“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

সংবাদপ্রসঙ্গে


 ।। শিবানী দে।।
(C)Image:ছবি
জকাল সাংবাদিকদের অনেক ভূমিকা-----ওঁরা জজ, ওঁরাই জুরি, ওঁরা সমাজের মতামত নির্ণায়কের কাজ করেন, ওঁরাই বিচার করেন, আবার ওঁরাই ফাঁসি দেন । আগে বলত, বাঘে ছুলে আঠারো ঘা, তারপর বলা হল পুলিশে ছুলে ছত্রিশ ঘা, এখন দেখা যাচ্ছে মিডিয়া ছুলে বাহাত্তর ঘা-তেও নিস্তার নেই ।যদি আপনার নাম কোনও  রগরগে কেসে দুর্ভাগ্যবশত যুক্ত হয়ে যায়, তবে ছোট বড় মাঝারি মিডিয়া হাউসের রিপোর্টাররা শুধু আপনিই নন, আপনার সাতকুলে কে কোথায় আছে তার হদিশ জেনে নিয়ে সকলের পেছনে ধাওয়া করবে---কে জানে কত দিন--- আপনার সাত কুলের মেয়ে মর্দ জোয়ান বুড়ো সকলের 'জিনা হারাম' । আপনার নাম কোনও ভাবে কোন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হলে,---- সে আপনি কিছু করে থাকুন বা না-ই থাকুন, বা মিথ্যে বা ভুল কেসে ফেঁসে যান, সেটা প্রমাণসাপেক্ষ । কিন্তু যে তীব্রতার সঙ্গে আপনাকে প্রথমটা দেগে দেওয়া হয়েছিল, আপনি নির্দোষ প্রমাণিত হলে আপনার সপক্ষে সেই তীব্রতার সিকি ভাগও ব্যয় করা হবেনা, তার জন্য বড়জোর কোন ফুটেজে এক লাইনই বরাদ্দ ।  কয়েকদিন কোন ইস্যুকে জিইয়ে রেখে টিভিতে কত রকমের চেঁচামেচি,কাগজে হেডলাইন, খবরটা থেকে বীভৎস, অশ্লীল, হাস্য, রৌদ্র--- যতরকম সম্ভব রস বের করে তার সীমা অবধি না পৌঁছেই অর্ধপথে ছেড়ে দিয়ে আবার নূতন খবরের খোঁজ । সর্বদাই হট থাকতে হবে, তবেই না বিকোবে ।
        বেচারা সিদ্ধার্থ দাসকে দেখুন না । বছর পঁচিশেক আগে ইন্দ্রাণীর সঙ্গে ফেঁসে গিয়েছিল । তার মায়ের বাড়ি সাংবাদিককুল খুঁজে পেলেন করিমগঞ্জে । অতএব কোনোও এক বিখ্যাত ইংলিশ নিউজ চ্যানেলে ছোটো করে হেডার হল,  Siddharth Das traced in Bangladesh border? সেখান থেকেই বোধ হয় ক্লু নিয়ে আমাদের এক বাংলা চ্যানেলে সিদ্ধার্থ দাসের সাক্ষাৎকারে জিগ্যেস করা হল, 'শোনা গেছে আপনি নাকি বাংলাদেশ চলে গিয়েছিলেন'  করিমগঞ্জে তার মা-বোন-ভাইকে কদিন নানা প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করা হল ।  দমদম এলাকায় তার শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে সাংবাদিক জিগ্যেস করে বসলেন,'ইন্দ্রাণী কি এখানে এসেছিল?' সাংবাদিকদের মাথায় যে কত রকমের প্রশ্ন কিলবিল করে !
        ইন্দ্রাণী মুখার্জির সাংঘাতিক উত্তেজক  কেসের সময়ই র‍্যাশনালিস্ট কুলবর্গী হত্যার খবর এলো , একদিনের বেশি  খবরের ফলো আপ হলো না । একটা মাঝারি শহরের সুন্দরী উচ্চাকাঙ্ক্ষী মেয়ে, তার একটা লিভ-ইন রিলেশনশিপসেই সম্পর্কে দুটো বাচ্চা,তারপর দুটো বিয়ে,মিডিয়া ব্যারন দ্বিতীয় স্বামীর অজান্তে  প্রাক্তন স্বামীর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে সেই প্রথম সম্পর্কজাত সন্তানকে হত্যা, লোকজন এই খবর দিনের পর দিন ধরে খাবে না, গিলবে ।  র‍্যাশনালিস্ট হত্যা সেই তুলনায় অতি তুচ্ছ!
         সেই সময়ে পশ্চিমবাংলায় আরো একটা খবর ছিল, এক মহিলা ও তার বাচ্চা মেয়েকে এক ব্যাঙ্ক ম্যানেজার কেটে টুকরো টুকরো করে ব্যাগে পুরে নদীতে ফেলেছে  ইন্দ্রাণী মুখার্জির তুলনায় লো-প্রোফাইল হলেও সেটাও বেশ জায়গা নিয়েছিল--- আদিরস ও মানুষ টুকরো টুকরো  করার বীভৎস রস ছিল তো  । বেশ চটকে চটকে কদিন পরিবেশন করা গেছে, আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে মাছের টুকরোর মত মানুষের টুকরো । খবর যত বীভৎস, যত অশ্লীলটি আর পি তত বেশি । এমনভাবে পরিবেশনা করা হচ্ছে, যেন এর বাইরে আর কিছু থাকতেই পারে না ।
         দিনের মধ্যে যতবার খবর পড়া হচ্ছে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই ভ্যাজর ভ্যাজর ।
        সাংবাদিকেরা নাহয় গীতা-উপনিষদোক্ত যোগীর মতন নির্মম, নির্মোহ, সাধারণ মানুষ তো আর সেরকম নয় । তারা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এ ধরণের অনুষ্ঠান দেখতে সঙ্কোচ-ভয় করে । অপরাধপ্রবণরা এ থেকে অপরাধ করার বার্তা পায় । অপরাধ হবার পর বিচার হয়ে শাস্তি পেতে অনেক সময় লেগে যায়, সেই পরিণতি দেখানোর আগেই নতুন অপরাধ সঙ্ঘটিত হয় ।
          পৃথিবীজুড়ে কত কি ঘটে যাচ্ছে, সে সব ত দূরস্থান, দেশে ও ভালমন্দ মিলিয়ে কত কিছু হচ্ছে, সেইসব খবরের কোন খোজ নেই । কাজ না থাকলে হয় গল্পের গরু গাছে ওঠার সিরিয়াল দেখুন, নাহয় রোমহর্ষক  বানানো খবর । এখন যুক্তির যুগ ? মোটেই নয় । অন্তত টিভি দেখলে বা সংবাদপত্র পড়লে আপনার এ রকমই মনে হবে 


কোন মন্তব্য নেই: