“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

আয়স কাল ০২

(কিছুদিন আগে এই ব্লগে দক্ষিণ আফ্রিকীয় লেখক জে এম কোয়েটজি-র লেখা 'এজ অব আয়রন' -এর একটা ছোট সমালোচনাভিত্তিক সংক্ষিপ্তসার লিখেছিলাম । উপন্যাসটির কাব্যিক ভাষা, বর্ণনার চিত্রকল্পআঙ্গিক   এবং  বিষয় বস্তু আমাকে খুবই আকৃষ্ট করেছিল। কিছু কিছু বাক্য ও বাক্যবন্ধ মনের মধ্যে অনুরণন করতে থাকত, মনে হত এই কথাগুলো বাংলায় বললে কেমন হত তাই ধীরে ধীরে বইটাই অনুবাদ করে ফেলেছিলাম, 'আয়স কাল' নাম দিয়ে । অনুবাদটি ধারাবাহিক ভাবে এই ব্লগে বেরোতে থাকবেহয়তো যথাযথ সময়ানুবর্তীতা মেনে হবেনা, কারণ টাইপ করাতে  আমি নিতান্তই শম্বুকগতি ।  আজ তার দ্বিতীয় ভাগ --- শিবানী দে )




(C)Image:ছবি





সেদিন বিকেল অবধি অনবরত বৃষ্টি পড়ছিল । সন্ধের অন্ধকার হবার পর আমি গেট খোলার শব্দ পেলাম, তার মিনিটখানেক পর বারান্দায় কুকুরের নখের শব্দ ।
আমি টিভি দেখছিলাম। মন্ত্রী বা উপমন্ত্রী জাতীয় কেউ একজন জাতির উদ্দেশ্যে কিছু একটা ঘোষণা করছিলেন । আমি দাঁড়িয়েছিলাম । ওঁরা যখনি কথা বলেন, আমি তখনি এরকম করি, যাতে কিছুটা আত্মসম্মান রক্ষা হয় (না হলে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়াতে হতে পারে)। তিনি বলছিলেন, ‘আমরা কোনো ভয়প্রদর্শনের কাছে মাথা নত করব না’----ওই ধরণেরই বক্তৃতা আর কি ।
আমার পেছনের পর্দা খোলা ছিল । একটা মুহূর্তে আমি বুঝতে পারলাম, নাম না জানা লোকটা বন্ধ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কাচের সার্সি দিয়ে ভেতরে বসা আমার কাঁধের উপর দিয়ে টিভি দেখছে । আমি সাউন্ড বাড়িয়ে দিলাম,পুরোপুরি না পৌঁছালেও বক্তৃতার ছন্দ বা বাক্যের ওঠাপড়া তার কাছে পৌঁছোয়, সেই ধীর লয়ের অপরিশীলিত আফ্রিকানস ভাষার ছন্দ, যার প্রতিটি বাক্য শেষ হয় উচ্চগ্রামে, ঠিক যেন লোহা মাটিতে রেখে হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হচ্ছে । আমরা দুজনে সেই হাতুড়ি পেটানো শুনতে থাকলাম । ওদের অধীনে জীবনধারণের অপমান: খবরের কাগজ খোল, বা টিভি দেখ, মনে হবে তুমি হাঁটু গেড়ে বসে আছ, আর ওরা তোমার উপর পেচ্ছাব করছে । ওদের নিচে, ওদের মাংসল ভুঁড়ির নিচে, ওদের পেচ্ছাব ভরা তলপেটের নিচে । আগে একসময় আমি বিড়বিড় করতাম, তোমাদের দিন ঘনিয়ে আসছে । এখন দেখছি ওরা আমার থেকে অ-নে-ক বেশিদিন বাঁচবে ।
দোকানে যাব বলে সেদিন বেরিয়েছি, গ্যারেজ খুলতে যাব, এমন সময় হঠাৎ অ্যাটাকটা হল । ব্যথার অতর্কিত আক্রমণ, ঠিক যেন একটা কুকুর পিঠের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দাঁত ফুটিয়ে দিয়েছে । আমি জোরে কঁকিয়ে উঠলাম, নড়তে পারছিলাম না । সেই লোকটা কোথা থেকে চলে আসল, আমাকে ধরে ধরে ঘরে পৌঁছে দিল ।
আমি সোফায় শুয়ে পড়লাম, বাঁপাশে ফিরে । একমাত্র বাঁপাশই বাকি আছে যেদিকে শুয়ে আমি কিছুটা আরাম বোধ করি । সে অপেক্ষা করতে থাকল । আমি বললাম, ‘বস ।সে বসল । ব্যথা একটু কমতে আরম্ভ করল । আমি তাকে বললাম, ‘আমার ক্যান্সার হয়েছে । এখন রোগ হাড়ে পৌছে গেছে । তাই এত ব্যথা করে ।
সে বুঝল কিনা বুঝলাম না ।
অনেকক্ষণ নীরবতার পর সে বলল, ‘এটা তো বড় বাড়ি, তুমি এটাকে বোর্ডিংহাউস বানিয়ে দিতে পার ।
আমি ক্লান্তির ভাব দেখালাম ।
সে বলতে থাকল, ‘তুমি ঘরগুলো ছাত্রদের ভাড়া দিতে পার ।
আমি হাই তুললাম, মনে হচ্ছিল দাঁতের পাটি আলগা হয়ে যাচ্ছে, তাই মুখ ঢাকলাম । একসময় হাই তুললে লজ্জা করত । এখন করে না ।
আমি বললাম, ‘আমার ঘরকন্না  দেখাশোনা করার জন্য একজন মহিলা আছে, সে তার আত্মীয়দের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করবার জন্য এই মাসটার শেষ অবধি ছুটি নিয়েছে । তোমার কি লোকজন আছে ?’
এই একটা অদ্ভুত বাক্যবন্ধ----নিজের লোকজন থাকা। তুমি কি আমার লোকজন ? আমার মনে হয় না । শুধুমাত্র ফ্লোরেন্সই একথা বলতে পারার অধিকারী ।
লোকটা কোন জবাব দিল না । তার মধ্যে একটা সন্তানহীনতার ছাপ আছে । শুধু সন্তানহীনতাই নয়, তার যেন কোন শৈশবই ছিল না । তার মুখ শুধু হাড় ও চামড়া সর্বস্ব । সাপের মাথা দেখলে যেমন মনে হয় সবসময়ই বয়স্ক, এই লোকটার মুখের পেছনেও কোন শিশুর মুখ কেউ কখনো আবিষ্কার করবে না । সবুজ, জানোয়ারসুলভ চোখ । এইরকম চোখের কি কোন বাচ্চা থাকতে পারে ?
আমি বললাম, ‘আমার স্বামীর সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ হয়েছে অনেকদিন হল । স্বামী এখন মৃত ।আমার একটা মেয়ে আছে, সে আমেরিকা থাকে । সে ১৯৭৬সালে এদেশ ছেড়েছিল, আর ফেরেনি । একজন আমেরিকানকে বিয়ে করেছে, তাদের দুটো সন্তান আছে ।
একটি কন্যা । আমার রক্তমাংসের রক্তমাংস তুমি ।
লোকটা একপ্যাকেট সিগারেট বের করল । আমি তাকে বললাম, ‘ঘরের ভেতর ধূমপান করোনা, প্লীজ।
তোমার শারীরিক অসুবিধাটা কি ?’ তাকে শুধোলাম । তুমি বলেছিলে প্রতিবন্ধী পেনশন পাও ?’
সে তার ডান হাত তুলে ধরল । অঙ্গুষ্ঠ ও তর্জনী দুটো একদিকে খাড়া, কিন্তু অন্য তিনটি আঙ্গুল হাতের চেটোর ভেতরে বাঁকানো । সে বলল, ‘আমি এই এই আঙ্গুলগুলো নাড়াতে পারি না ।
আমি তার হাতের দিকে তাকালাম, তিনটি বাঁকানো আঙ্গুল ও তার ডগায় ময়লা নখ । কাজ করে করা পড়া হাত নয়, বোঝা যাচ্ছে ।
অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল ?’
সে ঘাড় নাড়ল, তার নিজস্ব ভঙ্গির ঘাড় নাড়া, যার কোন অর্থ হয় না ।
বললাম, ‘লনের ঘাস কেটে দিলে আমি তোমাকে টাকা দেব ।
লনের ঘাস জায়গায় জায়গায় হাঁটু সমান উঁচু হয়ে গেছে । লোকটা ঘণ্টাখানেক ধরে ঝোপকাটার কাঁচি দিয়ে নিতান্ত অনিচ্ছাসহকারে ঘাসের উপর এলোপাথাড়ি মারতে থাকল । শেষ পর্যন্ত দেখা গেল মাত্র কয়েক বর্গগজ জায়গার ঘাস কাটা হয়েছে । আমি তাকে একঘণ্টার কাজের টাকা দিলাম । সে বলল, ‘আমি এধরণের কাজ করি না ।যাবার সময় বেড়ালদের খাবার ট্রে-তে হোঁচট খেয়ে সারাটা বারান্দা নোংরা করে চলে গেল ।
সব মিলিয়ে লোকটা কাজের তো নয়ই, মূর্তিমান ঝঞ্ঝাট । কিন্তু আমি তো তাকে চাই নি, সে নিজে চেয়ে আমার কাছে এসেছে । অথবা কি জানি সে কুকুর-ছাড়া বাড়ি চেয়েছিল, বেড়ালথাকা বাড়ি ।
নবাগতদের জন্য বেড়ালগুলোর থাকা মুস্কিল হয়েছে । যখনি তারা দরজার বাইরে মুখ দেখায়, কুকুরটা খেলাচ্ছলে তাদের দিকে তেড়ে আসে, আর তারা ভয়ে ভেতরে ঢুকে চুপচাপ থাকে । আজকে তারা খায়নি । আমি ভেবেছিলাম খাবার যেহেতু ফ্রিজে ছিল, তাদের পছন্দ হয়নি । তাই সেই দুর্গন্ধযুক্ত জিনিষটা (কী জানি কি সেটা, সিল না তিমির মাংস,) একটু গরম জল ঢেলে নেড়ে দিয়েছিলাম । তবুও তাদের পছন্দ হলনা । তারা ট্রেটার চারপাশে ল্যাজ উঁচু করে খানিকক্ষণ ঘুর ঘুর করতে থাকল ।আমি থালাটা তাদের দিকে ঠেলে দিয়ে বললাম, ‘খা তোরা ।বড় বেড়ালটা সামনের পা তুলে বসল যেন তাকে ছোঁয়া যেতে না পারে । আমার মেজাজটা ঠিক থাকল না । ফর্কটা ওদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বললাম, ‘জাহান্নামে যা তাহলে । তোদের খাওয়াতে খাওয়াতে মরে যাচ্ছি ।আমার গলায় একটা নতুন ধার ছিল, প্রায় পাগলের মত, শুনে নিজেই যেন তৃপ্ত হলাম । অনেক হয়েছে মানুষের কাছে ভাল সাজা, বেড়ালের কাছে ভাল সাজা । যা, জাহান্নামে যা তোরা ।আবার চেঁচালাম । লিনোলিয়ামের মেঝেয় নখের আঁচড়ের শব্দ তুলে তারা পালাল ।
মরুক গে । এমন মানসিক অবস্থায় আমি নিজের হাতটাকেও রুটি কাটার বোর্ডের উপর রেখে এক মুহূর্ত চিন্তা না করে দুটুকরো করে কেটে ফেলতে পারি । যে শরীর বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তার কথা ভেবে কি লাভ হবে ?আমি আমার হাতের দিকে তাকিয়ে ভাবি , এতো জিনিষপত্র ধরার একটা হক, হাতিয়ার মাত্র । আর এই পা-দুটো অকর্মণ্য, বিচ্ছিরি দুটো খুঁটি । কেন আমি এই সব অঙ্গকে সর্বত্র বয়ে বেড়াব ? কেন এগুলোকে রাতের পর রাত বিছানায় নিয়ে চাদরের নিচে রাখব, হাতগুলোকে  মুখের কাছে  বিচ্ছিরিভাবে উঁচু করে রেখে ঘুমহীন রাত কাটাব ? মুমূর্ষুর গলার ঘড় ঘড় শব্দের মত শব্দ করা এই তলপেট, আর এই ধুকধুক করা হৃদপিণ্ড----কেন ? ওদের দিয়ে আমি কি করব ?
মরবার আগে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি যাতে আমাদের শরীরের প্রতি মায়া কমে যায়, ঠিক যেভাবে যে দুধ আমাদের পুষ্টি যোগায়, তা যখন স্তন থেকে চলে যায়, তখন পাতলা হয়ে টকে যায় । আমরা নতুন জীবনের জন্য অধীর হয়ে উঠি । তবুও এই প্রথম জীবন, এই পার্থিব জীবন, এই পার্থিব শরীর, এর চেয়ে ভাল আর কি হতে পারে ? সমস্ত বিষণ্ণতা, হতাশা, ক্রোধ সত্ত্বেও যে এখনো এই শরীরের প্রতি আমার ভালবাসা কম হয়নি ।
বেশি ব্যথা হওয়ায় আমি ডাঃ সাইফ্রেটের দেওয়া দুটো পিল খেয়ে সোফাতেই শুয়ে রইলাম । কয়েকঘণ্টা পর যখন আমার ঘুম ভাঙ্গল, তখন আমি ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় আচ্ছন্ন এবং ঠাণ্ডায় কাতর । কোনো রকমে টলমল করে উপরের ঘরে গিয়ে পোশাক না পালটেই বিছানায় শুয়ে পড়লাম।
মাঝরাত্তিরে আমার মনে হল ঘরে অন্য কেউ আছে, এবং সেই লোকটা ছাড়া অন্য কেউ হতে পারে না । ওর উপস্থিতি অথবা গন্ধ । সেটা এখানেই ছিল, চলে গেল ।
সিঁড়ির নিচে থেকে একটা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ হল । সে মনে হয় স্টাডিতে ঢুকছে, এই লাইটের সুইচ টিপল। আমি মনে করতে চেষ্টা করলাম ডেস্কে কোনো প্রাইভেট কাগজপত্র আছে কি না । কিন্তু আমার মাথার আচ্ছন্নভাব এখনো ভালভাবে কাটেনি । মনে হচ্ছে সে বই দেখছে, একটা শেল্‌ফের পর আরেকটা, তারপর জার্নালের স্তূপ । এইসব ভেবে আমি মনের সমতা ফেরানোর চেষ্টা করছিলাম । এই সে দেওয়ালের ছবি দেখছে । একদিকে অ্যাগামেমনন-এর অলঙ্কারে সজ্জিতা সোফি স্লিম্যান । অন্যদিকে ব্রিটিশ মিউজিয়মে রক্ষিত গ্রিক শস্যদেবী ডিমিটার-এর গ্রিকদেবীসুলভ পোশাকপরিহিত ছবি । এখন প্রায় নিঃশব্দে সে ড্রয়ারগুলো টানছে । উপরের ড্রয়ারে আছে প্রচুর চিঠিপত্র, হিসেবখাতা, পুরোনো ছেঁড়া ডাকটিকিট, অনেক ফোটোগ্রাফ ----এসবে তার কোনো আকর্ষণ নেই ----কিন্তু নিচের ড্রয়ারে একটা চুরুটের বাক্স ভর্তি মুদ্রা আছে, পেনি, দ্রাকমা, সেণ্টাইম, শিলিং । যে হাতে আঙ্গুলগুলো বাঁকানো, সেই হাতই সে ঢোকায়, দুটো পাঁচ পেসেতার মুদ্রা নিয়ে পকেটে ঢোকায়, কারণ দক্ষিণ আফ্রিকার মুদ্রা র‍্যান্ড-এর সঙ্গে সেগুলো বদলান যাবে ।
বুঝলাম, সে কোন নিষ্পাপ দেবদূত নয় বরং তাকে তুলনা করা যেতে পারে সেই সব পতঙ্গের সঙ্গে, যারা অন্ধকার হলে শেল্‌ফের তলা থেকে কিছু পড়ে থাকা খাবারের গুঁড়ো খুঁজতে বেরোয় । আমি বুঝলাম যে সে ল্যান্ডিং-এর অন্য ধার দিয়ে দুটো বন্ধ দরজা খুলবার চেষ্টা করছে । ওখানে আছে শুধু আবর্জনা, আবর্জনা আর মৃত স্মৃতি’---- একথাই তাকে ফিসফিস করে বলতে বলতে আমার মাথা আবার আচ্ছন্ন হয়ে গেল ।
সারাটা দিন বিছানায় কাটল । শক্তি নেই, ক্ষুধাবোধ নেই । টলস্টয় পড়লাম, বিখ্যাত ক্যান্সারগল্পটা নয়, সেটা আমি অনেকবার পড়েছি । এটা অন্য গল্প, যে গল্পে দেবদূত এসে মুচির বাড়িতে বাস করেন । এমন কি হতে পারে কখনো, যে আমি হাঁটতে হাঁটতে মিল স্ট্রিটে গেলাম, কোনো ছদ্মবেশী দেবদূতকে বাড়ি নিয়ে এলাম, ও তার প্রয়োজনে সাহায্য- সেবা করলাম ? না, হতে পারে না । গ্রামদেশে হয়তো এখনো দু-এক জন পাওয়া যেতে পারে যে গরম রোদে মাইলস্টোনে ঠেস দিয়ে ঝিমোচ্ছে, তাদের মধ্যে কখনো কোন সুযোগ হতেও পারে দেবদূতসম কাউকে পাবার । হয়তো বা গৃহহীনদের বেআইনি বস্তিতেও পাওয়া যেতে পারে । কিন্তু মিল স্ট্রিটে বা শহরতলিতে দেবদূত থাকতে পারে না । যখন কোনো চালচুলোহীন অভ্যাগত বাড়ির দরজা খটখটায়, সে সাধারণত: হয় হতচ্ছাড়া, মাতাল, জাহান্নামে যাওয়া লোক । তবুও আমরা মনে মনে চাই আমাদের ঝিমন্ত বাড়িটা সেই গল্পের মত দেবদূতের মন্ত্রোচ্চারণে কেঁপে কেঁপে উঠুক ।
এই বাড়িটাও যেন অপেক্ষা করতে করতে, নিজেকে ধরে রাখতে রাখতে ক্লান্ত হয়ে গেছে । ইলেক্ট্রিকের তারের আবরণ শুকনো ঝুরঝুরে হয়ে গেছে, জলের নলে ময়লা জমে বন্ধপ্রায় । ড্রেনপাইপের স্ক্রুগুলোতে মরচে ধরে ক্ষয়ে গেছে, কোথাও বা পচা কাঠের থেকে আলগা হয়ে গেছে । ছাদের টালি শ্যাওলা ধরে ভারি হয়ে গেছে । বাড়িটা একসময় অত্যন্ত মজবুত করে নির্মিত হয়েছিল, কিন্তু ভালোবাসার অভাবে শীতল, জড়, মরণাপন্ন ।  জেলের কয়েদিদের দ্বারা তৈরি ইটে গাঁথা এ বাড়ির দেওয়ালগুলোকে আফ্রিকার সূর্যের তেজ ও গরম করতে পারত না । এখন সেগুলো এক অচ্ছেদ্য বিষণ্ণতা বিকিরণ করে ।
গত গ্রীষ্মে যখন মজুরেরা ড্রেনগুলো নতুন করে বসাচ্ছিল, আমি তাদেরকে পুরোনো পাইপগুলো খুঁড়ে তুলতে দেখেছিলাম । মাটির দু মিটার গভীরে ঢুকে তারা স্যাতলাধরা ইট, মরচেধরা লোহা, এমন কি একটা ঘোড়ার নাল পর্যন্ত তুলে আনল, কিন্তু কোনও হাড়গোড়ের অস্তিত্ব নেই । বোঝা গেল, এই বাস্তুতে অতীতে কোন মানুষ ছিল না , তাই ভূত কিংবা দেবদূতের এখানকার প্রতি কোনও আকর্ষণ নেই ।
 কিন্তু এই চিঠি আমার হৃদয়ের কথা বলার জন্য লিখা হচ্ছে না । অন্য কথা বলা হবে, হৃদয়ের নয় ।

কোন মন্তব্য নেই: