(C)image:ছবি |
(কিছুদিন
আগে এই ব্লগে দক্ষিণ
আফ্রিকীয় লেখক জে এম কোয়েটজি-র লেখা 'এজ অব আয়রন' -এর
একটা ছোট সমালোচনাভিত্তিক সংক্ষিপ্তসার লিখেছিলাম । উপন্যাসটির কাব্যিক ভাষা, বর্ণনার
চিত্রকল্প, আঙ্গিক
এবং বিষয়
বস্তু আমাকে খুবই আকৃষ্ট করেছিল। কিছু কিছু বাক্য ও বাক্যবন্ধ মনের
মধ্যে অনুরণন
করতে থাকত, মনে
হত এই কথাগুলো বাংলায় বললে কেমন হত ? তাই ধীরে ধীরে বইটাই
অনুবাদ করে ফেলেছিলাম, 'আয়স কাল' নাম
দিয়ে । অনুবাদটি ধারাবাহিক
ভাবে এই
ব্লগে বেরোতে থাকবে, হয়তো
যথাযথ সময়ানুবর্তিতা
মেনে হবেনা, কারণ টাইপ করাতে আমি
নিতান্তই শম্বুকগতি । আজ তার তৃতীয় ভাগ --- শিবানী
দে )
আজকে সকালে গাড়িটা কিছুতেই চালু হচ্ছিল না, তাই আমি সেই লোকটাকে, বাড়ির সেই নতুন বাসিন্দাকে বললাম গাড়িটা ঠেলতে । সে ঠেলে গাড়িটা ড্রাইভওয়ে পর্যন্ত নিয়ে ছাদে চাপড় মেরে বলল, 'এখন হয়েছে ।' ইঞ্জিন চালু হল, আমি রাস্তায় নেমে কয়েক গজ গিয়ে কিজানি কি মনে হল, একটু থামলাম, ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে মুখ বাড়িয়ে তাকে বললাম,
আমি একটু ফিশহেক যাব । তুমি কি আমার সঙ্গে যেতে চাও ?'
তো আমরা চললাম,
কুকুরটা পেছনের
সিটে বসে, সেই তোমার ছোটবেলার সবুজ হিলম্যান এলাকা দিয়ে । অনেকক্ষণ আমরা কোন কথা
বলিনি । হাসপাতাল, ইউনিভার্সিটি, বিশপস কোর্ট পেরিয়ে যাচ্ছিলাম, কুকুরটা আমার কাঁধের উপর দিয়ে ঝুঁকে ঠাণ্ডা হাওয়া ওর মুখে লাগাচ্ছিল । আস্তে আস্তে উইনবার্গ পাহাড়ের উপর চড়লাম ।সেখান থেকে নিচে নামতে আমি ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলাম, গাড়ি গড়িয়ে নিচে নামতে লাগল । যত তাড়াতাড়ি নামছি, তত স্টিয়ারিং-এর চাকা আমার হাতে কাঁপতে লাগল আর কুকুরটা উত্তেজনায়
কুঁইকুঁই করতে থাকল । আমারও মনে হচ্ছিল আমি মৃদু হাসছি, চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল ।
পাহাড়ের নিচে পৌছাতে পৌছাতে গাড়ির গতি
কমালাম । সে যেন আয়েস করে নিরুদ্বিগ্ন মুখে বসে আছে । ভাবলাম, ভাল, বেশ লোক ।
আমি বললাম, 'ছোটবেলায় আমি একটা
সাইকেল চড়ে পাহাড়ের ঢালু গা বেয়ে নামতাম, তার ব্রেক বলতে কিছু
ছিল না বললেই চলে । সাইকেলটা আসলে ছিল আমার দাদার । সে আমাকে চ্যালেঞ্জ
করত, আর আমার ভয়ডর বলতে
কিছু ছিল না । শিশুরা তো মৃত্যুর আসল অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনা। তারাও যে
কখনো মরবে এটা তাদের ভাবনাতেও আসে না ।
'আমি দাদার সাইকেল নিয়ে
এর চাইতেও খাড়া পাহাড় ধরে নামতাম । যত তাড়াতাড়ি নামতাম, তত নিজেকে বেশি উজ্জীবিত মনে হত ।
প্রাণপ্রাচুর্য আমার মধ্যে টগবগ করত, যেন চামড়া ফুটে বেরোবে, ঠিক যেন প্রজাপতি, যে গুটি কেটে নিজেই নিজেকে জন্ম দেয় ।
'পুরোনো গাড়িতে এইরকম
গড়িয়ে নামার সুবিধে আছে । কিন্তু আজকালকার গাড়িতে, তুমি হয়তো জান, ইঞ্জিনের সুইচ অফ
করে দিলেই স্টিয়ারিং ও বন্ধ হয়ে যায় । লোকে মাঝে মাঝে ভুল করে,
বা ভুলে যায়,
তারপর আর গাড়িকে
রাস্তায় রাখতে পারে না । মাঝে মাঝে রাস্তার ধারে চলে যায়, এবং তারপর সোজা
সমুদ্রে ।'
সোজা সমুদ্রে । রোদঝলমলে
সাগরে কাচের বুদবুদের ভেতরে বসে কেউ বন্ধ হয়ে যাওয়া স্টিয়ারিং-এর
সঙ্গে লড়ছে, এরকম কি আসলে ঘটে ? অনেকের কি এ ঘটনা ঘটে ? কোন শনিবার বিকেলবেলা
চ্যাপম্যান পাহাড়ের চুড়োয় দাঁড়িয়ে আমি কি কোন নারীপুরুষকে গাড়ি নিয়ে পাহাড়ের
গা থেকে 'মিজ'পোকার শেষ উড়ানের মত হাওয়াতে উড়ান দিয়ে সাগরে পড়তে দেখব ?
'একটা গল্প তোমাকে
শোনাতে ইচ্ছে করছে,' আমি বললাম । আমার মা যখন ছোট ছিলেন, তখন এই শতাব্দীর প্রথম দিক, পুরো পরিবার
ক্রিসমাসের সময় সাগরের কাছে বেড়াতে যেত । তখনো বলদের গাড়ির যুগ । মায়েরা সবাই বলদটানা গাড়ি চড়ে পূর্ব অন্তরীপের ইউনিয়ন ডেল থেকে পাইসাং নদীর মুখ পর্যন্ত চলে যেত । পুরো যাত্রাটা ছিল বেশ শ'মাইলের মত, এবং কদিন লাগত ঠিক জানিনা । রাস্তার ধারে তারা মাঝে মাঝে যাত্রা স্থগিত করত ।
'তাদের একটা বিশ্রামস্থল
ছিল একটা গিরিপথের সবচাইতে উঁচু স্থানে। আমার দাদুদিদিমা রাতটা বলদ গাড়ির ছই-এর
ভেতরে কাটাতেন । আমার মা ও দাদুদিদিমার অন্য সন্তানেরা গাড়ির
নিচে বিছানা পেতে শুত । গল্প এখানে শুরু হয়----আমার মা শান্ত অন্ধকার
রাতে গিরিপথের উচ্চতম স্থানে তাঁর ভাইবোনেদের সাথে কম্বলের তলায় শুয়ে শুয়ে
চাকার তিরের ফাঁক দিয়ে আকাশের তারা দেখত । দেখতে দেখতে মার মনে হত তারাগুলো
যেন নড়ছে । আবার মনে হত চাকাগুলোই যেন নড়ছে, খুব ধীরে ধীরে । মা ভাবত, এখন আমি কি করব ? যদি গাড়ি চলতে শুরু করে দেয় ? আমি কি চেঁচাব ?
আমি যদি চুপচাপ
শুয়ে থাকি, আর গাড়িটা ভেতরে আমার মাবাবা সমেত পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়াতে শুরু
করে দেয় ? না, এটা আমার মনের ভুল ?
'এভাবে শুয়ে শুয়ে তারাদের সরতে দেখতে দেখতে মার
ভয়ে শ্বাস রুদ্ধ হয়ে যেত, হৃদপিণ্ড ধুকধুক করত ।
আর কান পেতে শোনার
চেষ্টা করত গাড়ির চাকা ক্যাচোর ক্যাচোর করছে কি না, আর ভাবত, ডাকব সবাইকে ? ডাকব? ভাবতে ভাবতে কখন ঘুম পেয়ে যেত,
আর ঘুমে ভয় ও মৃত্যুর স্বপ্ন দেখত । কিন্তু ভোরবেলা যখন গাড়ির তলা থেকে বেরিয়ে আসত, চারদিকে আলো ও
শান্তি ।গাড়ি যেমন ছিল,তেমনি আছে, মা বাবা ও সবাই এখানেই আছে । সবই ভালো, যেমন ছিল তেমনি ।'
আমি এতটা বলার পর
লোকটার কিছু বলা উচিত, পাহাড়, গাড়ি, কিংবা সাইকেল, অথবা নিজের সম্পর্কে কিংবা নিজের শৈশব
সম্পর্কে । কিন্তু সে ছিল একগুঁয়ে রকমের চুপচাপ ।
আমি আবার শুরু করলাম,
'মা কিন্তু সে
রাতের কথা কাউকে কখন বলেনি । বোধ হয় আমার আসার অপেক্ষা
করছিল । আমি অনেক বার অনেক রকমে মার থেকে গল্পটা শুনেছি । ওরা যেন সবসময়ই পাইসাং
নদীতে যেত । কি সুন্দর সোনালি নাম ! আমি নিশ্চিত ছিলাম যে সেটা
পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর জায়গা হবে । মা মারা যাবার অনেক বছর পর আমি প্লেটেনবার্গ উপসাগর ও পাইসাং নদী দেখতে গিয়েছিলাম । দেখলাম যে ওটাকে নদী বলা চলে না, তির তির করা সামান্য জল নল খাগড়ার বনের ভেতর আটকে আছে , আর সন্ধেবেলা মশার ঝাঁক । শুকনো খাতের মধ্যে সারি সারি গাড়ি পার্ক করা, তাতে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা চেঁচামেচি করছে , আর খালি পা মোটা মোটা কয়েকটা লোক শর্ট পরে গ্যাসকুকারে সসেজ ভাজছে । সব মিলিয়ে জায়গাটাকে মোটেই স্বর্গীয় বলা চলে না । বছরের পর বছর পাহাড় ও উপত্যকার চড়াই উৎরাই ভেঙ্গে ওখানে যাতায়াত করার মানে হয় না ।'
বয়েজ ড্রাইভ-এর চড়াইয়ে
গাড়িটা উৎসাহী কিন্তু বুড়ো ঘোড়ী 'রোজিনান্তে'-র মত বেশ কষ্ট করে উঠতে লাগল । আমি স্টিয়ারিং-এর
চাকা শক্ত করে ধরে তাকে যেন মিনতি করতে থাকলাম । ম্যুজিনবার্গের উপরে
যেখান থেকে ফলস
বে-র উৎরাই দেখা যায়, সেখানে গাড়ি থামালাম, ইঞ্জিন ও বন্ধ করে দিলাম । কুকুরটা কুঁই কুঁই শুরু করল, তাই ওকেও বের করলাম । ও ঢালের পাথর, আশপাশের ঝোপঝাড় শুঁকতে থাকল, আমরা বেখাপ্পা চুপচাপ,
দেখতে থাকলাম ।
অবশেষে সে কথা বলল । 'তুমি গাড়িটাকে ভুল
দিকে মুখ করিয়ে রেখেছ । পাহাড়ের নিচের মুখে পার্ক করা উচিত ছিল ।'
আমার বিব্রতবোধকে
প্রকাশ করলাম না । আমি নিজেকে সবসময় একজন দক্ষ,সমর্থ মানুষ বলে পরিচিত হতে
চেয়েছি । বিশেষ করে এখন, যখন অসামর্থ্যের অবস্থা জীবনের দোর গোড়ায়
এসে দাঁড়িয়েছে ।
'তুমি আদতে কেপ-এর লোক ?' আমি তাকে শুধোলাম
।
'হাঁ ।'
'এখানে কি প্রথম থেকেই আছ ?'
সে অস্থিরভাবে মুখ ফেরাল । দুটো পরপর
প্রশ্ন, অনেক বেশি হয়েছে ।
একটা বিশাল সরলরেখার
ঢেউ, বেশ কয়েকশ গজ
লম্বা, বেলাভূমিতে গড়িয়ে এল, তার মাথায় সার্ফবোর্ডের উপর ঝুঁকে থাকা একজন লোক
।খাড়ির ওধারে হটেনটট হল্যান্ড পাহাড় নীল ও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে । আমি বুঝলাম,
ক্ষুধা, চোখের ক্ষুধা আমি
এখন এত বেশি অনুভব করছি, যে পলক ফেলতেও ইচ্ছে করছে না । এই যে সাগর, এই যে পাহাড়গুলো, তাদের ছবি আমার দর্শনেন্দ্রিয়র উপর এমন গভীর ছাপ রেখে দিক যে আমি যেখানেই যাব, তারা আমার সামনে থাকবে । আমার অন্তরে অন্তরে এই জগতের প্রতি ভালবাসার
বুভুক্ষা ।
একঝাঁক চড়ুই আমাদের
আশেপাশের ঝোপগুলোতে এসে বসল, ডানা ঝাপটে পাখা চুলকে নিজেদের পরিষ্কার
করল, আবার উড়ে গেল ।
ঢেউয়ে চড়া লোকটা তীরে পৌছাল ও আস্তে আস্তে বেলাভূমির দিকে
এগোল । হঠাৎ করে আমার চোখ জলে ভরে এল । আমি নিজেকে বললাম চোখের জল না ফেলার
জন্য, কিন্তু সত্যি কথাটা হল, আমি কাঁদছিলাম । স্টিয়ারিং-এর উপর
ঝুঁকে আমি বিবশ হয়ে গেলাম, প্রথম ধীরে, সংযম রেখে, তারপর দীর্ঘস্বরে, কোন বাঁধ না মেনে, ফুসফুস ও হৃদপিণ্ডকে উজাড় করে দিয়ে
কাঁদলাম ।
তারপর শ্বাস নিয়ে একটু শান্ত হয়ে বললাম,
'দুঃখিত, আমি বুঝতে পারিনি
হঠাৎ করে আমার কি হয়ে গেল ।'
আমার দুঃখপ্রকাশের কোন দরকার ছিলনা ।
লোকটা এমন ভাব করছিল যেন সে কিছু দেখে নি ।
আমি চোখ মুছলাম, নাক পরিষ্কার করলাম । 'এখন যাব কি?'
জিগ্যেস করলাম ।
সে গাড়ির দরজা খুলে
একটা লম্বা শিস বাজাল । কুকুরটা লাফিয়ে চলে এল । কুকুরটা বাধ্য, শিক্ষিত, নিশ্চয়ই কোন ভাল
বাড়ি থেকে চুরি করা হয়েছে ।
এখন বুঝতে পারলাম যে গাড়িটা ভুল দিকে
পার্ক করেছিলাম । সে বলল, 'গাড়ি পেছনের দিকে চালাও।'
আমি হ্যান্ডব্রেক
ছাড়লাম , গাড়িটা ঢালের দিকে কিছুটা গড়িয়ে দিলাম, তারপর ক্লাচ ছাড়লাম ।গাড়িটা
কেঁপে উঠে থেমে গেল । বললাম, 'গাড়িটাকে কখনো পিছোনের জন্য স্টার্ট করা হয় নি
।'
'তাহলে রাস্তার অন্য ধারে নিয়ে যাও,'
সে এমন করে
নির্দেশ দিচ্ছিল যেভাবে স্বামীরা স্ত্রীদের গাড়ি চালানোর ট্রেনিং দেয় ।
আমি গাড়িটাকে আরো
কিছুটা ঢালে পিছোলাম, তারপর রাস্তার অন্য ধারে নিয়ে এলাম । সঙ্গে সঙ্গে বিরাট
জোরে হর্ন দিতে দিতে একটা মার্সিডিস বেগে বেরিয়ে গেল । আমি ভয়ে ঢোক গিলে
বললাম, 'এটাকে দেখি নি ।'
সে জোরে বলল, 'যাও।'
আমি এই অপরিচিত লোকটাকে এত জোরে আদেশ
করতে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম । লোকটা আবার চেঁচাল , সোজা আমার মুখের উপর---'চালাও।'
ইঞ্জিন চালু হল । আমি কঠিন মুখে গাড়ি
চালাতে থাকলাম । মিল স্ট্রিটের মোড়ে এসে সে গাড়ি থেকে নেমে গেল ।
তার পা ও জুতো থেকেই
সবচেয়ে বেশি দুর্গন্ধ বেরোচ্ছিল । তার মোজা চাই, তার নতুন জুতো চাই । তার
স্নান করার, রোজ স্নান করার দরকার । নতুন অন্তর্বাসের দরকার । তার
বিছানার দরকার, দরকার মাথার উপর ছাদের, তিন বেলা খাবারের, ব্যাঙ্কে টাকার । তাকে অনেক কিছুই দেবার দরকার, কিন্তু কি করে
দেবে সেই মানুষ, যে, সত্যি বলতে, নিজেই মায়ের কোলে মাথা গুঁজে সান্ত্বনা পেতে চায় ?
বিকেল শেষের মুখে সে
ফিরে এল । আগেকার ঘটনা ভুলে যাবার ভান করে আমি তাকে নিয়ে বাগানে গেলাম । কি
কাজ করতে হবে বললাম । 'গাছগুলোকে ছাঁটার দরকার । তুমি কি ছাঁটতে জান ?'
সে মাথা নাড়ল । না, সে গাছ ছাঁটতে
জানেনা । অথবা, সে চায় না ।
বাগানের ভেতরের কোণায়,
লতাজাল প্রচণ্ড ঘন
হয়ে পুরোনো ওক কাঠের বেঞ্চি ও খরগোসের খাঁচা ঢেকে দিয়েছিল । 'এইসব পরিষ্কার
করতে হবে,' তাকে বললাম ।
সে লতাজালের একদিক তুলল ।
মাটিতে ছিল একটা খাঁচা, যার মধ্যে কিছু হাড়গোড়, এবং একটা বাচ্চা খরগোসের
পুরো কঙ্কাল, শেষবারের চেষ্টার ফলে ঘাড়টা একটু বাঁকানো ।
আমি বললাম, 'আমার পরিচারিকার
ছেলে খরগোস পুষত । আমিও তাকে এখানেই পুষতে দিতাম । তারপর ওর জীবনে
কিছু ঝামেলা এসে গেল । ও খরগোসগুলোর কথা ভুলে গেল এবং তারা না খেতে পেয়ে মরে
গেল । আমিও হাসপাতালে ছিলাম, তাই কিছুই জানতাম না । যখন ফিরে এলাম,
আর দেখলাম যে আমার
বাগানের মধ্যে এই ভয়ঙ্কর, কষ্টদায়ক ঘটনা ঘটেছে---- কারও
নজরে পড়ে নি, আমি অত্যন্ত মর্মপীড়িত হয়েছিলাম; প্রাণীরা কথা বলতে, কাঁদতে পারে না ।'
পাকা পেয়ারাগুলো ঝরে
পড়ছে, তাদের পোকা থিকথিকে পচা শাঁসে গাছের তলা ভরে গেছে । আমি বললাম,
'মনে হয়, যদি গাছগুলো ফলের
জন্ম দেওয়া বন্ধ করে দিত । কিন্তু তারা তা করে না ।'
কুকুরটা যথারীতি পিছুপিছু এসে খরগোসের
খাঁচা শুঁকতে লাগল । খরগোসগুলো অনেকদিন মৃত, তাদের গন্ধ ও চলে গেছে ।
'এই জায়গাটাকে কিছু একটা কর, যাতে এটা বশে থাকে,
পোড়ো জঙ্গলে পরিণত
না হয় ,' আমি বললাম ।
সে জিগ্যেস করল, 'কেন ?'
'কারণ আমি এই রকমই,' আমি বললাম । আমি
কোন অপরিচ্ছন্ন ব্যাপার ফেলে রেখে যেতে চাই না ।'
লোকটা একটু হেসে কাঁধ ঝাঁকাল ।
আমি আবার বললাম, 'তুমি যদি টাকা চাও, তোমাকে তা উপার্জন
করতে হবে । আমি এমনি এমনি তোমাকে টাকা দেব না ।'
সারা বিকেল ধরে সে কাজ
করল, ঘাস ও লতাগুলোকে
কাটবার ফাঁকে ফাঁকে দূরের দিকে তাকাচ্ছিল । আমি যে উপরের তলায় জানালা
থেকে তাকে নজর করছি, এমন ভান করছিল যে সে তা জানেই না । পাঁচটা বাজলে আমি তাকে টাকা দিলাম ।
বললাম, 'জানি তুমি মালি নও,আর আমি তোমাকে তুমি যা নও তা বানাতে চাইও না । কিন্তু দয়ার দানের উপর বেশিদিন চলতে পারে না ।'
টাকাগুলো নিয়ে সে ভাঁজ করে পকেটে রাখল ;
আমার দিকে না
তাকাতে চেয়ে অন্যদিকে দেখল, তারপর নরম ভাবে জিগ্যেস করল, 'কেন?'
'কারণ তুমি তার যোগ্য নও ।'
এবং সে মৃদু হেসে বলল, 'যোগ্য---- কে
কিসের যোগ্য ?'
কে কিসের যোগ্য ?
প্রশ্ন শুনে এত
রাগ ধরল যে আমি টাকার ব্যাগটা ওর দিকে ছুড়ে দিলাম । 'তাহলে কিসে
বিশ্বাস কর তুমি ? ছিনিয়ে নিতে ? নিয়ে যাও কি চাও । চলো, নাও ।'
শান্তভাবে সে পার্সটা নিল,
তার ভেতর থেকে
তিরিশ র্যান্ড ও কয়েকটা কয়েন নিয়ে ব্যাগটা ফেরত দিল । তারপর সে চলে গেল,
কুকুরটা ওর পেছন
পেছন । কিন্তু আধঘণ্টা পরে আবার ফেরত এল, এবার শুনলাম কাচের বোতলের ঠোকাঠুকির শব্দ
।
সাগরতটে লোকে যেরকম তোষক
ব্যবহার করে, সেরকম একটা ব্যবহৃত তোষক সে কুড়িয়ে পেয়েছে । কাঠ রাখার ঘরটা,
যেটা এখন ওর
আস্তানা, সেখানে ধুলো ময়লার মধ্যে মাথার দিকে একটা মোমবাতি ও
পায়ের দিকে কুকুরটাকে নিয়ে সে শুয়ে শুয়ে ধূমপান করছিল ।
আমি বললাম, 'আমার টাকা ফেরত দাও ।'
সে তার পকেট হাতড়ে কিছু টাকার নোট বের
করল, আমি সেগুলো নিলাম
। সব টাকা নয় অবশ্য, তবে ঠিক আছে ।
'তোমার যদি কিছু
লাগে তাহলে বলবে ।
আমি বকাঝকা করব না । আর দেখ, মোমবাতিটা সম্বন্ধে সাবধান । আগুন টাগুন লাগিও না ।'
বলে আমি ফিরলাম ,
কিন্তু এক মিনিট পরে আবার এলাম ।
আমি বললাম, 'তুমি বলেছিলে
বাড়িটাকে একটা ছাত্রাবাস বানিয়ে দিই না কেন ? আসলে, তার চাইতে ভাল জিনিষও করা যেতে পারে ।
যেমন ভিখিরিদের আবাসন ও করা যেতে পারে । একটা স্যুপ বানানোর রান্নাঘর ও
একটা ডরমিটরি । কিন্তু আমি তা করি না ।কেননা, দান-দাক্ষিণ্যের সেই মানসিকতাটাই এই দেশে
নষ্ট হয়ে গেছে । কারণ, যারা দান গ্রহণ করে, তারা সেই দানকে ঘৃণাও করে । আর যারা
দেয়, তারাও হতাশা নিয়ে দান করে । হৃদয় থেকে হৃদয়ে যে দান পৌঁছোয় না, তেমন দানে লাভ কি ? 'দান' মানে কি ? স্যুপ ? টাকা ? 'দান' কথাটা যে ল্যাটিন
শব্দ থেকে এসেছে, তার অর্থ হল 'হৃদয়' । দেওয়া এবং নেওয়া, দুটোই খুব সহজ নয়, এতে সক্ষমতার ব্যাপার আছে ,
তুমি বোঝার চেষ্টা
কর । তাই শুয়ে না থেকে কিছু কাজ করে সক্ষম হও ।'
একটা ভুল, ভুল বললাম । 'দান' শব্দটার সমার্থক
ল্যাটিন রূপের সঙ্গে 'হৃদয়ে'র কোন সম্বন্ধ নেই । কিন্তু একটা মিথ্যে শব্দার্থের উপর আমার
উপদেশবাণীটুকু নির্ভর করলে কিই বা এসে যায় ? আমি যখন তাকে কিছু বলি, আমার কথা কতটুকু তার কানে যায় সন্দেহ আছে । তীক্ষ্ণ পক্ষীচক্ষু থাকা সত্ত্বেও তার মাথা অতিরিক্ত মদ্য
পানে বোধ হয় সবসময়ই আচ্ছন্ন থাকে ।অথবা হয়তো সে 'কেয়ার'ই করেনা । 'কেয়ার' গ্রাহ্য করা,
যত্ন
করা)-----এটাই 'চ্যারিটি' (দান)-এর প্রকৃত ল্যাটিন মূল ধাতু ।* আমি তাকে যত্ন করতে চাই, সে গ্রাহ্য করে না
। কারণ সে যত্নের বাইরে ; যত্নের বাইরে, গ্রাহ্যের বাইরে । (চলবে)
______________________________________________________________________________
*charity শব্দটা ল্যাটিন caritas
থেকে এসেছে ।
_____________________________________________________________________________
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন