ যা দেশের উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করা হবে।যেমন রাস্তাঘাট, চিকিৎসালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। আবার ঐ অর্থ কাজে লাগিয়ে সরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে, যা মূলত দেশের অর্থনৈতিক পরিকাঠামোকে মজবুত করবে। যেমন ইস্পাত কারখানা, সুতো কল, বিদ্যুৎ উৎপাদন ইত্যাদি হবে সরকারি মালিকানাধীন। এছাড়া সরবারহ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা, যেমন রেলওয়ে, টেলিফোন, ডাক বিভাগ ইত্যাদি থাকবে সম্পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও মালিকানাধীন। অর্থাৎ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পাশাপাশি থাকবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা।পুরো দেশের অর্থনীতি থাকবে সরকারি নিয়ন্ত্রণে এবং এইভাবেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উপর সমাজতন্ত্রের জয়লাভ হবে ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়ে। এটাই ছিল নেহরু তথা ফেবিয়ানদের স্বপ্ন, যাকে মার্ক্সবাদীরা ইউটোপিয়া অর্থাৎ অলীক বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
   নেহরুর এই ফেবিয়ান চিন্তাধারা হয়ত বা অলীক ছিল, কারণ স্বাধীনতা-প্রাপ্তির পর যে সব সরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল, ধীরে ধীরে এর অনেকগুলোর অবস্থাই হয়ে পড়ে মৃতপ্রায়। এই শিল্পোদ্যোগগুলি যাতে বন্ধ হয়ে না যায় তাই প্রতিবছর বিপুল পরিমাণে অর্থ সাহায্য দিয়ে এগুলি টিকিয়ে রাখা হয়েছিল। আশির দশকে অবস্থাটা এমন দাঁড়ায় যে লব্ধ আয়করের একটি বড় অংশই সরকারের খরচ হয়ে যেত ঐ সব শিল্প প্রতিষ্ঠানদের ভরতুকি দিতে, যা কি না উন্নয়নমূলক কাজে খরচ হওয়ার কথা ছিল।তাই প্রতিবছর সরকারের বাজেট ঘাটতি পূরণ করতে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে। এখনও বাড়ছে।
   অন্যদিকে নেহেরুর সময় থেকে বেসরকারি শিল্পোদ্যোগগুলির উপর যে আয়করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার হার এতটাই বেশি ছিল যে অধিকাংশ উদ্যোগগুলিই তাদের আসল মুনাফা কাগজে কলমে না দেখিয়ে মুনাফা লব্ধ অর্থের একটি বড় অংশ নিজেদের হাতে রেখে দিত যা ওরা সরাসরি ব্যবসায় খরচ করতে পারত না। অর্থাৎ আসল মুনাফার একটি বড় অংশই পুঁজিতে রূপান্তরিত হতে পারত না। আয়করের হিসাবে বেহিসাবি এই টাকাই হলো কালো টাকা। কাজেই শিল্পপতিরা এই কালো টাকাকে ইচ্ছায় অথবা কখনও অনিচ্ছায় ভোগ বিলাসে ব্যয় করতে অভ্যস্ত হলেন।শেয়ার বাজার জুয়া খেলায় পরিণত হয়েছিল এই কালো টাকার দৌলতেই।যার ফলে সাদা টাকা, যা পুঁজি হিসাবে অত্যাবশ্যক সামগ্রী তৈরি করতে পারত, কিন্তু কালো টাকার দৌলতে বিলাসবহুল পণ্য সামগ্রীর বাড়তি চাহিদা মেটাতে সেই পুঁজি বিলাস সামগ্রী প্রস্তুত করতে উৎসাহিত হলো। ফলে অত্যাবশ্যক পণ্য সামগ্রীর উৎপাদনে বৃদ্ধি হলো কম। তাই ৮৫ শতাংশ হারে আয়কর চাপিয়ে দিয়ে সরকার ভেবেছিলেন যে বিপুল পরিমাণ অর্থ আসবে যা দিয়ে সরকারি শিল্পোদ্যোগ গড়ে তোলা সম্ভব হবে, অথচ তা তো হলই না, উল্টে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টির ফলে দুর্নীতির পথ হলো প্রশস্ত এবং সরকারের তহবিলে মা লক্ষ্মীর বদলে দেখা দিলেন মা ভবানী।
   সম্ভবত আয়করের হার শুরু থেকেই আরও কমিয়ে দিলে সরকারি তহবিলে মোটামুটি একই অর্থ জমা হতো এবং পরিবর্তে বেসরকারি পুঁজির পরিমাণও বাড়ত। 'পুঁজি', সে সরকারি হোক অথবা বেসরকারি, তা উৎপাদনের কাজেই ব্যবহৃত হবে এবং এর সুফল শেষ পর্যন্ত জনগণের উপরই বর্তাবে। শুধু তাই নয়, অন্তত ন্যায্য পরিমাণে আয়কর চাপানো হলে দুর্নীতির পরিমাণ হতো কম এবং সরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক মনোবৃত্তি সৃষ্টি করাও সম্ভব হতো। এই সুষম প্রতিযোগিতার সহাবস্থানের মধ্যেই নিহিত ছিল উন্নত ধরনের প্রযুক্তি এবং কারিগরি শিল্পের বিকাশ। প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী আয়করের হার হ্রাস করে দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু শিল্পোদ্যোগ এবং আয়কর বিভাগের মধ্যে যে দুর্নীতির জন্ম অনেক আগেই হয়ে গিয়েছে তাকে বশ করা অন্তত রাজীব সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। অবশ্য তার জন্য ঐ সরকারের প্রচেষ্টায় যে আন্তরিকতার অভাব ছিল তা একপ্রকার নিঃসন্দেহেই বলা যায়। রাজনৈতিক বোদ্ধারা মনে করেন, এই দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিতে গিয়েই যে রাজীব গান্ধী অর্থমন্ত্রক থেকে স্বচ্ছভাবমূর্তিসম্পন্ন মন্ত্রী ভি পি সিংহকে তাড়িয়েছিলেন।
   কিনসের অর্থনৈতিক চিন্তাধারা ছিল মূলত উন্নত পুঁজিবাদী দেশের উপর প্রতিষ্ঠিত। যেমন আমেরিকা অথবা ব্রিটেন।কিন্তু স্বাধীনোত্তর ভারতের চেহারা ছিল অন্যরকম। তখন পুঁজিবাদের বিকাশ ছিল নিতান্তই কম এবং সামন্ততন্ত্রের বিপুল বোঝা ছিল দেশের অর্থনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে প্রবল বাধা স্বরূপ। এই সামন্ততন্ত্রের বিলুপ্তি-করণের প্রধান উপায় ছিল ভূমি সংস্কার এবং অত্যন্ত দ্রুত হারে শিল্পায়ন, সেই সঙ্গে সরকারি ও বেসরকারি স্তরে পুঁজির বিকাশ। ভারতের মাটিতে এ দুটোর একটাও হয়নি। তাই স্বাধীনতা-প্রাপ্তির এত বছর পার হয়ে যাওয়ার পরেও সামন্ততন্ত্র টিকে আছে বিশেষত কৃষি জমিতে। ভূমি সংস্কারের মতো জরুরি বিষয় এখন সরকারের এজেন্ডা থেকে বেমালুম লোপাট হয়ে যাওয়ায় ভূস্বামীরা নিশ্চিন্তেই আছেন। তবে সবচেয়ে আক্ষেপের কথা হলো এই যে, নেহরু নিজেকে ফেবিয়ান এবং সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রী হিসাবে ভাবতে ভালোবাসতেন অথচ দলিত অথবা অর্ধ-দলিত বিশাল জনগণের স্বার্থে ভূমি সংস্কার যে অত্যাবশ্যক তা ভালো রকমভাবে জেনেও দীর্ঘ ১৭ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ের মধ্যে তিনি এই কাজটি করে যেতে পারেননি। তাই আজও দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির ফসল ব্যাপক জনগণের কাছে বেল পাকার সঙ্গে কাকের সম্পর্কের মতোই বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে।
   ব্রিটেন কিংবা জাপানে সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটেছে দ্রুত শিল্পোন্নয়ন তথা পুঁজিবাদের বিকাশের মধ্য দিয়ে। দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা তাইওয়ানে ভূমি সংস্কার এবং সেই সঙ্গে দ্রুত শিল্পোন্নয়নের মধ্য দিয়ে শুধুমাত্র সামন্ততন্ত্রের বিলোপ সাধনই হয়নি, সেই সঙ্গে সে সব দেশের আপামর জনসাধারণে মধ্যে এসেছে শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ। ফলে জনস্বাস্থ্য, পরিবার কল্যাণের সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নতির ফসল সব শ্রেণির জনগণের পক্ষেই লাভ করা সম্ভবপর হয়েছে। স্বাধীনোত্তর ভারতে দ্রুত সরকারি শিল্পায়নের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পুঁজিবাদেরও বিকাশ হওয়াটা প্রয়োজনীয় ছিল। সেই সঙ্গে সামন্ততন্ত্রের বিলোপ সাধনের জন্য প্রয়োজন ছিল ভূমি সংস্কারের। খুব দ্রুত উন্নয়নের জন্য কিছুটা অবাধ বাণিজ্যেরও প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এই অবাধ বাণিজ্যের অর্থনীতিতে ভীত ছিলেন জহরলাল নেহরু। তিনি ভাবলেন যে উদ্যোগ ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণকে শিথিল করে দিলে জাতীয় অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে, অর্থনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে আসবে চরম বৈষম্য, যার ফলে দেশের দারিদ্র্য ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। অন্যদিকে পুঁজিবাদের নিয়ন্ত্রণহীন বিকাশের ফলে জন্ম নেবে এমন এক ধনতান্ত্রিক গোষ্ঠী, যারা অর্থনীতি এবং আইন শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে দেবে। সরকারি নিয়ন্ত্রণ কমে যাওয়ায় গণতান্ত্রিক শক্তি হবে পরাভূত এবং সর্বত্র যথেচ্ছাচারের শিকার হবে দেশবাসী।
   সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকা অবস্থায় এসব হবে না বলে যে ধারণা করা হয়েছিল, বাস্তবে তার ফল হয়েছে উল্টো। যে কালো টাকার পাহাড় জমেছিল তার ফলে এক সমান্তরাল অর্থনীতিরও জন্ম হয়েছিল কয়েক দশকের মধ্যেই। বিশেষত রাজনীতির ক্ষেত্রে অবাধ দুর্নীতির অনুপ্রবেশের ফলে এই সরকারি নিয়ন্ত্রণের অপব্যবহার হয়েছে নিদারুণ ভাবে। অন্যদিকে কিনস ভক্ত নেহরু পুঁজিবাদকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে তার বিকাশকে করে দিলেন রুদ্ধ। আবার সরকারি অনুগ্রহে মুষ্টিমেয় শিল্পপতিরা লাইসেন্সিং এর সুবিধা ভোগ করে ফুলে ফেঁপে অতিকায় হয়ে গেলেন। প্রতিযোগিতা যেখানে সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রিত, সেখানে রাজনীতির ক্ষেত্রে শিল্পপতিদের মাত্রাতিরিক্ত হস্তক্ষেপে অবস্থাটা এমন হলো যে, দীর্ঘদিন কংগ্রেস রাজত্বে যে সব শিল্পপতিরা অতিমাত্রায় সুযোগসুবিধা ভোগ করেছিলেন তাঁরা সরকারি লাইসেন্সিং ব্যবস্থা দিয়েই তাঁদের প্রতিপক্ষের উপর চালিয়ে গেলেন দমননীতি। ফলে পুঁজিবাদের সুষ্ঠু বিকাশ ভারতবর্ষে তো হলই না, উল্টে একটি আধা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর তৈরি হয়ে গেল একচেটিয়া পুঁজি, যা বিশ্বের অর্থনৈতিক মানচিত্রে এক অভিনব নিদর্শন। সেই সঙ্গে লাইসেন্সিং ব্যবস্থার কোপে যে সব শিল্পপতিরা তাদের ব্যবসা বাণিজ্যের সুষ্ঠুভাবে বিকশিত করতে পারে নি তারা উগ্র হিন্দুত্ববাদের আশ্রয় নিয়ে তাদের অনুগামী রাজনীতিকদের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের এমনই এক ঘৃণ্য রাজনীতিরও জন্ম দিলেন, যার ফলে দেশ আজ ধর্মের নামে বিভাজিত।
   এখন প্রশ্ন হলো যে, পুঁজিবাদের বিকাশের শুরুতেই তাতে এতটা সরকারি নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দেওয়াটা কি খুব বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছিল? মানুষ যখন প্রাণ রক্ষার জন্য আহার করে তখন কি সে মেদবৃদ্ধির কথা ভাবে? অথবা ভবিষ্যতে অধিক খাওয়ার জন্য মেদবৃদ্ধি হতে পারে ভেবে সদ্যজাত শিশুকে কম করে খাওয়ানো কি ঠিক? যে অর্থনীতি ব্রিটেন কিংবা আমেরিকার জন্য প্রযোজ্য তাকে আমাদের দেশে প্রয়োগ করার আগে দেশের আর্থসামাজিক পরিমণ্ডল বিবেচনা করা কি উচিত ছিল না? নব্বইয়ের দশক থেকে শিল্পক্ষেত্রে লাইসেন্সিং ব্যবস্থাকে শিথিল করে দিয়ে সরকার সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন ঠিকই তবে শুভ কাজে বিলম্ব হওয়ার প্রধান কারণ ছিল এই যে, সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকাকালীন রাজনীতিবিদদের ক্ষমতা ছিল বেশি। শুধু তাই নয়, স্বজন অথবা প্রিয়জন পোষণের এটা ছিল একটি বড় হাতিয়ার। কাজেই রাজনীতিবিদদের আখেরে কিছু প্রাপ্তিযোগ হতো এই লাইসেন্স রাজের মধ্য দিয়ে। তাই রাজনীতিক ডাক্তাররা এই রোগকে ইচ্ছে করেই লালিত করে গেছেন, অন্যথায় এই লাইসেন্স রাজকে অনেক আগেই খর্ব করে দেওয়া সম্ভব ছিল। তবে এই লাইসেন্স-রাজ রাজনীতিবিদদের জন্য যে ক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ করে দিয়েছিল আজও তা তারা ছাড়তে পারছেন না। তাই সরকারি আনুকূল্য পাওয়া গেলে ব্যবসায়ীরা যে ফুলে ফেঁপে অতিকায় হতে পারেন এই ধারণা তাদের ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। এই জন্যই রাজনীতিবিদদের হাতে রাখতে তারা নির্বাচনের সময় অবাধে অর্থব্যয় করেন। তাই শ্রমিক শ্রেণি যেহেতু দেশের নির্বাচনে টাকা খরচ করতে পারে না তাই চমক-ডমকের অভাবে তাদের প্রতিনিধিত্বও কমে আসছে দেশের শাসন ব্যবস্থায়। তাই বলব যে অতিরিক্ত সরকারি নিয়ন্ত্রণ দেশের আপামর জনগণের স্বার্থে ফলপ্রসূ হয় নি। অন্যদিকে সামাজিক ন্যায়ের ক্ষেত্রে এর সুফল যতটা না পাওয়া গেছে, তারচেয়ে এর কুফলই পাওয়া গেছে বেশি।


কোন মন্তব্য নেই: